#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৭
#ইশরাত_জাহান
🦋
আজ নিরাদের বিদায় অনুষ্ঠান।বিদায় অনুষ্ঠানটি খুব বড় ভাবে আয়োজন করা হবে।সাথে পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন কার্ড দিবে।বিদায় অনুষ্ঠান উপলক্ষে মেয়েদের নীল শাড়ি ও ছেলেদের পাঞ্জাবী পড়তে বলা হয়েছে।নীরা এই কয়েকদিনের ভিতরে তার ও দ্বীপের জন্য একসাথে ম্যাচিং করে ড্রেস কিনেছে।আজকে সন্ধায় নীরব আসবে।কয়েকটা দিন শুধু নীরার বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকতে হয়েছে।আজকে সারাদিন তার ছুটি।দ্বীপ তাকে এই করা শাসনে রাখে আবার দ্বীপই তাকে ছুটি দেয়।
দ্বীপ ফ্রেশ হয়ে রেডি হবে নীরা তখন দ্বীপকে বলে,”আজকে আপনি এই পাঞ্জাবি পড়বেন।”
দ্বীপ তাকায় পাঞ্জাবির দিকে।পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে নীরাকে বলে,”এটা কখন কিনেছো?”
“ছুটির ভিতরেই কিনেছি।আপনাকে সারপ্রাইজ দিবো তাই দেখাইনি।এখন তাড়াতাড়ি পড়ে আসুন।”
দ্বীপ নীরার থেকে প্রথম কোনো পুরষ্কার পেয়েছে।এতে দ্বীপের ভালো লাগছে।তাই সে পাঞ্জাবি নিয়ে চলে গেলো অথচ দ্বীপ নিজেও জানে না নীরা তার সাথে ম্যাচিং করে শাড়ি পড়বে।
নীরা শাড়ি পরে ড্রয়িং রুমে এসেছে।কয়েকদিন পড়াশোনার চাপে ঘরের কাজ করতে পারে না।এর জন্য কেউ তাকে জোর করেনি।তবে পিংকি নীরাকে কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ঘরের অনেক কাজ করেছে।এতে নীরার মনে একটু জেদ চেপেছে।পরীক্ষা শেষ হলে ঘরের কাজে মন দিবে এমন এক জেদ নীরা মনে মনে করে রেখেছে।ড্রয়িং রুমে এসে নীরা দেখে পিংকি অনেক সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। নৃত্যে নাম দিয়েছে হয়তো।পিংকি অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে,নীরার কলেজেই।আজ সিনিয়র জুনিয়র সবাই নৃত্য করবে। যার যার ইচ্ছা। পিংকিও নাম দিয়েছে।
নীরার ইচ্ছা ছিলো নৃত্য করার।কিন্তু সে এখন নৃত্য করতে পারবে না।তার ক্যাডার সাহেব চায় না।পিংকি তো তার ডেমো দেখেছিলো।তাই নীরাকে খোঁচা দিয়ে বলে,”মানুষ বুঝে কাকে কোথায় মানায়।তাই তো আজ আমি নৃত্য করতে পারছি। আর অনেকের মনের ইচ্ছা থাকলেও পূরণ তো করতে পারেই না বরং ডেমো দেখিয়ে দেয়।”
নীরা কি কম নাকি!তাকে কেউ কথা শোনাবে আর সে চুপ থাকবে এমন তো হতেই পারে না।পিংকির কাছে এসে নীরা বলে,”কি বলোতো আমি তো জানতাম না আমার ক্যাডার সাহেব নাচনেওয়ালি দেখলে ঘৃণা করে তাই আবদার করেছিলাম।আমার ক্যাডার সাহেব আমাকে তার ব্যাক্তিগত নারী হিসেবে চায়।কোনো পর পুরুষের সামনে নৃত্য পরিবেশন করা নারী হিসেবে না।আমি এতেই খুশি।”
বলেই হামি দিতে দিতে রান্নাঘরের দিকে যায়।পিংকি রাগে চোখ মুখ লাল করে আছে।এই মেয়ের সাথে কথায় পারবে না।তাকে কিছু একটা করতে হবে।
সকালের খাবার খেয়ে দ্বীপ ও নীরা নিজেদের মতো কলেজে আসে।কলেজ গেট থেকে নীরা নেমে যায়।ওখানেই আসে কেয়া।কেয়া দ্বীপ ও নীরাকে দেখে বলে,”বাব্বা,তোরা তো দেখি সেম কালার সহ সেম প্রিন্টের ড্রেস পড়েছিস! স্যারকে তো পুরো হ্যান্ডসাম প্লাস জেন্টেলম্যান লাগছে।”
“নজর দিবি না।”
“আমার বয়েই গেছে নজর দিতে।আমার সাদা বিলাই আছে।তোর ক্যাডার সাহেবের দিকে তো অন্যান্য মেয়েরা নজর দিচ্ছে।ওই দেখ সিনিয়র আপুরা কিভাবে তাকাচ্ছে।”
নীরা দেখলো প্রায় কিছু সংখ্যক মেয়েরা দ্বীপের দিকে তাকিয়ে আছে।আবার কিছু মেয়েরা কলেজের ভিপিকে দেখতেছে।নীরার হিংসা হতে লাগলো।আরে ভাই ভিপি তারপর আরো হ্যান্ডসাম স্যারের দিকে তাকাচ্ছিস তাকা আমার বরের দিকে কেনো তাকাচ্ছিস?নীরা কেয়াকে বলে,”বুঝলি সাদা বিলাই এর চশমিশ!আমার ক্যাডার সাহেবের নজর দোষ শুধু বাড়িতেই না বাইরেও আছে।কোনো এক ওঝা দেখাতে হবে।যদি নজর থেকে বেঁচে যায়।”
“ধুর তোর মতো রনচন্ডি চ না মানে মেয়ে থাকতে কি আর ওঝা লাগে। এমনিতেও কোনো মেয়ে পাত্তা পাবে না।”
“চন্দ্র পাখি বলেও বললি না কেনো?আমি সবকিছু জেনে গেছি।”
“কিভাবে?”
“তোকে কেনো বলবো!তুই আমাকে বলেছিলি যে ক্যাডার সাহেব আমাকে ভালোবাসে?”
“আরে তুই যে থাপ্পড় থ্যারাপি পেয়েছিস ওগুলো তো একটাও আমি পাই নি।প্রথম দিন তো স্যারের থাপ্পড় খেয়ে অজ্ঞান ছিলি।এখন না হয় তোর অভ্যাস হয়েছে।আমার তো তা না।এই ভয়তে বলিনি।”
কেয়া আসার সাথে সাথে দ্বীপ চলে যায় নিজের স্থানে।কেয়া ও নীরা ঘোরাঘুরি করতে থাকে কলেজে।ঠিক সেই সময় নীরার সামনে একটি ছেলে আসে। ছেলেটি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করে নাম ইশতিয়াক।নীরার কাছে এসে নীরাকে বলে,”তোমাকে অনেক কিউট লাগছে।”
নীরা কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যেতে নেয়। ইশতিয়াক আবার আসে নীরার সামনে।নীরার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে নীরার দিকে গোলাপ ফুল দিয়ে বলে,”দীর্ঘ ছয় মাস হয়েছে আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে বলতে চেয়েও বলতে পারিনি।কিন্তু আজ আর তোমাকে দেখে থমকে থাকতে পারলাম না।তোমাকে এই দুই মাস দেখতে না পেয়ে খুব কষ্ট হয় আমার।আমি তোমার বাড়ির দিকে গেছি কিন্তু তোমাকে পাইনি।আগে যেমন ছাদে বা বাড়ির সামনের মাঠে খেলতে যেতে এখন আর দেখতে পাই না তোমাকে।এই জন্য পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।ভালোবাসি খুব খুব খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে নীরা।আমার নীরুবতী।”
নীরা ও কেয়া একে অপরের দিকে চাওয়া চাওয়ি করে।নীরা কিছু বলার আগে কেয়া বলে,”আফসোস,আপনি আমার জিজু হতে পারলেন না।আপনি যাকে প্রণয় বাক্য দিয়ে নীরুবতী উপাধি দিলেন সে এখন অন্যের চন্দ্র পাখি।”
ইশতিয়াক বুঝতে পারলো না কেয়ার কথা।তাই কেয়ার দিকে ফিরে বলে,”মানে?”
“মানে এই যে আমার বান্ধবী বিবাহিত।”
ইশতিয়াক মন খারাপ করে দুঃখিত বলে স্থান ত্যাগ করে।কেয়া হাসতে থাকে।বলে,”দোস্ত এই ছেলেটা আগে আসলে তোর আর সুগার ড্যাডি বিয়ে করতে হতো না।মনে আছে আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিলি তোর সাথে সুগার ড্যাডির বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
নীরার কোনো উত্তর না পেয়ে কেয়া খোঁচাতে থাকে নীরাকে।বলে,”কি হলো?এই তুই তোর জামাই থুয়ে ইশতিয়াক ভাইয়ের প্রেমে পড়লি নাকি?”
নীরা সামনে তাকিয়ে কাদো কাদো ফেস করে বলে,”সামনে দেখ।”
কেয়া সামনে তাকিয়ে দেখে দ্বীপ রাগে ফেটে যাওয়া ফেস করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে।কেয়া বলে,”কাম সারছে রে!”
অনুষ্ঠানের নাচ গান ও বক্তৃতা শুরু হবে বলে সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসে।স্যাররা কিছু বক্তৃতা দেয়।তারপর গান গাওয়া শুরু হয়।গান শেষে নৃত্য পরিবেশন করা হয়।একেক করে কয়েকজন নৃত্য করার পর পিংকিকে ডাকা হয় নৃত্যের জন্য।পিংকি গানের তালে প্রতিটি স্টেপ খুব সুন্দর ভাবে নাচে।পিংকির নাচ দেখছিলো দ্বীপ।মূলত দ্বীপ একা না সবাই দেখছে পিংকির নাচ।কিন্তু নীরার চোখে যেনো একা দ্বীপকেই বাদছে।
অনুষ্ঠান শেষে সবাই রেজিস্ট্রেশন কার্ড নিয়ে বাইরে এসে ছবি তুলতে থাকে।ইন্টারের পরীক্ষার্থীরা একসাথে ছবি তুলে কেউ কেউ কান্নাকাটি করে আবার কেউ কেউ বাড়ি চলে আসে।নীরা ও কেয়া গেটের কাছে এসে দাঁড়ায়।দ্বীপ ও রিক আসবে।রিক এসে কেয়ার সাথে ঘুরতে যাবে আর দ্বীপ ও নীরা বাড়িতে যাবে।দ্বীপ এসে নীরার কাছে দাড়াতেই রিক চলে আসে।রিকের হাতে বেলি ফুলের মালা।কেয়ার হাতে দিয়ে বলে,”তোমার এই নীল শাড়ির সাথে বেলি ফুলের মালা অনেক সুন্দর লাগবে,চশমিশ।”
কেয়া লজ্জা পেলো একটু।তারপর রিকের কাছ থেকে বেলি ফুলের মালা নিয়ে নীরাকে বলে,”আমার খোঁপায় একটু ফুল দিয়ে দে দোস্ত।”
নীরা কেয়ার খোঁপায় ফুল গুঁজে দিয়ে দেয়।তারপর তারা বিদায় নেয়।নীরা গাড়িতে উঠতেই দ্বীপ বলে,”আজকাল ছেলেদের থেকে খুব প্রোপজ পাওয়া হচ্ছে।”
নীরা হামি দিতে দিতে বলে,”ঘরে টিউব লাইট বর থাকলে যা হয়। বর তো আর ফুল দেয় না পর দেয়।কিন্তু আফসোস ফুল আর নেওয়া হয় না।এদিকে বান্ধবীদের দেখি বিএফ থেকে ফুলের মালাও গিফট পায়।আমারও ভাগ্য আর লোকেরও ভাগ্য।”
দ্বীপ রাগে জেদে জোরে স্প্রিডে গাড়ি চালায়।নীরা ভয় পেয়ে যায় এবার।বলতে থাকে,”মরে যাবো আমি মরে যাবো।ওরে ক্যাডার সাহেব লাগবে না আমার ফুল।আমার লাইফে আপনার মত ব্লাডিফুল থাকতে অন্য ফুল কেনো নিবো বলুন।গাড়ি আস্তে চালান।”
কে শোনে কার কথা দ্বীপ জোরে গাড়ি চালিয়ে আসে বাড়ির সামনে।নীরা হাফ ছেড়ে বলে,”এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আর জীবনেও আপনার সাথে আমি এক গাড়িতে উঠবো না।যদিও উঠি তার আগে আপনার নামে আমি জিডি করে রাখবো।আমার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।”
বলেই নীরা বাসায় চলে আসে।বাসায় এসে হিজাব খুলে শাড়ি পরেই থাকে।কারণ আর কিছুক্ষণ পর নীরব আসবে।নীরা ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে এসে মাথায় খোঁপা করে।ঠিক তখনই পিছন থেকে দ্বীপ নীরার খোঁপায় বেলি ফুলের মালা গুঁজে দেয়।নীরা আয়নায় এই দৃশ্য দেখতে থাকে।
মাথায় বেলি ফুলের মালা গুঁজে দিয়ে দ্বীপ বলে,”আমার ব্যাক্তিগত নারী শুধু আমার।তাকে না দিবে অন্যকেউ ফুল না দিবে অন্য কেউ ভালোবাসা।”
বলেই দ্বীপ নীরার দিকে ঝুঁকে আসে।নীরা বুঝতে পারে দ্বীপ তাকে এবার ভালোবাসার পরশ ছুঁয়ে দিবে।তাই নীরা চোখ বন্ধ করে নেয়।এবার যেনো নীরার সত্যি লজ্জা করছে।দ্বীপের গরম নিঃশ্বাস নীরার মুখে আলাদা অনুভূতি নিয়ে আসে।ঠিক সাথে সাথেই নীরা ফিল করে তার গালে শুকনো খরখরা কিছুর ছোঁয়া।ঠোঁটের ছোঁয়া কি এমন অদ্ভুত লাগে!নীরার কেনো এমন লাগছে?সাথে সাথে চোখ খুলে নীরা।দেখতে পায় দ্বীপ একটি গোলাপ দিয়ে তার গাল স্লাইড করছে।বিরক্ত হলো নীরা।কি ভাবলো আর কি হলো,ধুর।
দ্বীপ নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”যত্তসব দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় বিচরণ করে তাইনা?”
বলেই নীরার হাতে গোলাপ দিয়ে চলে যায় ঘর থেকে।নীরা গোলাপ হাতে নিয়ে বলে,”রসকষহীন ক্যাডার সাহেব।বউকে একটা চুমু দিতে পারে না।আমিও বা ভুলি কি করে!ইনি তো আট বছর ধরে ভালোবাসার প্রকাশই করতে পারেনি।আবার দিবে চুমু!একবার পরীক্ষা শেষ হোক আমি যদি আপনার থেকে এক ডজন বাচ্চা না নিয়েছি তো আমার নাম মুনজেরিন নীরা না।”
বলেই নীরা গোলাপ ফুল নিয়ে খোঁপার এক কোনায় গুঁজে।
চলবে…?