দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ১২ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
466

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথ খেয়াল করলো দোলা ওর সামনে দিয়ে চলে গেলো। নিজেকে সেয়ানা মনে করে মেয়েটা নিজের উপর নিশীথের নজর টের না পেলেও ওড়নার আড়ালে তার মুখ ভেংচি দেওয়াটাও নিশীথ ঠিকি লক্ষ্য করেছে। এতটাই সূক্ষ্মভাবে সে খেয়াল করে দোলনচাঁপাকে। অথচ এই মেয়ে কিনা এক সম্পূর্ণ অহেতুক এক বিষয়কে হেতু করে ওর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে? নিশীথ মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ঠোঁট চিড়ে বেরিয়ে আসে তাচ্ছিল্যের হাসি! একবার ভেবেছিলো কথা বলবে, কিন্তু পরে ভাবলো এ সন্ধ্যেবেলা লোকজনের মাঝে আর দোলাকে আটকানো ঠিক হবেনা। তাই আপাতত দোলার থেকে মনোযোগ সরিয়ে নিশীথ পুনরায় আড্ডায় মন দিলো।

তালুকদার বাড়ি খুজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হলোনা দোলার। এলাকার অভিজাত পরিবার হিসেবে মোটামুটি সবাই তাদেরকে চিনে। এছাড়াও বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে বড় করে লেখা “তালুকদার নিবাস” দেখে না চিনার উপায় নেই! যথারীতি দোলা এসে মেইনগেটের সামনে দাঁড়াতেই দারোয়ান ওকে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—কার সাথে দেখা করতে এসেছেন?

দোলাও নম্রমুখ এ বললো,

—আমার ছোটভাই এখানে খেলতে এসেছে, চাচা। ওকে বাসায় নিয়ে যেতে এসেছি।

দোলার কথায় দারোয়ান বুঝতে পারলো সে কার কথা বলছে। তাইতো মাথা নাড়িয়ে বললো,

—ওহ আচ্ছা! তুমি কি শিমুলের বোন?

—জি, চাচা। ও কোন ফ্লোরে আছে? আমায় বললে আমি নিয়ে আসতাম!

—হ্যাঁ, মা। যাও। আসলে এলাকার মানুষদের মোটামুটি সবাইকেই চিনি, তোমায় এর আগে দেখিনি তো তাই এতক্ষণ সময় নষ্ট করলাম!

দারোয়ান এর কথায় দোলা হেসে বলে,

—কোন অসুবিধে নেই, চাচা। আপনি তো আপনার কাজই করছিলেন। আমি কিছু মনে করিনি।

এরপর দারোয়ান দেখিয়ে দিলো শিমুল কোনদিকে আছে। দোলাও উনার কথামতো সেদিকে গেলো। ফ্ল্যাটের কলিংবেল চাপতেই কাজের লোক গেট খুলে দিলো। পেছন থেকে এক ভদ্রমহিলার কণ্ঠ ভেসে এলো,

—কে এসেছে, রুমা?

—এক আফায় আইছে, খালা।

রুমা নামক মেয়েটি উত্তর দিলো। ওর কথা শুনে ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন দরজার দিকে। স্বাভাবিকভাবেই দোলাকে দেখে চিনতে পারলেন না তিনি। সেভাবেই তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে প্রশ্ন করতেই দোলা সালাম দিলো,

—আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।

সালামের জবাব দিয়ে ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন,

—ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমি কে, মা? তোমায় তো ঠিক চিনতে পারলাম না!

জবাবে দোলা বললো,

—শিমুল আছে কি ভেতরে, আন্টি? মা বললো সুহাসের সাথে খেলতে এসেছে এখানে। আমি ওর বড় বোন। ওকে নিতে এসেছি।

এবার ভদ্রমহিলার টনক নড়লো। সব বুঝেছেন এভাবে মাথা নাড়িয়ে মুখে মিষ্টি হাসি টেনে বল্লেন,

—তাই বলো! সবে তো ৬টা বাজে। এখনি বাচ্চাদের খেলা শেষ হবে বুঝি? ওদের যে ভাব হয়েছে আর বলোনা! আমাদের সুহাসটা একটু চাপা, সমবয়সী বাচ্চাদের সাথে কম মিশে কিন্তু কারও সাথে একবার ভাব হলে তার সঙ্গ ছাড়তে চায়না। তোমার ভাই আবার ওর বিপরীত। ভীষণ চটপটে ও দারুণ মিশুক। এজন্যই এত অল্প সময়ে সুহাসের সাথে খাতির জমিয়ে ফেলেছে।

উনার মুখে নিজের ভাইয়ের প্রশংসা শুনে প্রসন্নসূচক হাসি হাসলো দোলা। মাথা নেড়ে বললো,

—জি, আন্টি। শিমুল আগে থেকেই এমন। আমাদের তিন ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল ও। কিন্তু ওকে যে দেখছি না? একটু ডাকবেন প্লিজ? আসলে ৭টার সময় ওকে স্যার পড়াতে আসবেন বাসায়। ওর হোমওয়ার্ক বাকি তাই মা বললো ওকে ডেকে আনতে। এজন্যই আমার আসা!

দোলার কথায় মহিলা বুঝদার সংগিতে মাথা নাড়লেন। বললেন,

—এখানেই খেলছিলো ওরা। দশ মিনিট আগেই ছাদে গেলো। তুমি বসো পাঁচ মিনিট, আমি রুমাকে দিয়ে ডেকে আনছি ওদের!

উনার কথায় সায় দিয়ে তার পাশের সোফায় দোলা বসলো। রুমাকে ছাদে পাঠিয়ে দোলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ আলাপ হলো ভদ্রমহিলার। এরই মাঝে কথায় কথায় দোলা জানতে পারলো, যার সাথে সে কথা বলছে, তার নাম আসমা বেগম। তিনি তালুকদার বাড়ির বড় পুত্রবধূ। তাদের উপরের ফ্ল্যাটে তার দেবরের পরিবার থাকে এবং সুহাস তার নিজের ছেলে নয়। সে উনার দেবরের ছোট ছেলে। একসাথে যৌথ পরিবার মিলে থাকায় দুটো ফ্ল্যাটেই রোজ আসা-যাওয়া লেগেই থাকে তাদের। এরই ফাঁকে তিনি দোলাকে নিজের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে সে বলে,

—আমার নাম দোলনচাঁপা। সবাই দোলা বলেই ডাকে। আমরা সপ্তাহ দুয়েক আগে এসেছি এখানে। আমার ছোটবোন কামিনি কলেজে পড়ে আর শিমুলকে তো চিনেনই। বাবা বছর কয়েক আগে মারা গিয়েছেন। আমার মা স্কুলে চাকরি করে! এটাই আমাদের ছোট্ট পরিবার!

দোলা সরল মুখে নিজের যাবতীয় বিবরণ দেয়। ওর কথা শুনে আসমা বেগম মুগ্ধ হয়ে বলেন,

—তোমাদের সবার নামই দেখি ফুলের নামে! দারুণ ব্যাপার তো। কে রেখেছিলো তোমাদের নাম?

দোলা হেসে ফেললো তার কথা বলার ধরনে। কেননা সে যেখানেই যাক, ওদের তিনজনের নাম শুনলে এ প্রশ্নটা তাকে প্রায় সব জায়গাতেই শুনতে হয়। তাইতো ওর কাছেও এর উত্তর রেডি থাকে। সেভাবেই সে জবাব দিলো,

—আমার আব্বু রেখেছিলেন, আন্টি। তিনি ফুল ভীষণ পছন্দ করতেন। এজন্যই আমাদের সবার এমন নাম!

আসমা বেগম হাসলেন দোলার কথায়। এর মাঝে শিমুল ও সুহাস চলে এলো। দোলাকে দেখে শিমুল অনেক অবাক হয়েছে সেভাবে বললো,

—দোলাপু? তুমি এখানে?

দোলা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। একবার আসমা বেগমের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে মিষ্টিসুরে বললো,

—তোকে নিতে এসেছি। একটুপর যে স্যার আসবে সে খবর কি আছে?

স্যারের কথায় শিমুল মাথায় হাত দেয়। এটা তো মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো! তবু দোলার দিক চেয়ে একটু অনুরোধের সুরে বললো,

—আপু, আর দশ মিনিট খেলি প্লিজ? এক রাউন্ড খেলেই তোমার সাথে চলে যাবো। প্লিজ?

দোলা চোখ পাকিয়ে তাকালো শিমুলের দিকে। মানা করবে এমন সময় শিমুল আবারো বলে,

—আই প্রমিজ শুধু দশ মিনিট। দেখো মাত্র ৬টা বাজলো। আমরা ৬.৩০ টার আগেই বাসায় যাবো। দু পেজ হোমওয়ার্ক করতে আমার ১০ মিনিটও লাগবেনা। এটুকু সময় থাকতে দাওনা আপু প্লিজ?

শিমুলের অনুরোধের ধরনে আসমা বেগমের মায়া হলো ওর প্রতি। তিনি দোলার উদ্দেশ্যে বললেন,

—এত করে যখন বলছে বেচারা আর দশ মিনিট থাকোনা এখানে, সমস্যা কই? তোমাদের বাড়ি তো এখানেই। ততক্ষণে আমরাও একটু গল্পগুজব করি। এই রুমা, বাসায় মেহমান আসছে। কিছু নাস্তার ব্যবস্থা কর!

দোলা যথেষ্ট নম্রভাবে মানা করার চেষ্টা করলো কিন্তু আসমা বেগম শুনলেন না। এই সুযোগে শিমুল ও সুহাস দৌড়ে ভেতরের একটা রুমে চলে গেলো। অগত্যা দোলাও এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় সোফায় বসে কথা বলতে লাগলো আসমা বেগমের সাথে। কিন্তু এবার সে যা শুনলো তা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা!

____________________

নিশীথ তড়িঘড়ি করে বাসায় ফিরছে। কারণ দাদু ফোন দিয়ে বলেছেন তার শরীর খারাপ, জলদি বাসায় আসতে। ব্যস, এটুক শুনে সে আর কোনোকিছু শুনার প্রয়োজন বোধ করেনি। জলদি ফোন কেটে একপ্রকার ছুটে চলে এসেছে বাসার সামনে। কপালের ঘাম বাম হাতে মুছে কলিংবেল চাপতেই রুমা দরজা খুলে দিলো। ওর কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানির হুকুম করে দাদুর রুমের দিকে নিশীথ হাটছিলো এমন সময় মায়ের আওয়াজে থেমে যায় সে। আসমা বেগম বললেন,

—কিরে নিশীথ, তুই এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলি যে? সূর্য আজ কোনদিক দিয়ে উঠলো?

নিশীথ হাটতে হাটতেই খামখেয়ালিভাবে মায়ের দিক ফিরে বললো,

—দাদু কোথায়, মা? দাদুর নাকি শরীর খারাপ করছে…

মায়ের উদ্দেশ্যে কথাটা বল্লেও সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারেনা সে। মায়ের সামনে বসা মানবীকে দেখে কণ্ঠস্বর গলার মাঝেই আটকে যায় ওর! নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা সেভাবে চেয়ে রয় দোলার দিকে! এদিকে নিশীথের পলকহীন চাহনি দেখে দোলার অস্বস্তি বেড়ে চলে। সে একটু আগেই আসমা বেগমের থেকে জেনেছে যে উনার দুই ছেলে। ছোটছেলের নাম শুনামাত্রই সে বুঝে গেছে, সে কার বাসায় এসেছে! একিসাথে ওর স্মরণে আসে শিমুলের বলা প্রথমদিনের কথা, সে-ও তো বলেছিলো নিশীথ তালুকদার বাড়ির ছেলে! ধুর! কেন যে ওর মনে ছিলোনা ব্যাপারটা! এতক্ষণ ধরে এ কারণেই শিমুলকে তাড়া দিচ্ছিলো এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বিধি বাম। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। দোলার সাথেও হলো ঠিক তাই! নিশীথের কথা ভাবামাত্রই কিছুক্ষণের মাথায় সে এখানে চলে এসেছে! দোলা মাথা নিচু করে ভাবে।

এদিকে নিশীথকে এভাবে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে আসমা বেগম বিরক্ত হোন। ছেলেকে ধমকে জিজ্ঞেস করেন,

—কি হয়েছে? কথার জবাব দিচ্ছিস না কেন? আর আব্বার কি হয়েছে? কই বাসায়-ই তো আছেন। শরীর খারাপ করছে আমায় তো একবারো বললেন না! আব্বা…ও আব্বা?

নিশীথের উদ্দেশ্যে কথা বলেই শশুড়কে ডাকতে লাগলেন আসমা বেগম। এতক্ষণে নিশীথের দাদু রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। দাদুকে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বেরিয়ে আসতে দেখে নিশীথ আরেক দফা অবাক হলো। দাদুর কাছে গিয়ে কিছু বলবে এর আগেই বৃদ্ধ নাতির উদ্দেশ্যে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,

—কি খবর, দাদুভাই? শরীর-মন ভালো আছে তো?

নিশীথের বেশিক্ষণ লাগলোনা ব্যাপারটা ধরতে! দাদু যে ওকে ইচ্ছা করেই শরীর খারাপ এর বাহানায় এ সারপ্রাইজ দিতে এভাবে বাসায় ডেকেছেন, বেশ সহজেই বুঝে ফেললো সে। অগত্যা একবার দোলার দিক তাকিয়ে ফের দাদুর দিক চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেললো নিশীথ! দাদুর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

—সারপ্রাইজ তো ভালোই দিতে জানো, বুড়ো! আই লাভড দিস সারপ্রাইজ।

নাতির দেখাদেখি দাদুও নিচুস্বরে ওর কানের কাছে বললেন,

—আর কি বাড়ি দেরি করে আসবে? আজ তাড়াতাড়ি না এলে এ দৃশ্য মিস করে ফেলতে!

নিশীথ হাসতে হাসতে চোখ টিপে নিচুস্বরে বলল,

—এমন সারপ্রাইজ প্রতিদিন পেলে তো রোজ সন্ধ্যেয় বাড়ি ফিরে বসে থাকবো!

দাদু খানিকটা উচ্চস্বরেই হাসলেন এবার নিশীথের কথা শুনে। এদিকে আসমা বেগম ও দোলা তাদের দাদু-নাতির আচরণের মাথামুণ্ডুও বুঝলোনা। নিরব দর্শকের ন্যায় চেয়ে থাকলো শুধু। এরই ফাঁকে দাদু নিজের ঘরে যেতে যেতে নিশীথের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বললেন,

—তোর দোলনচাঁপাকে নাতবউ হিসেবে আমার পছন্দ হয়েছে। তাই আমার যা করার দরকার ছিলো, আমি ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এখন বাকি সবকিছু তোর উপর নির্ভর করছে, দাদুভাই। নিজের প্রেমটা নিজ দায়িত্বে কর! বেস্ট অফ লাক, মাই বয়!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here