দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ১৭ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
479

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১৭
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের দিন শুরু হলো যতক্ষণে ততক্ষণে দুপুর তিনটা বেজে গেছে। কিন্তু দরজা-জানালা বন্ধ করা হিমশীতল রুমের ভেতরটায় এখনো কোনো আলো-বাতাস প্রবেশ না করায় বাইরে দিন কি রাত তা ভেতর থেকে বুঝার জো নেই! আড়মোড়া ভেঙে কিছুক্ষণ দু হাত ঘাড়ের দুপাশে ডলে ম্যাসাজ করে নিলো ছেলেটা। এক কাত হয়ে ঘুমোনোয় কাধের আশেপাশে কিছুটা ব্যাথা হয়ে গেছে। বালিশের আশেপাশে ফোন হাতড়ে নিতেই সময় দেখে চোখ কপালে উঠলো নিশীথের! সে এতক্ষণ ঘুমিয়েছে? মা ওকে একবারো ডাকতেও এলোনা আজকে! ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত। সচারাচর এমন হয়না। নিশীথ মাথা ঝাকিয়ে ভাবতে থাকে।
রুমের দরজা খুলতে যাবে এমন সময় ঠকঠক আওয়াজ হয় সেখানে। এবার নিশীথ বুঝে কেন মা আসেনি সকাল থেকে! ও দরজা লক করে ঘুমিয়েছিলো দেখে। সে দরজা খুলতেই আসমা বেগম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,

—এতক্ষণে ঘুম ভাংলো তবে? সারারাত কি ঘুমাসনি নাকি? এত দেরি তো হয়না তোর!

মা-কে কি বলবে ভেবে পায়না নিশীথ। ইতস্তত করে বললো,

—কাল রাতে ঘুম আসছিলোনা, মা। ঘুমোতে ঘুমোতে ফজর পার হয়ে গেছে!

ছেলের গালে হাত রেখে মা বললেন,

—এগুলো তো ঠিক না, বাবা। তোর রুটিনের কোনোই ঠিকঠিকানা নেই। এত অনিয়ম করলে কোনদিন না শরীর খারাপ হয় আবার!

মায়ের চিন্তা দেখে নিশীথ হাসে। এই একটা মানুষই আছে দুনিয়ায় যে বিনা কিছু বলে নিশীথকে বুঝে, মমতার হাত মাথায় রেখে ওর হাজারো মন খারাপ ভালো করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নিশীথ ও আসমা বেগম আর কোনো কথা বলবে, এরই মাঝে রুমা চলে আসে সেখানে।
আসমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,

—খালাম্মা, খালু সাহেব আইয়া পড়সে৷ আফনারে ডাকতেসে৷

নিশীথের বাবা এসেছে শুনে দ্রুত পায়ে হেটে রুমার সাথে চলে গেলেন আসমা বেগম। কিছুক্ষণ পর নিশীথও ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো সেখানে। বাবা-মা এর রুমের সামনে যেতেই দেখা হয়ে গেলো আয়মান তালুকদারের সাথে যিনি কিনা কিছু একটা নিয়ে কথা শুনাচ্ছিলেন আসমা বেগমকে৷ নিশীথের ব্যাপারটা মোটেও পছন্দ হলোনা। সে কিছু বলবে, তার আগেই ওর বাবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো ওর দিকে৷ ছেলের দিক এগিয়ে এসে টিটকারি মেরে বললেন,

—আরে, জমিদার মশাই যে? দেখে তো মনে হচ্ছে মাত্র ঘুম ভাঙলো। তা এখন কয়টা বাজে সে হিসেব কি আছে আপনার?

আয়মান সাহেবের ব্যঙ্গ করায় নিশীথ বিশেষ পাত্তা দিলোনা। মূলত উনার এমন কথাবার্তায় সে অভ্যস্ত বলা চলে। তাইতো নিশীথ বাবার কথায় পাত্তা না দিয়ে নিজের মতোন হেটে চলে যাচ্ছিলো ডাইনিং টেবিলের দিকে। তা লক্ষ্য করে আয়মান সাহেবের মেজাজ আরও বিগড়ে যায়। ছেলের উদ্দেশ্যে বাজখাঁই গলায় বলেন,

—বলছি এত বড় দামড়া ছেলে এ বয়সেও বাসায় বসে বসে খেতে লজ্জা লাগেনা? আরে মানুষ তো কিছু একটা করার কথা ভাবে নাকি? দু’দিন পর বিয়েটিয়ে দিতে হবে। তোকে কেউ বিয়ে করবে? এত সুযোগ পড়ে আছে তবু সারাদিন রাস্তায় পড়ে থাকে আর আড্ডা দেয়। তোর মতো সুযোগ থাকলে মানুষ এতদিন কাজ করে কোথায় থেকে কোথায় পৌঁছে যেতো। অথচ তুই এখনো বেকার বসে আছিস বাসায়। আদৌ ব্যবসায় ঢুকার ইচ্ছেটা আছে নাকি রোজকার মতো এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিবি আজকেও?

এবার বাবার কথায় নিশীথ এর মুখ থমথমে হয়। শক্ত হয় মাংসপেশী। পিতার দিক শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,

—বলেছিলাম মাস্টার্স এর পর এ ব্যাপারে ভেবে দেখবো। আমার যে ফাইনাল আছে সামনের মাসে। আগে ওটা ভালোমতো দিয়ে নিই৷ তারপর আমার যা যা করার সব করবো। বুঝেছো?

তারপর কি মনে করে আবার বলে বসে,

—ওহ সরি, আমিও বা তোমায় জিজ্ঞেস করছি কেন। আমার এসব তোমার মনে থাকবেনা নিশ্চয়ই? আমার কথা তোমার একটু কমই মনে থাকে কিনা! আমি তো আর নিশান…

—নিশীথ! চুপ কর এখন। বাবার সাথে এভাবে কথা বলতে হয়না, আব্বা!

আসমা বেগম মাঝপথে থামিয়ে দেন ছেলেকে। মায়ের কথায় নিশীথ ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মাঝেমধ্যে এমন কিছু কথা আছে যা সে বলতে চায়না তবু পরিস্থিতি ওকে অনেকটাই বাধ্য করে এক প্রকার। নিশীথ সরে আসতেই গজগজ করতে করতে রুমে ঢুকে গেলেন আয়মান তালুকদার। এই ছেলেকে নিয়ে আর পারেন না তিনি! হয়েছে একটা ত্যাদড়! নিজের যা মনে আসবে, তাই করবে। অন্য কারও কথার কোনো তোয়াক্কা নেই। মনে মনে বিড়বিড়িয়ে রাগ ঝাড়েন আয়মান সাহেব।

_________________

দোলা বসে আছে ড্রয়িংরুমে শিমুলের সাথে৷ একটু পরেই মামাবাড়ি থেকে নিজের বাসায় চলে যাবে ওরা। পারভীন বেগম ওর মামা-মামীর সাথে কি যেন আলাপ করছেন রুমের ভেতর। কামিনির এখনো রেডি হওয়া শেষ হয়নি। ও রুমে সাজগোজ করছে। এ মেয়েটা একটু বেশিই টিপটপ! দোলার পুরো উলটো। এমন নয় যে দোলা সাজগোজ করেনা, কিন্তু যখন দরকার পড়ে তখনই করে। কামিনির মতো সবসময় নয়। এজন্যই মাঝেমধ্যে বোনের কাজকর্ম দোলা বুঝে উঠতে পারেনা। নিজেদের বাসায়ই তো যাচ্ছে ওরা, তাইনা? তবে এত সাজগোজ করার কি আছে? কিন্তু এসব নিজের মনেই রাখে সে। ভুল করেও কামিনিকে বলেনা। মেকাপ নিয়ে ওকে কিছু বলা মানেই ঘরের মাঝে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগানো। এরই মাঝে শিমুল বলে উঠলো,

—আপু, তোমার ফোনটা দিবে?

—কেন? আমার ফোন নিয়ে কি করবি তুই?

—একটু গেম খেলতাম। আম্মু তো আসছেনা এখনো। কখন যাবো বাসায়? কিসের যে এত গল্প করছে রুমে মামামামির সাথে বুঝিনা! আমি ফোন নেওয়ার জন্য ঢুকতে চাইলাম ঢুকতেও দিলো না!

বিরক্তির সাথে বলে উঠলো শিমুল। দোলা হাসে ওর অধৈর্য্যপনায়। ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

—বড়রা মিলে কোনো জরুরী কথা বলছে হয়তো। তাই আমাদের থাকতে দেয়নি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর বসে বসে?

—একদম ভালো লাগছেনা, দোলাপু। এতক্ষণ কিছ্য বলেছি? কিন্তু এখন আর পারছিনা তাই বললাম। একটু দাও না তোমার ফোন!

—আমার ফোনে তো চার্জ নেই, সোনা। এজন্যই দিতে পারছিনা। তুই যদি এখন খেলিস তবে বাসায় যেতে যেতে বন্ধ হয়ে যাবে। কেউ কোনো দরকারে ফোন দিলেও তো পাবেনা। মিনির থেকে নে না হয়!

কামিনির নাম শুনে শিমুল মুখ বাকায়। চোখমুখ কুচকে বলে,

—তোমার মনে হয় মিনি আপু ফোন দিবে? যেয়ে দেখবা মেকাপ করে সেলফি তুলছে ঢং করে!

কামিনিকে অনুকরণ করে দেখায় শিমুল। দোলা হেসে ফেলে। ভাইয়ের কান্ডে হাসতে হাসতে বলে,

—ও দেখলে তোর খবর ছিলো। তাও একবার ট্রাই করে দেখ দেয় কিনা? না দিলে আবার চলে আসিস আমার এখানে। ততক্ষণ মা-ও চলে আসতে পারে। আমিও যেয়ে দেখি কথা শেষ হয়েছে কিনা!

বোনের কথায় মাথা নেড়ে শিমুল চলে গেলো। ও যাওয়ার পর দোলাও উঠে মামা-মামীর রুমের দিক হাটতে আরম্ভ করলো। কিন্তু এরই মাঝে ঘটে গেলো বিপদ। মামামামির রুম বাসার সবচেয়ে কোনায়। ওদিকে যেতে হলে পথিমধ্যে রাকিবের রুম ক্রস করে যেতে হয়। সচারাচর ওর রুমের দরজা লাগানোই থাকে বলে দোলা অত মাথায় ঘামায়না, কিন্তু আজকে বিধিবাম। যেই না ওর রুমের সামনে দিয়ে দোলা ক্রস করতে ধরলো ওমনি রাকিব এর দেখা পেলো। দোলা ওকে দেখেও অদেখা করে চলে যেতে লাগলে সে এগিয়ে এসে ওর হাত ধরতে যাবে এমন সময় দোলা বললো,

—আমাকে ধরার চেষ্টা করবেনা, রাকিব। ভালো করে বলে দিচ্ছি।

বলাবাহুল্য, ছোটবেলা থেকে পিঠাপিঠি বয়সী হওয়ায় দোলা ওকে নাম ধরেই ডাকে এবং তুমি বলে সম্বোধন করে। কিন্তু রাকিব এর যেন খুব একটা যায় আসলোনা ওর কথায়। বরং সে পথ আটকে রেখেই দোলাকে বললো,

—আজ হোক বা কাল, একদিন তো তোমায় ধরবোই! পালিয়ে যাবে কোথায়?

ওর কথার ধরনে দোলার গা জ্ব’লে গেলো। তেতে উঠে বললো,

—মুখ সামলে কথা বলো। নয়তো তোমার এগুলো কথা আমি মামাকে বলে দিবো!

ওর কথায় রাকিব কিছুটা মজা পেলো যেন। বিশ্রি হাসি দিয়ে বললো,

—বাবাকে বলে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছো? আচ্ছা বলেই দেখো! বাবা কি বলে আমায় জানিয়ো কেমন?

কথাটা বলে হাসতে হাসতে চলে গেলো রাকিব। যেতে যেতে হঠাৎ কি মনে করে পেছন ফিরে দোলার উদ্দেশ্যে বললো,

—উপস। একটা কথা বলতে ভুলে গেছি!

দোলা ভ্রু কুচকে তাকালে সে চোখ টিপে বললো,

—কাল রাতে টের পেয়ে গেছিলে দেখেই সরে আসা লাগলো। রুমে তোমার ওই ঝগড়ুটে বোনটাও ছিলো কিনা! ও টের পেলে একটা কান্ড করে বসতো! কিন্তু অসুবিধে নেই। তোমায় আমি হাতছাড়া করছিনা।

রাকিবের কথায় দোলার গা ঘিনঘিন করে উঠলো! কতটা বিশ্রি মানসিকতা ও মেরুদণ্ডহীন পুরুষ হলে কেউ এমন কথা মুখে বলতে পারে! রাগের শিখায় দোলার শরীর গরম হয়ে এলো। ঠিক তখনি মামা-মামীর রুম থেকে বেরিয়ে এলো ওর মা। হাসিমুখে থাকা মা-কে দেখে দোলা নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। পারভীন বেগম মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,

—কি হয়েছে, দোলা? মুখটা এমন লাগছে কেন?

মায়ের কথার কিছু জবাব দিবে এমন সময় পেছনে মামিকে আসতে দেখে দোলা চুপ হয়ে গেলো। শুধু ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

—বাসায় কখন যাচ্ছি, মা?

—এইতো এখনি। যা শিমুল আর মিনিকে ডেকে আন!

মায়ের কথায় মাথা নেড়ে দোলা দুই ভাইবোনকে ডাকতে চলে গেলো। তবে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, রাকিবের বিষয়টা সে মায়ের থেকে লুকোবেনা। লুকোনো উচিত হবেনা একদমই। কেননা, এরকম পুরুষদের প্রশ্রয় দেওয়াটাও সমান অন্যায়। তাই যা বলার মা-কে বাসায় যেয়ে সব আজকেই বলতে হবে!

#চলবে
নেক্সট পেতে পাশেই থাকুন জয়েন করে facebook.com/groups/golpobolistorylink

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here