#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
“তুমি আমায় কবে মা’রামা’রি করতে দেখেছো? কোথায় দেখেছো? কই আমি তো তোমায় দেখিনি।”
নিশীথের প্রশ্নে দোলা চোখমুখ কুচকায়। কোথায় সে ভেবেছিলো কথাটা বলেই টিউশনির বাহানায় এখান থেকে কেটে পড়বে, অথচ এই লোক কিনা দিব্যি প্রশ্ন করেই যাচ্ছে! আবার কথা বলার কি ধরন, নিজে দেখেনি বলে কৈফিয়ত চাইছে কবে দেখেছে! অদ্ভুত!
মনের মধ্যে এতকিছু ভাবলেও পারতপক্ষে নিশীথের সামনে প্রকাশ করেনা দোলা। কেননা, এখন যত কথা বাড়াবে ততই ভেজাল। তাই অন্তরের ক্রোধ বাহিরে প্রকাশ না করে যথাসম্ভব শান্ত স্বরে বলে,
—কবে, কোথায়, কখন দেখেছি এতকিছু বলতে তো আমি বাধ্য নই। তাছাড়াও আমি আপনাকে মাত্র বললাম আমার টিউশন আছে, স্টুডেন্ট পড়াতে যাবো। আমার তো আপনার মতো অঢেল টাকা নেই, তাই আমার জন্য নিজের প্রত্যেকটা ঘণ্টা গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, দয়া করে আমায় আটকে রেখে এসব অযথা প্রশ্ন করে আপনার-আমার দুজনেরই সময় নস্ট করবেন না প্লিজ!
বামহাতে পড়া নিজের চিকন বেল্টের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দোলা কথাগুলো বলে। ওর কণ্ঠের ব্যগ্রতায় ও ভাবভঙ্গিতে ওর ব্যস্ততা স্পষ্ট বুঝে নিশীথ। নয়তো দোলা সচারাচর এভাবে কথা বলেনা। ফলস্বরূপ নিজের রাগ চেপে সে কিছুক্ষণ ভাবে, ওকে আদৌ এখন যেতে দিবে কি দিবেনা।
বেহায়া মস্তিষ্ক বলছে দোলাকে আটকে রাখতে, চোখের সামনে তো বেশিক্ষণ থাকেনা মেয়েটা।
আবার অপরদিকে মন বলছে, ওকে যেতে দিতে। আজ হোক কিংবা কাল হোক দোলা তো নিশীথেরই হবে। সুতরাং, নিশীথ যদি নিজের দোলনচাঁপাকে না বুঝে তবে আর কে বুঝবে?
তাইতো পরক্ষণে মন ও মস্তিষ্কের লড়াইয়ে সরাসরি মনকে জয়ী করে নিশীথ দোলার কথা মেনে নেয়। তবু ওর ভাবমূর্তি ও কাঠিন্যে সামান্য পরিবর্তন আসেনা। কেবল মাথা নাড়িয়ে দোলার উদ্দেশ্যে তর্জনী তুলে ভরাট কণ্ঠে বলে,
—আজ তোমায় যেতে দিচ্ছি। কিন্তু পরেরবার থেকে এমন বেহু’দা কারণে আমার সাথে এমন করলে তখন তোমায় ছাড়বোনা! কথাটা মাথায় রেখো, দোলনচাঁপা।
কথাটা বলে দোলার সামনে থেকে পথ ছেড়ে সরে দাড়ালো নিশীথ। হাফ ছেড়ে যেন বাচলো মেয়েটা! বলাবাহুল্য, নিশীথের এমন ত্যাড়া কথাগুলো মোটেও পছন্দ হলোনা ওর। জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো “কোন অধিকারে ধরবেন আমায়? আপনাকে কোনোকিছুর জবাব দিতে কি আমি বাধ্য? আসছে যত্তসব!”
কিন্তু নিশীথের মতো ঘাড়ত্যাড়ার সাথে এসব প্রশ্ন করে পাড় পেতে পারবেনা সে, এতক্ষণে তা স্পষ্ট দোলার নিকট। বরঞ্চ এমন প্রশ্ন করলে তার বিপরীতে অন্য কোনো বেফাস কথাবার্তা বলে দিতে পারে লোকটা। আনমনে বিড়বিড় করতে করতে সোজা সামনের দিকে হাটা ধরলো দোলা। মেইনরোডে এসে স্টুডেন্ট এর বাসায় যাওয়ার জন্য রিকশা ঠিক করে। সবেমাত্র রিকশায় উঠে বসতেই নিশীথ পেছন থেকে বাধা দেয়।
বিরক্তিতে কপাল কুচকে দোলা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
—আবার থামালেন কেন? আপনিও আসবেন আমার সাথে স্টুডেন্টের বাসায়?
ওর রাগমিশ্রিত প্রশ্নে নিশীথ নিঃশব্দে হাসে। মুখটা অত্যন্ত স্বাভাবিক করে রিকশায় উঠে বসার ভংগিমা করে বলে,
—নিয়ে যাবে? হ্যাঁ, যাবো তো! চলো।
দোলাকে ভড়কে যায়। বলছে কি এই লোক? সত্যিই আসবে নাকি? ওর ভড়কানো রুপ দেখে এবার নিশীথ আর হাসি আটকায় না। দোলার সামনেই খানিকটা হো হো করে হেসে ফেলে। অতঃপর রিকশা থেকে নেমে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে রিকশাওয়ালার হাতে দিতে ধরতেই দোলা আটকায়।
—কি করছেন? আপনি কেন টাকা দিবেন?
এবার নিশীথ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় দোলার দিকে। যে চোখেমুখে একটু আগের হাসিহাসি ভাবটুকুর রেশমাত্রও নেই! ঠান্ডা স্বরে বলে,
—তোমায় কিছু বলেছি যে প্রশ্ন করছো? চুপচাপ বসে থাকো। আমার যা করার আমি করছি!
এরপর রিকশাওয়ালাকে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বললো,
—সাবধানে নিয়ে যেও, মামা।
দোলা গোমড়ামুখে নিশীথের কর্মকাণ্ড দেখলো শুধু। রিকশা চলে গেলো ওর গন্তব্যের উদ্দেশে। দোলা চলে যেতেই নিশীথ ফোন দিলো আকাশকে ফোন দিলো। যে এ মুহুর্তে বলতে গেলে দোলার ভার্সিটির আশেপাশেই ছিলো। নিশীথের ফোন পাওয়া মাত্র মিনিট দশেকের মাথায় ওর বলে দেওয়া জায়গাতে ওকে নিতে আসলো। আকাশের বাইকে করে নিশীথ নিজেদের গন্তব্যস্থল চলে গেলো।
_____________________
ছেলের আড্ডায় আজ নিতান্ত গাম্ভীর্যতা বিদ্যমান। সবার নজর সামনে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা নিশীথের দিকে, যার কপালে এখন প্রশ্নের ভাজ। আড্ডায় উপস্থিত ছেলেগুলো-ও তাই ওর দিক বেশ মনোযোগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। এক পলক ওদের দিক চেয়ে নিশীথ বললো,
—আমি লাস্ট কবে মা’রপি’ট করেছি বল তো?
তূর্য কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে কৌতুকের ছলে বলে উঠলো,
—তুমি তো প্রায়ই এসব করো। কালকেই না ভার্সিটির কাকে জানি মা’রলে। এখন তুমিই বলো, অত কিছু কি আর মনে থাকে আমাদের?
তূর্যর সবাই বাকিরা হাসতে ধরলেও নিশীথের তীর্যক চাহনি দেখে কেউ আর আপাতত হাসার ইচ্ছে পোষণ করলোনা। নিশীথকে স্বাভাবিক করতে আকাশ প্রশ্ন করলো,
—কি হয়েছে ভাই বলো তো? তোমায় দুপুর থেকেই দেখছি এমন চেহারায়। ভাবির সাথে দেখা করার পর তো তোমার মুড ভালো থাকার কথা, অথচ তুমি উলটো এমন অদ্ভুত প্রশ্ন করছো!
আকাশের কথায় বাকি ছেলেরাও মাথা নেড়ে সাড়া দেয়। কিছু একটা তো হয়েছে নিশীথের, আড্ডার শুরু থেকেই আজকে কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে ছিলো সে। আকাশের কথায় সাহস পেয়ে কবির-ও কথা বলে। নিশীথের উদ্দেশ্যে বলে,
—আকাশের সাথে আমিও একমত, ভাই। কি হয়েছে খুলে বলো। আর হঠাৎ করে মারপিটের কথাই বা বলছো কেন এই টাইম?
—কারণ ওই বা* টার জন্যই তো সব ভেজাল লেগেছে!
নিশীথ বিরক্তির সহিত চেচিয়ে উঠে। কিন্তু কেউ ওর কথার সারমর্ম বুঝতে পারেনা। তাই ছেলেদের দিক চেয়ে নিশীথ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর সবকিছু খুলে বলে। নিশীথের কথায় বাকিরা অবাক হয়। একিসাথে ভাবতে শুরু করে দোলা ওকে কোথায় দেখতে পারে। কেননা, এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও তো ওদের দুজনের সেভাবে দেখাও হয়না। হওয়ার কথাও না! তাই তূর্য যুক্তি খাটিয়ে উত্তর দেয়,
—ভাই, আমার মনে হয় সেদিন তুমি যে সন্ধ্যেবেলা ওই পকেটমারকে মেরেছিলে না যে আবদুল চাচার ফোন চুরি করেছিলো। ওটা মনে হয় ভাবী দেখছে! ওদের বাসা থেকে তো আমাদের টং এর দোকানটা দেখা যায়, ভুলে গেছো?
তূর্যর কথায় জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় সবাই। আকাশ চিল্লিয়ে বলে,
—একদম ঠিক বলেছিস। তাছাড়া আর কই-বা দেখবে? তোমাদের কি বাহিরে কোথাও দেখা হয়? বা তোমার মনে হয় ভাবি অন্য কোথাও দেখতে পারে?
নিশীথ মাথা নাড়ে। অর্থাৎ, তূর্য ঠিক বলেছে। দোলা যদি ওকে কখনো মার’পিট করতে দেখে তবে ওদের এলাকাতেই দেখেছে, অন্য কোথাও দেখার সম্ভাবনা শূন্য বললেই চলে! কিন্তু, সে তো একটা উপযুক্ত কারণে মারা’মারি করেছিলো ওইদিন। ওটা না করলে চোরটার সাহস বেড়ে যেতো এবং সে সুযোগ পেলেই এলাকায় ইচ্ছেমতো চুরি করতো। তাইতো সবার সামনেই ওকে মেরে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে ভয় দেখিয়েছে সে! উপরন্তু এলাকার মুরব্বিদের নিকট হতে বেশ প্রশংসাও কুড়িয়েছে বটে!
কিন্তু কথা হলো, এখন সেটা দোলাকে কে বুঝাবে? মেয়েটা তো কোনোকিছু না জেনেই ওকে ভুল বুঝে বসে আছে! নিশীথ অতীষ্ঠ ভংগিতে মাথা চাপড়ায়। ওর দোলনচাপা-ও কিছুটা ওর মতোই। মেয়েটারও বেশ রাগ আছে, যা আজ ওর কথাবার্তায় স্পষ্ট বুঝেছে নিশীথ। একে মানাতে ও সামলাতে বেশ ভালোই পুড়তে হবে ওকে! তবে যেয়ে না প্রেম হবে দোলনচাঁপার সাথে।
এসব ভাবতে ভাবতে নিশীথ ফোস করে দম ফেলে। পকেট থেকে ফোন বের করে লক খুলতেই ওয়ালপেপারে দোলার হাস্যোজ্জ্বল ছবিটা বের হয় চোখের সামনে। সাথে সাথে নিশীথের এই ছবি তুলার দিনটার কথা মনে পড়ে! সে গিয়েছিলো তূর্যদের বাসায়, যার বাসা দোলার বাসার সামনে। তূর্যকে জিজ্ঞেস করায় সে জানতে পারে ওর রুমের বারান্দা থেকে দোলার বারান্দা দেখা যায় স্পষ্ট। নিশীথ ভ্রু কুচকায়। যদিও সে জানে ওর দোলনচাঁপার দিকে তাকানোর সাহস ওর সাংগপাংগদের মধ্যে কারো নেই। তবুও তূর্যকে হুশিয়ারি দিয়ে নিশীথ নিজে বারান্দায় প্রবেশ করে। তখন দোলা ওকে চিনতোনা। সে সদ্য গোসল সেড়ে নিজ বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। দোলার সাদা রঙের শুভ্র জামায় নিশীথের মনে হয়েছিলো ওর সামনে সদ্য প্রস্ফুটিত দোলনচাঁপা ফুল দাঁড়িয়ে আছে! দোলার অগোচরে ওই ক্ষনিকের মুহুর্তেই নিশীথ ওর একটি ছবি ক্যামেরাবন্দী করে! সেই থেকে ছবিটা ওর ওয়ালপেপারে ঝুলছে। সেদিনই নিশীথ বাসায় যাওয়ার পথে দোলনচাঁপার গাছ কিনে নিয়ে যায়। সন্ধ্যাবেলায় প্রস্ফুটিত যার সুবাসে ওর প্রত্যেকটা রাত সুবাসিত হয়, অন্তর প্রশান্ত হয়!
নিশীথ ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। ফোনে বন্দি দোলার ছবির দিক তাকিয়ে বলে,
—অনেক তো হলো লুকোচুরি প্রেম প্রেম খেলা। এবার থেকে সরাসরি তোমার মন চুরির খেলা হবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ, মাই ডিয়ার দোলনচাঁপা।
#চলবে
গল্পের কাহিনি কেবল শুরু। যাদের কাছে মনে হচ্ছে কেন এখনো মিল হচ্ছেনা বা কাহিনি স্লো এগোচ্ছে তারা কাইন্ডলি গল্পের শেষে পড়বেন৷ আমি যেভাবে ভেবেছি ওভাবেই আগাবো। পর্ব কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না।