#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশুতি রাত। বাহিরে ঝি ঝি পোকা ডাকছে মনের সুখে। কিন্তু দোলার মনে সুখ নেই। সে তো নিজ রুমে বসে আছে একা। জানালার সাথে হেলান দিয়ে একমনে ওই অন্ধকার আকাশে তাকিয়ে কি যেন দেখছে মেয়েটা। মাথার মধ্যে ঘুরছে সারাদিনে ওর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো। নিশীথের আজকের ব্যবহার ছিলো ওর অন্য সব দিনের ব্যবহার এর চেয়ে আলাদা। আজকের নিশীথকে যেন বেশ ভিন্ন এক রুপে দেখেছে দোলা। যার প্রতিটি কথায় এবং কাজে স্পষ্ট ছিলো দোলার প্রতি ওর অন্যরকম অধিকারবোধ! যে অজানা অধিকারবোধের তীব্রতা এতটাই ছিলো যে দোলা চেয়েও এ বিষয়ে খুব বেশি কিছু বলতে পারেনি ওকে। শুধু নীরবে নিভৃতে পর্যবেক্ষণ করেছে নিশীথকে। তবে কি শিমুল ওকে প্রথমদিন নিশীথ সম্পর্কে যা বলেছিলো তা কি সঠিক? লোকটা কি সত্যিই ওকে পছন্দ করে?
নিজের কাছে নিজেই প্রশ্নটা করে দোলা ছটফট করে। কেননা, প্রাপ্ত বয়স্ক একটা ছেলেমানুষ ওর বয়সী একটা মেয়ের সাথে বিশেষ সম্পর্ক না থাকার পরেও যদি এরুপ আচরণ করে তবে সেটা কোনদিকে ইংগিত দেয়, বুঝতে অসুবিধে হয়না বিচক্ষণ মেয়েটার! উপরন্তু, ক’দিন থেকেই নিশীথের ওর প্রতি আচরণ ও ব্যবহারে এটা অনেকটাই স্বচ্ছ যে ওর মনে দোলার প্রতি কিছু আছে। নয়তো সামান্য ক’দিনের পরিচয়ের এক মেয়ের ওকে এভাবে ইগ্নোর করায় এতটা রিয়েক্ট নিশ্চয়ই করতোনা! মনে মনে এসব হিসেব কষার পর খানিকবাদে দোলা আবার ভাবনাচিন্তায় পড়ে যায়।
ওর ছোট্ট মনে প্রশ্ন আসে, এই স্বল্প সময়ে একটা মানুষের মনে আরেকজনের জন্য এরকম অনুভূতি আসা কি করে সম্ভব? নিশীথের সাথে তো ওর পরিচয় হলোই এইতো সেদিন। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? মেয়েটা ভেবে পায়না! মনে মনেই ছটফট করে। খাট থেকে উঠে রুমের মাঝেই কিছুক্ষণ অস্থিরভাবে হাটাহাটি করে। এরই মাঝে এক পর্যায়ে এসে কদম থামে ড্রেসিংটেবিলের আয়নার নিকট। স্বচ্ছ কাচের আয়নার মাঝে নিজের ঝকঝকা প্রতিবিম্ব লক্ষ্য করে সে ভাবে, এমন কি আছে ওর মধ্যে যা নিশীথকে আকর্ষণ করতে পারে?
বেশ কিছুক্ষণ নিজের চেহারা ও গড়ন ঘাটাঘাটি করেও সন্তোষজনক কোনো জবাব দোলা পেলোনা। কেননা, তার মতে সে দেখতে শুনতে অতটা খারাপ না হলেও কোনো মানুষকে প্রথম দেখায় আকর্ষণ করার মতো ক্ষমতা যে ওর আছে, দোলা তা কোনোভাবেই ভাবতে পারেনা। যেনতেন লোক হলেও কথা ছিলো, যে ওকে পছন্দ করেছে সে তো ওর কল্পনার পর্যায়েই পড়েনা। নিশীথের মতো আপাদমস্তক টিপটপ একখানা আলালের ঘরের দুলাল যে ওর মতো ছাপোষা সাধারণ মেয়েকে পছন্দ করবে, তাও আবার এত স্বল্প ক’দিনের পরিচয়ে, বিষয়টা নিতান্তই অবিশ্বাস্য ও হাস্যকর। তাই বেশ অনেকক্ষণ এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করার পর দোলা মাথা ঘামানো বাদ দিলো। সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করার চেষ্টা করছে, নিশীথ ওকে সত্যিকার অর্থে পছন্দ-টছন্দ করেনা। তবু লোকটা যে ওর সাথে এরকম আচরণ করছে এর পেছনে অবশ্যই অন্য কোনো কারণ আছে! কিন্তু সেটা কি হতে পারে- দোলার মাথায় ঢুকছেনা!
বেশ অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনার পর দোলা ধরে নিলো নিশীথ কোনো স্বার্থে ওর সাথে এমন আচরণ করছে। হয়তোবা দোলার সাথে এরুপ আচরণ করার পেছনে সুপ্ত কোনো কারণ লুকিয়ে আছে ছেলেটার মনে, যা সে জানেনা! বলা তো যায়না, বড়লোকের ছেলেদের কাছে প্রেম করা আজকাল হাতের মোয়া। দোলা ওর খুব কাছের বান্ধবীদের মধ্যে এরকম অনেক দেখেছে যে, বেশিরভাগ বড়লোকের সুদর্শন ছেলেরা ওদের মতো সাধারণ মেয়েদের সাথে কিছুদিন প্রেম করে টাইমপাস হিসেবে তারপর আবার তাদের ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের জায়গা দেখিয়ে দেয়। এ ক্ষণিকের মোহে ছেলেগুলোর কিছুই হয়না কিন্তু মাঝখানে দিয়ে মন ভাংগে মেয়েগুলোর। চোখের সামনে এরকম অনেককিছু দেখে, শুনেই দোলার প্রেম এর প্রতি ইচ্ছা-অনুরাগ সবটা উঠে গেছে। তাইতো প্রেম যাবতীয় বিষয়গুলোয় কোনো অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও সে বিশেষ আগ্রহবোধ করেনা।
কিন্তু এখন নিশীথের ব্যাপারে সে কি করবে না করবে- বিষয়টা নিয়ে মেয়েটা বেশ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। পরমুহূর্তে ভাবলো, যেহেতু নিশীথ এখনো সরাসরি এ ধরনের কিছুই ওকে বলেনি বা ইংগিত দেয়নি সুতরাং এ বিষয়ে নিশীথসহ অন্য কাউকে কিছু বলাও যাবেনা আর। তাই পরেরটা পরে দেখা যাবে। আপাতত দোলার মাথা ধরে গেছে এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে করতে। ঘুমানোর আগে এক কাপ কড়া চা খেয়ে মাথাব্যাথা সাড়াতে হবে ওর! যেমন ভাবনা তেমন কাজ, মন-মস্তিষ্ক থেকে নিশীথকে সরিয়ে ও রান্নাঘরে চলে গেলো।
___________________
পরদিন বিকেল। এদিন বাড়ি থেকে আর বের হয়নি দোলা। এর মধ্যে ওর মা ডাকলো। দোলাকে ডেকে বললেন ছাদ থেকে কাপড় তুলে আনতে। সময় দেখে দোলাও উপরে গেলো কাপড় তুলতে। চারতলা বাসার ছোট্ট ছাদখানায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ প্রাণভরে শ্বাস নিলো। সোনালি রোদের তাপে কাপড়গুলো এতক্ষণে শুকিয়ে কড়কড়ে হয়ে গেছে। কাপড় তুলে দোলা কি মনে করে নিচে উঁকি দিলো। বাচ্চারা খেলছে নিচে, দু-তিনজন মহিলা গল্প করতে করতে হেটে যাচ্ছেন। তেমনিভাবেই গলির মোড়ে চোখ ঘুরাতেই ওর চোখ পড়লো ঠিক নিশীথের উপর। যে কিনা এক হাতে সিগারেট ও অন্য হাতে চা নিয়ে হাসছে কারো সাথে। দৃশ্যটা দেখে দোলার ভ্রু নিজ হতেই কুচকে গেলো। এটা আবার কি ধরনের খাওয়ার স্টাইল? এক হাতে সিগারেট আর কিনা অপরহাতে চা? ছিঃ!
দুচোখ বিষিয়ে কিছুক্ষণ নিশীথের দিক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো দোলা। ভাবলো, নিশীথের যা করুক সে করুক, ওর কি? ওর কিছুই না! তাই কাপড়চোপড় হাতে নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে নেমে পড়লো সে।
বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে কাপড় গুছানোর মাঝেই পারভীন বেগম মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
—কয়টা বাজে রে? এই রুমের ঘড়ি নস্ট হয়ে গেছে দেখেছিস? কাল ব্যাটারি নিয়ে আসিস তো।
—কবে নস্ট হলো, মা? তুমি আগে বলোনি কেন? কাল তো বেরিয়েছিলামই বাহিরে। কালকেই নিয়ে আসতাম!
দোলা জবাব দেয়।
—আমিও আজ সকালেই খেয়াল করেছি। বলবো বলবো করে তো আর মনে থাকেনা। কম কাজ করি নাকি সংসারের? তাও তোরা দুই বোন টুকিটাকি সাহায্য করিস দেখে রক্ষে হয়। নয়তো যে কিভাবে চলতাম আমি তোর বাপের যাওয়ার পর!
প্রয়াত স্বামীর কথা মনে করে পারভীন বেগমের চোখ দুটো ভরে আসে জলে। দোলার নিজেরও বাবার কথা মনে হয়ে খারাপ লাগে। তবু মায়ের মন ভালো করতে নিজের মন খারাপকে চেপে রাখে সে। কথা ঘুরাতে মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,
—আচ্ছা এসব বাদ দেও। শিমুলকে তো দেখছিনা, মা। ও কোথায় গেছে? ছাদ থেকে উকি দিলাম ওকে পাই কিনা দেখার জন্য কিন্তু ওকে বাদে দুনিয়ার সবাইকে দেখে আসলাম!
শেষের কথাটা নিশীথের উদ্দেশ্যে বল্লেও মেয়ের কথা ধরতে সক্ষম হলেননা পারভীন বেগম। স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
—নির্ঘাত ওই বাসায় গেছে। এত মানা করি ছেলেটাকে! তাও শুনেনা। আজকে বাড়ি আসতে দে ওকে, কয়েক ঘা পড়লে তবে না ঠিক হবে!
মায়ের এহেন রাগ দেখে দোলা খানিকটা ভড়কায়! বিস্ময় এর সহিত বলে,
—কার কথা বলছো, মা? আর এত রাগ করছো কেন? কোথায় গেছে শিমুল?
পারভীন বেগম ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মেয়ের দিক চেয়ে হতাশ স্বরে বললেন,
—আর বলিস না তোর ভাইয়ের কথা। কিছু বলিনা দেখে বেশি দস্যি হয়ে গেছে কিনা! বিকেল না হতেই চলে যায় গলির শেষের ওই তালুকদারদের বাসায়। ওখানে ওর বয়সী এক বাচ্চাছেলে আছে যার সাথে বেশ ভাব জমেছে ওর। কিন্তু এগুলো কি ঠিক, বল? দিনদুপুরে এভাবে মানুষের বাসায় যাওয়া কেমন দেখায়? এত মানা করেছি এই ছেলেকে তবু শোনার নাম নেয়না! আর তুইও বা বসে আছিস কেন? ক’টা বাজে দেখ না!
ছেলেকে শাসানোর কথা বলতে বলতে মেয়েকেও ধমকে জিজ্ঞেস করলেন পারভীন বেগম। দোলা ভড়কে গেলো মায়ের হঠাৎ ধমকে। কোনোমতে ফোনে সময় দেখে বললো,
—পাচ মিনিট কম ছয়টা।
ওর মা কপাল চাপড়ে বললেন। সাতটার সময় স্যার আসবে পড়াতে আর জমিদার এখনো খেলতে ব্যস্ত! আজকে নাকি হোমওয়ার্কটাও করেনি ঠিকমতো! ওকে যেয়ে মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে আসতে হবে দেখছি আজকে!
কথাটা বলেই মাথায় ওড়না পেচিয়ে রুম ছাড়ার জন্য উদ্যত হলেন পারভীন বেগম। দোলা বুঝলো মা কোনোকারণে ভীষণ ক্ষেপে আছে শিমুলের উপর। এ মুহুর্তে যদি তিনি বাড়ির বাইরে বের হোন তবে নির্ঘাত মানুষের মধ্যেই মারতে মারতে বাড়ি নিয়ে আসবেন শিমুলকে। তাইতো মা কে থামাতে তিনি বলেন,
—মা, তুমি যেয়োনা। তোমার মাথা ঠিক নেই এখন। দেখা গেলো মানুষের সামনেই বেচারাকে মারছো।
মেয়ের কথায় যেনো আরেকটু তেতে উঠেন পারভীন বেগম। তেজ দেখিয়ে বলেন,
—তুই বেশি জানিস? ওকে এখন না আনলে জীবনেও বাসায় এসে পড়া কমপ্লিট করতে পারবেনা। এত টাকা দিয়ে স্যারের কাছে পড়িয়ে লাভ কি হবে যদি ও এসব করে?
দোলা বুঝে মায়ের যুক্তি। তবু বলে,
—সব বুঝছি, মা। কিন্তু তুমি যেয়োনা। আমি যা বলছি সব বুঝেই বলছি।
—তবে কে যাবে শুনি? তুই যাবি?
পারভীন বেগম পালটা প্রশ্ন করেন দোলাকে। মায়ের সাথে না পেরে অগত্যা দোলাও বলে ফেলে,
—হ্যাঁ, আমিই যাচ্ছি। এটলিস্ট তোমার যাওয়ার থেকে আমার যাওয়ায় বেটার হবে!
—তবে যা। কান ধরে টেনে নিয়ে আসবি শয়তানটাকে!
ছেলের বাহানায় দোলাকে শাসিয়ে কথাগুলো বলে মাথা থেকে ওড়না ফেলে পুনরায় কাপড় গুছাতে লেগে গেলেন। মায়ের দিক চেয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলা মাথায় কাপড় দিয়ে বেরিয়ে পড়লো বাসা থেকে। গলির শেষে টং এর দোকানে নিশীথকে দেখে আনমনে মুখ ভেংচিয়ে পা বাড়িয়ে হাটা শুরু করলো তালুকদার বাড়ির নিকট।
কিন্তু এতকিছুর মাঝে বোকা মেয়েটা ঘুণাক্ষরেও টের পেলোনা সে আসলে কার বাসায় যাচ্ছে!
#চলবে
রিচেক দেওয়ার সময় হয়নি। আজকে পর্ব দিতে পারতাম না কিন্তু একপ্রকার সময় বের করেই লিখেছি আপনাদের জন্য। আজ আমার জন্মদিন। সবাই আমার জন্য বেশি বেশি দোয়া করবেন। ভালোবাসা!! 🤍