#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
দাদু চলে যাওয়ার পর উনার পিছু পিছু নিশীথও কিছুক্ষণের জন্য নিজের রুমে চলে গেলো। তা দেখে দোলা হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন! এতক্ষণ নিশীথের সাথে চোখাচোখি না হওয়ার জন্য মাথা নিচু করে প্রায় দম বন্ধ করে রেখেছিলো সে। এবার শ্বাস নিয়ে আসমা বেগমের উদ্দেশ্যে বললো,
—আন্টি, দশ মিনিট তো হয়েই এসেছে প্রায়। দেরি হলে মা বকবে দুজনকেই। আমরা এখন যাই?
দোলার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে আসমা বেগম বললেন,
—আরে দোলা, তুমি এত চিন্তা করছো কেন বুঝলাম না! সবেমাত্র তো এলে। কিছুক্ষণ থেকেই না হয় যাও? এক্ষুনি নাস্তা আনবে রুমা। না খেয়ে তোমাদের যেতে দিচ্ছিনা। শিমুলও খেয়েই যাবে!
দোলা বুঝলো এনার সাথে কথায় সে পারবেনা, উপরন্তু গুরুজনদের সাথে বিশেষ তর্ক করতে সে আগ্রহী কোনোকালেই ছিলোনা। তাদের কথা মেনে নেওয়াই ওর মুখ্য কাজ ছিলো সবসময় এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হলোনা! অনেকটাই মনের বিরুদ্ধে মাথা নেড়ে দোলা রাজি হয়। মনে মনে কটমট করতে করতে শিমুলের অপেক্ষা করে, ওকে বকতে থাকে। আজ যদি সে এখানে না আসতো তবে ওকে-ও আসতে হতোনা এবং নিশীথের সাথে এভাবে দেখাও হতোনা!
দোলা মনে মনে ফুসে।
রুমা নাস্তা নিয়ে আসে। এরই মাঝে নিশীথ ও দাদু চলে আসেন নাস্তা খেতে। দাদুর সাথে দোলার কিছুক্ষণ সৌজন্যমূলক কথাবার্তা হয়। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে নিশীথ সেদিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। সরাসরি না দেখলেও নিজের উপর সে দৃষ্টির প্রগাঢ় তীব্রতা দোলা ঠিকি অনুভব করতে পারে। নিজের অজান্তেই ওর লাল দুটো লালচে আভায় সেজে উঠে। তা খেয়াল করলে নিশীথ মনে মনে হাসে!
তবে কি দোলনচাঁপা একটু একটু করে ওর প্রেমের জালে ফাসছে বটে?
খাওয়া শেষে দাদু উঠে গেলেন। দোলার কথায় রুমাও শিমুলকে ডাকতে চলে গেলো ভেতরে। আসমা বেগম দোলার সাথে নিশীথ এর পরিচয় করিয়ে দিলেন। তবে দুজনের একজনও প্রকাশ করলোনা তারা একে-অপরকে আগে থেকে চিনে! আসমা বেগম আরও কিছু বলবেন এর মাঝে তার ফোন বেজে উঠায় দ্রুতপায়ে নিজ কক্ষের দিকে ছুটলেন তিনি। নিশীথ মনে মনে বেশ খুশি হলো এ সময়ে মায়ের ফোন আসার জন্য! ড্রয়িংরুমে এখন কেউ নেই। এটাই তো দোলার সাথে কথা বলার মোক্ষম সুযোগ! এর চেয়ে ভালো আর কি হতে পারে? নিশীথ সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দোলার দিকে এগোতে চায়, কিন্তু দোলা হয়তো বুঝে গেলো নিশীথ কি করতে চায়। তাইতো আচমকা কিছু না বলেই সোফা থেকে উঠে একপ্রকার ছুটে বেরোলো ড্রয়িংরুম থেকে। হঠাৎ ওর এহেন আচরণে ছেলেটা ক্ষণিকের জন্য ভড়কায়। অতঃপর ত্রস্ত পায়ে হেটে চলে দোলার পিছু।
ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে নিশীথ দেখে দোলা গ্লাসে পানি ঢালছে। তা দেখে সে ধীরেসুস্থে ওর নিকট এগিয়ে যায়। সবেমাত্র নাম ধরে ডাকলো,
—দোলনচাঁপা,
ওমনি দোলা পানির গ্লাস মুখে নেয়। যেন নিশীথের কথা শুনেইনি এমন ভান করে খুব মনোযোগ দিয়ে পানি খেতে লাগে। ওর মনোযোগের মাত্রা এতটাই বেশি যে দেখে মনে হয় এই দুনিয়ায় এ মুহুর্তে দোলার জন্য পানি খাওয়ার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই। নিশীথ মনে মনে প্রচুর বিরক্ত হয়। মেয়েটা যে ওকে ইচ্ছা করে আবারো ইগ্নোর করছে তা বেশ ভালোই বুঝতে পারে। এবার একে ভালোভাবে শক্ত কথায় জব্দ করতে হবে, নয়তো এ বুঝবেনা। নিশীথ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়। দোলা পানি খাওয়া শেষ করে পাশে তাকিয়ে দেখে নিশীথ নেই। যা দেখে একিসাথে খুশি ও বিস্মিত হয়! সে যে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে দোলা আশা করেনি তাই একটু অবাক হয়েছে বটে। কিন্তু কেউ দেখে ফেললে বাজে হতো তাই দোলা মনে মনে নিশীথের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দম নেয়।
ঘাড়ের উপর উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়তেই দোলার হুশ ফিরে আসে! চকিত বেগে পেছন ঘুরবে তার আগেই ওর হাতদুটো কেউ পেছন থেকে নিজ মুঠোয় বন্দি করে নেয়। বিস্ময়ে উত্তেজনায় দোলার শ্বাসরোধ হয়ে আসে। তবু নিজেকে কোনোমতে সামলে সে কথা বলার চেষ্টা করে। কেননা, সে বুঝতে পেরেছে কাজটা কে করছে! দোলার তপ্ত কণ্ঠে উদ্বেলিত হয়,
—হাত ছেড়ে দিন, নিশীথ ভাই।
—ছাড়বোনা।
নিশীথের দৃঢ় জবাব। দোলা আকুতি করে,
—এক্ষুনি কেউ এসে যাবে। আপনার বাসা এটা, আমাদের এভাবে দেখলে বিষয়টা ভালো দেখাবেনা। প্লিজ বুঝার চেষ্টা করুন!
—আমার বাসা দেখেই তো ছাড়ছিনা। কেউ যদি দেখেও ফেলে তবে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার! তুমি শুধু এটা বলো, আমায় এখনো কেন ইগ্নোর করছো? সেদিন দুপুরের ডোজটা কি কম হয়ে গিয়েছিলো নাকি আরও লাগবে?
বেশ নিচু অথচ তীক্ষ্ণ আওয়াজে বলা নিশীথের শব্দগুলো দোলার শ্রবণেন্দ্রিয় ভেদ করে তীব্রভাবে। কিছুক্ষণ এ কথাগুলোই ঘুরেফিরে কানে বাজে অনবরত। তবু সে আগেকার ন্যায় বলে,
—আপনি আমার সাথে এমন করতে পারেন না, নিশীথ ভাই। এখনো সময় আছে এসব বাদ দিন!
—কি বাদ দিতে বলছো?
দোলার হাতদুটো ধরে নিজের কাছে আরেকটু টেনে নিয়ে নিশীথ প্রশ্ন করে। কিন্তু মেয়েটা জবাব দেবার আগেই পায়ের আওয়াজ কানে ভাসে। দোলার মাথা ভনভন করে! নিশ্চয় কেউ আসছে! যদি আসমা বেগম হন? তবে উনি কি মনে করবেন তাকে? বলাবাহুল্য, নিজের ছেলের দোষ কেউ ধরবেনা, সব দোষ পরের মেয়েরই হবে। যদি তিনি দুজনকে এভাবে দেখে ফেলেন এখানে, তবে নিশ্চিত ভাববেন দোলাই তার ছেলেকে ফাসিয়েছে, ওকে দিয়ে এসব করাচ্ছে। এরপর সে যতই নিজের স্বার্থে কথা বলুক না কেন, উনি বুঝবেন না! এভাবে পুরো এলাকায় ওর বদনাম হবে! মা-কে কিভাবে মুখ দেখাবে সে? ভয়ে-লজ্জায় দোলার চোখ পানিতে টইটম্বুর প্রায়!
নিশীথ কিছু বলবে এর আগেই পায়ের আওয়াজ পেয়ে দোলার হাতদুটো ছেড়ে দেয়। ওর নিকট হতে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে গ্লাসে পানি ঢালার ভান করে। এর মাঝে ফোন হাতে আসমা বেগম এলেন এবং দুজনকে ডাইনিং টেবিলের সামনে দেখে খানিকটা বিস্মিত হয়ে বললেন,
—আরে, তোমরা এখানে? পানি খেতে এসেছিলে বুঝি?
দোলা চোখের পানি ঢাকতে অন্যদিক হয়। মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে জবাব দেয়,
—জি আন্টি।
আসমা বেগম লক্ষ্য না করলেও দোলার আড়ালে লুকোনো অশ্রুজল নিশীথের ঠিকি চোখে পড়ে। সে কিছুটা অবাক হয়। এটুকুতেই কেদে দিয়েছে মেয়েটা? সে কি তবে এবারে একটু বেশি বেশি করে ফেলেছে নাকি?
কিন্তু আপাতত মনের ভাবনা মনেই রাখতে হয়। কারণ মায়ের সামনে নিশীথ চেয়েও দোলাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনা। এরই মাঝে শিমুল চলে আসে সুহাসের সাথে। নিশীথকে দেখে সুহাস দৌড়ে আসে ওর কাছে। শিমুলও বোনের কাছে চলে আসে। অতঃপর আসমা বেগমকে বলে বিদায় নিয়ে দোলা ও শিমুল নিচে চলে গেলো। যাওয়ার সময় দোলা ভুলেও নিশীথের দিকে তাকালো না। এবার নিশীথও কিছু মনে করলোনা। উপরন্তু, প্রিয়তমার চোখের পানি দেখে সে নিজেও খানিকটা থমকে গেছে!
দুই ভাইবোনে হেটে চললো বাসার উদ্দেশ্যে। শিমুল নিজের স্বভাব মতোন সারাদিন কি কি করেছে না করেছে এসব গল্প করতে লাগলো বোনের সাথে। কিন্তু আজ দোলার এসবে মন নেই। ওর মাথায় ক্রমাগত নিশীথের আচরণ ঘুরপাক খাচ্ছে। আজকে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে সে। ওর মনে নিশীথের প্রতি ভয় দিনকে দিন কমার বদলে বেড়েই চলছে। তা কি ছেলেটা আদৌ বুঝছে? নাকি সে শুধুই নিজের অনুভূতি জোরপূর্বক ওকে বুঝানোর চেষ্টা করছে?
নিশীথকে এটা কিভাবে বুঝাবে দোলা জানেনা। তবে মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নিলো, এরপর থেকে নিশীথ এরকম কিছু করতে এলে ওকে ভালোভাবে নিজের মতামত জানিয়ে দেবে। নিশীথকে শুধু নিজের অনুভুতি বুঝলেই হবেনা, দোলার দিকটাও ভেবে দেখতে হবে।
এসব ভেবে একটি বড়সড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোলা!
দোলারা বাসার কাছে যাবে এমন সময় মায়ের ফোন আসে ওর ফোনে। মা-কে ফোন দিতে দেখে শিমুল ওর হাত ছেড়ে দৌড়ে উঠে যায় উপরে। দোলাও চুপচাপ পিছু পিছু আসছিলো। এমন সময় পেছন থেকে সেই চেনা ডাক ভেসে আসে,
—দোলনচাঁপা?
নিশীথের গম্ভীর স্বর দোলার অন্তরে হিমশীতল অনুভূতি জাগায়। তবু সে সাহস করে পেছন ফিরে। তা দেখে নিশীথ একটু শান্ত হয়। ছেলেটাকে অস্থির দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন দৌড়ে এসেছে এতদূর। দোলা বেশ ঠান্ডা স্বরে বললো,
—বলুন।
—তুমি কি তখনকার জন্য কষ্ট পেয়েছো?
নিশীথ ব্যাকুল কণ্ঠে শুধায়। দোলা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। আগেকার ন্যায় বলে,
—কষ্ট পাওয়াই কি স্বাভাবিক নয়? নাকি অন্যকিছু আশা করেছিলেন?
নিশীথ কিছুটা থমকে যায় দোলার এহেন ভাবলেশহীন জবাবে। তবু বলে,
—আমি আর কি করবো বলো? তুমি আমায় যেভাবে অদেখা করছিলে আমি আর কি করবো বলো…
—বলবো।
দোলা হঠাৎ উত্তর দেওয়ায় নিশীথ ভড়কে যায়। প্রশ্ন করতে যায়,
—কি বলবে?
—পরশুদিন দুপুরে আমার ভার্সিটির বাহিরে অপেক্ষা করবেন। যা বলার ওইদিন বলবো।
নিশীথ এর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। অজানা খুশির মুহুর্তের আশায় প্রত্যাশা বাড়ে মনে! মুখ ফুটে বের হয়,
—সত্যি??
দোলা রোবটের ন্যায় মাথা নাড়ায়। অতঃপর আর কোনোকিছু না বলে চুপচাপ চলে যায় বাড়ির ভেতর। রাতের আধারে লাইটের নিচে ওর চলমান ছায়ার দিক একদৃষ্টে চেয়ে থাকে নিশীথ। সে দেখার কোনো শেষ নেই…
#চলবে