#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
পরেরদিন ঢাকায় প্রচন্ড বৃষ্টি। বিকেলবেলা ঘনকালো মেঘমালার গুরুমগুরুম ডাকে চারপাশ যখন আ’তং’কিত, এরই মাঝে দোলনচাঁপার কক্ষে একটি দুঃসংবাদ নিয়ে প্রবেশ করলেন ওর মা পারভীন বেগম। বিছানায় হেলান দিয়ে জানালার ধারে বসে একধ্যানে বৃষ্টি দেখতে থাকা মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,
—দোলা, শুনছিস?
—হ্যাঁ মা, বলো না!
পেছন ফিরে মায়ের উদ্দেশ্যে জবাব দেয় সে। প্রত্যুত্তরে ওর মা বলেন,
—এই অসময়ে একটা দুঃসংবাদ দিতে এলাম রে, মা। কাণ্ড ঘটে গেছে একটা আর বলিস না!
দুঃসংবাদ শুনে অজানা চিন্তায় দোলার বুক ধ্বক করে উঠে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে মায়ের নিকট এসে শুধায়,
—কিসের দুঃসংবাদ, মা? তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন? সব ঠিক আছে তো? কার কি হয়েছে?
—তোর বড়মামার নাকি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, ভাইজান হাসপাতালে ভর্তি আছে। ভাবী একটু আগেই ফোন করে বললো।
বড়মামার হার্ট অ্যাটাকের কথা শুনে দোলার মন খারাপ হয়। মামা তাকে বড্ড স্নেহ করেন তাকে, মেয়ের নজরেই দেখেছেন সবসময়। এখন হঠাৎ করে তার অসুস্থতার খবর মন বিষন্ন করতে যথেষ্ট। আর বিলম্ব না করে মায়ের উদ্দেশ্যে সে বলে,
—তাহলে তো মামার সাথে দেখা করতে যেতে হবে, মা। কখন বেরোবে?
দোলার কথায় মাথা নাড়ান পারভীন বেগম। দোলার কাধে হাত রেখে বলেন,
—এ কথাই তো তোকে বলতে এসেছিলাম রে। ভাবী নিজে থেকে ফোন করে জানালেন, এখন দেখা না করতে গেলে কেমন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো বৃষ্টি! যে মশুলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে এখন বাহিরে, এর মধ্যে রিকশা/সিএনজি কিভাবে পাবো কিছুই তো বুঝছিনা।
—তা ঠিক বলেছো বটে। কিন্তু যাওয়া তো উচিত। না গেলে বিষয়টা ভালো দেখাবেনা। এক কাজ করি, তুমি আমি গিয়ে দেখে আসি মামাকে? শিমুল আর কামিনি না হয় বাসায় থাক! ওদের এ বৃষ্টির মাঝে বেরোনোর কোনো দরকার নেই।
দোলার কথায় প্রসন্ন হাসেন পারভীন বেগম। তার বড় মেয়ে ভীষণ দায়িত্ববান, ছোট ভাইবোনদের উপর কোনোরুপ কস্ট আসুক বা ওদের অসুবিধে হোক এটা দোলা কখনোই হতে দেয়না। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। দোলার গালে হাত রেখে তিনি বলেন,
—তা ঠিক বলেছিস বটে। ওরা ছোটমানুষ বাসায় থাক। শিমুল ঘুমোচ্ছে, আমি কামিনিকে বলছি বাসা দেখে রাখতে। তুই রেডি হ, আমিও যাই বোরখাটা পরে আসি।
মায়ের কথায় দোলা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। পারভীন বেগম চলে যেতেই আলমারি খুলে গাঢ় নেভি-ব্লু রঙ এর একটা সিল্কের কামিজ বের করে নিলো সে। বৃষ্টির দিনে এ কাপড় সবচেয়ে ভালো। শুকায়ও তাড়াতাড়ি, পড়েও আরাম। ঝটপটানো রেডি হয়ে রুম থেকে বেরোতেই মায়ের মুখোমুখি হলো সে। উনিও সম্পূর্ণ রেডি। তার পাশে ঘুমুঘুমু চোখে কামিনি দাঁড়িয়ে আছে বাসার চাবি নিয়ে। ওকে দেখে দোলা হাসে, স্পষ্টত বুঝাই যাচ্ছে ওরা মা-মেয়ে দুজন বাসা থেকে বের হয়ে গেলে কামিনি দরজায় তালা লাগিয়ে নিজরুমে গিয়ে ঘুমাবে। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে তালা লাগানোর পূর্বে দোলা বোনের উদ্দেশ্যে বলে,
—ভালো করে দরজা লাগা, কেউ বাইরে থেকে ডাকলে খুলবিনা। ফোন কাছেই রাখবি।
—হ্যাঁ আপু, সব জানি। এখন যাও তো। তোমার লেকচার দিতে হবেনা। আমি ঘুমোবো তোমরা বেরিয়ে গেলেই।
বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে উঠে কামিনি। ওকে ধমক দিয়ে পারভীন বেগম বলেন,
—ভালো কথা শুনতে তো লেকচারই মনে হবে তোর কাছে, বেয়াদব। দোলা যা যা বললো, সব মাথায় থাকে যেন? আমরা তাড়াতাড়িই ফেরার চেস্টা করবো।
অতঃপর দুজন বেরিয়ে যায়। দোলার মামা ধানমণ্ডির ল্যাবএইড হসপিটালে ভর্তি আছেন, যেটা ওদের বাসা থেকে মোটামুটি দূর।
এখন দেখার বিষয় এ বৃষ্টির দিনে কোনো সিএনজি পাওয়া যাবে কিনা! দোলা মনে মনে ভাবে।
_____________________
বৃষ্টি আগের থেকে কমেছে কিছুটা তবুও বিশেষ লাভ হলোনা। কারণ বৃষ্টির ফোটাগুলো বেশ ভালোই জোরে পড়ছে। অবশ্য দোলা ও তার মা দুজনে দুটো ছাতা নিয়ে বেরিয়েছে। দোলার ধারণা সঠিক, এ বৃষ্টির মাঝে কোনো যানবাহনের টিকিটাও খুজে পেলোনা তারা। এলাকার মোড় থেকে বেরিয়ে মেইনরোডে যাত্রীছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে দুজনে। এ নিয়ে পাচ-ছয়টা সিনএনজি গেলো যাদের একটাও ধানমন্ডি যাবেনা। মাঝে অবশ্য কেউ রাজি হলেও যে ভাড়া চায় তা ওদের যাওয়া-আসার ভাড়ার দ্বিগুণ। অগত্যা বৃষ্টির মাঝে চুপচাপ দাঁড়িয়ে প্রহর গুনছে দোলা।
এরই মাঝে সে লক্ষ্য করলো দুটো ছেলে রাস্তায় হাটছে। ওদের কিছুটা চেনাচেনা মনে হলো দোলার। পরক্ষণেই মনে পড়ে গেলো এরা ওর বাসার গলিতে থাকা ছেলেগুলো। কালকে এদের দেখেছিলো বারান্দা থেকে। কিন্তু ওরা আবার এই বৃষ্টির মাঝে কোথায় যাচ্ছে? দোলা আনমনে ভাবে। খানিকবাদে মাথা ঘামানো বাদ দেয়! ওরা যেখানে যায় যাক, তার কি? দোলা আর বেশি কিছু ভাবেনা। এদিকে ছাতা মাথায় ছেলেগুলো ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে ওরা কোথাও যাচ্ছেনা। ঘুরেফিরে রাস্তায় হেটে আবার এদিকেই ফিরে আসছে। আচমকা দুজনের মধ্যে একটা ছেলে দোলার দিকে তাকায়, একিসময় দোলা তাকাতেই হকচকিয়ে সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। দোলা চমকে ওঠে। একিসাথে কিছুটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে চেয়ে রয় সেদিকে।
এরই মাঝে ওর মায়ের আওয়াজ কানে ভাসে,
—এখানে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ সময় নস্ট করবো রে, দোলা? চল আমরা তার চেয়ে আরেকটু হেটে এগিয়ে যাই। দেখি ওইদিকে কিছু পাই কিনা।
মায়ের কথায় যুক্তি দেখে দোলা আর দ্বিমত করলোনা। মাথা নাড়িয়ে যাত্রীছাউনি থেকে বেরিয়ে ছাতা মেলে আবার রাস্তায় হাটা শুরু করে। হঠাৎ ওদের সামনে একটি সিএনজি এসে দাঁড়ায়। এভাবে সিএনজি আসায় দোলা খানিকটা অবাক হয়। সিএনজিওয়ালাকে ধানমণ্ডি যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করতেই লোকটা বলে,
—যেখানে কইবেন সেখানেই যামু। উইঠা পড়েন, আফা।
—ভাড়া কত নিবা, মামা?
—আফনে যত দিবেন। বৃষ্টি দেইখা বেশি নিমুনা। এহন রাস্তায় থাকবেন না উইঠা বসবেন?
সিএনজিওয়ালার কথা শুনে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে দোলার মা, একিসাথে দোলাও উঠে পড়ে। এ অসময়ে এভাবে সে সিএনজি পাবে কল্পনাও করেনি। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া করে ধানমন্ডির উদ্দেশ্যে দুজন বেরিয়ে পড়ে।
________________
হিমশীতল রুমে খালি গায়ে বুক অব্দি কাথা টেনে শুয়ে আছে নিশীথ। ওর ঘুমুঘুমু চোখজোড়া কুচকে আসে ফোনের আওয়াজে। পেশিবহুল হাত বাড়িয়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন টেনে নিয়ে রিসিভ করতেই ওপার থেকে আকাশের কণ্ঠস্বর ভেসে উঠে,
—হ্যালো, ভাই।
—বল। ও চলে গেছে?
—এটা বলার জন্যই ফোন দিলাম, ভাই। সিএনজির ব্যবস্থা করে দিসিলাম। এতক্ষণে হয়তো পৌঁছেও গেছে। ভাবীর সাথে ভাবীর আম্মাও ছিলো৷
—হু? গুড জব। রাতে দেখা করিস।
—আচ্ছা ভাই, থ্যাংক ইউ।
ফোন কেটে নিশীথ উঠে বসে। অন্ধকার রুমটার এক কোণে মাটির টবে ফুটে থাকা দোলনচাঁপা ফুলটার মিস্টি গন্ধে রুমের পরিবেশ মৌ মৌ করছে। চোখ ডলে ঘুমঘুম ভাব কাটিয়ে সে সুবাসে বুক ভরে নিশ্বাস নেয় নিশীথ।
খানিকবাদে চোখ মেলতেই ফোনের হোমস্ক্রিনে জ্বলতে থাকা ওড়না মাথায় হাস্যোজ্জ্বল দোলনচাঁপার দিকে নজর পড়ে ওর। প্রেয়সীর দিকে সেভাবেই কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে চেয়ে রয়। মিটিমিটি আলোয় জ্বলা ড্রিমলাইটের আলোয় নিশীথের ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ভেসে উঠে। অনুযোগভরা গভীর কণ্ঠস্বরে কক্ষ থমকে যায়,
“আমার শুভ্র দোলনচাঁপা, আর কতদিন দূর থেকে তোমার সুবাস নেবো? একবার তো কাছে এসো। তোমার সুবাসে আমার জীবনটাকে মোহিত করো!”
#চলবে