দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ২২ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
465

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২২
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসা থেকে বেরিয়ে সুহাসকে সাথে নিয়ে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো নিশীথ। ও চা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই সুহাস স্বাচ্ছন্দ্যে মাথা দুলালো। চা-ওয়ালা মামাকে দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে নিশীথ গম্ভীরমুখে কিছু একটা ভাবলো। ওর বন্ধুদের আসবে মিনিট বিশেক পরে, ততক্ষণ সুহাসকে সঙ্গ দিবে সে। একিসাথে নিশীথের মনের আকাশে দোলার প্রতি চাপা রাগ ও অভিমানের কালো মেঘ জমতে লাগলো। সে বিশ্বাস করতে পারছেনা দোলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এবং সেটাও এত তাড়াতাড়ি! তবে সে যখন জিজ্ঞেস করলো সেদিন মেয়েটা কিছু বললোনা কেন? বিয়ের মতো ব্যাপার নিশ্চয়ই ওর অমতে হবেনা! রাগে নিশীথের মাথা গরম হয়।

দোকানদার চা দিতেই প্রথম কাপ সুহাসকে এগিয়ে দেয়। নিজের কাপ হাতে নিয়ে অন্যমনস্কভাবে পাশে তাকাতেই শিমুলকে চোখে পড়লো নিশীথের। কি মনে করে ও সুহাসকে বললো,

—তুই পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর। আমি এক্ষুনি আসছি?

সুহাস চশমাটুকু কপালের উপর তুলে চায়ের কাপে ফুঁক দিচ্ছিলো বেশ মনোযোগ দিয়ে। ভাইয়ের কথায় মাথা হেলে সায় জানিয়ে পুনরায় নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে৷ নিশীথ দ্রুতকদমে এগিয়ে যায় শিমুলের নিকট। সাধারণ গতিতে হেটে যাচ্ছে ছেলেটা। চেহারায় ইষৎ বিষন্নতার ছাপ, যেন কিছু নিয়ে বেশ চিন্তায় আছে এমন। লম্বা পাজোড়া চালিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই নিশীথ শিমুলের আগে যেতে সক্ষম হয়। হঠাৎ নিজের সামনে ওকে দেখে ভড়কে যায় ছেলেটা। ওর চোখমুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে ভয় পেয়েছে। নিশীথ সামান্য হাসে। ওর কোকড়া চুলের উপর হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—কি খবর, শিমুল? অনেকদিন দেখিনা তোমায়!

—এইতো ভালো, ভাইয়া। আপনি ভালো আছেন?

—আছি। আর বাসায় আসোনা কেন? ব্যাপার কি?

—কিছুই না। একটু বিজি আছি এখন তাই খেলতে যাচ্ছিনা। সুহাস কেমন আছে?

—ভালো আছে। তবে তোমার কথা খুব মনে করে। বাসায় এসো কেমন?

শিমুল মাথা নাড়িয়ে চলে যেতে নেয়। এ সময় নিশীথ গলার স্বর পাল্টায়। বেশ গম্ভীর সুরে প্রশ্ন করে,

—সুহাস বললো তোমার বোনের নাকি বিয়ে হচ্ছে? তা সেটা কবে? দাওয়াত-টাওয়াত দিবেনা নাকি?আমাদেরও বলো!

রসিকতার মাঝেও ওর কণ্ঠের গাম্ভীর্যে শিমুল থমকায়। দোলার বিয়ের কথা মনে হতে ওর মুখটা আবারো মলিন দেখায়, নিশীথ সবকিছু ভালোভাবে লক্ষ্য করে। সে আবারো জিজ্ঞেস করে,

—কি হয়েছে, শিমুল? এনি প্রবলেম?

—এ বিয়েটাই তো প্রবলেম।

শিমুল বিড়বিড় করে নিচুস্বরে। নিশীথ বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকায়। চোখের ইশারায় শুধায় “কি?”

শিমুল কিছুক্ষণ ভাবে কি বলবে। কিন্তু নিশীথের সাথে ওর সেরকম সম্পর্ক নেই যে ওকে সবটা খোলাখুলি বলা যাবে। উপরন্তু সে মনে করতো নিশীথ হয়তো ওর বোনকে ভালোবাসে। কিন্তু তাই যদি হতো তবে তো সে দোলার বিয়ের খবর শুনে এরকম ঠান্ডা রিয়েকশন দিতোনা। উল্টো, তো সে যেচে পড়ে দাওয়াত চাইছে!
তাই শিমুলের মনটা আরও বিষন্ন হলো। মনে মনে ভাবলো কি এমন হতো যদি ওর বোনকে নিশীথ ভালোবাসতো? সে তো এতদিন ভাবতো নিশীথ আর ওর বোনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। তাই সে খুশিমনে নিশীথকে দুলাভাই মানতে রাজি ছিলো কিন্তু এখন দেখছে সবকিছু জলে! নিয়তি বোধহয় ওই রাকিবটাকেই রেখেছে ওর বোনের সাথে। অতঃপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—বিয়ের ডেইট এখনো ঠিক হয়নি, ভাইয়া। আর তাছাড়াও…

—তাছাড়া কি?

—তাছাড়াও বিয়েটা আমাদের ফ্যামিলির মধ্যেই হচ্ছে। তাই পরিবারের বাইরে কাউকে…

—ফ্যামিলির মধ্যে মানে?

শিমুল জিব কাটে। বলতে বলতে বেশি বলে ফেলার স্বভাবটা ওর যাবেনা বোধহয় কোনোদিন! তবু ইতস্তত করে বলে,

—আমাদের মামাতো ভাই এর সাথে দোলাপুর বিয়ের কথা ঠিক হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাউকে কিছু জানানোর জন্য বাসা থেকে মানা করা হয়েছে। আমি হয়তো কথার ছলে সুহাসকে বলে ফেলেছিলাম। আপনিও কাউকে বলবেন না প্লিজ? আমি এখন যাই? মা বাসায় নেই, আপু একা আছে। আমি দেরি করলে বকবে!

নিশীথ মাথা নেড়ে ওকে যেতে দিলো। কিন্তু এতক্ষণ শিমুলের সাথে কথা বলে ওর মনে সন্দেহ হলো। কিছু তো একটা গড়বড় আছে। এত চুপিসারে বিয়ের ব্যাপার, তাও আবার কাউকে জানাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে! ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার মনে হলোনা নিশীথের। তবে সে এটুকু বেশ বুঝলো যে, দোলার ভাই ঠিক ওর মতোই। এত সহজে ওকে সবটা খুলে বলবেনা। নেহাৎ, সুহাসের সাথে বেশি ক্লোজ বলেই ওকে হয়তো বলেছে দোলার বিয়ের কথা। সুতরাং এখানে সময় নষ্ট করে তেমন লাভ নেই। তাই এ যাত্রায় হাল ছেড়ে নিশীথ ওকে বিদাই দিয়ে চলে এলো সুহাসের কাছে। মনে মনে ভাবলো, শিমুলের থেকে যা যা শুনার- এ কাজে বুদ্ধি করে সুহাসকেই লাগাতে হবে। মনে মনে সব ভেবে নিশীথ ফন্দি আটলো! খানিকবাদে দ্রুত হাত বাড়িয়ে কাউকে ফোন লাগালো৷ মিনিট পাঁচেক কথাবার্তার পর এক সূক্ষ্ম বক্র হাসির রেখা দেখা গেলো ওর ঠোঁটের ভাজে। ফোনের হোমস্ক্রিনে হাস্যোজ্জ্বল দোলার ছবির দিক চেয়ে নিশীথের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। নিজের মসৃণ চুলের মাঝে হাত চালিয়ে বললো,

—আমায় জবাব না দিয়ে সোজা মামাতো ভাইকে বিয়ে করা হচ্ছে, হু? ইন্টেরেস্টিং! বড্ড আকাশে উড়া হচ্ছে দেখি। যত ইচ্ছা উড়তে থাকো, নো প্রব্লেম। তোমায় কিভাবে মাটিতে নামাতে হবে, তা এ নিশীথের ভালো করেই জানা আছে।

বাকা হেসে কথাগুলো বলে নিশীথ খানিকটা থামলো। রাকিবের কথা মনে হতেই আবার বিড়বিড়িয়ে বললো,

—তোমার সাথে এবার তোমার মামাতো ভাইয়েরও ভালোমতোই খোজখবর নিতে হবে দেখছি। বি রেডি ফর দ্যাট, মাই ডিয়ার দোলনচাঁপা!

_______________________

ভাইয়ের বাড়িতে বিব্রত মুখে বসে আছেন পারভীন বেগম। দোলার মামা-মামি রোবটের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছে। বলাবাহুল্য, এখানে আজ বিয়ের তারিখ পাকা করতে আসার কথা থাকলেও তিনি এসেছেন অন্যকাজে। যদিও চক্ষুলজ্জায় তিনি রাকিবের কুকর্মের কথা সরাসরি বলেননি তবু, ধীরে সুস্থে ঠান্ডা মাথায় ভাই-ভাবিকে বলেছেন দোলা এ বিয়েতে রাজি নয়। ব্যস! তিনি এ কথা বলার পর থেকেই ভাই-ভাবি এভাবে চেয়ে আছেন উনার দিকে। তাদের এহেন চাহনি বেশ অস্বস্তিতে ফেললো পারভীন বেগমকে। নীরবতা ভেঙে অবশেষে তিনি বললেন,

—কি হয়েছে, ভাই সাহেব? কিছু বলবেন না?

দোলার মামা আমজাদ সাহেব একবার বোনের দিকে তো একবার বউয়ের দিকে তাকাচ্ছেন। খানিক বাদে গলা ঝেড়ে বললেন,

—রাকিব যে বললো ওরা দুজন একে-অপরকে পছন্দ করে আগে থেকে। আর সামনে দোলার জন্মদিন, তাই ওকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে হুট করে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া! তাহলে দোলা এখন রাজি হচ্ছেনা কেন?

পারভীন বেগম এদিক-সেদিক চাইলেন। এখন তিনি কিভাবে বুঝাবেন ওসব তো রাকিবের ধান্ধা ছিলো ছলেবলে ওদেরকে রাজি করানোর, আসল ঘটনা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কিন্তু মুখে বললেন,

—রাকিব একাই দোলাকে পছন্দ করে। এজন্যই হয়তো এভাবে বলেছে যাতে আমরা সকলে রাজি হই। কারণ দোলাকে যখন আমি বিয়ের কথা বললাম ও সরাসরি মানা করে দিলো। সে এখন বিয়ের ব্যাপারে কিছুই ভাবছেনা নাকি! তাছাড়াও…

—বিয়ের ব্যাপারে ভাবছেনা মানে? তোমার মেয়ের বয়স ২০+ হয়ে গেছে। এখন বিয়ে করবেনা তো কবে করবে? ৩০ পেরোলে বিয়ে করার ধান্ধায় থাকলে কি ওর কোনোদিন বিয়ে হবে?

পারভীন বেগমের মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলে উঠলেন ওনার ভাবি। তার কথায় আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন পারভীন বেগম। যেখানে ভাবি কষ্ট পাবেন বলে তার দুশ্চরিত্র ছেলের ব্যাপারে সরাসরি কিছু বললেন না তিনি সেখানে কিনা তার ভাবি তার মেয়ের ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই বলে যাচ্ছেন?
চোখে পানি নিয়ে তিনি মুখে বললেন,

—আমি তো এমন কিছু বলিনি, ভাবী। আমার দোলাও এরকম কিছু বলেনি। হ্যাঁ, আমি বেচে থাকলে অবশ্যই মেয়ের বিয়ে দেব। হয়তো একটু সময় লাগবে কিন্তু ভাগ্যে থাকলে একসময় তো অবশ্যই বিয়ে হবে। এসব তো রিজিকের ব্যাপার!

পারভীন বেগমের এমন কথা মোটেও পছন্দ হলোনা রাকিবের মায়ের। কেননা, নিজের ছেলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় তিনি মনে মনে দোলার উপর বেশ ক্ষিপ্ত হলেন। কথাবার্তাতেও যার রেশ স্পষ্ট শোনা গেলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,

—এখন এসব বললে কি হবে, পারভীন? আগেই যদি জানতে দোলা বিয়ের জন্য রাজি হবেনা তবে বিয়ের প্রস্তাবে তুমি হ্যাঁ বলেছিলে কেন? আমি তো আমার বোনদের জানিয়ে দিয়েছি রাকিবের বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারে। এখন শেষ মুহুর্তে এসে তোমার মেয়ে এভাবে পল্টি মারলে আমরা কোথায় যাবো? আমাদের কি কোনো মান-সম্মান নেই? কি পেয়েছে তোমার মেয়ে? ওকে তো এতদিন আমরা ভোলাভালা মনে করতাম, এখন এসে এসব করছে।

—ভাবি…

পারভীন বেগম উনাকে থামিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করতেই উনি আবারো বলতে লাগলেন,

—কিসের ভাবি? শেষ মুহুর্তে এসে এসব ফাজলামি ভালো লাগেনা, পারভীন। বলছি, আমার ছেলে কি দেখতে খারাপ যে রাজি হবেনা? নাকি আমাদের কোনো কিছুর অভাব আছে যে মেয়ে রাজি হবেনা? নাকি তোমার মেয়ের আগে থেকেই অন্য কাউকে পছন্দ আছে যে….

—উফ, শায়লা! তুমি থামো তো। এখন কিন্তু বলতে বলতে বেশি বলে ফেলছো।

স্ত্রীকে থামিয়ে কথাটি বললেন আমজাদ সাহেব। যতই তিনি কষ্ট পান, দোলাকে সবসময় নিজের মেয়ের মতোনই স্নেহ করে এসেছেন তিনি। এতক্ষণ শায়লার সব কথা শুনলেও যখন তিনি দোলার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললেন তখন কথাটা আর না বলে পারলেন না। এদিকে স্বামীর কথায় আরও তেতে উঠলেন শায়লা। সেভাবেই বললেন,

—হ্যা, এখন তো সবাই আমাকেই চুপ করাবে। বোনের মেয়ের জন্য তো খুব দরদ আছে কিন্তু এদিকে নিজের ছেলের মানসম্মান যে চলে গেলো তাতে কিছু না?

—দোলা ওরকম মেয়ে নয়, শায়লা। এটা আমি একাই নয় বরং তুমি নিজেও জানো। এখন হয়তো তুমি যা বলছো সবটা পরিস্থিতির বশীভূত হয়ে বলছো। কিন্তু একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখো তখন হয়তো পারভীনের কথা বুঝবে! আমাদের সবারই এ ব্যাপারে ভাবার জন্য সময় দরকার। পারভীন, তুই আজ যা না হয়? তোর ভাবির মাথা গরম আছে দেখছিসই তো! আমরা না হয় পরে এ ব্যাপারে ফাইনাল কোনো সিদ্ধান্তে যাবো, কেমন?

—অবশ্যই, ভাই সাহেব। আপনি যে আমার কথা বুঝেছেন, এর সম্মান রেখেছেন তাতেই আমি খুশি। আজ আসি তবে। আসসালামু আলাইকুম।

ভাইয়ের বাসা থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন পারভীন বেগম। উনি চলে যেতেই আমজাদ সাহেবের বাড়িতে কিছুক্ষণ ঝড় চললো। শায়লার ননস্টপ চিৎকার ও আওয়াজে রুমে থাকা রাকিবও এতক্ষণে বেরিয়ে এসেছে। সে পুরো ঘটনা না শুনলেও মায়ের কথাগুলো শুনে কি ঘটে গেছে এটুকু ঠিকি বুঝে ফেলেছে। দোলার সাহস দেখে রাকিব মনে মনে অবাক না হয়ে পারেনা! সে তো ভেবেছিলো ওর মতো নরম মেয়ে কখনো বড়দের কথা অমান্য করতেই পারবেনা। এজন্যই বিয়ে করার কোনো ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও শুধু দোলাকে হাত করতে কাউকে কিছু না বলে সরাসরি বাবা-মাকে বলে ওর মায়ের কাছে বিয়ের প্রস্তাবটুকু রেখেছিল সে। এ মেয়ে এখন সেটাকেও রিজেক্ট করে দিলো? রাগে-অপমানে রাকিবের মুখ গরম হয়। ব্যাপারটা ওর ইগোতে ভীষণভাবে লাগে। মুষ্টিবদ্ধ হাতে ঘৃণাভরা কণ্ঠে হিসহিসিয়ে বলে,

—সবার সামনে আমায় এভাবে রিজেক্ট করে কাজটা ঠিক করলেনা, দোলা। এর শা’স্তি তোমাকে ভু’গতে হবে!

#চলবে
Next পেতে পাশেই থাকুন জয়েন করে facebook.com/groups/golpobolistorylink

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here