#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
তালুকদার বাড়ির ছোট ছেলে নিশীথ তালুকদার। বড় ভাই নিশান বিদেশ থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বাবা-মায়ের চোখের মনি সে। ওর বাবা আয়মান তালুকদার উনার ছোটভাইয়ের সাথে মিলে বাড়ি করেছেন ঢাকায়, একি বাসার দুই ফ্লোরে থাকেন তারা। নিশীথের দাদী মারা যাওয়ায় বৃদ্ধ দাদু ওদের বাসাতেই থাকেন। এলাকার বিত্তশালী পরিবারের মধ্যে অন্যতম হওয়ায় নিজেদের এলাকায় ও আশেপাশে তালুকদার পরিবারের বেশ নামডাক। আয়মান তালুকদার ও তার ছোটভাই আরেফিন তালুকদার সহ নিশীথের বড় ভাই অব্দি, সবাই যেখানে দায়-দায়িত্ব ও অন্যান্য দিকে নিজেদের বংশের মান রেখেছে, বাড়ির ছোটছেলে নিশীথ সেখানে ব্যতিক্রম। তার চালচলন বাপ-চাচা দের মতো নয়, বরং তাকে স্বভাবে-সুলভে অনেকটা উড়নচণ্ডীই বলা চলে। দায়িত্ব পালন করার ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাতেই সে ধারেকাছে নেই। বরং বাহিরের চাকচিক্যের প্রতি তার অনির্বাণ আকর্ষণ বিদ্যমান। শখের বাইক, গাড়ি, ব্র্যান্ডেড ঘড়ি থেকে শুরু করে যখন যা ভালো লাগে, বেপরোয়া নিশীথ তা কোনো না কোনোভাবে নিয়েই ছেড়েছে। ভালো লাগার জিনিস নিজের মুঠোয় আনার ক্ষেত্রে তার কোনো আপোষ নেই!
এভাবেই বন্ধুদের সাথে সারাদিন আড্ডা দেওয়া, নিজের স্মার্টনেস ও ছন্নছাড়া স্বভাবের কারণেই হোক না কেন ভার্সিটি লাইফে বেশ পরিচিত মুখ ছিলো সে। এবার মাস্টার্স ফাইনাল দিবে তবুও যেন তার সেসব নিয়ে কোনো মাথাব্যাথাই নেই। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে বাপ-চাচাদের ব্যবসায় ঢুকে যাবে। এমন সুনিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ সামনে থাকলে কে-ই বা পড়তে চাইবে?
তবে এতসব হেয়ালি আর সারাদিন টইটই করে সাংগপাংগ নিয়ে ঘুরে বেরালেও রেজাল্টের দিক দিয়ে নিশীথ প্রশংসার দাবিদার। বংশের বাকিদের মতো পড়াশুনার ক্ষেত্রে মেধার পরিচয় রেখেছে সে। ধা’রা’লো মস্তিষ্কের অধিকারি হওয়ায় সারাবছর বেশি পড়াশুনা না করেও পরীক্ষার কিছুদিন আগে পড়তে বসেও সিজিপিএ তার চতুরতার পরিচয় দেয় বটে!
বন্ধুদের দেখাদেখি ভার্সিটি লাইফে দু-একটা প্রেম করলেও ভার্সিটি শেষ হওয়ার আগেই সেগুলোও শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে আর প্রেমে পড়ার মানসিকতা বা ইচ্ছে কোনোটাই নিশীথের মনে জাগেনি। নিজের বেপরোয়া, কেয়ার-ফ্রি জীবনে নিজের মতোই বড্ড সুখে ছিলো সে। তবে সে সুখ শুধু ততদিনই টিকেছিলো, যতদিন না তার জীবনে দোলনচাঁপার আগমন ঘটে! তাইতো এখনো কোনো গভীর রাতে নিশীথ একা একা আনমনে ভাবে, এই অল্প সময়ে সে কিভাবে দোলনচাঁপার প্রতি এতটা আসক্ত হয়েছিল। স্মৃতিচারণ করে, সে কিভাবে দোলনচাঁপার প্রেমে পড়েছিলো!
সপ্তাহখানেক আগের কথা…
সেদিন ছিলো বৃহস্পতিবার। সন্ধ্যার আকাশে অন্ধকার নামবে নামবে ভাব। একটু আগে বৃষ্টি হয়ে থেমেছে, তাই ছেলেগুলোও বাসা ছেড়ে বেরিয়েছে। আর সন্ধ্যা মানেই তো এলাকার ছেলেপুলেদের আড্ডার মোক্ষম সময়। নিশীথদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়! যথারীতি এলাকার মোড়ে এক ছেলের বাইকে বসে থেকে আলোচনায় মজেছিলো নিশীথ। হাসাহাসি ও নানান কথায় মুখর ছিলো সকলে। এরই মাঝে কোত্থেকে যেন কাদামাখা এক প্লাস্টিকের ক্রিকেট বল এসে লাগে নিশীথের পিঠে। সাদা টিশার্টে কাদা লাগার বিষয়টা উপলব্ধি করতেই রগচটা নিশীথের ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত হয় কঠোরভাবে। পেছন ফিরে বলটা হাতে তুলে নিয়ে বলের মালিককে আচ্ছামতোন অকথ্য বাক্য শুনানোর আগেই তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে এক ১৩/১৪ বছরের এক কিশোরের দিকে, যে আপাতদৃষ্টিতে চোখমুখ খিচে গলির রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছে। কেননা ওর পিছে এক মেয়ে ছেলেটার কান ধরে রেখেছে এবং শাসনের ন্যায় কিছু একটা বলছে! দুজনকে দেখে বুঝাই যাচ্ছে ওরা ভাই-বোন আর এ বৃষ্টি দিনের ভরাসন্ধ্যায় অচেনা সেই ভাইবোনের শাসনময় খুনসুটির এ সাধারণ দৃশ্যটা নিশীথ বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ছেলেটা বারবার বলছে,
“আপু কানটা ছাড়ো প্লিজ, রাস্তায় লোকে দেখছে!”
এবার নিশীথ মেয়েটার গলা শুনতে পেলো। মিষ্টিভাষী মেয়েটা শাসনের সুরে ভাইকে বললো,
“বড্ড বাদর হয়ে গেছিস তুই, শিমুল। যেখানে সেখানে বল মারছিস, কারও গায়ে লাগলে কি হবে? এলাকায় মাত্র এসেছি আজকে আর এসেই তোর বাদরামি শুরু হয়ে গেলো তাইনা?”
“আচ্ছা আপু, সরি৷ আর করবোনা এমন। এবার তো কানটা ছাড়ো বলটা নিয়ে আসি”
“লাগবেনা কোনো বল। এখন সোজা তুই বাড়ি যাবি! লোকে কখন যে তোর নামে কমপ্লেইন করে মা সেই ভয়ে আছে। তাইতো আমাকে পাঠালো তোকে ধরে আনতে। তুই সোজা আমার সাথে বাসায় যাবি। চল!”
অগত্যা বোনের সাথে হার মেনে ছেলেটা চলতে শুরু করলো। ভাইকে কথা মানতে দেখে দোলনচাঁপাও ওর কান থেকে হাত সরিয়ে নিলো। এতক্ষণ নিশীথ আড়াল থেকে মেয়েটার চেহারা দেখার চেষ্টা করছিলো শুধু, কিন্তু মাথায় কাপড় দেওয়া থাকায় সঠিকভাবে দেখতে সক্ষম হচ্ছিলোনা! তাই আর দেখার চেষ্টা না করে নিশীথ চোখটা সরিয়ে নিয়েছিলো। সেকেন্ড বাদেই আবার কি মনে করে যেন সেদিক ফিরতেই নিশীথ অনুভব করলো এই পাশ ফেরাটাই ওর জীবনের অন্যতম বি’নাশ’কা’রী এক সিদ্ধান্ত ছিলো!
দমকা বাতাসে দোলার মাথায় থাকা ওড়নাটা দুলতে দুলতে কাধে এসে পড়লো। এরই ফাকে ওর এলোমেলো খোপা দৃশ্যমান হলো। সেখান হতে বেরিয়ে আসা কিছু ছন্নছাড়া চুল ওর কপালের উপর এসে বারি খেতে লাগলো। বিরক্তিতে ঠোঁট ফুলিয়ে বাম হাতে কপালের উপর খেলতে থাকা চুলের গোছা সরিয়ে পুনরায় আলগোছে হাত খোপা করে মাথার উপর কাপড় টেনে মেয়েটা নিঃশব্দে বাড়ি চলে গেলো। অথচ সে জানলোই না ওর ফেলে রাখা কদমের সাথে কারও হৃদয়ের গতিও মন্থর হতে লাগলো! অচেনা মেয়ের প্রতি এক অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ বলে তনমন অস্থির হয়ে উঠলো!
নিশীথ কতক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে ছিলো ওর হুশ নেই। অনেকটা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বেশ অনেকক্ষণ চেয়ে থাকার পর বাহুতে এক ছোট ভাইয়ের আওয়াজে ওর ধ্যান ফিরলো।
—কি ব্যাপার, নিশীথ ভাই? তখন থেকে কি দেখছো ওইদিকে?
বাড়তে থাকা শ্বাসপ্রশ্বাস ও ঢিপঢিপানো হৃদপিণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে নিশীথ ঢোক গিলে। গলা ভিজিয়ে শুষ্ক কণ্ঠে উত্তর দেয়,
—ক,কই? কিছুই না তো! তোরা কি যেন বলছিলি? আমি খেয়াল করিনি।
—আমরা বলছিলাম যে, ওই পিচ্চিটা তোমার পছন্দের টিশার্ট ন’ষ্ট করে দিলো আর তুমি ওকে এভাবেই ছেড়ে দিলে? কিছুই বল্লেনা?
অবাক হয়ে আকাশ প্রশ্ন করে। নিশীথ কিছু বলার আগেই আকাশের দেখাদেখি কবির বলে উঠে,
—আসলেই তো। আমিও ওটাই ভাবছিলাম। কাহিনি কি, ভাই? তোমার হইছেটা কি?
আকাশ ও কবিরের প্রশ্নে বাকি ছেলেপেলেও সাড়া দেয়। কেননা ওদের নিশীথ ভাইয়ের র’গচটা স্বভাব এ তী’ক্ষ্ণ মেজা’জের কথা এলাকার ছেলেরা বেশ ভালো করেই জানে। তাই ওকে হুট করে এভাবে শান্ত হতে দেখে সবাই বেশ অবাকই বটে! বিষয়টা চমকপ্রদ। রহস্য কি? ওদের জানতে হবে!
তবে ওদের প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে হাতের মুঠে কাদা লাগানো বলটা ঘুরাতে ঘুরাতে আড়চোখে নিশীথের নজর ঘুরে যায় দোলাদের বাসার দিকে। ওদের বিল্ডিং এর দিকে দৃষ্টি ছু’ড়ে ভ্রু নাচিয়ে নিশীথ প্রশ্ন করে,
—আচ্ছা, অর্কদের বাসায় কি নতুন ভাড়াটিয়ে উঠেছে?
নিশীথের প্রশ্নে দলের বাকিদেরও নজর চলে গেলো দোলাদের বিল্ডিং এর দিকে। এরই মাঝে তূর্য বলে উঠলো,
—হ্যাঁ, ভাই। আজকেই উঠছে মনে হয়। কাল অর্কের সাথে দেখা হইছিলো। ও তো বললো নতুন ফ্যামিলি উঠবে আজকে থেকে।
—হু? তাহলে ওটাই।
চাপাস্বরে আওড়ায় নিশীথ। ওর কথা বুঝতে না পেরে বাকিরা মনোযোগী দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকায়। পুনরায় প্রশ্ন করে,
—কি হয়েছে, ভাই? কোনো সমস্যা?
কিছু একটা ভেবে নিশীথের ভ্রুযুগল শিথিল হয়, খানিকবাদে আবার কপাল মসৃণ করে। আয়েশ করে পুনরায় বাইকের উপর হেলান দিয়ে ছেলেপেলের উদ্দেশ্যে বলে,
—আরে নাহ। কোনো প্যারা নাই। চাপ নিস না তোরা। তারপর বল, কি যেন বলছিলাম আমরা? আড্ডা এভাবে থেমে গেলে তো চলবেনা! এই আকাশ, এবার তুই শুরু কর।
—জো হুকুম, মেরে ভাই।
যথারীতি নিশীথের আজ্ঞা পেয়ে পুনরায় হৈ-হুল্লোড় এ মেতে উঠে ছেলেদের দল। আড্ডার এক ফাঁকেই তূর্যর ফোনে টুং করে মেসেজ বেজে উঠে। পকেট থেকে ফোন বের করে মেসেজ পড়তেই ওর ভ্রুযুগল সরু হয়। নিশীথ মেসেজ পাঠিয়েছে। সামনাসামনি বসেও এভাবে মেসেজ পাঠানোর কি মানে হয় সে বুঝলোনা। তবু নিশীথের মেসেজকে অদেখা করতে পারবেনা সে। তাই মেসেজ ওপেন করতেই দেখলো নিশীথ লিখেছে –
“অর্কদের বাড়ির দোতলায় কারা উঠেছে, ওদের সম্পর্কে সব খবর আমার লাগবে। তুই কালকেই ওর থেকে শুনে আমায় ইনফর্ম করবি, ঠিকাছে?”
কিছুক্ষণের জন্য মেসেজটি দেখে চকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকাতেই তূর্য দেখলো নিশীথ চোখের ইশারায় ওকে বুঝাচ্ছে –
“কাজটা কাল অব্দি হতেই হবে!”
মাথা নাড়িয়ে নিশীথের কথায় রাজি হলেও তূর্যর মাথায় তৎমক্ষণাত ঢুকলোনা ওদের দলপতির মাথায় কি চলছে! সে বুঝলোনা, ওদের র’গচ’টা, ছন্ন’ছা’ড়া নিশীথ কারও প্রেমের জা’লে বাধা পড়তে যাচ্ছে। এক অতি সাধারণ দোলনচাঁপার সুবাসে বেপরোয়া নিশীথের মন-প্রাণ সবটাই সুরভীত হলো!
#চলবে
গল্পটা কেমন লাগছে সবাই অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবেন।