দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ৪ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
650

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৪
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

মামাকে দেখতে হাসপাতালে মা-মেয়ে দুজনে গেলেও আসার পথে দোলাকে একাই ফিরতে হলো। মামাকে রিলিজ দিবে রাতে, দোলার মামির অনুরোধে ওর মা আজ রাতটা নিজের ভাইয়ের বাসায় থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর বাসায় যেহেতু কামিনি ও শিমুল একাই আছে তাই ফলস্বরুপ হাসপাতাল থেকে দোলাকে বাসায় ফিরতে হলো। বৃষ্টি এতক্ষণে কমে গিয়েছে একেবারেই। কাধে ঝুলানো ব্যাগ ও বাম হাতে ছাতা নিয়ে দোলা যতক্ষণে এলাকার মোড়ে পৌঁছালো, ঘড়ির কাটায় রাত ৯টা বেজে গেছে ততক্ষণে। ঢাকা শহরে এটা তেমন রাত না হলেও একা মেয়েকে এ সময় বাড়ি পাঠিয়ে বড্ড টেনশনে ছিলেন ওর মা। তাইতো মেয়েটা এলাকায় প্রবেশ করেই ওর মা-কে ফোন করে জানিয়ে দিলো ঠিকভাবে বাসায় পৌছানোর কথা! ফোন কেটে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মাথার ওড়নাটা ঠিক করে সে হেটে চললো বাসার উদ্দেশ্যে।

নিশীথদের আড্ডা বসেছিলো মোড়ের চায়ের দোকানটায়। বন্ধুদের সাথে আড্ডার মাঝেই আকাশ হঠাৎ খেয়াল করলো ধীরপায়ে গলিতে প্রবেশ করা দোলাকে। প্রায় সাথে সাথেই নিশীথের কাছে গিয়ে সেদিকে ইশারা করলো ছেলেটা। নিশীথ তখন মাত্র সিগারেটে আগুন ধরিয়েছিলো, আকাশের কথায় মুহুর্ত বিলম্ব না করে পেছন ফিরলো সে। দোলাকে এ সময় একা একা বাসায় ফিরতে দেখে বেশ অবাক হলো। একিসাথে খানিকটা রাগ হলো মেয়েটার প্রতি। এ অসময়ে কেউ একা একা বাড়ি ফিরে? ও না ওর মায়ের সাথে বেরিয়েছিলো? প্রশ্নের দল ভীড় জমায় নিশীথের মাথায়। তবু দেরি না করে হাতের আংগুলে সি’গা’রেট পিষে ত্রস্ত পায়ে হেটে চললো দোলার পিছে। ওর দলের বাকিরা নিঃশব্দে চেয়ে রইলো নিশীথের যাওয়ার দিকে। এতক্ষণে দোলাকে দেখে ওরাও বুঝেছে নিশীথের এভাবে চলে যাওয়ার কারণ। তাইতো বিনা বাক্যে দলপতির প্রস্থানে বিন্দুমাত্র অবাক হলোনা কেউ!

দোলা হাটছে নিজের মতোন। এইতো এখান থেকেই ওর বাসা দেখা যাচ্ছে। অথচ ও জানতেও পারলোনা ওর পেছনে ধীরপায়ে একিসাথে কেউ হেটে চলেছে। খুশিমনে হেটে যাওয়ার মাঝেই দোলার কদম নিজ হতে থেমে গেলো। এর কারণ ওর ঠিক সামনে রাস্তার মাঝখানে আরাম করে বসে থাকা কুকুরটা! বলাবাহুল্য, দোলার ছোটবেলা থেকেই ভীষণ রকমের কুকুরভীতি রয়েছে। সেই যে স্কুলে থাকতে তিন-তিনবার পাগলা কুকুরের তাড়া খেয়েছিলো, এরপর থেকে পথেঘাটে যেখানেই কোনো কুকুর দেখে ও ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকে। আজকেও এর ব্যতিক্রম হলোনা। কুকুরটি জেগে আছে এবং দোলার মনে হলো যেন প্রাণীটা নিজের হিংস্র দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে! ভেবেছিলো সামনে কেউ থাকলে তার পিছু পিছু সে পার হয়ে যাবে কিন্তু আপাতত ওর সামনে কেউ নেই, তাই নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে কিভাবে ওর পাশ অতিক্রম করবে দোলা ভাবছিলো জড়সড় হয়ে৷ ওদিকে, ওর পেছন পেছন চলতে থাকা নিশীথের কদমও রুখে যায় দোলাকে দাঁড়াতে দেখে! মেয়েটার হয়েছে কি? হঠাৎ এভাবে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলো যে? নিশীথ খানিকটা এগিয়ে আসে, দোলার পাশে দাড়াতেই ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকায়। অতঃপর বুঝতে পারে ওর হঠাৎ দাঁড়ানোর কারণ! এত বড় মেয়ে কুকুর ভয় পায় ভাবতেই খানিকটা হাসি পায় নিশীথের। তবে নিজেকে সামলে আচমকা সে দোলার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তৎক্ষণাত দোলা চমকে উঠে। পারতপক্ষে এতক্ষণ নিজের চিন্তায় বিভোর সে খেয়ালই করেনি ওর পাশে কে ছিলো। তাইতো হঠাৎ নিজের সামনে এক সুঠামদেহী পুরুষকে দাড়াতে দেখে কিছুটা অবাকই হয় সে বটে! তবে মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে এবার সে লোকটার পিছে পিছে যেয়ে পাশ কাটাতে পারবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। নিশীথ চলতে শুরু করার সাথে সাথেই দোলা ওর পিছু পিছু এক প্রকার দৌড়ে সরে গেলো কুকুরটার পাশ দিয়ে। অতঃপর যেন কিছুই হয়নি সেভাবেই নিশীথকে পাশ কাটিয়ে চলে নিজের মতোন কেটে পড়ছিলো। ঠিক এমন সময় পেছন থেকে গাঢ় পুরুষালি কণ্ঠস্বর শুনে সে থমকে দাঁড়ায় নিজের জায়গায়।

“রাস্তার মাঝখানে এভাবে ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেই কি কুকুর চলে যাবে?”

দোলা পেছন ফিরতেই নজর কাড়ে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বলিষ্ঠ সুদর্শন পুরুষ, যে কিনা একটু আগে ওর সাহায্য করেছে। ছেলেটাকে ইষত চেনা চেনা লাগলেও সে ঠিক মনে করতে পারলোনা ওকে ঠিক আগে কোথাও সে দেখেছে কিনা! তবু খানিকটা থতমত খেয়ে দোলা ইতস্তত করে বলে উঠলো,

—আসলে আমার ছোটবেলা থেকেই কুকুর দেখলে ভয় লাগে তাই ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আপনি উপকার করেছেন বলে ধন্যবাদ।

দোলার এমন কথায় নিশীথ ভ্রু কুচকায়। কণ্ঠের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে,

—কোনোকিছুকে ভয় পেলে তাকে বুঝতে দিতে হয়না। যতক্ষণ অপরজন বুঝবেনা আপনি তাকে ভয় পাচ্ছেন ততক্ষণ সে আপনাকে ভয় দেখাবেনা। বুঝেছেন, মিস?

দোলা মাথা নাড়ে। এরপর আবার চলতে শুরু করবে এমন সময় নিশীথের বিড়বিড়িয়ে বলা কিছু কথা ওর কানে আসতেই সে থেমে যায়।

“একা একা রাতের বেলা বাসায় ফিরতে ভয় পায়না আবার সামান্য কুকুর দেখলেই ভয়ে মিইয়ে যায়। মেয়েমানুষ বড়ই অদ্ভুত!”

নিশীথের কথায় দোলার খানিকটা অপমানবোধ হলেও সে বিশেষ মাথা ঘামালোনা। তবে ওকে থামতে দেখে নিশীথ এ সুযোগে দোলার সাথে কথা বলার সুযোগ লুফে নিলো। সবকিছু জেনেও আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলো,

—আপনার নাম কি? এলাকায় নতুন নাকি?

—আমি দোলনচাঁপা। জি, এলাকায় নতুন। সপ্তাহখানেক হবে এসেছি।

—ওহ। তো মায়ের সাথে বেরিয়ে একা একা ফিরে এলেন যে? এনি প্রবলেম?

কথাটি বলার সাথে সাথে নিশীথ উপলব্ধি করে সে মাত্র বড় একটা ভুল করে ফেললো! এখন দোলা যদি প্রশ্ন করে সে কিভাবে জানলো?
পরক্ষণেই নিশীথের ভাবনাকে সঠিক প্রমাণ করে দোলার কপালে সূক্ষ্ম ভাজ লক্ষ্য করা গেলো। সে দ্বিধান্বিত আওয়াজে শুধালো,

—আমি আমার মায়ের সাথে বেরিয়েছিলাম তা আপনি কিভাবে জানলেন?

দোলার জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই নিশীথ ঠান্ডা মাথায় উত্তর দেয়,

—বিকেলে বোধহয় আপনাকে দেখেছিলাম একটা আন্টির সাথে বের হতে। ধরে নিয়েছি উনি আপনার মা, এখন আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমার ধারণা সঠিক।

নিশীথের ঠান্ডা মাথার স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে দোলার মনের সন্দেহ দূর হয়। এবার সে-ও মুখ স্বাভাবিক করে বলে,

—ওহ আচ্ছা। আসি তাহলে, ভাইয়া!

দোলার মুখে “ভাই” সম্বোধনে নিশীথের স্বাভাবিক মুখটা ভার হয়ে এলো। চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। অথচ যার কারণে এসব হলো সে একবার পেছন ফিরে দেখলোও না! নিশীথের হৃদয়ে প্রেমের বাণ ছু’ড়ে হৃদয়হীনা নিজের মতোন চলে গেলো! মুষ্টিবদ্ধ হাতে শক্ত চোয়ালে ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল নিশীথ। মনে মনে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,

—আমার বোকা দোলনচাঁপা, যদি কাউকে ভবিষ্যৎ দেখানোর সুযোগ থাকতো, তবে আমি আজ স্বাচ্ছন্দ্যে তোমায় আমাদের ভবিষ্যৎ দেখাতে চাইতাম। তখন হয়তো তুমি অজান্তেও আজকের মতো ভুল পুনরায় করতে না!

_____________

বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিজের রুমে বসে ফোন টিপছিলো দোলা। বসে বসে একটু আগে ওর আর নিশীথের কথোপকথন মনে করছিলো। সে ছেলেটাকে নাম বলে এলো ঠিকি অথচ ওর নামটাই কিনা শুনলোনা? এতটা বোকা কেন সে? আজব!
নিজের প্রতি নিজেরই বিরক্ত হলো দোলা। এ বিরক্তির প্রধান কারণ নিশীথকে ওর কেন এত চেনা চেনা মনে হচ্ছে তা ও বুঝতে পারছেনা। সে কি আগে ওকে আদৌ কোথায় দেখেছে? দেখলে মনে পড়ছেনা কেন? মাথায় কিছুক্ষণ জোর খাটালো মেয়েটা। তবুও অলস দেমাগ সঠিক তথ্য না দেওয়ায় এক পর্যায়ে সে হাল ছাড়লো! চিনলে চিনুক, না চিনলে না চিনুক। একি এলাকায় থাকে তারা, যেকোনো দিন দেখা হতেই পারে। সবকিছু কি মনে রাখতে পারে মস্তিষ্ক? পারেনা তো! অতএব এটা নিয়ে এত মাথা খাটানোর কিছু নেই। এবার একটু রেস্ট নেওয়া উচিত। এমনিতেও বাইরে থেকে এসে ইষত মাথা ব্যাথা করছে মেয়েটার। এখন একটু বিশ্রাম ওর বড্ড প্রয়োজন। নিজের ভাবনা অনুযায়ী মাত্র কাথা টেনে একটু শুয়েছে এমন সময় ওর রুমে হুড়মুড়িয়ে শিমুল ঢুকে পড়ে। চোখ খুলে সেদিক চেয়ে বিরক্ত কণ্ঠে দোলা বলে,

—কি হয়েছে তোর? মাত্রই শুয়েছি। এখন ডিস্টার্ব দিবিনা তো, শিমুল। যা এখান থেকে!

বোনের কথাকে তোয়াক্কা না করে শিমুল নিজের মতোন হেলেদুলে এসে বসে বোনের পাশে। ওর মুখ গোমড়া। সেদিক চেয়ে দোলা শোয়া থেকে উঠে বসে। ভাইয়ের চুলে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—কি হয়েছে? মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস কেন?

এবার শিমুল মুখ খুলে। বোনের উদ্দেশ্যে বলে,

—তুমি নিশীথ ভাইকে চিনো আমায় আগে বলোনি কেন, আপু? সেদিন কেন বললে তাকে চিনোনা?

ভাইয়ের কথায় যেন আকাশ থেকে পড়লো দোলা। কি বলছে সে? এখানে নিশীথ কোত্থেকে এলো? মাথা নাড়িয়ে ও শিমুলকে বলে,

—কি বলতে চাইছিস সরাসরি বল? আমি কেন তোকে মিথ্যা বলতে যাবো? এখানে নিশীথের কথা কিভাবে এলো?

—এখন ঢং করোনা, আপু। আমি একটু আগে বারান্দা থেকে দেখেছি তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিশীথ ভাইয়ার সাথে কথা বলছিলে। আমি তখন জেগেই ছিলাম! সব দেখেছি হুহ!

শিমুলের কথায় এবার আরেকদফা অবাক হয় দোলা। তার মানে ওটা নিশীথ ছিলো? সেই নিশীথ, যার কথা সেদিন শিমুল ওকে বললো? যাকে সে পেছন থেকে দেখেছিলো ওই বৃষ্টির দিনে বারান্দা থেকে? এজন্যই এত চেনা চেনা লাগছিলো বুঝি?
দোলা আনমনে ভাবে! তবে সেদিন ও নিশীথকে যেমন ভেবেছিলো, আজকের নিশীথকে তার কাছে পুরোপুরি আলাদা ব্যক্তিত্বের লেগেছে।
কোনটা সত্যি তবে? নাকি সে নিশীথের বাহ্যিক আচরণ দেখে ওর ব্যক্তিত্বকে ভুল অনুমান করে বসেছিলো এতদিন? দোলার মনের আকাশে নিশীথকে নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্নের মেঘ ঘুরে বেড়ায়!

#চলবে

পর্বকে কেউ ছোট বলবেন না। পুরো লেখা ডিলিট হয়ে যাওয়ায় আজ সারাদিনে এটুকু লিখেছি। এ কারণে পর্বটা খাপছাড়া মনে হতে পারে। রিচেক দেওয়ার সুযোগ হয়নি। পরের পর্ব ঠিকঠাক ভাবে লিখব ইন শা আল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here