#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
প্রতিদিন বাসায় ফিরে একবার হলেও দাদুর রুমে গিয়ে তার সাথে গল্প করা নিশীথের অন্যতম একটা অভ্যাস। ছোটবেলা থেকেই দাদুর সাথে ভীষণ ভাব তার। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। রাত তখন ৯টা বেজে ৫ মিনিট গড়িয়েছে। নিশীথের দাদু ওরফে ইউনুস তালুকদার সবেমাত্র খেয়েদেয়ে নিজের রুমে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় রুমের দরজা ঠেলে প্রবেশ করে নিশীথ। কালো রঙের গেঞ্জি গায়ে ভেজা চুল হাত দিয়ে ঝাড়তে ঝাড়তেই তার দিকে হেটে আসা নিশীথকে দেখে ইউনুস সাহেব খুব একটা অবাক হলেন না বটে। বরং এ অসময়ে তার নাতি বাসায় ফিরে তার কাছে আসে, এসবে তিনি যেন বেশ ভালোই অভ্যস্ত!
নিশীথ এসে পাশে বসতেই নাতিকে দেখে এক গাল হেসে উনি বললেন,
—কি খবর দাদুভাই, এতক্ষণে বুঝি মনে পড়লো আমার কথা?
দাদুর কথায় নিশীথ হেসে বললো,
—বাসায় ঢুকে ফ্রেশ হয়েই সবার আগে তোমার কাছে এসেছি। আর তুমিই এটা বলছো! এমনটা আমায় বলতে পারলে, দাদু?
দাদুও হেসে ফেললেন নিশীথের সাথে। কথায় কথায় বললেন,
—এত দেরি করে রোজ ফেরা কি ভালো কথা? তোর বয়সে আমরা কত কিছু করতাম, আর তোকে দেখ! শুধু সারাদিন বন্ধুদের সাথে হট্টগোল করা আর রাত করে বাড়ি ফেরা! বউমা কিন্তু আমায় সকালে বলেছে তোকে বুঝাতে…
—উফফ দাদু, থামো তো! কই একটু তোমার কাছে এসেছি সারাদিন পর ভালোমন্দ দুটো কথা বলতে আর তুমি কিনা মায়ের পক্ষ হয়ে ওকালতি করছো?
নিশীথ বিরক্তিকর কণ্ঠে আওড়ায়। দাদু বুঝেন তার রগচটা নাতি এভাবে বুঝবেনা। কিন্তু একি সাথে ওর মায়ের চিন্তাটাও স্বাভাবিক। এ বয়সের জোয়ান ছেলে কোনোকিছু না করে সারাদিন আড্ডা দেওয়া আর বসে বসে টাকা উড়ানো কি ভালো দেখায়? তাইতো কথা ঘুরিয়ে নিশীথের কাধে হাত রেখে বললেন,
—দেখ নিশীথ, আমি কিন্তু কখনো তোকে এসব বিষয়ে কোনোকিছু বলিনি। এ পর্যন্ত তোর বাবা-মা তোকে অনেকবার এ বিষয়ে কথা বললেও আমি কি কখনো বলেছি? তুই নিজেই বল।
দাদুর কথায় নিশীথ মাথা নাড়ায়। আসলেই তিনি কখনো ওকে এসব বিষয়ে কোনকিছু বলেননি। এমনকি নিশীথের বাবা যখন ওকে বারবার ব্যবসায় যোগ দিতে বলতো তখনো ওর দাদু বলতেন ছেলের যখন মন চাবে তখন কাজে ঢুকবে, তার আগে নয়। কিন্তু সেই দাদুই যখন আজ এসব বলছেন তখন নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। নিশীথ মনে মনে ভাবে। তাই স্পষ্টচিত্তে দাদার উদ্দেশ্যে বলে,
—তা বলোনি অবশ্য। কিন্তু আজকে এভাবে হুট করে বলার পেছনে নিশ্চয়ই কারণ আছে। এখন জলদি সেটাও বলে ফেলো!
নিশীথের স্পষ্টবাদীতায় ইউনুস সাহেব হাসলেন। তার ছোটনাতি প্রকৃত অর্থেই বেশ অধৈর্য এবং একিসাথে বিচক্ষণও বটে। কিভাবে চট করে ধরে ফেললো তার এসব কথা বলার কারণ! তাই তিনিও আর ভনীতা না করে বললেন,
—বেশ। তবে তাই বলছি। তোর পড়ালেখা প্রায় শেষের দিকে। এ সময়ে সবাই কতকিছু করছে। তোর বন্ধুদেরই দেখ। কতজন চাকরিতে ঢুকেছে, কেউবা বিসিএস এর জন্য পড়ছে আবার কেউ নিজেরই ছোটখাট ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে। তাহলে তোর কি মনে হয়না তোরও কিছু করা উচিত? তোর বাপের তো বয়স হয়ে যাচ্ছে, ভাই। তোর বড়ভাই তার মধ্যে বিদেশ চলে গেছে। এখন তুইও যদি দায়িত্ব না নিস তবে আমাদের ব্যবসা এগোবে কিভাবে?
দাদার কথায় নিশীথ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানতো এমন একটা দিন আসবে। এতদিন সবার কথা ফেলতে পারলেও দাদুর সাথে সে তর্কে যায়না। কিন্তু ওর ব্যবসায় যোগ দেবার তেমন ইচ্ছে নেই। সে বিষয়ে দাদাকে কিভাবে বুঝাবে? উনি যদি মন খারাপ করেন? নিশীথ কিছুক্ষণ ভাবে।
অতঃপর বলা শুরু করে,
—দেখো দাদু, আমার মাস্টার্সটা কমপ্লিট হতে দাও। আর বেশিদিন তো নেই। তখন না হয় ভাববো কি করা যায়। এ কয়দিন একটু শান্তিতে থাকতে দাও তোমরা আমায়!
নিশীথের কথায় দাদা সন্তুষ্ট না হলেও আপাতত মেনে নেন। নিশীথ যখন বলেছে মাস্টার্স শেষ হবার পর এসব নিয়ে বলতে তখন তিনি আর কথা না বাড়ানোয় ভালো মনে করলেন। এ বিষয়ে তখনই কথা বলবেন। আসলেই বেশিদিন বাকি নেই আর, মাসখানেক এর মতোন সময়। এতদিন যখন কথা তুলেননি তখন এটুক অপেক্ষা করাই যায়!
ইউনুস সাহেব মাথা নেড়ে সায় দিলেন। কথার প্রসঙ্গ ঘুরাতে নাতির উদ্দেশ্যে বললেন,
—তা দাদুভাই, শুধু কি ছেলেপেলের সাথে আড্ডা দিলেই হবে নাকি প্রেম-ট্রেমও করা হচ্ছে? এসব বিষয়ে তো আর এ বুড়োকে কিছু বলবেনা!
প্রেমের কথা শুনে নিশীথ এতক্ষণের গম্ভীর ভাবমূর্তি থেকে বেড়িয়ে আসে। মুখখানা পুনরায় স্বাভাবিক করে। ঠাট্টার সুরে বলে,
—বলেও লাভ কি? তুমি তো এসব জানোই। আমার সুন্দরী দাদিকেও তো এভাবেই প্রেমের জা’লে ফাসিয়ে বিয়ে করেছিলে।
নাতির এহেন কথায় উচ্চস্বরে হেসে উঠেন বুড়ো। খানিকবাদে বয়সের প্রভাবে হাসির সাথে কাশিও চলে আসে। নিশীথ উঠে গিয়ে পানি এগিয়ে দেয়। দাদার পানি খাওয়া শেষ হতেই নিশীথ গম্ভীরমুখে বলে,
—প্রেম তো করেছিলাম দুটো। ওগুলো তো তুমি জানো। কিন্তু এবার…
নিশীথ থামলো। সে বুঝতে পারলোনা দাদুকে দোলনচাঁপার কথা কিভাবে বলবে। তিনি কি আদৌ বিশ্বাস করবেন, আদৌ বুঝবেন ওর অল্প সময়ের প্রেমের গভীরতা? দোটানা কাটিয়ে নিশীথ ঠিক করলো আর কাউকে না হলেও দাদুকেই জানানো উচিত। অন্তত তার অভিজ্ঞতা থেকে অবশ্যই কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে সে।
নিশীথ যখন নিজ ভাবনায় বিভোর তখন ইউনুস সাহেব এগিয়ে আসেন। নাতির শিওরে বসে তিনিও বেশ গম্ভীর গলায় বলেন,
—তবে কি, দাদুভাই? এবার কাউকে সত্যিকারে ভালোবাসলে বুঝি?
দাদুর প্রশ্নে নিশীথ শান্ত চোখে চায়। ওর চোখদুটো ও তার মাঝে লুকায়িত অনুভূতিগুলো কিছু না বলেও বৃদ্ধ দাদার অভিজ্ঞ চোখে ঠিকি ধরা পড়ে। তিনি নিশীথকে আশ্বস্ত করতে বললেন,
—কি হয়েছে সব বল। আমি তো বুঝি তোকে। তুই এতটাও বড় হোসনি যে আমায় কিছু বলতে পারবিনা।
দাদুর কথায় নিশীথ উদাস স্বরে বলে,
—একটা মেয়েকে ভালো লেগেছে, দাদু। সত্যি বলতে শুধু ভালো লাগাতেই সীমাবদ্ধ নেই আমি, ভালোবেসে ফেলেছি ওকে। কিন্তু বাকি সবকিছুতে আমি কেয়ারলেস, বেপরোয়া হলেও ওর বেলায় আমি ভিন্ন। ওকে নিজের অনুভুতি জানাতে অজানা কারণেই ভয় হয়। যদি ও না মানে? যদি আমার সাথে কথা না বলে? এসব ভাবনা আমার ভেতরকে লণ্ডভণ্ড করে দেয়।
ইউনুস সাহেব এবার বুঝেন নিশীথের অনুভূতি। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন আসে, কে সেই মেয়ে যার ক্ষেত্রে তার বেপরোয়া নাতি এতটা ভিন্ন? কি এমন বিশেষত্ব আছে তার মধ্যে? নিশীথের আগেকার প্রেমেও তো এভাবে ওকে ভাবতে দেখেননি তিনি। তবে কারণ কি? তাইতো উনি জিজ্ঞেস করলেন, মেয়েটা কে? কোথায় থাকে? কবে থেকে ভালো লাগে আর কেন-ই বা নিশীথের দোটানার কারণ! তখন নিশীথ ছন্নছাড়া ভাবে জবাব দেয়,
—আমাদের এলাকার। খুব কাছেই থাকে। ওর বিশেষত্ব বলতে তেমন কিছুই নেই। মেয়েটা খুব সাধারণ। আগে যাদের সাথে প্রেম করেছি ওদের তো তুমি দেখেছোই। দোলনচাঁপা ওদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একদম সিম্পল। কিন্তু ওর এই সাধারণত্বই ওর বিশেষত্ব। এটাই আমায় ভীষণভাবে টানে। আর সবচেয়ে ফানি ব্যাপার কি জানো?
ইউনুস সাহেব বেশ কৌতুহলের সাথে মাথা নাড়লে নিশীথ বলে,
—আমি ওকে দেখেছি মাত্র সপ্তাহখানেক পেরিয়েছে। আর এইটুক সময়েই ওর জন্য আমার মনে এসব অনুভূতি আসে। এটাকে কি তুমি স্বাভাবিক বলে মনে করো? নাকি কোনো পাগলামি? বলো তো!
নিশীথের কথায় প্রথমে ইউনুস সাহেব বেশ অবাক হলেন। বলছে কি তার নাতি? নিশীথ যা বলছে সেসব যদি সত্যি হয়, তবে তার নাতি এবার সত্যি সত্যি ভালোবাসার জা’লে ফেসে গিয়েছে, তাও ভীষণ বাজেভাবে! কে এই দোলনচাঁপা? যার জন্য নিশীথ এত ব্যাকুল? ইউনুস সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে। কিছু তো অবশ্যই আছে মেয়েটার মধ্যে, যা তার বেপরোয়া নাতিকে এটুকু সময়ে এতটা পাগল করে দিয়েছে! আজকে নিশীথের কথা শুনে ওর দোলনচাঁপাকে দেখার ব্যাপক আগ্রহ জন্মে ইউনুস সাহেবের মনে!
#চলবে
আজকে আপনাদের দোলনচাঁপা আসেনি। কিন্তু পরের পর্বের সিংহভাগজুড়েই সে থাকবে। পর্ব-৯ আসছে অনেক জলদি ইন শা আল্লাহ।