#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৯ (১ম অংশ)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
“কি নাম বললি যেন মেয়েটার?”
দাদুর প্রশ্নে নিশীথ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। এক পলক উনার দিক চেয়ে দৃষ্টি সরিয়ে বলে,
—দোলনচাঁপা।
দাদুর দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ বিস্ময়। সেভাবেই বললেন,
—তোর দাদির ভীষণ প্রিয় ফুল ছিলো ওটা। নামটা কিছুটা বড়, এখনকার মর্ডান যুগে তো এসব নাম খুব কমই শুনা যায়।
দাদুর কথায় হাসি ফুটে উঠে নিশীথের মুখে। মাথা নাড়িয়ে বলে,
—আমিও এটাই ভেবেছিলাম জানো? যেদিন প্রথম ওর নাম শুনি। একদিন জিজ্ঞেস করবো দেখি!
নিশীথের কথায় দাদু ঠোঁট টিপে হেসে বলেন,
—শুধু জিজ্ঞেস করলেই হবে, দাদাভাই? আরও যে অনেককিছুই করতে হবে। তুই তো বুদ্ধিমান, তোকে তো আর নতুন করে বলতে হবেনা কিছু! শুধু এটুকুই বলবো, যা করার জলদি কর। মরার আগে যেন তোর বিয়েশাদি দেখে যেতে পারি!
দাদুর প্রথমের কথায় নিশীথ হাসলেও পরের কথায় চটে যায়। থমথমে মুখে বলে,
—ফারদার এসব কথা আমার সামনে বলবেনা, দাদু। তুমি শুধু আমার বিয়েই নয়, আমার নাতিপুতিও দেখে যাবে।
নিশীথের অসন্তুষ্টতায় মলিন হাসেন দাদু। তার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, কে জানে কতদিন বাচবেন? হায়াত-মউতের কথা কি আর কেউ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে? তাইতো তিনি এ কথা বলেছেন। কিন্তু তার নাতি এসব বুঝতে নারাজ। তাই নিশীথকে শুধরে তিনি বললেন,
—ইনশাআল্লাহ বলতে হয় রে, ভাই। আল্লাহ রহম করলে আর তোদের দোয়া থাকলে অবশ্যই দেখবো। আমারও এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার ইচ্ছে নাই।
দাদুর কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে নিশীথের বুক চিড়ে। নিজের রুমে যেতে যেতে আপনমনে সে দাদুর জন্য প্রার্থনা করলো সেই সৃষ্টিকর্তার কাছে, যিনি জন্ম-মৃত্যু থেকে শুরু জীবনসঙ্গীসহ সবকিছু পূর্বে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। একমাত্র তিনি চাইলেই সকলের জীবনের সব অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ হওয়া সম্ভব!
__________________
পরদিন দুপুর। আজকে দোলার ভার্সিটি নেই। ক্লাস না থাকায় সারাদিন অলস সময় পার করিয়েছে। এরই মধ্যে রান্নাঘর থেকে উচ্চস্বরে মা পারভীন বেগম ডাকলেন ওকে। মায়ের কথায় দোলা রান্নাঘরে গেলো। পারভীন বেগম মাছ কাটছিলেন। বড় মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করলেন,
—তোর কি কোনো কাজ আছে রে?
—নেই তো, মা। কেন?
দোলা উত্তর দেয়। উত্তরে পারভীন বেগম বললেন,
—তবে একটা কাজ করতে পারবি?
—হ্যাঁ বলো না।
—মাছ কাটতে বসে খেয়াল হলো আলু ফুরিয়ে গেছে। কামিনি তো নেই বাসায় যে ওকে বলবো। তুই তো ফ্রি আছিস। একটু গিয়ে আলু আর ধনেপাতা নিয়ে আয় না! আলু দিয়ে ছোটমাছের চচ্চড়ি করবো। তোরা তো পছন্দ করিস! রাস্তা পেরোলেই সামনে বাজার। ওখানেই পাবি।
মায়ের কথায় দোলা রাজি হয়। পারতপক্ষে বাসায় বসে বসে সে বোর হচ্ছিলো। এ সুযোগে একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসা যাবে। তাই বরাবরের ন্যায় মায়ের বাধ্য সে এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলো। রুমে গিয়ে বাসার জামা পালটে সুতির জামা গায়ে জড়ালো। টাকার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো।
নিজমনে গুনগুন করতে করতে হেটে চলছিলো দোলা। মনে মনে ভাবছিলো নিশীথ সামনে না পড়লেই ভালো। সেভাবেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলো। আজকে ওর ভাগ্য প্রসন্ন মনে হলো। কেননা নিশীথকে আশেপাশে কোথাও দেখা গেলোনা। তাইতো খুশিমনে এলাকার মোড় থেকে বেরিয়ে বাজারে চলে গেলো সে। ঘণ্টাখানেক পেরোনোর আগ দিয়েই হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে ফিরে আসছিলো। কিন্তু এবার বিধি বাম! খানিকটা সামনেই এলাকার এক মুরব্বি চাচার সাথে নিশীথ কথা বলছে। দোলা পড়ে গেলো দ্বিধায়। যদি নিশীথ ওকে দেখে ফেলে? কথা বলতে আসবে কি? নাকি আসবেনা? সে কি একটু বেশিই ভাবছে? দোলা মনে মনে ভাবে। ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে যায় তাড়াহুড়ো করে। কিন্তু নিশীথ ওকে দেখেনা। নিশ্চিন্ত মনে যখন দোলা নিজ বাসার কাছে পৌঁছাবে ঠিক এমন সময় পেছন থেকে ভরাট পুরুষালি গলা ভেসে আসে,
—দোলনচাঁপা?
যার ভয় ছিলো তা হয়ে যাওয়ায় দোলা হকচকিয়ে যায়। চোখখানা বন্ধ করে জোরে একটা শ্বাস নেয়। নিশীথের সাথে কথা বলবেনা ভেবেও নিজের বিরুদ্ধে গিয়ে পেছন ফিরে জবাব দেয়,
—জি বলুন।
নিশীথ চেহারা স্বাভাবিক করে উত্তর দেয়,
—আজ এ সময় বাসায় যে? ভার্সিটি নেই?
—না, ভাইয়া।
কথাটা দ্রুত বলে দোলা কেটে পড়তে ধরে। কিন্তু নিশীথ পালটা প্রশ্ন করে বসে,
—আরে দাঁড়াও, কোথায় গিয়েছিলে? বাজারে নাকি?
দোলার হাতের ব্যাগের দিক তাকিয়ে নিশীথ বলে। দোলা মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়। নিশীথ যে ওকে ইচ্ছে করে আটকিয়ে সব জেনেবুঝেও প্রশ্ন করছে, ব্যাপারটা বুঝতে ওর বিলম্ব হয়না খুব একটা!
তাইতো চোখমুখ শক্ত করে মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে উত্তর দেয়,
—দেখতেই যখন পারছেন তখন আবার প্রশ্ন করছেন কেন, নিশীথ ভাই? আমার একটু তাড়া আছে। মা বাজারের জন্য অপেক্ষা করছে। আসি কেমন?
দোলার এহেন ঠান্ডা উত্তরে নিশীথ খানিকটা চমকে যায়। মেয়েটা সচারচর এভাবে কথা বলেনা। তবে আজকে হঠাৎ কি হয়েছে ওর? নিজ ভাবনাকে পাশে সরিয়ে নিশীথ বলে,
—ব্যাগটা সম্ভবত ভারী। আমি সাহায্য করবো?
কিন্তু দোলা এবারও আগেকার ন্যায় মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলে ওঠে,
—তার দরকার নেই। এতক্ষণ যখন একা আনতে পেরেছি, বাকি রাস্তাও আর দরকার পড়বেনা। থ্যাংক ইউ।
ব্যস। এবার কথার বুলি শেষ হতেই দোলা আর আগ-পিছ না তাকিয়ে দ্রুত হাটা ধরে। বলতে গেলে একপ্রকার পালিয়েই চলে গেলো নিশীথের সামনে থেকে। বিষয়টা নিশীথ বেশ গভীরভাবে লক্ষ্য করে। কিন্তু ওর মনে ভর করে বিস্ময়! হঠাৎ করে কি এমন হলো মেয়েটার? এমন করছে কেন?
চিন্তার প্রমাণস্বরুপ ওর কপালের মাঝে ভাজ প্রত্যক্ষমান হয়। তর্জনীর সাহায্যে কপাল ঘেঁষে নিশীথ মনে মনে আওড়ায়,
—কিছু তো একটা হয়েছে। নয়তো দোলার এমন অদ্ভুত আচরণ করার কথা নয়। কিন্তু বিষয়টা কি আমাকে খোজ করতে হবে! এবং সেটা অত্যন্ত দ্রুত। নয়তো এভাবে চলতে থাকলে আমাদের প্রেমটা শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যাবে।
#চলবে