দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ৯ (২য় অংশ) #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
524

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ৯ (২য় অংশ)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিশীথের ধৈর্য বরাবরই খুব কম হলেও এই প্রথম সে ধৈর্য সহকারে নিজের ও দোলার ব্যাপারটা নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ চিন্তাভাবনা করলো। নিছক একদিনে দোলার এহেন ব্যবহারকে পুজি করে মনে সন্দেহ পোষাটা ঠিক হবে কিনা তা বুঝতে না পারায় আরও কয়েকদিন দোলার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো। তবে দুঃখজনক হলেও এ যাত্রায় নিশীথের ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করে দোলা ওর সাথে আগেকার ন্যায় ঠিকাঠাক ব্যবহার করলোনা। বরঞ্চ সেদিনের ন্যায় রুক্ষ্ম ও ঠান্ডা ব্যবহার করেই একপ্রকার পালিয়ে গেলো ওর সামনে থেকে। বিষয়টা নিশীথের মনে বাজেভাবে দাগ কাটলো। সে সিদ্ধান্ত নিলো এবার আর হেলাফেলা করা যাবেনা। হয় দোলাকে ওর মনের কথা বলে দিতে হবে, নয়তো ওর মনের দ্বিধা দূর করতে হবে। কিছু একটা তো করতে হবেই!

যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নিশীথ ঠিক করলো এবার সে সময় নিয়ে দোলার সাথে দেখা করবে। সরাসরি কথা কথা বলে সব ভুল বুঝাবুঝি দূর করবে, দরকার পড়লে তৎক্ষণাত ওকে নিজের মনের কথা বলে দিবে। তবু আর কাল বিলম্ব করবেনা! তাই নিজের প্ল্যান মোতাবেক পরদিন বিকেলে নিশীথ চলে গেলো দোলার ভার্সিটির সামনে। ঠিক যখন দোলার ছুটি হয় তার আগে, সে কিছুদিন আগে খেয়াল করেছে এ সময় দোলা ভার্সিটি থেকে বের হয়। তাইতো সুযোগ বুঝে ওই সময়েই দোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলো সে। নিশীথ চাইলেও পারতো বাসার কাছে দোলাকে থামিয়ে প্রশ্ন করতে কিন্তু সে চায়না এলাকার কেউ ওদের অন্য চোখে দেখুক। যেহেতু এখনো ওদের মধ্যে কোনোকিছু হয়নি এবং দোলাও এসব বিষয়ে কম্ফোর্টেবল হবেনা তাই সে ইচ্ছা করেই এখানে এসেছে। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর ভার্সিটির মেইন গেটের বাইরে বের হলো দোলা। কিন্তু সে নিশীথকে লক্ষ্য করেনি তাই নিজমনে হেটে চলছিলো বরাবরের মতোন। নিশীথও ওকে বুঝতে না দিয়ে চুপচাপ ওর পিছু পিছু হেটে চলছিলো।

এদিকটার রাস্তায় প্রচুর ভীড়। গাড়ি অনবরত চলতে থাকায় রাস্তা পার হতে পারছিলোনা দোলা। এমনিতেও সে এই কাজে খানিকটা অপারগ। তাইতো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অন্যদিকে যাবে, ঠিক এমন সময় পেছন থেকে হাতে টান পড়ায় বেজায় চমকে যায় সে! চোখ বড় বড় করে সেদিক তাকাতেই চোখ পড়লো সুঠামদেহী নিশীথের দিকে। যে আপাতদৃষ্টিতে বেশ মনোযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই সময় এই স্থানে নিশীথকে নিজ স্বপ্নেও আশা না করায় দোলা যেন আকাশ থেকে পড়লো। কি করবে না করবে চিন্তা করার মাঝেই পুনরায় হাতে টান পড়লো। কেননা, কয়েকটা গাড়ি পার হয়ে যেতেই দোলার হাত ধরে দ্রুত ভংগিতে রাস্তা পার হয়ে গেলো নিশীথ। রাস্তা পার হওয়া মাত্র সেকেন্ড খানেকের জন্য হাত ছাড়তেই দোলা যেন সুযোগ পেয়ে গেলো। সাথে সাথে উল্টো দিক ঘুরে দ্রুতগতিতে হাটতে আরম্ভ করলো।

—এক মিনিট দাঁড়াও। আমার কথা শুনো!

পেছন থেকে নিশীথের আওয়াজ ভেসে এলো। কিন্তু দোলার পা থামলোনা তবুও। সে নিজের মতোই ক্রমশ এগিয়ে চলছে এক পথে। এমন সময় নিশীথ চড়া গলায় ডাকায় পা জোড়া যেন খানিকটা কেপে উঠলো ওর!

—দাঁড়াতে বলেছি, দোলনচাঁপা। স্টপ!

বলাবাহুল্য, এতক্ষণ দোলার কদম বেশ দ্রুতগতিতে চললেও এবার নিশীথের এমন গুরুগম্ভীর আদেশ অমান্য করার সাহস তার পায়ের হয়নি। কেননা বিনা নিমন্ত্রণে, বিনাবাক্য ব্যয়ে নিশীথের এক কথায় ওর কদমজোড়া থেমে গেলো নিজ হতেই! দোলাকে থামতে দেখে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো নিশীথ। অবশেষে মেয়েটা কথা শুনেছে। বড় বড় কদম ফেলে সেকেন্ড খানেকের মাঝে সে পৌঁছে গেলো দোলার নিকট। যা পিছন না ফিরেও বেশ বুঝতে পারলো মেয়েটা। এ গলির দিকটা এমনিতেও নির্জন। মানুষজন খুব একটা দেখা যাচ্ছেনা। তার মধ্যে নিশীথ এভাবে পথ আটকানোয় অজানা ভয়ে ও অনাকাঙ্ক্ষিত কোনোকিছু ঘটার আশংকায় নিশ্বাস ক্রমান্বয়ে ভারী হতে লাগলো তার।

ফলস্বরূপ, নিশীথ কিছু বলার আগেই নিচু স্বরে অনুরোধের সুরে সে বললো,

—পথ আটকালেন কেন? যেতে দিন প্লিজ।

দোলার কথায় নিশীথের ভাবমূর্তির বিশেষ পরিবর্তন হয়না। সে আগেকার মতোই ভরাট আওয়াজে ডাকে,

—পেছন ফিরো।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবার দোলা পেছন ফিরে। কেননা, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা শেষ করে চলে যেতে পারলেই সে বাচে! তাই মুখভঙ্গি ভার করে দোলা পেছন ফিরলো। ফিরতেই চোখ পড়লো তীক্ষ্ণ চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকা নিশীথের দিকে। যে দৃষ্টি যেন বিনাবাক্যে ওকে অভিযোগ বলছে, বিনাবাক্যে ওকে শাসন করছে! দোলা কিছুক্ষণের জন্য ভড়কায়! নিশীথ যেন এটারই সুযোগ নেয়! কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই সরাসরি প্রশ্ন করে,

—কি সমস্যা তোমার? আমায় ক’দিন ধরে ইগ্নোর করছো কেন?

নিশীথ কথাটা এভাবে সরাসরি প্রশ্ন করে বসবে দোলা আশা করেনি। তাই কিছুক্ষণের জন্য দ্বিধায় পড়ে যায় কিভাবে উত্তর দিবে। আদৌ উত্তর দিবে কিনা এসব নিয়ে। কিন্তু, নিশীথের কড়া চাহনি ও মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিক তাকিয়ে সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটাই আপাতত শ্রেয় মনে করলো।
মনে সাহস সঞ্চার করে একটা ঢোক গিলে শুষ্ক গলা ভিজিয়ে বলল,

—আ,আমি আপনাকে ইগ্নোর করবো কেন? আজব তো!

নিশীথের দিকে না তাকিয়ে দোলা চেরাচোখে উত্তর দেয়। ওর মিথ্যা ধরতে বিন্দুমাত্র বিলম্ব হয়না নিশীথের। সেভাবেই পালটা প্রশ্ন করে,

—সত্যি বলছো তো?

দোলা বিরক্তিতে কপাল কুচকায়। লোকটা এমন কেন? জেনেবুঝে ইচ্ছে করে জেরা করছে ওকে! সে যখন বুঝছেই ওকে ইগ্নোর করা হচ্ছে তবে কেন যেচে পড়ে দোলার কাছে আসছে? এমন কোনো ভালো সম্পর্ক তো এখনো হয়নি ওদের মধ্যে যার রেশ ধরে নিশীথ ওকে এভাবে প্রশ্ন করতে পারে। তাই মনের সংশয় মনে না চেপে দোলা নিশীথের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,

—এখানে সত্যি মিথ্যে বলার কথাটা আসছে কোত্থেকে বলুন তো, নিশীথ ভাই? আর আপনিই বা আমাকে এসব প্রশ্ন করছেন কেন?

এতক্ষণ দোলার সব কথায় নিশীথ নির্বিকার থাকলেও এবার আর অনুভূতি দমন করতে পারেনা। নিজের ভেতরের ক্রো’ধ যেন ডুকরে বেরিয়ে আসতে চায়। তবু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে, বরং সহসা কদম বাড়িয়ে এগিয়ে এলো দোলার নিকট। ওর এগিয়ে আসা দেখে দোলা ক্রমশ পিছিয়ে গেলো ভয়ে। কম্পনরত ওষ্ঠ নাড়িয়ে কিছু বলবে এর আগেই নিশীথ শীতল কণ্ঠে শুধালো,

—কেন করবোনা?

নিশীথের কাছে থেকে এমন প্রশ্ন আশা করেনি দোলা। তাই কিছুটা অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকালো ওর মুখপানে। কিন্তু ছেলেটা আগেকার ন্যায় একিদৃষ্টিতেই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। যেন অপেক্ষা করছে ওর নিকট থেকে কোনো উত্তরের! দোলা ঘাবড়ায়। তবু ওর দমে গেলে চলবেনা। তাই যথাসম্ভব স্বাভাবিক কণ্ঠে জবাব দেয়,

—করবেন না কারণ আমাদের মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যার ফলে আপনি আমাকে এভাবে মাঝরাস্তায় আটকিয়ে এসব প্রশ্ন করতে পারবেন।

দোলার প্রশ্নে নিশীথের বাম ভ্রু ঠেলে একপাশে উঠে গেলো কপালে। ঠোঁট বাকিয়ে কৌতুকের ছলে বললো,

—তবে কি তুমি চাচ্ছো আমাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক হোক?

দোলার ডাগর চোখে ভর করে বিস্ময়। অক্ষিদ্বয় কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে যেন সেভাবে তাকায়। লোকটা এরকম কেন? কই সে তো এভাবে ভেবে কিছু বলেনি! এখন তো দেখছে তাকে নিজের প্রশ্নেই ফাসিয়ে দিলো নিশীথ। নিদরুণ লজ্জায় চোখ এদিক সেদিক ঘুরায়। নাক ফুলিয়ে রা’গী গলায় বলে,

—আমি কি সেটা বলেছি? দু লাইন বেশি বুঝেন কেন?

দোলার রা’গ করায় যেন নিশীথ মজা পায়। তবে তা নিজের মুখভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে দেয়না। কেননা, এখন মজা করার সময় নয়। আগে দোলার থেকে সব শুনতে হবে তারপর ওর ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। তাইতো আগেকার ন্যায় শীতল কণ্ঠে বলে,

—আমি যখন দুই লাইন বেশি বুঝছি, তখন তুমিই না হয় চার লাইন ক্লিয়ার করে দাও।

—মানে?

দোলা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে। নিশীথের কথার আগামাথা কিছুই ওর মস্তিষ্কে ঢুকেনা। ওর প্রশ্নে নিশীথ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,

—মানেটা খুব সিম্পল। তুমি আমাকে কেন ইগ্নোর করছিলে বলে দাও। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিবো।

—আপনার আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবেনা। আমার এখন টিউশন আছে, সেখানে যাবো। আর আমি আপনাকে কোনোকিছুর জবাব দিতে বাধ্য নই। আমাকে প্লিজ যেতে দিন, নিশীথ ভাই!

নিশীথ এবার চটে যায়। মেয়েটাকে যতটা নরম ভেবেছিলো, এখন মনে হচ্ছে দোলা ততটাও নরম নয়। তাই রাগ চাপতে ব্যর্থ হওয়ায় নিশীথ ঠান্ডা গলায় বলে,

—ভালোই ভালোই প্রশ্ন করছি, ভালোই ভালোই উত্তর দিবে। এখন আমায় রাগিও না, দোলনচাঁপা। অনেকক্ষণ ধরে নিজের রাগ কন্ট্রোল করে আছি, একবার আমার রাগ মাথায় চাপলে যা হবে, তা তোমার জন্য ভালো হবেনা।

নিশীথের শীতল গলার হুমকি শুনে দোলা বড়সড় এক ঢোক গিললো। নিশীথকে বেশ নাছোড়বান্দা মনে হচ্ছে। আজকে জবাব না শুনে সে যেতে দিবেনা। তাই কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে অবশেষে দোলা মাথা নিচু করে মিনমিনিয়ে বললো,

—আপনি মানুষকে মা’রেন। এগুলো খারাপ কাজ। আমার এসব ভালো লাগেনা। তাই আপনাকে এড়িয়ে চলছিলাম এ ক’দিন।

নিশীথের চোখেমুখে বিস্ময়। দোলার কথাগুলো মাথায় ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে যেন। কিন্তু দোলা ওকে মা’রপি’ট করতে দেখলো কবে? কোথায় দেখলো? কখন দেখলো?
নিশীথ মনে মনে অনুসন্ধান করতে লাগলো!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here