“জানো আপু, ভাইয়া আমাকে বাসায় ঢুকতেই দিচ্ছিলোনা। অথচ যেইনা আন্টি তোমার নাম নিলো ওমনি হঠাৎ রাজি হয়ে গেলো!”
আচমকা ছোট ভাই এর মুখে এমন কথা শুনে চমকে উঠে দোলা। সে তো একধ্যানে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চা বানাচ্ছিলো নিজের জন্য। এমন বৃষ্টির দিনে বারান্দায় বসে ধোয়া উঠা এক কাপ গরম চা না খেলে কি জমে? অথচ এর মাঝে হঠাৎ করে তার ভাই কোত্থেকে উড়ে এসে এভাবে কার কথা বলছে সে বুঝতে পারলোনা। ব্যাপারটা ঠিক ধরতে না পেরে বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলো,
—কার কথা বলছিস রে, শিমুল? কিছুই তো বুঝলাম না। কোন ভাইয়া? কোন আন্টি?
বোনের কথায় কপাল চাপড়ায় শিমুল। তার বোনটাও বড্ড বোকা, একবারে কিছুই বুঝেনা। ভেঙে ভেঙে বুঝাতে হয় সব। আবার পরক্ষণেই ওর মনে হলো সে যেভাবে বিনা নোটিসে হুট করে এসে কথাটা বলেছে, যেকোনো মানুষের মাথায় কিছু না ঢোকাটাই স্বাভাবিক। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সে বলে,
—আরে, ওই যে আমাদের গলির শুরুতে যে বড় একটা বাসা আছে না? তালুকদার বাড়ি? ওখানে যে নিশীথ ভাইয়া থাকে, তার কথা বলছি। তুমি দেখোনি ভাইয়াকে?
ভাইয়ের কথায় ভ্রু সরু হয়ে আসে দোলার। তারা এই এলাকায় এসেছে সপ্তাহখানেক হবে মাত্র, সে নিজেই ঠিকমতোন কাউকেই চেনেনা তেমন। নিশীথ নামের কাউকে কখনো দেখেছে বলেও ওর মনে পড়ছেনা।
অথচ তার ভাইকে দেখো! দিব্যি এলাকার কে কোথায় থাকে, কার বাসায় কি হয় ঠিকি এসবের খবর নিয়ে চলছে! চুলো বন্ধ করে ভাইয়ের মাথায় গাট্টি মেরে কাপে চা ঢালতে ঢালতে দোলা বলে,
—অযথাই যে একজনের কথা বলছিস, এত কিছু তুই কিভাবে জানিস শুনি? উনাদের বাসায় গিয়েছিলি বুঝি? চিনিস তাদের?
—চিনবোনা কেন? আমি কি তোমার মতো শুধু ঘরে বসে থাকি নাকি? আমি যে বাড়ির ছেলেমানুষ! আমাকে তো এলাকায় বেরিয়ে চারপাশের খোজ-খবর নিতেই হবে তাইনা?
ভাইয়ের পাকা পাকা কথা শুনে দোলা হেসে ফেলে। এই ছেলের কথা শুনে কে বলবে যে সে মাত্র ক্লাস সিক্সে পড়ে? ওর হাসি দেখে মুখ ফুলিয়ে শিমুল বলে,
—এই আপু, তুমি হাসছো কেন? আমার কথা বিশ্বাস করলেনা?
—নাহ, করলাম না। এখন সামনে থেকে সর তো, শিমুল। বড্ড জ্বালাচ্ছিস সকাল সকাল। একটা শুক্রবারের দিন শান্তিমতোন বসে চা-টাও খেতে দিবিনা নাকি?
রান্নাঘর পেরিয়ে নিজ রুমের বারান্দায় যেতে যেতে বললো দোলা। ওর পিছু পিছু ছুটে গেলো শিমুল নিজেও। যেন বোনের সূক্ষ্ম খোটা কোনোরুপ গায়েই মাখলোনা সে। বারান্দায় বসে চায়ে চুমুক দিয়ে একমনে বৃষ্টি দেখতে থাকা দোলার দিক চেয়ে কি মনে করে যেন বললো,
—আপু তুমি রাগ না করলে একটা কথা বলি?
—আমি মানা করলেও তো তুই শুনবিনা। তার চেয়ে কি বলার আছে ঝটপট বল!
খানিকক্ষণ আমতা আমতা করে শ্বাস রোধ করে দ্রুতবেগে শিমুল বললো,
—আমার না মনে হয় ওই ভাইয়াটা তোমায় পছন্দ করে!
ব্যস! কথাটা বলা শেষ হওয়া মাত্রই সে ভো দৌড় দিলো, এক ছুটে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। শিমুল জানে তার বোন এসব বিষয়ে বেশ নিশ্চল। প্রেম-ভালোবাসা এসবে দোলার বিশেষ আগ্রহ নেই, থাকলেও ওকে কোনোদিন প্রকাশ করতে দেখেনি কেউ। তাই এ মুহুর্তে বোনের চেয়ে নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাই সে শ্রেয় মনে করছে!
এদিকে রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও ভাইয়ের চলে যাওয়ার দিক চেয়ে আনমনে হেসে ফেললো দোলা। কিসব যে ঘুরে এ ছেলের মাথায় তা কেউ জানেনা! একে থামাতে হবে নয়তো নির্ঘাত কোনো একটা ঝামেলা পাকিয়ে ফেলবে সে। মনে মনে ভেবে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পুনরায় চা খাওয়ায় মনোযোগ দেয় মেয়েটা। বর্ষাকাল তার ভীষণ প্রিয় সময়। চারদিকে কেমন যেন স্নিগ্ধ স্নিগ্ধ ভাব! মৃ’ত’প্রায় ফুলগুলোও যেন বৃষ্টির ছোয়ায় প্রাণ ফিরে পায়, নতুন রুপে ফুটে উঠে ধরণীর বুকে। এমনই এক বর্ষার দিনে সে নিজেও ফুলের মতো এসেছিলো পৃথিবীতে। দুনিয়ার বুক আলো করে বাবা-মার গৃহে নিজের পবিত্র সুবাস ছড়িয়েছিলো। তাইতো ফুলের মতোন সুন্দর মেয়েটার নামটাও বাবা রেখেছিলেন ভীষণ শখ করে- “দোলনচাঁপা”।
আজ বাবা নেই সাথে, দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে বছর তিনেক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। ফেলে গেছেন তার শেষ স্মৃতি হিসেবে তার তিন সন্তান ” দোলনচাপা, কামিনি ও শিমুল” কে। ফুলের প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই তার তিন সন্তানের এমন নাম রাখা। আগে দোলনচাঁপা ছিলো চঞ্চল, প্রাণবন্ত। বাবার আদুরে মেয়েটা তার প্রয়াতের পর থেকে কেমন যেন নিভে গেছে। দোলনচাপাঁ থেকে হয়ে গেছে “দোলা”। বিশ বছরের ছোট জীবনে নামের পাশাপাশি নিজের স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্যেও যেন ভাটা পড়েছে তার। তিন সন্তানের জননী তার মা একটি সরকারি স্কুলে চাকরি করেন, আর দোলা নিজের ভার্সিটির পড়ার পাশাপাশি স্কুলের বাচ্চাদের টিউশনি করায়। তার মা বহুবার মানা করেছে কিন্তু দোলা ছিলো নিজ সিদ্ধান্তে অটল। এ বয়সেই মনোবল ভীষণ শক্ত তার। কল্পনাকে আকড়ে ধরে নয় বরং বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই জীবনের পথে এগিয়ে চলতে একান্ত বিশ্বাসী সে!
নিজের দোতালার বারান্দার রেলিং এ হেলান দিয়ে এসব ভেবেই চা শেষ করলো দোলা। বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে এতক্ষণে, তবে থামেনি একেবারে। তবু্ও এরই মাঝে একঝাক তরুণের দল চোখ পড়লো নিচে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝলো এলাকার মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে যাচ্ছে হয়তো। ছেলেদের দেখে মাথায় কাপড় টেনে চুপচাপ ঘরে ফিরছিলো দোলা। এমন সময় একটি শব্দ তার মনোযোগ আকর্ষণ করে কদম রুখতে বাধ্য করে।
“নিশীথ ভাই, শুনছো? আমরা কি একটু আগেই বের হয়ে গেলাম না? বৃষ্টি একেবারে থামলেই বের হওয়া লাগতো মনে হয়!”
নামটা দোলার কাছে চেনা চেনা লাগে। কয়েক সেকেন্ড মাথায় জোর খাটাতেই মনে পড়ে যায় শিমুলের বলা কথাগুলো! তবে কি সে যার কথা বলছিলো, এটাই কি সেই নিশীথ? কিন্তু ফিরে তাকিয়ে একটা অচেনা ছেলেকে দেখা কি ঠিক হবে? দোটানায় পড়ে যায় দোলার মন। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা শেষে মনের উপর মস্তিষ্ক জয়লাভ করে। ফিরবেনা ফিরবেনা করেও অবশেষে ফিরে তাকায় অবাধ্য চোখ!
কালো রঙের পাঞ্জাবি পড়ে ছেলেদের ভীড়ের মাঝে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবক। বাম কানে আইফোন ধরে রাখা তার, পাঞ্জাবির গুটানো হাতায় সিলভার রঙের দামী ঘড়ি দৃশ্যমান। অপরহাত ক্রমাগত নিজের বৃষ্টিভেজা চুলের ভাজে চালাচ্ছে। সে প্রত্যুত্তরে কি বললো তা সঠিক কানে এলোনা দোলার। তবে পেছন থেকে পুরো চেহারা বুঝতে না পারলেও দোলা ধরে নিলো এটা নিশ্চিত এলাকার কোনো এক প্রভাবশালী পরিবারের ছেলে হবে সে। অন্তত ছেলেটার বিলাসবহুল হাবভাব দেখে তা স্পষ্ট বুঝাই যাচ্ছে! আর তার ভাই কিনা ভেবে বসলো এমন এক বিত্তশালী ছেলে কিনা তাকে পছন্দ করবে? তার মতো সাধারণ ছিমছাম গোছের এক মেয়েকে? মুখ ফিরে রুমে যেতে যেতে নিজ মনেই তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে সে। এমন ছেলেদের সম্পর্কে কিছুটা হলেও তার ধারণা আছে। মনে মনে দোলা বলে উঠলো,
—তুই বড্ড সরল রে, শিমুল। চালাক-চতুর এ দুনিয়ার সম্বন্ধে তোর যে কোনো ধারণাই নেই! উঠতি বয়স তোর, এমন বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে যে কারও ব্যক্তিত্বে পটে যেতে পারিস। কৃত্তিম এ মুগ্ধতা থেকে তোকে বাচিয়ে রাখতে হবে। এখন তোকে এই ছেলের থেকে দূরে রাখতে হবে।
দোলা রুমে ফিরে গেলো। বৃষ্টির বেগটাও দৃশ্যমান রুপে কমে এলো। নিশীথ পেছন ফিরলো। কান থেকে ফোন রাখতেই চিরচেনা স্বভাবে ওর চোখদুটো দোতলার সেই কাংক্ষিত বারান্দাটার দিকে ফিরে তাকালো। চোখ বুজে ভেজা মাটির ঘ্রাণ নিয়ে যেন মুহুর্তটাকে সে অনুভব করলো। যেখানে এখনো তার রেখে যাওয়া বৃষ্টিভেজা দোলনচাঁপার সুবাস রয়ে গেছে!
রে
#দোলনচাঁপার_সুবাস
#সূচনা পর্ব
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? আশা করছি বরাবরের ন্যায় এবারও আপনাদের ভালোবাসা পাবো। অবশ্যই বেশি বেশি রেসপন্স করবেন সবাই।