দোলনচাঁপার_সুবাস #পর্বঃ১৯ #লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

0
516

#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ১৯
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

দোলার বুকটা ধুকপুক করছে অনবরত। ওর মনে হচ্ছে, নিশীথ বিয়ের কথা বলার পর থেকে এর মাঝে অনাদিকাল পেরিয়ে গেছে। সময়টা যেন মুহুর্তের জন্য থমকে গেছে! নিজের কানকে বিশ্বাস করতেও যেন দ্বিধাবোধ হচ্ছে ওর। সে কি ঠিক শুনেছে? নিশীথ বিয়ের কথা বলছে? যে নিশীথকে ওর বিষয়ে সিরিয়াস ভাবতোনা, যাকে সর্বদা ছন্নছাড়া, আলালের ঘরের দুলাল ভেবে এসেছে তার মুখে এমন কথা দোলাকে চিন্তায় ফেলে দেয়!

—আ-আমি..

—এক মিনিট!

হঠাৎ তড়িৎগতিতে কথা বলে দোলাকে থামিয়ে দেয় নিশীথ। মেয়েটা অবাক হয় আরেকবার। নিশীথ ঠিক কি করতে চাইছে বুঝতে সন্দিহান সে কপালে ভাজ নিয়ে মাথা নাড়ে। নীরবে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?”
নিশীথ চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। ওকে অনেকটা অস্থির দেখায়। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে চোখ মেলে বলে,

—আমি জানি, হুট করে এভাবে প্রশ্ন করায় তুমি কনফিউশনে ভুগছো হয়তো। এরকম ডিসিশন অবশ্যই এত অল্প সময়ে নেওয়া যায়না। তাই আমি তোমাকে এখনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে বলছিনা!

দোলা চমকে উঠে তাকালো। তাকাতেই সরাসরি নিশীথ এর চোখের সাথে চোখ মিলে গেলো। এত ধারালো তীব্র চাহনি ওর মন-মস্তিষ্ক ধারণ করতে পারলোনা! দোলা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো। সে মুহুর্তে নিশীথ এক অদ্ভুত কাজ করে বসলো! দোলার চিবুকে হাত রেখে বললো,

—তোমাকে আমি সময় দিচ্ছি, দোলনচাঁপা। যতদিন ইচ্ছা সময় নাও তবু আমি চাই তুমি ভেবেচিন্তে নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নাও!

নিশীথের ভরাট কণ্ঠে কিছুটা বিষাদের ছায়া, যে বিষাদের রেশ দ্বিধাহীনভাবে পৌঁছে গেলো দোলার অন্তরেও! সে কি এতটাই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে লোকটাকে? দোলা ভাবলো। এরই মাঝে পুনরায় নিশীথের কণ্ঠ শুনা গেলো।

—এমন নয় যে আমি জীবনে প্রথম কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দিচ্ছি…

ওর শেষ কথায় দোলা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই নিশীথ থেমে যায়। মেয়েটা যাতে ওকে ভুল না বুঝে তাই সে বুঝানোর মতো করে বলে,

—কিন্তু সেসব ছিলো অতীত, বলতে গেলে আবেগের সময়। যেটা এখন নেই। তোমার জন্য আমি সিরিয়াস। যতটুকু সিরিয়াস হলে কাউকে সারাজীবনের জন্য নিজের সাথে রাখার তাড়না থাকে মনের ভেতর ঠিক ততটুকুই সিরিয়াস আমি তোমায় নিয়ে। তাই বারবার বলছি, এমন কোনোকিছু বলোনা দোলনচাঁপা, যাতে আমার মন ভেঙে যায়। তুমি যতদিন চাবে সময় নাও উত্তর দেওয়ার, তুমি চাইলে আমি ততদিন তোমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো, অপেক্ষা করবো তোমার জন্য।

দোলা হতাশাময় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর মন বরাবরই নরম। সে সবার সামনে নিজেকে কঠোর ও শক্ত মনের অধিকারি দেখালেও ওর ভেতরকার কোমল নারীসত্ত্বা সুযোগ বুঝে প্রকাশ ঘটাতে বিলম্ব করেনা বৈকি! এক্ষেত্রেও ঘটলো ঠিক তাই! যতই সে বুকে সাহস জুটিয়ে মুখে না বলতে চাইছে ততই ওর জবান সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে যেন! মনে মনে পুরোপুরি না বলার ইচ্ছা থাকলেও মুখে আসার আগেই শব্দ দলা পেকে যাচ্ছে। তার মধ্যে নিশীথের এই মারাত্মক চাহনি! দোলা ভেবে পায়না সে কিভাবে বলবে নিশীথকে, ওর দিকে এভাবে না তাকাতে? সে কিভাবে বুঝাবে লোকটাকে যে এভাবে তাকালে ওর ভেতরটা কেপে উঠে, সারাজীবন সযত্নে লুকিয়ে রাখা কোমল মনটায় নিমিষে উথাল-পাতাল শুরু হয়ে যায়! কিন্তু মুখে সে এসবের কিছুই বলতে পারলোনা। শুধু বললো,

—আমি আপনাকে এখনো ঠিকমতো চিনিনা, নিশীথ ভাই। আপনার সম্পর্কে, আপনার পরিবার সম্পর্কে তেমন কিছুই আমি জানিনা৷ আমি শিওর আপনার ক্ষেত্রেও অনেকটা একি ব্যাপার! তাই নয় কি?

নিশীথ মাথা নাড়ে। সে নিজেও দোলার ব্যাপারে অত কিছু জানেনা। যেটুকু বাড়িওয়ালা অর্থাৎ তূর্যর মা-কে দোলার মা বলেছে সেটুকুই সে জানে ওর ব্যাপারে। এছাড়া আর কিছুই জানার প্রয়োজন বোধ করেনি সে। তাই সে মুখে বললো,

—হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি বুঝাতে চাইছো? আন্টির কাছে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলছো?

নিশীথের কথায় দোলা চোখ বুজে ফেলে। এই ছেলের গাড়ির চাকা সবসময় ওই এক জায়গায় গিয়েই আটকে! তবু সে বুঝানোর মতো করে বললো,

—আমি বলতে চাইছিলাম যে, বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। এটা সারাজীবনের একটা সম্পর্ক যেটা শুধু আমাদের না আমাদের পরিবারের মধ্যেও সেতু হিসেবে কাজ করবে। আপনার ও আমার ফ্যামিলির মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান, নিশীথ ভাই। এমন অসম সম্পর্কে বিয়ের মতো ঘটনা…

ওকে মাঝপথে থামিয়ে নিশীথ বলতে লাগলো,

—আমি জানি আমার সম্পর্কে তুমি এখনো অনেক কিছুই জানোনা। কিন্তু তুমি কোনোদিন জানতে চাওনি বলেই আমি তোমাকে কিছু বলার সুযোগ পাইনি। আমার ফ্যামিলি এমন না যেমন তুমি ভাবছো, জানো? আমার মা-কে তুমি দেখেছো না? তাকে দেখে কি তোমার মনে হয়েছে সে এমন মানসিকতার?

দোলা নিরুত্তর রয়৷ নিশীথ ভুল কিছু বলেনি। তবু এ প্রশ্নের জবাব সে দিবেনা। ওর চুপ থাকা দেখে নিশীথ আবারো বলে,

—আর প্রসঙ্গ রইলো আমার বাবার, উনি বাইরে থেকে কঠোর হলেও আমার মনে হয়না আমার বিয়ের ব্যাপারে কোনো ঝামেলা করবে। যদি করেও তবে ওসব আমি ঠিকি ম্যানেজ করে নিবো। শুধু তুমি রাজি হলেই হয়েছে। তোমায় ছাড়া আমি আর কোনোকিছুর পরোয়া করিনা, দোলনচাঁপা।

বাতাসে দোলার কপালের উপর একগুচ্ছ চুল এসে বাড়ি খাচ্ছিলো। নিজ হাতে সযত্নে সেই চুল কানের পিছে গুজে দিলো নিশীথ। ওর স্পর্শের শিহরণে দোলা সামান্য কেপে উঠলো। মিনমিনিয়ে বললো,

—আমি যাই? এখন বাসায় না গেলে খুজতে আসবে উপরে।

নিশীথ হাতঘড়িতে সময় দেখলো। প্রায় বিশ মিনিটের মতোন সময় অতিবাহিত হয়েছে। অনেকক্ষণই ছিলো তারা এখানে বলা যায়! কিন্তু দোলা সাথে থাকলে সময়ের হুশ থাকেনা ওর এটাই হলো সমস্যা! তবে দোলা আজকে রিজেক্ট করেনি এতেই সে খুশি। জবাব না দিক, এটা নিশীথ মানতে পারতো কিন্তু আজকে এতকিছু বলার পর, নিজের সকল অনুভুতি ওর সামনে নিংড়ে দেবার পরও যদি দোলা ওকে ফিরিয়ে দিতো তবে নিশীথের আত্মসম্মানে লাগতো। ওর পুরুষত্ব ওকে আর এ সম্পর্কে অগ্রসর হতে দিতোনা। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ওর ইচ্ছে শুনেছেন, নিশীথের মর্যাদা রেখেছেন। দোলা উল্টাপাল্টা কিছু বলেনি! ওর ভাবনার মাঝেই দোলা চলে যেতে অগ্রসর হলে নিশীথ পেছন থেকে ডাকে। দোলা পেছন না ফিরলেও থেমে যায়৷ নিশীথ শুধায়,

—কার বাসায় গিয়েছিলে কাল? বল্লেনা যে?

দোলা পেছন ফিরে এক পলক। থমথমে মুখে বলে,

—এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাইছিনা আমি।

অতঃপর বিড়বিড়িয়ে বললো, “অন্তত আপনাকে তো অবশ্যই বলবোনা। এমনিতেই মাথা নষ্ট, শুনলে আরও যাবে। আপনার এসব না জানাই ভালো!”

কিন্তু দোলা লক্ষ্য করেনি নিশীথ ততক্ষণে ওর দিকে এগিয়ে এসেছে অনেকটাই এবং সে কথাগুলো শুনেও নিয়েছে। সে যতক্ষণে চোখ তুলে তাকালো, নিশীথকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকতে দেখলো। ওকে চুপচাপ দেখা মাত্রই সে এক ছুটে বেরিয়ে গেলো ছাদ থেকে। নিশীথ সেদিকে সরু চোখে তাকিয়ে থাকলো!

দোলা চলে যেতেই তূর্য প্রবেশ করলো ছাদে। ক্লান্ত ভংগিমায় হাত এদিক ওদিক করে বললো,

—কি ব্যাপার বড়দা, প্রেম দেখি জমে ক্ষীর? আমি বলি ছাদ থেকে বের হয়না কেন এখনো! তা ভাবী কিভাবে পটলো আমাদের শুনালে যে?

নিশীথ নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলো তূর্যর কথায়। ওর কাধ চাপড়ে বললো,

—প্রেম প্রেম ভাব, প্রেমিকার সম্মতির অভাব! বুঝলি ছোটু?

—মানে?
তূর্য বোকার মতো শুধায়। নিশীথ আর জবাব না দিয়ে ওকে সাথে নিয়ে নিচে নামে। ওর মাথায় এখন অন্যকিছু ঘুরছে, ব্যাপারটা না জানা পর্যন্ত এ চিন্তা দূর হবেনা সহজে!

____________________

দোলা বাসায় ফিরলো বেশ অন্যমনস্ক, খামখেয়াল ভাবে। হাতের কাপড়গুলো ঠিকমতো রাখলোও না যেন। কোনোমতে সোফার উপর ফেলে নিজের রুমের দিক যেতেই কামিনি ডাকলো ওকে।

—কোথায় গিয়েছিলে, আপু?

—ছাদে
দোলার নিরস উত্তর।

—ছাদে কাপড় তুলতে এতক্ষণ লাগলো? আমি আরও ভাবলাম তুমিও চলে বাইরে গেছো মায়ের সাথে। জানো কি হয়েছে…

—আমি রুমে যাই, মিনি? এখন কথা শুনতে ভালো লাগছেনা রে।

দোলার মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে কামিনি থেমে গেলো। এগিয়ে এসে দোলাকে কিছুক্ষণ খেয়াল করে বোনের দিক চেয়ে বললো,

—কি হয়েছে, আপু? শরীর খারাপ লাগছে?

দোলার এ মুহুর্তে কিছু বলতে ইচ্ছে হলোনা। তাই শুধু মাথা নাড়লো। কামিনিও আর বাধা দিলোনা, দোলা নিজ রুমে চলে এলো। ওর মাথা আর কাজ করছেনা, চোখ বন্ধ করলেই নিশীথের চেহারা ভেসে আসছে। ওর বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ক্রমশ। মা-কে ফোন দিয়ে শুনলো কতক্ষণে আসবে, ও আর এসব নিতে পারছেনা একদমি। এ যাত্রায় কপাল ভালো থাকায় পারভীন বেগম জানালেন উনি আধা ঘণ্টার মাঝে বাসায় ফিরবেন, মাগরিবের আগেই! শুনে মেয়েটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। এবার শুধু মায়ের আসার অপেক্ষা।

পারভীন বেগম বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে উঠতেই বড়মেয়েকে রুমে ঢুকতে দেখলেন। সেদিক চেয়ে হেসে বললেন,

—আরে দোলা? আয় আয়। মামি তোর জন্য কি কিনেছে দেখ…

—ওসব পরে দেখবো, মা। আগে বলো মামা-মামির সাথে কাল তোমার কি কথা হয়েছে? আর কি এমন কথা বলবে যা তুমি সকাল থেকে বলতে চেয়েও পারছোনা? আমার আর ধৈর্য হচ্ছেনা, তুমি এখনি সব বলো আমায়!

মেয়ের অধৈর্যপনায় পারভীন বেগম খানিকটা বিস্মিত হলেনই বটে। তার বাচ্চাদের মধ্যে দোলা বরাবরই সবচেয়ে ধৈর্যবান, আজ সে এমন করছে এর পিছে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। তাই তিনিও আর রাখঢাক না করে বললেন,

—বেশ, সব বলছি। এত অধৈর্য হলে হয়? আরে এসব ব্যাপার তো আরামে বসে ভালোভাবে বলতে হয়। আর তুই এগুলোতেই তাড়াহুড়ো করতে চাইছিস?

মায়ের কথা বোধগম্য না হওয়ায় দোলা প্রশ্ন করে,

—মানে? কিসের কথা বলছো?

—ওমা! কিসের আবার? এমনভাবে বলছিস যেন তুই জানিসই না?

—কি জানিনা আমি? আমি বুঝতে পারছিনা সত্যি। প্লিজ সবটা খুলে বলো!

—আরে তোর বিয়ের ব্যাপারে! রাকিবের সাথে তোর বিয়ে ঠিক করলাম আমরা। তুই জানিস না?

দোলা এবার আকাশ থেকে পড়লো। কি বলছে এসব মা? যা সে দুঃস্বপ্নে ভেবেছে ওর মা কিনা শেষমেশ সেটাই করে এলো? হতভম্ব সে উউদ্ভ্রান্তের ন্যায় প্রশ্ন করলো,

—এসব কি বলছো, মা? রাকিবের সাথে আমার বিয়ে? কিভাবে? আর আমি জানবোই না কিভাবে?

দোলার মা ভ্রু কুচকে বললেন,

—হ্যাঁ! এত অবাক হচ্ছিস কেন? তোর তো জানারই কথা। তোর খুশির জন্য এতকিছু করলাম আর তোকে দেখে মনে হচ্ছে আজকেই প্রথম শুনলি?

খানিকটা থেমে বললেন,

—শোন মা, আমি বুঝি মেয়েরা বিয়ের ব্যাপারে লজ্জাশরম পাবেই। কিন্তু, তাই বলে কি মায়ের কাছে লজ্জা পেলে হবে? তুই আমায় আগে বলবিনা? বোকা মেয়ে!

দোলার থুতনি ধরে চুমু খেয়ে উঠে গেলেন দোলার মা। এদিকে দোলা আছে মহাবিভ্রাটে? কিসব বলছে পারভীন বেগম? সবটাই যেন অদ্ভুত এক ধোয়াশার ন্যায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে নিউরনের মধ্যে!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here