#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২৭ (২য় অংশ)
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
কথায় আছে, কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না। ঠিক তেমনি, দুশ্চরিত্র লোকেরাও সহজে ভালো হয়না। উদাহরণস্বরুপ, রাকিবের কথাই বলা যাক! গতকাল রাকিবের থেকে নিশীথের থেকে অপমানিত হওয়ার পর ওর মনে অনুশোচনাবোধ জন্মানো তো দূরের কথা, বরং দোলার থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছে বেড়ে গেলো! কোথায় সে নিজের পাপচিন্তার কথা বাদ দিয়ে শুধরে যাবে তা নয়, উল্টো সন্ধ্যেবেলা ও বাড়ি ফিরেই চোখমুখ কালো করবার অভিনয় করে মায়ের নিকট এগিয়ে গেলো।
শায়লা বেগম তখন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে টিভিতে তার প্রিয় সিরিয়াল দেখছিলেন। এমন সময় ছেলেকে বাসায় আসতে দেখে তিনি হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
—কিরে, চলে আসলি? দোলার সাথে কথাবার্তা হলো?
মায়ের কথার জবাব না দিয়ে রাকিব থমথমে মুখে চেয়ে রয়। শায়লা বেগম ছেলের আঁধারে ঢাকা মুখপানে চেয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। বুঝে যান কিছু একটা তো হয়েছে। তাই আপাতত পছন্দের সিরিয়াল দেখার মায়া ত্যাগ করে টিভি বন্ধ করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। রাকিবের নিকট গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—কি হয়েছে, বাবা? ভালো করে বল নয়তো বুঝবো কি করে? আর চেহারার এই হাল বানিয়েছিস কেন? ও আবারো রিজে’ক্ট করেছে তোকে?
—মা! তোমায় মানা করেছি না? তবু বারবার রিজে’ক্ট এর কথা মনে করিয়ে দাও কেন?
—আচ্ছা আর বলবোনা। কিন্তু ওই মেয়েটার সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারছিনা! ফোনে এত শুনানোর পরেও ও তোকে মানা করার দুঃসাহস পাবে আমি ভাবতেও পারিনি। ওর মা তো ঠিকি মাথা নত করে রাখে আমাদের সামনে। অথচ মেয়েটাকে মানুষ করতে পারলোনা ঠিকমতো, চরম বেয়াদব হয়েছে একটা! আমার সোনার টুকরো ছেলেকে রিজেক্ট করে?
এরপর খানিকটা থেমে শায়লা একা একাই বিড়বিড়িয়ে বললেন,
—ও কি রিজেক্ট করবে তোকে? আরে আমরাই তো নেহাৎ ভালোমানুষি দেখিয়ে এত বড় বাড়ির মেয়েদের প্রস্তাব ছেড়ে ওর মতো মেয়েকে বিয়ে করাইতে চাইছিলাম! এখন ওদের আসল অবস্থান দেখাতে হবে। আমি এখনি পারভীনকে ফোন দিয়ে বলে দিচ্ছি আমরাই দোলাকে রিজেক্ট করলাম! আমার ছেলেকে অপমান করা হচ্ছে তাইনা? আমিও তবে দেখাবো এবার!
মায়ের কথাবার্তা শুনে রাকিব বাকা হাসে। মা ব্যাপক ক্ষে’পেছে৷ অর্থাৎ লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ের বাড়ি মারতে হবে। তাই ও আর সময় বিলম্ব না করে উদাসীন চেহারা বানিয়ে করুণ মুখে বললো,
—ও যে শুধু বেয়াদব তাই নয়, মা। মেয়েটা খুব খারাপ। উপর দিয়ে সহজ-সরল হওয়ার নাটক করে অথচ তলে তলে রা’স’লীলা করে বেড়ায়!
—মানে? কিসব বলছিস?
—আরেহ দোলার কথাই বলছি। ওকে দেখলে মনে হয়না কেমন ছিমছাম ছাপোষা মেয়ে? অথচ মাথাভর্তি চিকন বুদ্ধি! আমি গেলাম ওর সাথে বোঝাপড়া করে আমাদের সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য তাইনা? এটা কি কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো?
শায়লা বেগম নেতিবাচক মাথা নাড়ান। এটা মোটেও খারাপ কিছু নয়, বরং রাকিব যখন বললো ও দোলাকে সত্যিই পছন্দ করে তখনই তিনি নিজ থেকে ওকে ফোন করে ছেলের সাথে একবার কথা বলতে পাঠিয়েছেন, ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে নতুন একটা সুযোগ দেওয়ার চেস্টা করতেই তো এসব করা। অথচ এখন তার ছেলে এসব কি বলছে!
—কি হয়েছে ভালো করে বলতো, রাকিব। আমি কিন্তু তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছিনা। দোলা আবার চালাকির কি করলো? কিছু হয়েছে কি রেস্টুরেন্টে?
মায়ের উদ্বিগ্নতায় রাকিব মনে মনে হাসে। যেভাবে ভেবেছিলো সবকিছু সেদিকেই যাচ্ছে। তাই আর দেরি না করে ও আগেকার ন্যায় বলতে লাগে,
—বলছি তোমাদের ভাইজি একা যায়নি ওখানে। বরং সাথে নিজের প্রেমিককেও নিয়ে গিয়েছিলো। সেই ছেলে তো আবার গু’ন্ডা টাইপের। এলাকার মাস্তা’ন বোধহয়, বুঝোনা? আমাকে থ্রে’ট দিলো দোলার থেকে দূরে থাকতে। ওর আশেপাশে আমায় দেখলেও নাকি আমায় জা’নে মে’রে ফেলবে!
ছেলের কথায় শায়লা বেগম বেশ অবাক হন। দোলার মতোন মেয়ের আবার প্রেমিকও আছে? তাও সে ছেলে নাকি গু’ন্ডা-মা’স্তান? সুতরাং, কোনো রাখঢাক না করে সরাসরি তিনি ছেলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন,
—কি বলছিস এসব! তুই সত্যি বলছিস তো?
রাকিব বিরক্ত হয়। এত কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথাগুলো বললো অথচ ওর নিজের মা কিনা ওকে বিশ্বাস না করে এখন এমন বেহুদা প্রশ্ন করছে?
—মিথ্যা বলবো কেন? তোমার কি আমার উপর বিশ্বাস নেই? নাকি দোলার বাহ্যিক সরল রুপ দেখে তুমিও ওকে অন্ধবিশ্বাস করো আর সবার মতোন?
—না, তা বলছিনা। তবে ওকে দেখে আসলেই মনে হয়না ও এরকম প্রেম-ট্রেম করতে পারে। তাও ওর মতো সাদাসিধা কোনো ছেলের কথা বললে না হয় মানতে পারতাম। কিন্তু ডাইরেক্ট গু’ন্ডার সাথে প্রেম করছে ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে ক’ষ্ট হচ্ছে!
—থাক আর কষ্ট করে বিশ্বাস করতে হবেনা। তুমি না হয় সরাসরি প্রমাণ দেখেই বিশ্বাস করো! এই দ্যাখো, আমার গলায় হালকা লাল আং’গুলের ছাপ দেখছো? ওটা দোলার প্রেমিকের হাতের ছাপ! আমায় ওয়া’র্নিং দেওয়ার সময় গলা চে’পে ধরেছিলো!
শায়লা বেগম বিস্ময় চেপে ছেলের নিকট এগিয়ে আসেন। রাকিব শার্টের বোতাম খুলে গলার দিকে ফাকা করে, ড্রয়িংরুমের ঝলমলে আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ওর গলায় আংগুলের ছা’পগুলো। এবার শায়লার রাকিবের কথা বুঝতে ও বিশ্বাস করতে কোনোপ্রকার অসুবিধা হয়না! বরং, নিজ ছেলের প্রতি দোলার এহেন আচরণ ওর প্রতি ঘৃণায় উনার অন্তর বি’ষিয়ে দিলো। শায়লা হিস’হিসিয়ে বললেন,
—যে মেয়েকে নিয়ে এত বড় বড় কথা ওদের মায়ের, সেই মেয়ে যে ওর আড়ালে এসব করে বেড়াচ্ছে তা কি পারভীন জানে? ওদিকে, তোর বাপের আজকেই সিলেট যাওয়া লাগলো! বাসায় থাকলে তো তাকেও শুনাতাম তার আদরের ভাতিজির কু’কর্ম। ওদের দুই ভাই-বোনের মুখটা দেখার মতো হতো!
রাকিব কুটিল হাসে। তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব দেয়,
—জানলে কি আর অত গর্ব করতে পারতো? তার চেয়ে তুমি এক কাজ করো। বাবাকে পরে জানানো যাবে। তার চেয়ে তুমি বরং ফুপিকেই নিজ দায়িত্বে জানিয়ে দাও তার মেয়ের কীর্তিকালাপ সম্পর্কে!
রাকিবের কথায় শায়লা বেগম কিছু একটা ভাবলেন। উনার অন্তরে হিং’সা ও ক্রো’ধের আ’গুন জ্ব’লছে ক্রমশ। তিনি সহজে এই মা-মেয়েকে ছাড়ছেন না!
_____________________
পরদিন দুপুর। দোলার মা একে একে খাবার রেডি করছেন টেবিলে। দোলা রান্নায় সাহায্য করায় আপাতত ও গোসল সেড়ে এসে বসে আছে। কামিনি মায়ের সাহায্য করছে খাবার টেবিলে রাখায়। নিশীথকে তো আসতে বলেছে কিন্তু ও আদৌ আসবে কিনা দোলা পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। বস্তুত, কাল রাতে যেভাবে রাগ করে ফোন কে’টে দিলো তাতে দোলার মন বিচলিত হয়ে আছে।
পুরো বাড়ি হরেক রকম ভোজনের সুবাসে মৌ মৌ করছে। এর মাঝে শিমুলও গোসল সেড়ে বেরিয়ে এলো। ওর মাথায় এখনো টাওয়াল ঝুলছে। বুঝাই যাচ্ছে, খাবারের সুগন্ধেই ও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে এখানে। শিমুল চেয়ারে বসার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে বললো,
—ওয়াও! কত্তদিন পর পোলাও। আজ অবশেষে পেটভরে খাবো!
কিন্তু ও চেয়ারে বসার আগেই ওকে বাধা দিলো কামিনি। টাওয়াল সরিয়ে ওর কান মলে দিয়ে বলল,
—তাই না? আজ পেটভরে খাবি আর অন্যদিন বোধহয় না খেয়ে থাকিস তুই?
—উফফ, আপু। কান ছাড়ো লাগছে! মা, দেখো তো!
শিমুল প্রতিবাদ করে উঠলো। পারভীন বেগম ছেলেমেয়ের খুনসুটি দেখে হাসলেন। দুজনের উদ্দেশ্যে বললেন,
—তোরা থাম এখন। বাসায় মেহমান আসবে যেকোনো সময় আর তোরা কিনা ঝগড়া করছিস?
—মেহমান? শুধু নিশীথ ভাইয়াই তো আসবে!
শিমুল অবাক স্বরে শুধায়। পারভীন বেগম চোখ পাকিয়ে বলেন,
—তো ও কি মেহমান নয়? তুই আর তোর বোন না হয় চিনিস, আমাদের সাথে তো কোনোদিন দেখা হয়নি। সে হিসেবে তো ও মেহমানই হলো! আর নিশীথ আসার আগ পর্যন্ত কেউ খাবারের দিকে হাত বাড়াবিনা, মনে থাকে যেন!
শিমুল আর কথা বাড়ায় না। উদাস মুখে চুল মুছে বারান্দায় টাওয়াল নাড়তে চলে যায়। মূলত, সে বুঝতে পেরেছে নিশীথ না আসা অব্দি ওর কপালে খাবার জুটবেনা। এদিকে দোলার ফোনে টুং করে মেসেজ এলো। চকিত দৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই ও দেখলো নিশীথ বার্তা পাঠিয়েছে।
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে দেখা হচ্ছে! তুমি রেডি তো?”
দোলার কি হলো ও জানেনা। আচমকা বক্ষপিঞ্জরে কাপন ধরলো, হার্টবিট বেড়ে গেলো মুহূর্তেই। কই! নিশীথের সাথে তো আগেও কত দেখা হয়েছে। তবে আজ কেন এমন হচ্ছে? এরই মাঝে শিমুল বারান্দা থেকে চলে এলো। সবার উদ্দেশ্যে বললো,
—নিশীথ ভাইকে মাত্রই নিচে দেখলাম, মা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় আসবে!
পারভীন বেগম খুশি হলেন। মাথার কাপড় টেনে সোফায় বসে নিশীথের অপেক্ষা করতে লাগলেন। সকাল থেকেই শিমুলের মুখে ছেলেটার অনেক প্রশংসা শুনলেন তিনি। এদিকে দোলারও সাহায্য করেছে কালকে। ছেলেটাকে না দেখা অব্দি তিনিও শান্তি পাচ্ছিলেন না! এবার অপেক্ষা ঘুচলো তবে!
বাসার সকলে যখন নিশীথের জন্য অপেক্ষা করতে ব্যস্ত, এরই মাঝে কলিংবেল বেজে উঠলো জোরেশোরে। অর্থাৎ, অপেক্ষার প্রহর শেষ।
নিমন্ত্রণে সাড়া দিতে নিশীথ এসে গেছে!
#চলবে