প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_৭ জাওয়াদ জামী জামী

0
358

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৭
জাওয়াদ জামী জামী

বাড়ির গেইট পেরিয়ে উঠানে পা রাখল তাহমিদ। ও দুই হাতে রায়হান আহমেদকে ধরে রেখেছে।
বাড়ির উঠানে মানুষজন গিজগিজ করছে। উঠানের পূর্ব দিকে আম গাছের ছায়াতলে সামিয়ানা টাঙানো। সেখানে খাটিয়া রাখা হয়েছে।
খাটিয়া ঘিরে কয়েকজন মেয়ে কুরআন তিলাওয়াত করছে। এখানে সেখানে বসে কয়েকজন কাঁদছে।

রায়হান আহমেদকে দেখে এগিয়ে এলো দুইজন। তাহমিদ এখানকার কাউকেই চেনেনা, তাই বাধ্য হয়ে সেই অপরিচিত দুইজনের কাছেই সোপর্দ করল রায়হান আহমেদকে।
সেই দুই ব্যক্তি রায়হান আহমেদকে ধরে খাটিয়ার দিকে নিয়ে যায়। কেউ একজন এসে তাহমিদকে চেয়ার দিলে, তাহমিদ সেখানে বসল।

নায়লা আঞ্জুম বিরক্ত নিয়ে খাটিয়ার কাছে যায়। তার বরাবরই এসব ভালো লাগেনা। বিশেষ করে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে একটু দূরেই থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে সে। এখানকার কে বাঁচল কে ম’র’ল, তাতে তার কোন যায় আসেনা। তাই আইরিন পারভিনের মৃ’ত্যু’ও তার অন্তরে দাগ কা’ট’তে পারলনা। সে কপালে বিরক্তির ভাঁজ নিয়ে খাটিয়ায় রাখা লা’শে’র দিকে তাকিয়ে রইল।

কুহু কাঁদতে কাঁদতে বারবার জ্ঞান হারাচ্ছে। ওকে কেউ সামলাতে পারছেনা। সৃজন সেই কখন থেকে মা’য়ের পাশে বসে আছে। কখনো সে ডুকরে কেঁদে উঠছে, আবার কখনওবা মা’কে করুণ স্বরে ডাকছে। কিন্তু মা ওর কথা শুনলে তো।

চারপাশে কান্নার শব্দে বাড়ির বাতাস ভারি হয়ে গেছে। তাহমিদের বড্ড হাঁসফাঁস লাগছে। ও খাটিয়ার পাশে বসা ছেলেটির কান্না দেখেই বুঝতে পারছে, ছেলেটি রায়হান আহমেদের ভাতিজা। ছোট্ট ছেলেটির কান্না ও সহ্য করতে পারছেনা। বারবার ছেলেটির মাঝে নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছে।

চেয়ারে বসে নানান চিন্তা করছে তাহমিদ। ভাবছে এই ছেলেটা আর তার বোনের কি হবে। ওরা কয়েক মাসের ব্যবধানে বাবা-মা দুজনকেই হারাল! ভাগ্য কতটা নির্মম হলে মানুষের সাথে এমনটা ঘটে।

কারও কান্নার শব্দ শুনে সেদিকে তাকায় তাহমিদ। দুইজন মধ্যবয়সী নারী একটা কিশোরী মেয়েকে ধরে নিয়ে আসছে। উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারার কিশোরীর চোখ দুটো ফুলে আছে, দু-চোখ বেয়ে ঝরছে নোনাজল। কান্নার দমকে নাকের পাতা ফুলে ফুলে উঠছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সামান্য শক্তিও অবশিষ্ট নেই সেই কিশোরীর। হাঁটতে গেলেই পা দুলে উঠছে।
হ্যালা, পাতলা মেয়েটির উচ্চতাও কম নয়। হালকা সবুজ রংয়ের থ্রিপিস তার পরনে। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে রেখেছে।
কান্নারত মেয়েটিকে সামনে আসতে দেখেই আপনা-আপনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায় তাহমিদ।

নায়লা আঞ্জুম কিছুতেই গ্রামে থাকতে চাইছেনা। সে চাচ্ছে যত তারাতারি সম্ভব ও রাজশাহী ফিরে যাবে। কিন্তু রায়হান আহমেদের একটাই কথা সে অন্তত দুইটা দিন গ্রামে থাকবে। তার ছেলেমেয়েরাও এটাই চায়। আইরিন পারভিনকে দাফন করে বাড়িতে আসলেই নায়লা আঞ্জুম স্বামীকে বলল, সে রাজশাহী ফিরে যাবে। আর তখনই দুজনের বিতন্ডা বেঁধে যায়। তাহমিদ ওর খালার এমন স্বার্থপরতা দেখে ভিষণ রে’গে যায়। কিন্তু বাড়িতে আত্মীয় স্বজনরা থাকায় সে কিছু বলতে পারছেনা।

নায়লা আঞ্জুমের চেঁচামেচি শুনে কয়েকজন আত্মীয় ফিসফাস করছে। তাহমিদ সেটা ইশারায় রায়হান আহমেদকে বলে দেয়।
রায়হান আহমেদ রা’গে নায়লা আঞ্জুমকে হিড়হিড় করে টেনে একটা রুমে নিয়ে যায়।

” তোমার সমস্যা কি, নায়লা? একটা দিন এখানে থাকতে তোমার সমস্যা কোথায়? ” রায়হান আহমেদ রে’গে গেছেন।

” আমার সমস্যা কিছুই না। কিন্তু তোমার আদিখ্যেতা বেশি। যখন তোমার বড় ভাই মা’ রা গেল, তখনও তো এত আদিখ্যেতা করনি। তবে এখন কেন করছ? ”

” সেদিন ভুল করেছি বলে, আজও সেই একই ভুল করতে চাইনা। কান খুলে শুনে রাখ, আমি আগামী তিনদিন এখানেই থাকব। আমার ছেলেমেয়েরাও আমার সাথেই থাকবে। তোমার ভালো না লাগলে কাল সকালে চলে যাবে। তবে আজকে রাত তোমার এখানেই কাটাতে হবে। এটাই ফাইনাল। ”

” তুমি আমাকে অর্ডার দিচ্ছ? হাউ ডেয়ার ইউ? আমি তোমার নির্দেশ মেনে চলব! তুমি ভুলে যেওনা আমি কে। তাই আমাকে অর্ডার করার সাহস করোনা। ”

নায়লা আঞ্জুম কথা পুরোটা শেষ না করতেই রায়হান আহমেদের হাতে সপাটে থা’প্প’ড় খেয়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে থাকে।

” তুমি ভুলে যেওনা আমি কে। আমি যদি অযোগ্য কেউ হতাম, তোমার বাবা নিশ্চয়ই আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতনা। একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে রাখ, আমার পরিচয়েই তোমার পরিচয়। বাবার পরিচয়ে বোকারা নিজের পরিচিতি বাড়ায়। আমি এই মুহূর্তে আর একটাও কথা বলতে চাচ্ছিনা। তুমি আজ এখানে থাকবে এটাই ফাইনাল। এরপরও যদি একটা কথা বল, তবে এর পরিনতি খুব খারাপ হবে। আজকে আমার মন, মাথা সব খারাপ হয়ে আছে। ”

রায়হান আহমেদের গলায় এমন কিছু ছিল যা শুনে নায়লা আঞ্জুম ঘাবড়ে গেছে। তাই সে আর কোন কথা বাড়ায়না। রা’গে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বিছানায় গিয়ে বসল।

রায়হান আহমেদ উঠানে গিয়ে তাহমিদের পাশে বসল। তাহমিদ লক্ষ্য করল রায়হান আহমেদের মুখ শুকিয়ে গেছে। ও কিছু একটা বলতে গেলেই সেখানে উপস্থিত হয় সাইদ আহমেদ। সে-ও একটা চেয়ার টেনে বসল। দুই ভাইয়ের কারও মুখেই কোন কথা নেই। নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে গ্রাস করেছে। এভাবে বসে থাকতে তাহমিদেরও অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্তু আপাতত ওর কিছুই করার নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মুখ খুলল সাইদ আহমেদ।

” মেজো ভাই, কুহুর পরীক্ষার আর আটদিন আছে। এই অবস্থায় মেয়েটা কিভাবে পরীক্ষা দেবে! ওদের চিন্তায় আমার নিজেকে কেমন পা’গ’ল পা’গ’ল লাগছে।”

” কুহুকে বোঝাতে হবে। ওর পাশে ছায়া হয়ে আমাদেরকেই থাকতে হবে। ওদেরকে বোঝাতে হবে সকল প্রয়োজন, বিপদ-আপদে আমরা ওদের পাশে থাকব। আমি ভাবছি, পরীক্ষার পর কুহু, সৃজনকে আমার কাছে নিয়ে রাখব। সেখানেই এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নিবে। পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুই ওদের খেয়াল রাখিস। ”

দুই ভাইয়ের কথার মাঝে তাহমিদ থাকতে চাইলনা। তাই ও চেয়ার ছাড়ল। কিন্তু রায়হান আহমেদ ওকে অন্য কোথাও যেতে দিলনা। তাদের দুই ভাইয়ের আলোচনার সঙ্গী করল তাহমিদকে।

রাতে খাবার পর তাহমিদকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে সাইদ আহমেদ। তাহমিদের সাথে পরিচিত হবার পর ওর ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে গেছে সে। তাই দুজনের বন্ধুত্ব হতে দেরি লাগেনি।
তাই যখন সাইদ আহমেদ তাহমিদকে বাহিরে যাওয়ার কথা বলেছে, তাহমিদও না করেনি।

বাহিরে থেকে বাড়িতে এসে ঢুকতেই তাহমিদের চোখ যায় বারান্দায় মাদুরে বসে থাকা কুহুর দিকে। মেয়েটার দুইপাশে কয়েকজন মহিলা বসে আছে। রায়হান আহমেদও সেখানে বসে আছে। সে সৃজনকে জড়িয়ে রেখেছে। তাহমিদ বুঝল তারা সবাই দুই ভাইবোনকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। মেয়েটা কোন কথা না বলে চুপচাপ শুনছে।
তাহমিদের হঠাৎই অযাচিত তৃষ্ণা পেয়ে বসল। ও এই বাড়িতে আসবার পর থেকে কুহুর গলা শোনেনি। এই মুহূর্তে ওর কুহুর কথা শুনতে সাধ জাগছে। কিন্তু ও ভালোভাবেই জানে পরিবারের লোকজনের মাঝে গিয়ে কারও কথা শোনা শোভনীয় নয়। তাই সে সাইদ আহমেদকে ফোনে কথা বলার বাহানা দিয়ে বাহিরে যায়।

শাকিলা সুলতানা, সোহানী পারভিন, রায়হান আহমেদ আর সাইদ আহমেদ মিলে কুহু আর সৃজনকে অনেকভাবে বুঝায়। সেখানেই ভাইবোনের সামনে রায়হান আহমেদ জানায়, কুহুর পরীক্ষা শেষ হলেই সে ওদেরকে রাজশাহী নিয়ে যাবে। সৃজনকে সেখানেই ভর্তি করিয়ে দিবে।ভাইয়ের এমন সিদ্ধান্তে শাকিলা সুলতানা বেশ খুশি হয়েছেন। আবার সোহানী পারভিন এবং সাইদ আহমেদও অমত করেনা। সবার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে কুহুও সায় দেয়। ওর এই মুহূর্তে আর কিছুই করার নেই। আজকে চাচাদের এভাবে কাছে পেয়ে ও অনেকটাই ভরসা পেয়েছে।

রাতে তাহমিদ রায়হান আহমেদের সাথে এক রুমে শুয়েছে। নায়লা আঞ্জুম তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে এক রুমে শুয়েছে। রায়হান আহমেদ অনেক রাত পর্যন্ত তাহমিদের সাথে গল্প করল। এরপর সে ঘুমিয়ে গেলেও তাহমিদ জেগেই রইল। বেশ কিছুক্ষণ ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে। কিন্তু তবুও ঘুম আসেনা। এদিকে রাত তিনটা বেজে গেছে। কিন্তু ঘুম আসার কোনও লক্ষ্মণই নেই। তাই ও ফোন রেখে বাহিরে এসে দাঁড়ায়। উঠানের একপাশে কয়েকটা চেয়ার দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়।

আকাশে থালার মত চাঁদ রুপালি আলো ছড়াচ্ছে। দূরে কোথাও রাতজাগা পাখি তীক্ষ্ণস্বরে ডেকে উঠল। ঝিঁঝিঁর ডাকে কানে তালা লাগার জোগাড়। সুশীতল হাওয়া এসে থেকে থেকে ছুঁয়ে দিচ্ছে শরীর।
তাহমিদ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশ পানে। এমন নিস্তব্দ রাত, এই চাঁদ, সবাই ওর রাত জাগার সাথী। জীবনের কতশত রাত যে ও আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিয়েছে তা কেবল সে-ই জানে। এই রাত, এই চাঁদের মত তাহমিদও একা।

কোন কিছুর শব্দে ধ্যান ভাঙ্গে তাহমিদের। শব্দের উৎসের দিকে তাকাতেই দেখল সেই শ্যামবরণ কিশোরী গুটিসুটি মে’রে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে একইসাথে খেলা করছে ভয় এবং কৌতুহল।

” রিল্যাক্স, আমি তাহমিদ। রায়হান আহমেদ আমার খালু। আমি তার সাথেই এসেছি। ” তাহমিদ বুঝতে পারছে কুহু ওকে চেনেনা। তাই ও আগেভাগেই নিজের পরিচয় দেয়।

তাহমিদের কথা শুনেও কুহুর ভয় কাটলনা। ও ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।
তাহমিদ লক্ষ্য করল কুহু কাঁপছে। বেশি কথা বললে মেয়েটা নির্ঘাত চিৎকার দেবে। আর ও এই কাজটা করলে নিজের মানসম্মান কিছুই থাকবেনা। আর এই একটা চিৎকারে ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাবে এটাও বুঝতে পারছে। তাই তাহমিদ ভেতরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

” আপনি ভয় পাবেননা। আমি রুমে যাচ্ছি। ”

তাহমিদ সেখানে না দাঁড়িয়ে কুহুকে পাশ কাটিয়ে রুমের দিকে চলে যায়। তবে ও দরজা না লাগিয়ে একটা চেয়ারে বসে কুহুর দিকে নজর রাখে। এত রাতে মেয়েটাকে বাহিরে দেখে তাহমিদও ঘাবড়ে গেছে। আসলে ও একটু ভয় পাচ্ছে। মা’য়ের শোকে মেয়েটা না কিছু একটা করে বসে। তাই ও অতি সংগোপনে নজর রাখে কুহুর দিকে।

তাহমিদ ভেতরে যেতেই কুহু উঠানে নেমে সোজা কলপাড়ে যায়। কিছুক্ষণ পর অযু করে বেরিয়ে আসে। আজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করবে।

কুহু রুমে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে তাহমিদ। ওর দুচোখের পাতা ভারি হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই ঘুম যেন দু-চোখে তাদের রাজত্ব শুরু করেছে। যেন বহুকালের নির্ঘুম চোখ আজ একটু শান্তি চাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে না ঘুমালে ও বাঁচবেনা।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here