#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৮
জাওয়াদ জামী জামী
বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে আকাশপাতাল চিন্তায় মত্ত কুহু। ও বারবার তাহমিদের এহেন আচরণের কারন খুঁজে চলেছে। মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়েই তাহমিদের এমন অধিকারবোধ দেখে কুহু বিস্মিত। যদিও পরিচয়টা শুধু তেমনভাবেও হয়নি। কিন্তু কুহু এটা বুঝতে পেরেছে লোকটা মন্দ নয়। একটা মেয়েকে মাঝরাতে একা পেয়েও যে দুরত্ব বজায় রাখে, আর যাই হোক সে কখোনো খারাপ হতে পারেনা। কিন্তু কুহু ভয় পাচ্ছে, যদি চাচির চোখে এসব পরে যায়, তখন কি হবে! কিন্তু ও নিজেই কেন তাহমিদকে এড়িয়ে চলতে পারছেনা? হাজারো ভাবনার মাঝেই কুহু একসময় ঘুমিয়ে পরল। ওর আর উত্তর খুঁজে পাওয়া হলোনা।
পরদিন সকালে ড্রয়িংরুমে এসে কুহু বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। পুরো ড্রয়িংরুমের ফার্নিচার কয়েকজন মিলে কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। একপাশে নতুন ফার্নিচার রাখা হয়েছে। জানালা-দরজায় নতুন পর্দা লাগানো হয়েছে। ও একনজর চোখ বুলিয়ে রান্নাঘরে যায়।
তাহমিদও নিচে এসে অবাক হয়ে গেছে। হঠাৎ এমনভাবে বাসা সাজানোর কোন কারন খুঁজে পায়না ও। খালাকে জিজ্ঞেস করেও কিছুই জানতে পারলনা।
খাবার টেবিলে আসলে কুহু ওকে নাস্তা এগিয়ে দেয়। আজকে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হওয়ায় সবাই যে যার মত নাস্তা করে নিয়েছে।
” খালা, তোমরা খেয়েছ? ”
” আমি খাইছি, বাপজান। কিন্তু কুহু মা খায়নি। তার নাকি সকালে খাইতে ইচ্ছে করেনা। অনেকবার কইলাম, তবুও সে খাইলনা। ”
” তার খাওয়া লাগবেনা। আমার মনে হয় সে সন্যাসীনি। আর সন্যাসীদের না খেলেও চলে। আলো-বাতাসেই তাদের পেট ভরে যায়। তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ, আলো-বাতাস খেয়েছে কিনা। যদি না খেয়ে থাকে তবে তার জন্য আমি সেসবের ব্যবস্থা করব। এতটুকু উপকারতো আমি করতেই পারি। ”
” আবার শুরু হয়ে গেছে খোঁ’চা দেয়া! কুহু, কেন যে তুই এই লোকটাকে নাস্তা দিতে গেলি? তুই জানিসনা, এইটা খোঁ’চা কুমার? সে খোঁ’চা দেয়া ছাড়া কিছুই বলতে পারেনা। তুই আসলেই একটা গর্দভ। ” কুহু আনমনে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।
” গালি দেয়া শেষ হলে বসে নাস্তা করে নাও। সময় তোমার জন্য বসে নেই। ”
” আমার ক্ষুধা নেই। ” কুহু মনে মনে ভাবে, এই মানুষ বুঝল কেমন করে ও গালি দিচ্ছে!
” খালা, এই মেয়ে যেন আগামী তিনদিন খেতে না পায়। ও না খেয়ে নিজের চাচার পয়সা বাঁচাক। ”
তাহমিদের কথা শুনে রা’গে কুহুর পিত্তি জ্ব’লে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে তাহমিদকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু বরাবরের মতো কথারা কন্ঠায় এসে আটকে গেছে। তারপরও মুখ খুলল ও। কঠিন কথা না হোক, অনন্ত হালকা করে হলেও দুইটা কথা শোনাতে পারলে আপাতত শান্তি পাবে।
” তিনদিন না খেয়ে থাকতে পারব। এটা তেমন কিছুই নয়। একটু কষ্ট হলেও সহ্য করে নেব। ”
কুহুর কথা শুনে আপনাআপনিই তাহমিদের কপাল কুঁচকে আসে। ও মেয়েটাকে যতটা সরল ভেবেছিল, আদতেই যে মেয়েটা সেটা নয়, তা বুঝতে তাহমিদের দেরি হয়না। একে একটু শায়েস্তা না করলেই নয়।
” খালা, জয় যে কয়দিন এখানে আছে, সে কয়দিন তোমার এই ত্যাড়া মা তার সেবা করবে। আমি সিস্টারকে বলে দেব। ওকে এখনই জয়ের রুমে পাঠাও। জয়কে খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানো, ওর যাবতীয় কাজ যেন এই মেয়ে করে। আমি খালামনিকে বলে দিচ্ছি। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভেতর ধক করে উঠল। এই লোক বলে কি! ঐ উজবুকের সামনে গেলেই নির্ঘাত সে অসভ্যতা করবে। তার হাত-পা ভাঙ্গলে কি হবে! মুখ তো ঠিকই আছে। কুহু আর কিছু ভাবতে পারলনা। চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পরল। সামনে থাকা প্লেট নিজের দিকে এগিয়ে নিয়ে একটা পরোটা তুলে নেয়।
কুহুর কাজ দেখে তাহমিদ মৃদু হেসে খেতে থাকল। সোজা কথায় কাজ না হলে, মাঝেমধ্যে একটু ছলনার আশ্রয় নিলে ক্ষতি কি। ছলনা থেকে যদি ভালো কিছু হয়, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছলনাই শ্রেয়।
কুহু ধীরে ধীরে খাচ্ছে। ওর খেতেই ইচ্ছে করছেনা। কিন্তু সামনে বসে থাকা যমের ভয়ে কষ্ট করে খেতে হচ্ছে।
তাহমিদের খাওয়া হয়ে গেলে সে উঠে যায়। এরপর কুহুরও খাওয়া শেষ হয়।
কুহু খাওয়া শেষ করে নানিমার কাছে যায়। অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে বসে বৃদ্ধার কাছে। তার নাতির নামে বিচার দেয়।
” নানিমা, আপনার ঐ নাতিটা ভিষণ খারাপ। শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখায়। আমার ক্ষুধা না লাগলে কি করব, বলুনতো? তাকে দেখতে যতই নিস্পাপ লাগুকনা কেন, আদতেই সে বদের হাড্ডি। বাবুর মেজাজ সব সময়ই গরম থাকে। যাকে বলে মিলিটারির মেজাজ। এই মেজাজ নিয়ে শিক্ষকতা করে কেমন করে! ছাত্রছাত্রীদের না জানি কত নাকানিচুবানি খাওয়ায়! বেচারা স্টুডেন্টসদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে। অনেক পাপ করলেই তবে এমন শিক্ষক কারও ভাগ্যে জোটে। গোমড়ামুখোটাকে একদিনও হাসতে দেখলামনা। যেটা সবাই দেখতে চায়। কিন্তু কারো ভাগ্যে সেটা দেখা হয়না। অথচ তার ধমক কেউ শুনতে না চাইলেও ফ্রিতে সবাই সেটা পেয়ে যায়। ”
কুহু লক্ষ্য করল নানিমা এক হাত দিয়ে কিছু একটা ইশারা করছে। সে বারবার রুমের ব্যালকনির দিকে ইশারা করছে।
নানিমা কি দেখাচ্ছেন! কুহু কৌতুহলী হয়ে ব্যালকনির দিকে যায়। সেখানে হাসিমুখে বসে থাকা তাহমিদকে দেখে ওর পিলে চমকে গেছে। তাহমিদ ব্যঙ্গ হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
” আল্লাহরে! ভুল জায়গায় ঠিক কথা বলে ফেলেছি। কুহুরে, তুই আসলেই উচ্চ মাপের গা’ধী। ” কোনমতে কথাটা বলেই কুহু দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
কুহু চলে যেতেই তাহমিদ হো হো করে হেসে উঠল। ও খাবার পর নানিমার কাছে এসেছিল। তখনই একটা ফোন আসায় ব্যালকোনিতে যায়। তার কিছুক্ষণ পর রুমে কুহু আসে। আর তারপরই বেচারি ফেঁসে যায়।
তাহমিদ নানিমার কাছে এসে বসল। ও তখনো হেসেই চলেছে। আচ্ছা জব্দ করেছে ও মেয়েটাকে।
” বুঝলে নানিমা, আমার পাখিটা কিন্তু বেশ দুষ্টু। শুধু ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয়। বেশতো অভিযোগ করছিল। হঠাৎ করে ব্যালকনিতে গেল কেন! নিশ্চয়ই তুমি ইশারা করেছিলে? মোটেও ঠিক করনি। এই সুযোগে ওর মনের সব কথা আমি জেনে নিতাম। যেগুলো ও আমার জন্য মনেই জমা রেখেছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে নানিমাও হাসল।
” ভালো কথা, নানিমা। বাসায় আজ সাজ সাজ রব কেন? কি হতে চলেছে? তোমার দুই মেয়ে বাসা নতুন করে সাজিয়েছে। ”
বৃদ্ধা হাত নাড়িয়ে বললেন, তিনি কিছুই জানেননা।
বিকেলে কোচিং থেকে বের হতেই কুহু দেখল তাহমিদ কোচিংয়ের সামনে দোকানে বসে আছে। তাহমিদ কুহর দিকেই তাকিয়ে আছে। কুহু সেটা দেখেই চোখ নামায়।
” বাব্বাহ্, আজ ভদ্রলোক দোকানে কেন! ” নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করল কুহু।
তাহমিদ কুহুকে দেখে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। কেউ কোন কথা বলছেনা। কুহু ভয় পাচ্ছে সকালের ঘটনার জন্য। না জানি বদ লোকটা কখন কি বলে বসে।
কিন্তু কুহুকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ চুপ থাকে। ও চুপচাপ হাঁটছে। ওর পাশাপাশি হাঁটছে কুহু। যেন নীরবতাই ওদের দুজনের পথ নির্দেশ করছে। একজন আগে থেকে ঠিক করা গন্তব্যে হাঁটছে। তার পাশে অপরজন কোন দ্বিধা ছাড়াই হেঁটে চলেছে।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তাহমিদ রিক্সা নিল। কুহু আরেকবার অবাক হয়। ও চিন্তা করছে, রিক্সাই যখন নিবে, তখন আবার হাঁটলো কেন? কিন্তু মেয়েটাতো জানেনা, তাহমিদের খুব ইচ্ছে ছিল ওর পাশাপাশি হাঁটার। হাঁটার ফাঁকে আলতোকরে ওর হাত ছুঁয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা জন্মেছে তাহমিদের মনে।
তাহমিদ রিক্সাওয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বলল। কুহু কোন প্রশ্ন করলনা। তাহমিদের সিদ্ধান্তকে মনে মনে সায় দিল। প্রতিবারের মত তাহমিদ কুহুর পেছন দিয়ে হাত নিয়েছে। তবে আজ কুহুর ভেতর তেমন একটা জড়তা নেই।
ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে তাহমিদ বাদাম, পপকর্ন আর চকলেট নিল। কুহু এবারও চুপচাপ দেখে গেল।
ক্যাম্পাসের ভেতর এসে ফাঁকা জায়গা দেখে বসল তাহমিদ। ওর দেখাদেখি কুহুও বসল।
বাদামের প্যাকেট কুহুর দিকে বাড়িয়ে দিলে কুহু আপত্তি জানায়।
” বাদাম খেতে ভালো লাগেনা। ”
” কেন! ”
” ছিলতে বিরক্ত লাগে, তাই। ”
তাহমিদ কিছু না বলে কয়েকটা বাদাম ছিলে কুহুর দিকে এগিয়ে দেয়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে কুহু তাহমিদের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে চোখাচোখি হয় দুজনের। কুহু এখন পর্যন্ত ভালোভাবে তাহমিদের দিকে তাকায়নি। আজ হঠাৎই তাহমিদকে কাছ থেকে লক্ষ্য করল।
সরোবরের স্বচ্ছ পানির মত তার টলটলে চোখজোড়ায় বড্ড মায়া মেশানো। টিকোলো নাক, পুরুষ্টু কালচে খয়েরী ঠোঁট। চওড়া কপাল। কাঁচা হলুদের ন্যায় গাত্রবর্ণের তাহমিদকে সুপুরুষ বলাই যায়। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই কুহু চোখ নামিয়ে নিল। হঠাৎই সামনে বসা এই যুবকটিকে ওর কাছে বেশ আকর্ষনিয় মনে হচ্ছে।
কুহুকে মাথা নিচু করতে দেখে হাসল তাহমিদ। এতদিন পর মেয়েটা ওর দিকে সরাসরি তাকিয়েছে, ভাবতেই ভালো লাগছে।
” চোখ নামিয়ে নিলে যে? আমাকেও নাহয় দেখতে দিতে তোমার কাজল দীঘির ন্যায় গভীর চোখজোড়া। আমি আরেকবার ডুবতাম তোমার আঁখিপল্লবের ঝলকানিতে। ”
কুহু এবার বেশ লজ্জা পায়। ওর শ্যামলা চেহারায় লালচে আভা ফুটে উঠল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে লজ্জা নিরারণের মিছেই চেষ্টা করল। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে, তাহমিদ ওর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
তাহমিদ হঠাৎই হো হো করে হেসে উঠল। ওর হাসিতে প্রকম্পিত হল চারপাশ। বিকেলের আবছা আলোর রোশনাই ঝরে পরল ধরনীতে। আশেপাশের কয়েকজন মেয়ে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল তাহমিদের দিকে। এই সুযোগে কুহু আরেকবার তাকালো হাস্যরত মানুষটার দিকে। এই প্রথম লক্ষ্য করল তাহমিদের গজ দাঁতটি। কুহু মুগ্ধ হয়ে দেখছে মানুষটার হাসি। কাউকে হাসলে এত চমৎকার লাগে, এটা আজই প্রথম উপলব্ধি করল।
চলবে….