#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২০
জাওয়াদ জামী জামী
রিশা এতক্ষণ অবাক চোখে মিথিলা আরজুমান্দকে দেখছে। ও এতদিন অনেক কিছুই জানতনা, যেগুলো আজ জেনে গেছে। ও জানত ওর বড় খালামনি দেশের বাহিরে থাকে। স্বামীর সাথে তার বাকি দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। কিন্তু ও ঘুনাক্ষরেও জানতনা, ওর বড় খালামনি তাহমিদকে এভাবে ফেলে রেখে গেছে! নায়লা আঞ্জুম সব সময় ওদের বলেছে, মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তান নিয়ে সুইজারল্যান্ড থাকে। ও ভেবেছিল, বড় খালামনি এভাবে চলে যাওয়ায় তাহমিদ তার মা’য়ের ওপর রাগ করেছে। কিন্তু আজ ও এসব কি শুনল! হঠাৎই ওর মন বিদ্রোহ করে বসল। ড্রয়িংরুমে বসে থাকা ওর মা, খালামনিদের অসহ্য লাগতে শুরু করল। বিশেষ করে মিথিলা আরজুমান্দকে।
” ছিহ্ খালামনি, তুমি এমন কাজ কিভাবে করেছিলে? তোমার একবারও ভাইয়ার কথা মনে হয়নি! তোমার জন্য ভাইয়া এত কষ্ট পাচ্ছে। একজন মা হয়ে তুমি এমন কাজ করলে কিভাবে? ” রিশা আবেগের বশে কথাগুলো বলল।
মিথিলা আরজুমান্দ রিশার দিকে আহত চোখে তাকায়।
” রিশা, তোমার এতবড় সাহস, তুমি বড় আপার সাথে এভাবে কথা বলছ? বেয়াদব মেয়ে, আদবকায়দা ভুলে গেছ? ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।
” রিশা, তুমি আমার সাথে এস। আমরা রুমে যাই। এখানের সার্কাস দেখতে মোটেও ভালো লাগছেনা। যারা তাহমিদের মত ছেলের মূল্য দিতে জানেনা, তারা আবার মানুষের পর্যায়ে পরে নাকি! ” রায়হান আহমেদ স্ত্রী’র কথায় পাত্তা না দিয়ে, রিশাকে বললেন।
” আমি এখন রুমে যাবনা, বাবা। আমি ভাইয়ার কাছে যাব। এই দুঃসময়ে ভাইয়ার কাছে থাকা জরুরী। ”
” চল, আমরা দুজনেই তাহমিদের কাছে যাই। ” রায়হান আহমেদ মেয়েকে নিয়ে পা বাড়ালেন দোতলায়।
” দাঁড়াও, রায়হান। আমিও যাব তোমাদের সাথে। এখানকার অসুস্থ পরিবেশে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ” খালেদ হাসানও তাহমিদের রুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।
রায়হান আহমেদের সাথে নিশোও দোতলায় যায়।
মিথিলা আরজুমান্দ লজ্জায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। স্বামী- ছেলেমেয়েদের সামনে তাকে এভাবে লজ্জায় পরতে হবে, তা সে ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি।
মিথিলা আরজুমান্দের স্বামী নাহিদ সারোয়ার চোখ গরম করে স্ত্রী’র দিকে তাকিয়ে আছে। তাকে এত বছর পর প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে এসে এমন পরিস্থিতিতে পরতে হবে জানলে, সে কখনোই এখানে আসতনা।
নাহিয়া আর মিশাল অবাক চোখে ওদের মা’কে দেখছে। ওদের মা’য়ের এরূপ জঘন্য অতীত আছে সেটা ওরা ভাবতেই পারছেনা। এর জন্যও ওদের বাবাও যে দায়ী সেটা কিছুতেই ওরা মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছেনা। তাহমিদের কান্না ভেজা চোখ, অসহায় মুখ নাহিয়ার চোখের সামনে ভাসছে।
” ছিহ্ মম, তুমি এতটা জঘন্য! আমি জাস্ট ভাবতে পারছিনা। নিজের সুখের জন্য তুমি একটা পরিবার ভেঙে দিয়েছ! তুমি একটাবারও তোমার ছেলের কথা চিন্তা করোনি? এখনতো আমার মনে হচ্ছে, তোমার প্রয়োজনে তুমি আমাদেরও ছেড়ে যেতে পার। আই জাস্ট হেইট ইউ। এ্যান্ড সেইম অন ইউ, মম। ”
” নাহিয়া, মাই বেইবি, তুমি এভাবে বলোনা। তুমি আমার কলিজা। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আমার কিউটি বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ ব্যগ্র কন্ঠে বলতে থাকে।
” ভালোবাসা মাই ফুট। আমার মনে হয় তুমি কাউকে ভালোবাসতে জানোনা। তুমি শুধু নিজেকেই ভালোবাসতে জানো। যদি কাউকে ভালোবাসতে তবে ঐ ভাইয়াটাকে কষ্ট দিতে না। তার ক্রন্দনরত মুখটা দেখে আমার নিজের প্রতি ঘৃ’ণা হচ্ছে। আর পাপা, তুমিও কম যাওনা। একটা সংসার ভাঙার চিন্তা তুমি কিভাবে করতে পারলে? তুমি একবারও ঐ ভাইয়ার দিকটা ভাবতে পারনি! ”
” নাহিয়া সোনা, রিল্যাক্স। এত হাইপার হয়োনা, সোনা। এসো আমরা বসে কথা বলি। তুমি আমার কথা মন দিয়ে শোন, তাহলেই সব বুঝতে পারবে। ” নাহিদ সারোয়ার তার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।
” নো পাপা, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং রাইট নাও। বোথ অফ ইউ আর কালপ্রিট। আই ওয়ান্ট টু গো ব্যাক টু সুইজারল্যান্ড রাইট নাও। তোমরা যদি না যাও, তবে আমি একাই চলে যেতে পারব। ”
নাহিদ সারোয়ার বুঝতে পারছে তার মেয়ে এখন কোন কথা শোনার অবস্থায় নেই। পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে গেছে। সে মিথিলা আরজুমান্দের দিকে তাকিয়ে বলল,
” মিথিলা, রেডি হয়ে নাও। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হব। নাহিয়া সোনা তুমিও রেডি হয়। আর মিশাল তুমিও। ”
মিথিলা আরজুমান্দ মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরল। এতদিন পর তাকে অতীতের তিক্ত পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে হবে তা সে ভাবতেই পারেনি।
তাহমিদ কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল। এরপর উঠে আবার ব্যাগ হাতে নিল।
” খালা, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব ঠিকই, কিন্তু এখনই রাজশাহী ছাড়ছিনা। জয় রাজশাহী থেকে গেলেই তবে আমিও ঢাকা ফিরব। তুমি এই কয়টা দিন একটু সামলে নিও। বাসার বাহিরে কুহুর সকল বিষয় আমি দেখব, সে আমি যেখানেই থাকিনা কেন। ” থমথমে গলায় বলল তাহমিদ।
” আমি তোমার মত কইরা পরিস্থিতি সামলাইতে পারবনা, বাপজান। এতিম মাইয়াডা তুমি না থাকলে ভাইসা যাইব। রায়হান ভাই যতই চেষ্টা করুক, নায়লার হাত থাইকা তারে তুমিই পারবা রক্ষা করতে। তুমি এই বাড়ি ছাইড়না। তুমি চইলা গেলে তোমার নানিমা ম’ই’রা যাইব। হেই মানুষটা তোমার মুখ চাইয়া, আর তার পোলাডারে দেখবার লাইগাই বাঁইচা আছে। তুমি এইভাবে যাইওনা, বাপজান। ” রাজিয়া খালা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
তাহমিদ নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত। এদিকে রাজিয়া খালার কান্না ওর বুকের ভেতর তোলপাড় করছে। এই মানুষটার চোখের পানি ও সইতে পারেনা।
” ভাইয়া, তুমি সত্যিই চলে যাবে? যেওনা, ভাইয়া। তুমি চলে গেলে আমরা একা হয়ে যাব। ” রিশা দৌড়ে এসে তাহমিদের হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নিল।
তাহমিদ সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর দুই খালু রুমে এসে দাঁড়িয়েছেন।
” তাহমিদ, তুমি এভাবে হুটহাট কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। রা’গ কখনো কারো ভালো করতে পারেনা। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেয়ার ঠান্ডা মাথায় নিও। ” রায়হান আহমেদ সস্নেহে বললেন। খালেদ হাসান মাথা নাড়িয়ে রায়হান আহমেদের কথায় সায় দিলেন।
নিশোও এসে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরল। সকলের এমন আকুতি হেলায় ঠেলতে পারলনা।
” ঠিক আছে। আমি কোথাও যাচ্ছিনা। তবে ঐ ভদ্রমহিলা যতক্ষণ এই বাসায় আছে, ততক্ষণ আমি এখানে থাকছিনা। সে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলে, তুমি আমাকে জানিয়ে দিও, খালা। ”
তাহমিদ আর এক সেকেন্ডও রুমে দাঁড়ালনা। দৃঢ় পায়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
ড্রয়িংরুমের সকলে তাহমিদকে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ তাদের দিকে একবারও না তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
মিথিলা আরজুমান্দ ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। সেদিনের সেই ছোট্ট ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে! কত সুদর্শন হয়েছে সে! কিন্তু একটিবারও তার ছেলে তাকে মা বলে ডাকলনা, এই আফসোস তার আজীবন থেকে যাবে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পর মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে করে নিয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস আর ছেলের ঘৃ’ণা।
রাত তিনটা দশ। তাহমিদ এখনো বাসায় ফেরেনি। রাজিয়া খালা তাকে ফোন করে মিথিলা আরজুমান্দ চলে গেছে সেইটা জানিয়েছেন। কিন্তু তাহমিদের বাসায় ফেরার নাম নেই। কুহু আর খালা অস্থির চিত্তে ড্রয়িংরুমে বসে তাহমিদের অপেক্ষা করছে। খালা কয়েকবার ওকে ফোন করলেও তাহমিদ আর ফোন রিসিভ করেনি।
আরও দশ মিনিট পর কলিং বেল বাজলে কুহু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। ওর মধ্যে এই মুহূর্তে ভয়ের কোনও অস্তিত্ব নেই। তাহমিদকে দেখবার জন্য ওর মন কেমন করছে। বিকেলে মানুষটার চুপসানো মুখ দেখে ওর ভিষণই কষ্ট হচ্ছিল।
দরজা খুলে দিতেই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা তাহমিদকে দেখে কুহুর বুকের ভেতর তোলপাড় হতে থাকে। মানুষটা এক নজর কুহুর দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করেছে। এই কয়েক সেকেন্ডেই কুহু তাহমিদের লাল চোখদুটো দেখতে পেয়েছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গায়ে থাকা টি-শার্টে ধুলোবালি লেগে আছে। প্যান্টেও তাই। কুহু একপাশে সরে দাঁড়ালে তাহমিদ ভেতরে ঢুকে সোজা ওপরে যেতে চাইলে খালা ওকে ডাক দেয়।
” বাপজান, তুমি মুখহাত ধুইয়া আস, আমি খাবার গরম করতাছি। ”
” আমি খাবনা, খালা। ”
” আমি আর কুহু মা’য় তোমার জন্য অপেক্ষা করতাছি। আমরাও খাই নাই। তারে অনেক বইলাও আমি খাওয়াইতে পারিনি। সে আমার কথা শুনলইনা। তার একটাই কথা, তুমি না খাইলে সে-ও খাবেনা। ”
তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখল মেয়েটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
” তোমার সাথে সাথে দেখছি এই মেয়েটাও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শিখে গেছে! মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার মোক্ষম হাতিয়ার তার কাছে আছে। সে ভালো করেই জানে দুনিয়ার সবাইকে ইগনোর করলেও, আমি তাকে ইগনোর করতে পারবনা। এই মেয়ে ক্রিয়ার বিপরীত ক্রিয়ায় বিশ্বাসী। সে প্রতিক্রিয়া দেখতে ভালোবাসে। তাই সে না খেয়ে আছে এত রাত রাত পর্যন্ত। আর আমিও অসহায় মানুষ সর্বদাই তার ফাঁদে পা দিতে একপায়ে রাজী। খাবার গরম কর আমি দশ মিনিটেই আসছি। ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। ও ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। কেন যে খালা ঐ খোঁ’চা কুমারের সামনে কথাটা বলতে গেল!
তবে তাহমিদকে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে দেখে খালা ও কুহু দুজনেই হাঁফ ছাড়ল।
চলবে….