প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_২১ জাওয়াদ জামী জামী

0
217

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২১
জাওয়াদ জামী জামী

মিথিলা আরজুমান্দ স্বামী-সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় একটা পাঁচতারকা হোটেলে উঠেছে। নাহিয়া ঘৃ’ণা’য় বাবা-মা’ র দিকে তাকাচ্ছেনা।

” নাহিয়া বেইবি ,তুমি এভাবে আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুড়িয়ে রেখনা। আমি তোমাকে এভাবে দেখতে পারছিনা। কথা বল বেইবি। ” মিথিলা আরজুমান্দ মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে।

” শ্যাটআপ, মম। তোমার এমন কথা আমি জাস্ট নিতে পারছিনা। তোমার কথাকে আমার ন্যাকামো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমার সব অভিনয়। একটা কথা বলতো, এতদিন ধরে তুমি তোমার প্রথম সন্তানকে একদিনও মনে করনি? কি করে পেরেছ, তাকে না দেখে থাকতে! ” নাহিয়া মা’য়ের সঙ্গে ঘৃণাভরে কথা বলছে।

” আমার জীবনে তোমাদের মূল্য সবথেকে বেশি। তাই কারও কথা ভাবার সময় আমি পাইনি। তোমরাই আমার কাছে সব। আব্বার কথায় বিয়ে করেছিলাম রাশেদ কুরাইশিকে। তার অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির কমতি ছিলনা। একসময় আমার কোলজুড়ে সন্তানও আসল। ও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। একসময় বুঝতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির মন সংসার থেকে উঠে গেছে। একদিন জানতে পারলাম, রাশেদ কুরাইশির তার সেক্রেটারির সাথে সম্পর্ক চলছে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করায়, সে অস্বীকার করল। আমিও আর কথা বাড়াইনি। একদিন তাহমিদকে নিয়ে শপিংয়ে গিয়ে তোমার পাপার সাথে পরিচয়। সেই পরিচয় পরিনয়ে গড়াতে সময় লাগেনি। ধীরে ধীরে রাশেদ কুরাইশির সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। একদিন সময় বুঝে কুরাইশি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি তোমার পাপার কাছে। এর দুইমাস পর চলে যাই সুইজারল্যান্ড। ”

” কি করে পেরেছ, সন্তানকে রেখে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে? একবারও কি ঐ ভাইয়াটার চেহারা তোমার চোখে ভাসেনি? এখানে পাপাও সমান দোষী। সে চাইলেই পারত একটা সংসারকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে। কি করে পারলে! ”

” আমার কাছে তোমার পাপাই সব ছিল। আমার তখন অন্য কারো কথা ভাববার অবকাশ ছিলনা। এরপর আমার জীবনে তুমি আসলে। আমি আমার দুনিয়ায় ব্যস্ত হয়ে পরলাম। তোমার পাপাও আমাকে অন্যকাউকে মনে করার সুযোগই দেয়নি। তাই তাহমিদকে আমার একটা দিনের জন্যও মনে পরেনি। আমি জানতাম ও সুখে আছে। ইভেন গতকাল পর্যন্তও আমি ওকে মনে করিনি। আমি তাহমিদের জন্য দেশে আসিনি, এসেছি তোমার নানুকে দেখতে। দেশে আসার আগে জানতে পেরেছি তাহমিদ রাজশাহীতে আছে। তখনই শুধু মনে হয়েছে ওকে আমি একবার দেখতে পাব। আশা করছি তোমার উত্তর পেয়ে গেছ। ”

নাহিয়া অবাক হয়ে মিথিলা আরজুমান্দদের দিকে তাকিয়ে আছে। ও ভাবছে, কোনও মা আদৌ কি সন্তানকে না দেখে থাকতে পারে! কতটা পাষাণ হলে মানুষ এমন করতে পারে!

” এখন যদি তোমার অন্য কাউকে ভালো লাগে, কিংবা পাপার অন্য কোন মেয়েকে পছন্দ হয়, তবে কি তোমরা আলাদা হয়ে যাবে? আমাদের কথা মনে করবেনা নিশ্চয়ই? ”

” এসব কি বলছ, সোনা? তুমি আমাদের প্রিন্সেস। আমাদের ভালোবাসার ফল। তোমাকে, মিশালকে ছেড়ে যাবার কথা আমরা কল্পনাই করতে পারিনা। শান্ত হও বেইবি। তুমি আমার কথা একটু বুঝতে চেষ্টা কর। এত হাইপার হলে তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। ”

” আমি কিভাবে শান্ত হই, মম! তোমাদের করা অন্যায়ের কথা মনে হলেই আমার বুকে ঘৃণারা আছড়ে পরছে। বারবার ঐ ভাইয়াটার কান্না ভেজা চোখদুটো চোখে ভাসছে। একটা নয় বছরের ছেলে মা’কে ছাড়া কতটা অসহায় তার কথা শুনে আমি বুঝতে পারছি। আমি তার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করে, নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিনা। সে তাহলে কিভাবে জীবনের এতটাদিন কাটিয়েছে, ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে। মা ছাড়া একটা সন্তান যে কতটা অসহায়, সেটা তুমি দুইদিনের জন্য বাহিরে গেলে আমি বুঝতে পারি। তবে আজ আমার মনে হচ্ছে, তুমি ভিষণই স্বার্থপর একজন মানুষ। নিজের সুখের জন্য সংসার ছেড়েছিলে, আবার নতুন সংসারে গিয়ে সেই পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছ। আমাদের সাথে দাদু বাড়ির সম্পর্ক রাখতে দাওনি। দেশে এসে দাদুর বাড়িতে না গিয়ে উঠেছিলে হোটেলে। আবার আজকেও সেটাই করলে। আর পাপাও তোমাকে অন্ধের মত সাপোর্ট দিয়ে গেছে। যাহোক আমি আর কথা বাড়াতে চাচ্ছিনা। তোমার নিজের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তুমি নিতেই পার। আর আমিও পারি নিজেকে একটু ভালো রাখতে। তাই এখন থেকে সেই চেষ্টাই করব। আমি সুইজারল্যান্ড ফিরে হোস্টেলে উঠব। সেখান থেকেই পড়াশোনা করব। এবং এটাই ফাইনাল। ”

” নাহিয়া সোনা, তুমি এসব কি বলছ! আমরা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবনা। তুমি আমাদের চোখের মনি। ” নাহিদ সারোয়ার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করছে।

” বাসায় থাকলেই তোমাদেরকে দেখতে হবে। আর যতবারই তোমাদের দেখব, ততবারই এক অসহায় সন্তানের হাহাকার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। যেটা আমি সহ্য করতে পারবনা। তাই আশা করছি তোমরা আমাকে কোন বাঁধা দেবেনা। ”

নাহিদ সারোয়ার এবং মিথিলা আরজুমান্দ দুজন দু’জনের দিকে তাকায়। তারা বুঝতে পারছে তাদের মেয়ে এই মুহুর্তে তাদের কোন কথা শুনবেনা। তাই তারা আপাতত চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। একবার সুইজারল্যান্ড যেতে পারলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মেয়েকে বোঝাতে পারবে।

সকাল থেকে তাহমিদ রুম থেকে বের হয়নি। সকালে নাস্তা করবার জন্য রাজিয়া খালা কয়েকবার ওকে ডাকতে এসেছিলেন। কিন্তু তাহমিদ যায়নি।

বেলা এগারোটার দিকে খালা আরেকবার ওকে ডাকতে আসলেন।

” বাপজান, চল খাইবা। সবার খাওয়া শেষ। এখন তুমি খাইলেই আমরা খাইতে পারি। আর দেরি কইরোনা, বাপজান। ” খালার দরদ মাখা কথা শুনে তাহমিদ আর শুয়ে থাকতে পারলনা। ও উঠে বসল।

” খালা, তুমি যাও। আমি আসছি। টেবিলে তিনজনের খাবার দিও। তোমার সাথে সাথে নিশ্চয়ই সেই মেয়েও খায়নি? তোমরা দেখছি আমাকে ব্ল্যাকমেইলের ওপরই রাখবে। আমার সকাল হবে ব্ল্যাকমেইলের নাস্তা করে, রাত হবে ব্ল্যাকমেইলের ডিনার করে। ভাবা যায়! জীবনটাই ব্ল্যাকমেইলময়। ”

” আর কথা কইওনা। নিচে আস, আমি খাবার দিতাছি। খাওয়ার পর তোমার নানিমার কাছে যাইবা। হেয় কাইল থাকা খালি কানতাছে। ”

” আচ্ছা, খালা। ” তাহমিদ আর কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢুকল।

তাহমিদ খাবার টেবিলে আসলে কুহু গরম ভাতের প্লেট এগিয়ে দেয় ওর দিকে।

” খালা, তোমরা খাবেনা? জলদি এস। ”

” তুমি খাও, বাপজান। আমি হাতের কাজ কইরাই খাব। কুহু মা, তুমিও বাপজানের সাথে খাইয়া লও। ”

” না খালা, আমি আপনারই খাব। ”

তাহমিদ কিছু না বলে শুটকি ভর্তা দিয়ে ভাত মেখে এক লোকমা ভাত কুহুর মুখের দিকে ধরে।
তাহমিদের এমন কাজে কুহু চরম বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকে।

” খাবে? নাকি আমি প্লেট রেখে উঠে যাব? সিদ্ধান্ত তোমার। ”

কুহু আঁড়চোখে তাকায় ড্রয়িংরুমের চারপাশে। সেখানে কাউকে না দেখে, একটু ইতস্তত করে খাবার মুখে নেয়।

রাজিয়া খালা দৃশ্যটা দেখে স্বস্তির হাসি হাসলেন।

কুহু এক লোকমা ভাত মুখে নিয়েই রান্নাঘরে চলে যায়। চুপচাপ খালার পেছনে সেঁধিয়ে থাকে। লোকটা বারবার ওকে লজ্জায় ফেলে দেয়। সে যেমন নিজের অনুভূতি লুকায়না, তেমনি কুহুর অনুভূতিও টেনে বের করতে ওস্তাদ।

” নানিমা, তুমি কালকের সব ঘটনা শুনেছ? তোমার বড় মেয়ে উনিশ বছর পর মাতৃত্বের দাবী নিয়ে এসেছে। অথচ যে একটা সময় আমাকে ছেড়ে যেতে দু’বার ভাবেনি। তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছ, নানিমা? কষ্ট পেয়েছ তোমার মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেছি জন্য? কষ্ট পেলে আমাকে জানিয়ে দিও, আমি এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। ” তাহমিদের চোখের কোনে চিকচিক করছে দুঃখের অশ্রু। সে খাওয়া শেষ করেই নানিমার কাছে এসেছে।

তাহমিদের কথা শুনে বৃদ্ধা তার একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন। তাহমিদ তার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতেই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। এক হাত দিয়ে তাহমিদকে নিজের কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করছেন। তাহমিদ তার দিকে এগিয়ে গেলে তিনি একহাতে ওকে জড়িয়ে নিলেন।

কুহু কোচিং-এ যাবার সময় আশেপাশে তাহমিদকে দেখলনা। আজ সারাদিন মানুষটা বাসা থেকে বের হয়নি। সে এখনো রুমেই আছে। কুহুর বুক চিঁড়ে আপনাআপনি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসল। ও একনজর দোতলায় তাকিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।

কোচিং শেষ করে বেরিয়ে আসতেই, তাহমিদকে সামনের দোকানে বসে থাকতে দেখল কুহু। সে উদাস নয়নে সূদুরে তাকিয়ে আছে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনও খেয়াল নেই। কুহু বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু তাহমিদ ওকে লক্ষ্যই করলনা। বাধ্য হয়ে কুহু মৃদু পায়ে এগিয়ে আসে।

তাহমিদের সামনে এসে দাঁড়ালেও সে কুহুকে লক্ষ্য করলনা। এবার কুহু অবাক হয়। মানুষটা সেই কখন থেকে কিছু একটা ভেবেই চলেছে। তার মন-মস্তিস্কে চিন্তার ঝড় বইছে, সেটা কুহু বুঝতে পারছে। কিন্তু ও কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাহমিদকে এবার ডাকতেই হবে। ও তাহমিদকে কিভাবে ডাকবে সেই চিন্তাই করছে।

” এই যে মহাশয়? কোথায় হারালেন? আমি অনেকক্ষণ ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ” সাহস করে কুহু কথা বলল।

হঠাৎ কারো আওয়াজ পেয়ে চমকে তাকায় তাহমিদ। সামনে দাঁড়ানো কুহুকে দেখে স্মিথ হেসে উঠে দাঁড়ায়। একটা ফাঁকা রিক্সা ডেকে উঠে বসল।

আজও ও কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। একটু ফাঁকামত জায়গা দেখে কুহুকে নিয়ে বসল। কুহু জড়োসড়ো হয়ে বসতেই, তাহমিদ ঘাসের ওপর সটান হয়ে শুয়ে পরল।

” আজকে শুধু বাদাম কিনেছি। প্যাকেট খুলে দেখ সবগুলো বাদাম ছিলে রেখেছি। তুমি চুপচাপ এগুলো খাও। এই সুযোগে আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। খবরদার আমাকে ডাকবেনা বলে দিলাম। আমাকে ডেকেছ তো ফেঁসেছ। তোমাকে ক্যাম্পাসে রেখে আমি বাসায় চলে যাব। সময় না কাটলে আমার ফোনে টিকটক দেখতে পার। ” কথাগুলো বলেই চোখ বুজল তাহমিদ। অবশ্য তার আগে নিজের ফোন পকেট থেকে বের করে কুহুর দিকে এগিয়ে দিয়েছে।

কুহু তাহমিদের এমন বেপেরোয়া কথা শুনে মুখ বাঁকায়। তাহমিদের চোখ বন্ধ দেখে ও কিছু বলার ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে বাদামের প্যাকেট খুলল।

মাগরিবের আজান দিয়েছে। কুহু এবার উসখুস করছে। আজ চাচি ওকে ছাড়বেনা। কিন্তু কুহু হঠাৎ করেই অনুভব করল আজ ও চাচিকে মোটেও ভয় পাচ্ছেনা। তাহমিদের দিকে চোখ পরতেই দেখল মানুষটা প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছে। তাই তাকে ডাকতে কুহুর মন সায় দিলনা। ও গত এক ঘন্টায় বাদামগুলো খেয়ে নিয়েছে। সেই সাথে একক আধিপত্য খাটাচ্ছে তাহমিদের ফোনে।

আরও পনের মিনিট পর তাহমিদের ঘুম ভাঙ্গলো। ও হাই তুলে উঠে বসল। সামনে বসা মেয়েটার দিকে তাকাতেই আপনাআপনি ঠোঁটের কোন প্রসারিত হল।

” বাসায় যাবেনা নাকি এখানেই সংসার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছ? ”

তাহমিদের কথা শুনে বিরক্ত হয় কুহু। এ কেমনধারা কথা বলছে লোকটা! সে-ই আমাকে অপেক্ষা করতে বলে, উল্টো আমাকেই খোঁ’চা দিচ্ছে!

” তারাতারি বাসায় চলুন। আমি চাচিকে নিয়ে চিন্তা করছি। আজ আমার কপালে কি আছে আল্লাহই জানেন। ”

” তোমার কপালে আমার আদর বৈ কিছুই নেই। বুঝলে মেয়ে তোমার কপালে তাহমিদের রাজত্ব শুরু হয়েছে অনেকদিন আগেই। ”

” ছিহ্। অসভ্য লোক খালি আজেবাজে কথা বলে! ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ নিরবে হাসল। ও কুহুর কথার উত্তর না দিয়েই সামনে হাঁটতে থাকে। কুহুও বাধ্য মেয়ের মত ওর পিছু নেয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here