#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২২
জাওয়াদ জামী জামী
গত কয়েকদিনের ন্যায় আজ কুহু রিক্সায় জড়োসড়ো হয়ে বসলনা। তাহমিদ আজ ওর মধ্যে কোন জড়তা না দেখে গোপনে হাসল। তবে ও কুহুর পেছন দিয়ে রিক্সায় হাত রাখতে ভুললনা।
প্রায় আধাঘন্টা পর ওদের রিক্সা বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। কুহুর হঠাৎ করেই ভয় লাগতে শুরু করল। অন্যদিনের মত আজ তাহমিদ ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলনা। বাসার ভেতর ঢুকে কিসের সম্মুখীন হবে, সেটা ভাবতেই কুহুর গলা শুকিয়ে আসছে। ওর দু’পা যেন মাটির সাথে সেঁটে গিয়েছে।
” কি হলো, বাসায় না গিয়ে এখানে ল্যাম্পপোষ্টের মত দাঁড়িয়ে রইলে কেন? নাকি মহল্লার মানুষদের আলো দেয়ার সাধ জেগেছে? তবে তুমি থাক, আমি ভেতরে গেলাম। ” তাহমিদ কথাটা বলেই বাসার দিকে পা বাড়ায়।
তাহমিদের রুদ্রমূর্তি দেখে কুহুর কথা বাড়ানোর সাহস হয়না। ও তাহমিদের পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। আর মনে মনে দোয়া-দরুদ পাঠ করতে থাকে।
বাসায় ঢুকতেই ড্রয়িংরুমে রায়হান আহমেদকে বসে থাকতে দেখল কুহু। তার পাশে নায়লা আঞ্জুমও বসে আছে।
কুহুকে তাহমিদের সাথে দেখে কুটিল চোখে তাকায় নায়লা আঞ্জুম। সে কুহুকে কঠিন কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়। কিন্তু তার আগেই কথা বললেন রায়হান আহমেদ।
” কুহু মা, তুই এতক্ষণ কোথায় ছিলি? আমি চিন্তায় পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছিলাম। ফোন নিয়ে যাসনি কেন? আর তাহমিদের সাথে কোথায় দেখা হয়েছে তোর? ” রায়হান আহমেদের গলায় নিখাঁদ উদ্বেগ।
” চাচা, আমি…. কুহু কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদ কথা বলল,
” তালুকদার সাহেব, ও কোচিং থেকে বেরিয়ে সম্ভবত রিক্সার অপেক্ষায় ছিল, আমিও তখন সেখান দিয়েই আসছিলাম। ওকে দেখে ভাবলাম, আমিও বাসায় যাচ্ছি, ওকেও নিয়ে যাই। তো আসার পথে আমার একটা কাজ পরে যায়। আর আমার কাজের জন্যই বাসায় আসতে দেরি হয়েছে। ”
কুহু হা করে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা অনায়াসে যা ইচ্ছে তাই বলল, কোন বিকার নেই তার চেহারায়!
” ওহ্ বুঝেছি। রুমে যা, মা। ভালোই হয়েছে তাহমিদের সাথে এসেছিস। তবে এরপর বাহিরে গেলে ফোন নিতে ভুলবিনা। ”
” ঠিক আছে, চাচা। ” কুহু আর সেখানে দাঁড়ায়না।
পরদিন সকালে শায়লা হাসান স্বামী-সন্তান নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। জয়কে বাসা থেকে বেড়োতে দেখে কুহু হাঁফ ছাড়ল। তবে যাওয়ার আগে জয় ওকে চোখের ইশারায় কিছু বলে গেল, যা কুহুর বোধগম্য হয়না। যেটা তাহমিদের নজর এড়ায়নি এবং ও জয় কি বলতে চেয়েছে, তা ঠিকই বুঝেছে।
সেদিন বিকেলে কোচিং থেকে বেরিয়ে কুহু বরাবরের মতো তাহমিদকে দেখতে পায়। আজকেও তাহমিদ কুহুকে নিয়ে ক্যাম্পাসে এসেছে। আজও তাহমিদ বাদাম ছিলে রেখেছে। যা দেখে কুহু হাসল।
” যখন-তখন এভাবে হেসে আমাকে খু’ন করার মতলব এঁটেছ, মেয়ে! তুমি কি জানো তোমার হাসিতে আমি খেই হারিয়ে ফেলি? ওলট-পালট হয় আমার পুরো দুনিয়া? নাকি আমাকে ঘায়েল করতেই এই মোক্ষম অস্ত্রের ব্যবহার কর! ”
কুহু তাহমিদের কথা নীরবে শুনে যায়। ও কি উত্তর দেবে! এই মানুষটার সামনে আসলেই ওর সাথে কথারা বেইমানী করে। তারা ঘাপটি মেরে বসে থাকে কন্ঠায়। চেপে ধরে রাখে ওর কন্ঠ নালী।
কুহুকে নীরব থাকতে দেখে আবারও মুখ খুলল তাহমিদ।
” আজ রাতেই আমি ঢাকায় ফিরছি। আগামী দেড়মাস এমুখো হতে পারবনা। এরইমধ্যে তোমার এডমিশনও হয়ে যাবে। এই কয়দিন তুমি রিক্সায় যাতায়াত করবে। আমি রিক্সা ঠিক করে রেখেছি। প্রতিদিন সময় মত রিক্সাওয়ালা চাচা এসে তোমাকে নিয়ে যাবে, আবার বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ধাক্কা খেল।
” আজকেই চলে যাবেন! ”
” হুম। অনেকদিন ছুটি কাটালাম, আর কত? এত ছুটি কাটাতে গিয়ে চাকরিটা চলে গেলে, অভিভাবকরা কি তাদের মেয়েকে কোন বেকার ছেলের হাতে তুলে দেবে? এখনকার অভিভাবকদের আকাশসম চাহিদা। অল্পে তাদের মন ভরেনা। তারা মেয়ের জন্য ইলন মাস্কের মত পাত্র খোঁজে। তবে তাদের চেহারাও হতে হবে টম ক্রুজের মত। আবার তাদের আচরণও হতে ত্যালতেলে মোমের পুতুলের মত। কথায় কথায় গলে পরবে। আমারতো আবার এসব কিছুই নেই। আছে একটা সামান্য চাকরি। এটা চলে গেলে জীবনে কপালে বউ জুটবেনা। আজীবন আমাকে বউ হীনতায় কাটাতে হবে। আমি সারাজীবন একবেলা করে খেয়ে কাটতে রাজি আছি। কিন্তু বউ হীনতায় একদিনও কাটাতে রাজি নই। বউ হীন পুরুষ আর ঘাসহীন গরুর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। ঘাস আর বউ, গরু আর পুরুষের পরিপূরক। এই দুটো ছাড়া গরু আর পুরুষ অচল। ”
এবার কুহুর মাথা বন বন করে ঘুরছে। এই লোক কোন কথাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে! একটা ছোট প্রশ্নের উত্তর সে কিভাবে প্যাঁচাচ্ছে এটা ভাবা যায়! আসলেই লোকটা ত্যাড়া।
” আমি বাসায় যাব। আজকে দেরি হলে চাচিকে দেয়ার মত কোনও উত্তর আমার কাছে নেই। ” কুহু উঠে দাঁড়িয়ে বলল।
” চুপ করে বস। আজকেও আমার সাথে বাসায় যাবে। আমার কথা এখনো শেষ হয়নি। ”
তাহমিদের চোখ রাঙ্গানি দেখে কুহু ধপ করে বসে পরল।
” কি বলবেন তারাতারি বলুন। ”
” এত তাড়াহুড়ো কিসের? আমি কি বলেছি মনে আছে তো? ”
কুহু বুঝতে না পেরে তাকায় সামনে বসে থাকা সুদর্শন যুবকটির দিকে।
” প্রতিদিন সময়মত গেইটের সামনে দাঁড়াবে, আজকে আমরা যে রিক্সায় যাব, সেই রিক্সাই তোমাকে নিতে যাবে। আসার সময়ও সেই রিক্সায়ই আসবে। রাস্তায় কারও সাথে কথা বলবেনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। আর নায়লা আঞ্জুমের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায় থাকবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে চিন্তায় পরে যায় কুহু। ও প্রতিদিন অটোতে চলাফেরা করে। আর রিক্সার তুলনায় অটোর ভাড়া কম। প্রতিদিন রিক্সায় চলাফেরা করলে ওর ৬০-৭০ টাকা ভাড়া লাগবে। এত টাকা ও রিক্সা ভাড়ার জন্য খরচ করবে! যদিও চাচা প্রতিদিন ওকে টাকা দেয়। কিন্তু তাই বলে এত টাকা খরচ করতে ওর বিবেকে বাঁধবে। এমনিতেই চাচি ওদের টাকা দিকে দেখলে চোখ গরম করে তাকায়। কুহু এবার সত্যিই অকূল পাথারে পরল। ও তাহমিদকে কি বলবে?
কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ যা বোঝার বুঝে নেয়।
” কি এত চিন্তা করছ? যা যা বললাম, সেগুলো মাথার ভেতর ভালোভাবে ঢুকিয়ে নাও। আমার কথার অন্যথা হলে তোমার কঠিন শাস্তি অবধারিত। আর এতদিনে আমাকে নিশ্চয়ই চিনেছ তুমি? ”
” হুম। ” কুহু ছোট্ট করে উত্তর দেয়। ওর মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে।
আরও কিছুক্ষণ ওরা ক্যাম্পাসে বসল। কুহু চুপচাপ বসে আছে, আর তাহমিদ ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন বহুকালের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে। মেয়েটাকে এত দেখছে তবুও ওর মনের তৃষ্ণা, চোখের তৃষ্ণা কিছুই মিটছেনা। ওর বুকের ভেতর এখন থেকেই হাঁস-ফাঁস করছে। মেয়েটাকে এতদিন না দেখে থাকবে কিভাবে! এই মেয়েটা যে ওর বেঁচে থাকার খোরাক। ওর মরুর মত জীবনে এক পশলা শীতল বৃষ্টি হয়ে ঝরেছে এই মেয়েটা। যে বৃষ্টির তোড়ে ছাপিয়ে গেছে হৃদয়ের দু কূল। বাঁধভাঙা ভালোবাসা এসে জমা হয়েছে হৃদয় অম্বরে।
কুহু অনুভব করছে তাহমিদ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর সমস্ত শরীর শিরশিরিয়ে উঠল। টুপ করেই ভালো লাগায় ছেয়ে যায় ওর পুরো সত্তা। আজকাল এই মানুষটার ধমকেও ভালোবাসা খুঁজে পায় কুহু। তার মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দকনা অমৃত ঢেলে দেয় কুহুর কর্নকুহরে। তার একটুখানি হাসিও কুহুর রাতের ঘুম কেড়ে নিতে যথেষ্ট। হঠাৎই কুহুর চোখজোড়া মানুষটাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে যায়। ও হাসিমুখে সামনে বসা পুরুষটির দিকে তাকাতেই থমকে যায়। সেই পুরুষটি ওকে নেশাক্ত চোখে দেখছে! দু’জনের চোখাচোখি হয় কয়েক মুহুর্তের জন্য। এই কয়েক মুহূর্ত সাক্ষী হয়ে রইল দু’জনের অব্যক্ত ভালোবাসার। নীরবে কথা হয় দুটি হিয়ার। দু’জনের প্রেমময় আঁখি জোড়ায় আরেকবার সৃষ্টি হয় প্রনয়ের পদ্মদিঘি।
কুহু লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। ওর লজ্জায় আরক্তিম চেহারা দেখে তাহমিদ প্রানখোলা হাসল।
” এই সামান্য চোখাচোখিতেই লজ্জায় রাঙা হচ্ছ রমনী! যেদিন আমার চোখজোড়া প্রেয়সীর সর্বাঙ্গে প্রেমের দংশন করবে, সেদিন কি সে সইতে পারবে? নাকি লজ্জায় সংজ্ঞা হারিয়ে আমার রোমাঞ্চের চৌদ্দটা বাজাবে! রমনী তুমি আজ আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলে। লজ্জায় সংজ্ঞা হারানো বউ পাহারা দিয়ে রাত কাটানোর কথা ভাবতেই আমার শরীরের প্রতিটি র’ক্তকনিকা ছলকে উঠছে। ”
তাহমিদের এমন নির্লজ্জ কথা শুনে কুহু আর বসে থাকতে পারলনা। ও এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে যায়। ওর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। আজ অব্দি কেউ ওকে এভাবে বলেনি। এই নিলাজ লোকটার সাথে আর কিছুক্ষণ থাকলে ও নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে।
” আমি বাসায় যাব। আপনি না গেলেও আমি একাই চলে যাব। ”
” আগে কাঁপা-কাঁপি বন্ধ কর, তারপর বাসায় যাও। নতুবা লোকজন তোমাকে এভাবে কাঁপতে দেখলে ভাববে, আমি তোমার সাথে কোন দুষ্টুমি করেছি। আদতেই যেটা আমি করিনি, সেই দোষ কেন নিজের কাঁধে নেব! যদি সামান্যও কিছু করতাম, তবে না হয় মানা যেত। করব নাকি কিছু? ”
ব্যাস, আর কুহুকে পায় কে। ও আর সেখানে দাঁড়ায়না। দ্রুত পায়ে হাঁটতে শুরু করল।
তাহমিদও হেসে কুহুর পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। মেয়েটা যেভাবে টালমাটাল পায়ে হাঁটছে, যেকোন মুহূর্তে হোটচ খাবে। তাই ওর পেছনে থাকা তাহমিদের কাছে আবশ্যক মনে হল।
চলবে….