প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_২৩ জাওয়াদ জামী জামী

0
192

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৩
জাওয়াদ জামী জামী

” সাবধানে চলাফেরা করবে। রিক্সাওয়ালা চাচার সাথেই কেবল কোচিং-এ যাবে। কালকেই তোমার রেজাল্ট দেবে। চিন্তা করবেনা একদম। রেজাল্ট যেটা আসবে, সেটাই মেনে নিয়ে মন দিয়ে এ্যাডমিশনের প্রস্তুতি নেবে। ” তাহমিদ ড্রইংরুমে বসে কুহুর সাথে কথা বলছে। ওর পাশে খালাও বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পরই তাহমিদ রওনা দেবে। আগেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছে।

” বাপজান, আজকে রাতটা থাইকা গেলেই পারতা। কুহু মা’য়ের রেজাল্ট কি হয় শুইনাই যাইতা? ”

” না খালা, কালকে এগারোটার মধ্যে আমাকে ভার্সিটিতে যেতে হবে। কযেকটা ইমারজেন্সি কাজ পরে গেছে। কয়েক জায়গায় এ্যাপ্লিকেশন করেছিলাম। সেসব জায়গা থেকে ডাক এসেছে। নয়তো কালকে থেকেই যেতাম। ”

” আচ্ছা, তোমার যেইটা ভালো মনে হয়, সেইটাই কইরো। তবে কাহ শেষ হইলে আইসা পরবা। দেরি করবানা কিন্তু। ”

” খালা, তোমার মা’কে দেখে রেখ। পড়াশোনায় যেন ফাঁকি দিতে না পারে, সেটা দেখবে। ”

তাহমিদ খালার সাথে কথা বলছে দেখে কুহু রুমে যায়। খালার সাথে তার কোন জরুরী কথা থাকতেই পারে। তাই ড্রয়িংরুমে থাকলনা মেয়েটা।

” খালা, এই টাকাগুলো রাখ। কুহুকে দিলে ও কিছুতেই নিবেনা। ওর, সৃজনের যেকোন প্রয়োজনে টাকাগুলো ওদের দিবে। নিজের প্রয়োজনেও খরচ করবে। ”

” বাপজান, আমার কাছে টাকা আছে। তোমার দেওন লাগবোনা। কুহু মা’য়ের টাকার দরকার পরলে আমি তাকে টাকা দিমুনে। ”

” তোমার টাকা যত্ন করে রেখে দাও। যখন কোন ইমারজেন্সি পরবে, তখন খরচ করো। এখন টাকাগুলো লুকিয়ে রাখ। কুহু যেন কিছুতেই দেখতে না পায়। আর শোন, নায়লা আঞ্জুমের কথা থেকে মেয়েটাকে বাঁচিয়ে রেখ। সে যেন কুহুকে কোন আজেবাজে কথা বলতে না পারে। ”

” তুমি এত চিন্তা কইরোনাতো, বাপজান। তারে যখন আমি মা ডাকছি, তখন তারে দেইখা রাখার দ্বায়িত্বও আমার। তোমার বাস কয়টায়? ”

” সাড়ে বারোটায়। আমি বারোটায় বের হব। আর দশ মিনিট আছি। তুমি একবার ওকে ডাকবে, খালা? ”

তাহমিদের কথা শুনে খালা কুহুকে ডাকলেন। কুহু ড্রয়িংরুমে আসতেই খালা রান্নাঘরে গেলেন কাজের ছুঁতোয়।

” সৃজনকে বাহিরে যেতে দিওনা। এই মহল্লার কয়েকজন উঠতি বয়সী ছেলে আছে, যারা খুবই খারাপ। ওদের সাথে যেন ও মিশতে না পারে। স্কুল, কোচিং ছাড়া ওকে বাহিরে থাকতে দিওনা। যদিও আমি ওকে বলে দিয়েছি। তারপরও তুমি একবার বল। ”

” ঠিক আছে। আমি ওকে বলে দেব। আপনি সাবধানে থাকবেন। ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করবেন। কাজ না থাকলে অযথাই বাহিরে থাকবেননা। ” কুহু মৃদুস্বরে বলল।

তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে হাসল। মেয়েটা বরাবরের মত মাথা নিচু করে বসে আছে। তবে অন্যদিনের মত আজ মাথায় ওড়না নেই। ওর লম্বা কেশরাশি পিঠে লুটোপুটি করছে। পেলব আঁখিপল্লবে মাঝে মধ্যে এসে আছড়ে পরছে কিছু অবাধ্য ছন্নছাড়া মেঘবরণ কেশরাশি। মেয়েটা ওদেরকে মৃদু হাতে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই ওরা আবারও হানা দিচ্ছে।

” একবার মুখ তুলে চাইবেনা? আড়াই মাস দেখবোনা ঐ স্নিগ্ধ মায়ায় জড়ানো মুখখানি। অন্তত দশটা মিনিট এই কুসুমের ন্যায় প্রস্ফুটিত মুখখানি দেখে নিজের তৃষ্ণা মেটাই। চোখের তারায় এঁকে নিই ঐ মুখাবয়বের প্রতিটা বিন্দু। যাতে আগামী আড়াই মাস নিজের মনকে লাগাম দিতে পারি। প্রবোধ দিতে পারি নিজের মনকে। ”

তাহমিদের আদুরে গলা শুনে কুহুর বুকের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ওর চোখের কোনে জমেছে বিরহের অশ্রু। সত্যিই মানুষটা অনেকদিন এমুখো হবেনা? ওর দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেবেনা? কিংবা সময়ে-অসময়ে ছুটে আসবেনা ওর বিপদে!

” তাকাবেনা আমার দিকে? অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়েই কি আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে! নাকি তুমি চাইছ আমি এখানে আর না আসি? ”

তাহমিদের এহেন কথায় কুহু এক ঝটকায় মাথা তুলে তাকায়। চোখ রাখে তাহমিদের চোখে। মেয়েটার চোখে টলমল করছে অশ্রকনারা। যে কোন মুহূর্তে তারা টুপ করে ঝরে পরবে।

তাহমিদ কিছুই না বলে তাকিয়ে থাকল ঐ কাজল দীঘির জলে। ও ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে জলের অতল তলে। আজ কিছু অবাধ্য ইচ্ছেরা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছে। অনেক কষ্টে তাহমিদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। ও নিজের সামনে বসা মেয়েটার মন জিততে চায়।

” বারোটা বেজে গেছে। এবার আমাকে বেড়োতে হবে। তুমি সাবধানে থাকবে। কোন সমস্যা হলে খালাকে জানাবে। খালা, আমি বেড়োব। ”

তাহমিদের ডাক শুনে খালা বেরিয়ে আসলেন রান্নাঘর থেকে। চোখের জলে বিদায় দিলেন সন্তানসম তাহমিদকে।

কুহু দরজায় দাঁড়িয়ে তাহমিদের চলে যাওয়া দেখল। মানুষটা যেতে যতে কয়েকবার পেছন ফিরে তাকিয়েছে।

পরদিন সকাল থেকেই কুহু মনমরা হয়ে আছে। আজকে ওর রেজাল্ট দেবে। সকালেই বড় ফুপু একবার ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। ছোট চাচাও ফোন দিয়েছেন। তারা বারবার কুহুকে সাহস জুগিয়েছেন। এমনকি রায়হান আহমেদও অফিসে যাওয়ার সময় কুহুকে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছেন। খালাও একটু পরপর কুহুকে এটাসেটা বলছেন। তিনি মেয়েটার মন ভালো করতে অনেক কিছুই করছেন।

তাহমিদ কিছুক্ষণ আগেই খালার সাথে কথা বলেছে। সে অনেক আগেই বাসায় পৌঁছেছে। বাসায় পৌঁছেই সে খালাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। তারপর দুইবার খালাকে ফোন করে কথা বলেছে। কিন্তু কুহুর সাথে একবারও কথা বলেনি।

ড্রয়িং রুমে অস্থিরভাবে পায়চারী করছে কুহু। মেজো চাচা ফোন করে জানিয়েছেন তিনি রেজাল্ট শুনে বাসায় জানিয়ে দেবেন। রেজাল্ট আউট হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। এখনো কুহুর কাছে রেজাল্ট আসেনি। ওর কাছে স্মার্ট ফোন নেই তাই অনলাইনে খবরও নিতে পারছেনা। রিশা স্কুলে গেছে। ওর ফোনও এখন নিতে পারবেনা। অবশ্য ও স্কুলে যাওয়ার সময় কুহুর কাছে ফোন দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কুহু নায়লা আঞ্জুমের কথা ভেবে রিশার কাছ ফোন নেয়নি।

অনেকক্ষণ পর রাজিয়া খালার ফোন বেজে উঠল। খালা কাজের ফাঁকেই ফোন রিসিভ করলেন। খালার কথা শুনে কুহু বুঝতে পারল তাহমিদ ফোন দিয়েছে।

” কুহু মা, বাপজান তোমার সাথে কথা বলবে। ধর কথা কও। ”

কুহু কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন নিয়ে কানে ঠেকায়।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কাছে কেউ আছে? থাকলে তার কাছে টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাও। আর পছন্দের মিষ্টি কিনে আনতে বল। এরপর পেট পুরে সেগুলো খাও। আমি রাজশাহী থাকলে মিষ্টি কেনার দ্বায়িত্ব আমিই নিতাম। এবং খেতামও আমিই। ”

তাহমিদের উদ্ভট কথা শুনে কুহুর চোখ কপালে উঠল। এই লোকটা সব সময়ই এমন হেয়ালি করে কথা বলে কেন!

” আমি মিষ্টি খাব কেন? মিষ্টি খেতে আমার ভালো লাগেনা। ”

” ভালো না লাগলেও খেতে হবে। শুধু আজকের জন্য। জেলার টপার বলে কথা! বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়! এমন রেজাল্ট করলে মিষ্টির দোকান কাছে এসে বলবে, আমাদের খাচ্ছেননা কেন ম্যাম? ”

তাহমিদের কথা বলতে কুহুর মনে হচ্ছে ও মাথা ঘুরে পরে যাবে।

” আপনি সত্যি বলছেন? আমার রেজাল্ট আপনি জানতে পেরেছেন? কিন্তু কিভাবে? আমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর পেলেন কোথায় থেকে! ”

” শোন মেয়ে, আমি জীবনে খুব কমই মিথ্যা বলেছি। লাস্ট মিথ্যা বলেছি গত দুইদিন আগে। তা-ও তোমার জন্য। আর রইল তোমার রোল, রেজিষ্ট্রেশন নম্বর। সেটা আমি তুড়ি মেরে জোগাড় করেছি। এবার খালাকে, নানিমাকে গিয়ে রেজাল্ট জানিয়ে এস। আমি রাখছি। ”

তাহমিদ ফোন রাখলে কুহু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। ও তাহমিদের কথা বিশ্বাস করবে কিনা সেটা ভেবে পাচ্ছেনা। ও ভালো করেই জানে তাহমিদ এই বিষয় নিয়ে ওর সাথে মজা করবেনা। কিন্তু ও এত ভালো রেজাল্ট করেছে সেটা ভাবতে পারছেনা।

ওর ভাবনার মাঝেই বেজে উঠল ফোন। কুহু দেখল মেজো চাচা ফোন দিয়েছে।

কুহু ফোন রিসিভ প্রথমেই চাচাকে সালাম দিল।

” কুহু মা, তুই একবারে ফাটিয়ে দিয়েছিস। জেলায় টপার হয়েছিস। আর বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে দ্বিতীয়। আমরা সবাই তোর এই রেজাল্টে ভিষন খুশি হয়েছি। দোয়া করি জীবনে অনেক বড় হ, মা। ” রায়হান আহমেদ খুশিতে কেঁদে দিলেন।

আজ সারাদিন কুহুর ফোন রিসিভ করেই কাটল। বিকেলে কোচিং-এ গিয়ে রেজাল্টের কথা বলতেই সবাই খুশি হয়। সজল কোচিং-এ এসেছে কুহুর সাথে দেখা করতে। তার সাথে মায়াও আছে।

কুহু এখানে সজল আর মায়াকে আশা করেনি। ও ওদের দুজনকে একসাথে দেখে অবাক হয়ে গেছে। মায়া এসে জড়িয়ে ধরল কুহুকে।

” কনগ্রেচুলেশন কুহু। তোমার রেজাল্ট শুনে আমি অবাক হয়ে গেছি। তোমাকে দেখে কিন্তু মোটেও বোঝা যায়না, তোমার মাথায় এত বুদ্ধি। এমনিতেই তাহমিদ তোমাকে ছুপা রুস্তম বলেনা। এই নাও তোমার জন্য চকলেট এনেছি। তুমি তো আবার মিষ্টি খাওনা। তাই কয়েকরকম চকলেট এনেছি। এগুলো খেতে নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? ”

কুহু মায়ার কথা শুনে বুঝল ওর মিষ্টি না খাওয়ার কথা নিশ্চয়ই তাহমিদ মায়া আপুকে বলেছে। অজান্তেই কুহুর ঠোঁটে খেলে যায় হাসির রেখা। লোকটা পারেও।

কুহু হাসিমুখে মায়ার কাছ থেকে চকলেটের প্যাকেট নিল।

পরদিন বিকেলে কোচিং-এ ক্লাস করছে কুহু। ক্লাসের মাঝেই ওর ফোন বেজে উঠল। কুহু ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল আননোন নম্বর। অচেনা নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করলনা। পরপর দুইবার বাজল ফোন। কিন্তু ও রিসিভ করলনা।
কিছুক্ষণ পর টুং শব্দ করে ম্যাসেজ আসল। পরপর তিনটা ম্যাসেজ আসল। কুহু কৌতুহলবশত ম্যাসেজ ওপেন করল। সেই অচেনা নম্বর থেকেই ম্যাসেজ এসেছে। কুহু ভ্রু কুঁচকে ম্যাসেজগুলো পড়তে শুরু করল।

” এইযে মেয়ে, আমি একটা অসহায় মানুষ কতবার ফোন করলাম। কিন্তু তুমি ভীতু কুমারী রিসিভ করছনা। ”

” ফোন রিসিভ কর, মেয়ে। নইলে আমি রাতেই রাজশাহী এসে তোমার বারোটা বাজিয়ে দেব। ”

” এই বেয়াদব মেয়ে, ফোন রিসিভ কর। তোমার ভাগ্য ভালো আমি তোমার সামনে নেই। এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে তোমাকে ঠাঁটিয়ে থা’প্প’ড় মা’র’তে। ”

ম্যাসেজগুলো পড়তে পড়তেই কুহুর ঠোঁটে হাসি ফুটল। তাহমিদ যে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে এটা বুঝতে ওর বেগ পেতে হলোনা। তখনই আরেকবার ফোন বেজে উঠল। সেই নম্বর দেখে কুহু রিসিভ করল।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়ালাইকুমুসসালাম। শুকরিয়া চিনতে পারার জন্য। ”

কুহু উত্তর না দিয়ে হাসল।

” এবার টিচারকে বলে একটু বাহিরে যাও। দেখবে একটা পার্সেল নিয়ে বাহিরে একজন দাঁড়িয়ে আছে। সোজা গিয়ে পার্সেলটা রিসিভ কর। ”

” পার্সেল! কিসের পার্সেল? ”

” কথা কম বল। আর বাহিরে যাও। এক সেকেন্ড দেরি করলে তোমার কপালে খারাবি আছে। ” কুহু তাহমিদের ধমকে ভয় না পেয়ে বসেই রইল।

” আগে বলুন কিসের পার্সেল। তবেই আমি বাহিরে যাব। ”

” তোমার বিয়ের দেনমোহর আছে। খুশি? এবার যাও। ”

ক্লাসের কয়েকজন কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। এমনকি স্যারও তাকিয়ে আছে। কুহু আর কথা না বাড়িয়ে স্যারকে বলে বাহিরে যায়।

ক্লাসে এসে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে কুহু। এতবড় পার্সেল নিয়ে বাসায় যাওয়া অসম্ভব। চাচি দেখলে ওকে আস্ত রাখবেনা। প্যার্সেল খুলে দেখল প্রায় পঞ্চাশটা বই, থ্রি পিস আর সৃজনের জন্য টি-শার্ট, প্যান্ট। কুহু আর কিছু ভাবতে পারছেনা।

সমস্যার সমাধান দিল তাহমিদ। ও বইগুলো কোচিং-এ রেখে যেতে বলল। কাপড়গুলো ব্যাগে তুলতে বলে দিল। কুহু তাহমিদের কথামত কাজ করল। কোচিং-এ বই রাখতে কোনও সমস্যা হলোনা। কয়েকদিনে ও বইগুলো বাসায় নিয়ে যাবে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here