#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৪
জাওয়াদ জামী জামী
দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে কয়েকটা দিন। কুহু নিয়মিত কোচিং-এ যাচ্ছে, বাসায় মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে। রিক্সাওয়ালা চাচা প্রতিদিন সময়মত এসে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে
আবার ক্লাস শেষ করে বাহিরে এসেই চাচাকে দেখতে পায়। প্রতিদিন ওকে নিয়ে যাওয়াআসা করলেও সে একদিনও কুহুর কাছ থেকে ভাড়া নেয়না। কুহু জোর করে ভাড়া দিতে চাইলে সে বলে, ” আপনার কাছে থেকে টাকা নেয়া বারন আছে, মা। আব্বা বিশ্বাস করে আপনাকে পৌঁছে দেওয়ার দ্বায়িত্ব আমাকে দিয়েছে। আমি তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে চাই। ”
এই কথা শোনার পর কুহু আর কিছু বলতে পারেনা।
তাহমিদ প্রতিদিনই খালার কাছে ফোন দিয়ে কথা বলে। তবে কুহুর সাথে প্রতিদিন কথা বলেনা। দুই-তিন পর কুহুকে ফোন করে। তাও আবার রাত এগারোটার পর। ফোন করে সে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেনা। এতে অবশ্য কুহুর মোটেও খারাপ লাগেনা। কারন ও জানে, তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের জন্যই ওকে সব সময় ফোন করেনা। নায়লা আঞ্জুম জানতে পারলে বিষয়টা অনেক দূর গড়াবে।
কুহু প্রতিদিনের ন্যায় কোচিং-এ এসেছে। এখনো ক্লাস শুরু হয়নি।
” কুহু, একটু অফিসে এস। তোমার সাথে দরকারী কথা আছে। ” কোচিং-এর ফিজিক্সের টিচার এসে কুহুকে ডাকলেন।
কুহু স্যারের কথা শোনার জন্য অফিসে যায়।
” আসব স্যার? ” দরজায় দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইল কুহু।
” এস। ”
কুহু ভেতরে আসলে স্যার আবারও কথা বললেন,
” কুহু, তুমি টিউশনির ব্যাপারে আমাকে বলেছিলে। আমি কয়েক জায়গায় কথা বলেছিলাম। কিন্তু তখন কেউই সাড়া দেয়নি। কিন্তু এখন তাদেরকে যখন তোমার রেজাল্টের কথা বললাম, তাদের মধ্যে কয়েকজন চেয়েছে তাদের ছেলেমেয়েদের তুমি পড়াও। এছাড়াও দুইটা কোচিং-ও চেয়েছে, তুমি তাদের সাথে কাজ কর। এজন্য অবশ্য তারা তোমার প্রাপ্য বেতন দিতে রাজি আছে। এখন তুমি কি করবে, সেটা ভেবে দেখ। ”
স্যারের কথা শুনে কুহু হাঁফ ছাড়ল। ও খুব করে চেয়েছিল যেন দুই-একটা টিউশনি পায়। এতে ওর সুবিধা হত।
” স্যার, আমি কালকেই আপনাকে জানাব। এই এলাকার ভেতর কোচিং কিংবা টিউশনি যাই হোকনা কেন আমি করব। ”
কুহু স্যারের কাছ থেকে কোচিং আর যেখানে ছাত্র পড়াতে হবে তার ডিটেইলস নেয়। এবার বাসায় গিয়ে খালা আর চাচার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার পালা।
রায়হান আহমেদ রাতে বাসায় আসলে, রাতের খাবার পর কুহু তার সাথে কথা বলতে চায়।
” চাচা, তোমার সাথে কিছু কথা ছিল। ” রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। তখন সেখানে আসল।
” কি বলবি, মা? আমার কাছে এসে বস। তারপর তোর যা যা বলার বল। ”
কুহু ওর চাচার পাশে বসে চিন্তা করছে কিভাবে কথা শুরু করবে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বুক ভরে শ্বাস নেয় মেয়েটা।
” চাচা, আমি কোচিং-এর স্যারকে টিউশনির কথা বলেছিলাম। তিনি আজকে বললেন, কয়েক জায়গায় কথা বলেছেন। এখন তুমি রাজি থাকলে আমি স্যারের সাথে কথা বলব। ”
কুহুর কথা শুনে রায়হান আহমেদ ওর দিকে কিছুক্ষন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি বুঝতে চাইছেন কুহুর মনের কথা। কিন্তু তার সামনে বসে থাকা চাপা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে তিনি অক্ষম হলেন। তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” তোর কি টিউশনি করা খুব জরুরী, মা? টিউশনি করতে গেলে অ্যাডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিবি কেমন করে? আমি চাইনা তুই এখন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনদিকে নজর দিস। এসবের জন্য অনেক সময় পরে আছে। ”
চাচার কথা শুনে কুহুর চোখে পানি আসল। চাচা যে ওর ভালো চায়, সেটা ওর বুঝতে বাকি থাকেনা। কিন্তু এই মুহুর্তে কুহুর একটা কাজ দরকার। চাচির চোখ রাঙ্গানি কিংবা অপমান, অসম্মান ওকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছে। একটা কাজ ওর ভিষণই দরকার। যাতে ওদের দুই ভাই-বোনের খরচ জোগাতে সমস্যা না হয়। তাই ও খুব সাবধানে মুখ খুলল। চাচার সামনে চাচির বিষয়ে মুখ খোলা যাবেনা।
” চাচা, আমি পড়াশোনাকে প্রায়োরিটি দিয়েই যা করার করতে চাই। টিউশনি কিংবা কোচিং-এ ক্লাস নিলে সকাল সাতটা থেকে মাগরিবের আগ পর্যন্তই নিতে হবে। রাতে আমি সম্পূর্ণ ফ্রি থাকব। রাতে পড়ার জন্য যথেষ্ট সুযোগ পাব। আমি জানি চাচা, তুমি ছোট চাচা, ফুপু আমাদের জন্য চিন্তা কর। তোমাদের চাওয়া আমি অবশ্যই পূরণ করব। কিন্তু এই সুযোগে আমি নিজেকেও ঝালাই করে নিতে চাই। তুমি আর না করোনা, চাচা। ”
রায়হান আহমেদ বুঝলেন কুহু খুব করে চাচ্ছে কিছু একটা করতে। সেই সাথে তিনি এ-ও বুঝলেন মেয়েটা রোজগার করে তার কাঁধ থেকে বোঝা সরাতে চাইছে। এই বাসায় যে কুহু আর সৃজন প্রতিনিয়ত ভয়ে ভয়ে থাকে, সেটা তিনি বুঝতে পারেন। তিনি অনেকবার ওদেরকে বুঝিয়েছেন। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। হঠাৎ করেই কষ্টে তার বুক ভারি হয়ে আসে। বড় ভাই-ভাবী বেঁচে থাকলে ছেলেমেয়ে দুটো এমন ভয়ে ভয়ে বাঁচতনা। ওরা নিজেদের মত করে স্বাধীনভাবে বাঁচত।
” আমি সম্মতি দিতে পারি এক শর্তে। পড়াশোনা ঠিক রেখে টিউশনি কিংবা কোচিং যা করার করবি। যদি আমি শুনি ওসব করতে যেয়ে তোর পড়াশোনায় সামান্যতমও সমস্যা হচ্ছে, তবে সাথে সাথেই তোকে সবকিছু থেকে ইস্তফা দিতে হবে। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স তোকে পেতেই হবে। ”
চাচার কথায় কুহু প্রান ফিরে পেল। ও প্রানখুলে হেসে জবাব দিল,
” তুমি চিন্তা করোনা, চাচা। আমার কাছে পড়াশোনাই সব। লেখাপড়া করার জন্য আমি সবকিছু করতে রাজি আছি। আর পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স আমি পাবই। সেই বিশ্বাস আমার আছে। ”
রাতে খালাকে সবটা বললে তিনিও রাজি হয়ে যান। তবে রাতে তিনি তাহমিদকে জানাতে পারেননি বিষয়টা। পরদিন সকালে তাহমিদ ফোন দিলে তিনি তাহমিদকে সব জানান। তাহমিদ মনযোগ দিয়ে খালার সব কথা শোনে।
পরদিন কোচিং-এ গিয়ে কুহু স্যারের সাথে কথা বলল। ও সকাল সাতটায় একটা কোচিং-এ পড়াবে। সেখানে ক্লাস এইট থেকে ক্লাস টেনের শিক্ষার্থীদের অংক আর ইংরেজি ক্লাস নেবে। আর বাকি দিন ওর কোচিং-এর ফাঁকে আরেকটা কোচিং-এ ক্লাস নিবে। ও রাতে অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোন বাসায় আপাতত পড়াতে যাবেনা। এই দুইটা কোচিং থেকে ওদের দুই ভাই-বোনের চলার মত খরচ হয়ে যাবে। ও সামনের মাস থেকেই কোচিং-এ জয়েন করবে। এই মাসের আর তিনদিন আছে। এই তিনদিন ও ফ্রি থাকবে। তারপর আরেকবার নতুনভাবে শুরু হবে বেঁচে থাকার লড়াই।
রাত এগারোটা চল্লিশ। কুহু মনযোগ দিয়ে পড়ছে। সৃজন খাটে ঘুমাচ্ছে। ও আর খালা মেঝেতে বিছানা পেতে শোয়। খালাও ওর পাশে ঘুমিয়েছে। ফোনের শব্দে পড়ায় ব্যঘাত ঘটল। বই বন্ধ করে ফোন হাতে নিতেই দেখল স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে ‘ খোঁ’চা কুমার ‘ লেখাটা।
কুহু মৃদু হাসল। মানুষটা তিনদিন পর ফোন দিয়েছে। কুহু ফোন হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে করিডোরের শেষ মাথায অবস্থিত ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে ফোন বাজতে বাজতে একবার কেটে গেছে। কুহু ধৈর্য্য সহকারে আরেকবার তাহমিদের ফোনের অপেক্ষা করছে। এবার ফোন বাজতেই কুহু রিসিভ করল।
” আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। কেমন আছো? দিনকাল কেমন যাচ্ছে? ”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন? ” কুহু উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।
” কি ঘটনা! তুমি বোধকরি আমার চিন্তায় শুকিয়ে গেছ? কন্ঠ এমন ব্যাকুল শোনায় কেন? Something is fishy? ”
এবার তাহমিদের কথা শুনে কুহুর মাথা ঘুরছে। ওর মন বলছে, এই মানুষটা কি সব সময়ই এমন খোঁ’চা দিয়ে কথা বলবে! একে থামাতেই হবে।
” একটা জরুরী কথা ছিল। আপনি কি শুনবেন? নাকি আমি ফোন কেটে দেব। ” কুহু সরাসরি হুমকি দেয় তাহমিদকে।
” জ্বি বলুন, শুনছি আপনার জরুরী কথা। অযথা ফোন কাটবেন কেন! আপনি ফোন কাটলে আমার বিরাট লস হয়ে যাবে। কারও মধু মাখানো গলা শুনতে পাবোনা। কাঁপা কাঁপা সেই গলায় কি যে নেশা সেটা কেবল আমিই জানি। আমার কান সেই গলার আওয়াজ না পেলে বধির হয়ে যাবে। ”
” আমি ফোন রাখছি। ” এবার কুহুর হুমকিতে কাজ হল।
” এই খবরদার ফোন রাখবেনা। নেহাৎ আমি অসহায় পুরুষ, তাই কারনে-অকারনে তোমার এমন হুমকি সহ্য করি। এই আমাকে অসহায় পেয়ে তুমি। বারেবারে সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। ”
তাহমিদের মিইয়ে যাওয়া গলা শুনে কুহু হাসল। মানুষটাকে জব্দ করার উপায় পেয়েছে ও।
” আমি একটা কোচিং-এ জয়েন করছি আর তিনদন পরই। আসলে একটা নয় দুইটা কোচিং-এ সুযোগ পেয়েছি। ” কুহু উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল।
” কনগ্রেচুলেশন। তুমিও স্বাবলম্বী নারীর তালিকায় নাম লিখালে! কে বলেছে তালুকদার সাহেবের ভাতিজী অসহায়! তবে দুইটা কোচিং-এ ক্লাস নিয়ে পড়াশোনা ঠিকমত চালাতে পারবেতো? আশা করছি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। ”
” দিনে আমি খুব একটা পড়িনা। দিনে ক্লাস নিয়ে রাতে পড়তে কোন সমস্যা হবেনা। শুধু এক জায়গায়ই পরীক্ষা দেব, তাই খুব একটা টেনশন করছিনা। ”
” সমস্যা না হলেই ভালো। পড়াশোনায় কোন ত্রুটি যেন না হয়। এক জায়গায় পরীক্ষা দেবে মানে? অ্যাডমিশন কোন কোন ভার্সিটিতে দিবে? ”
” শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় অংশ নেব। ”
” কেন? অন্য বিশ্ববিদ্যালয় কি দোষ করল? ”
” আমি যদি অন্য কোথাও চান্স পাই, তবে সৃজনকে এখানে রেখে আমাকে সেখানে থাকতে হবে। আমি সৃজনকে কোথাও একা রাখতে চাইনা। সে-ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। ”
এবার তাহমিদ কুহুর কথায় বিরক্ত হয়। কিন্তু ও কুহুকে বুঝতে দেয়না। ও নিজের বিরক্তি চেপে রেখে কথা বলল।
” কেন, রুয়েট কি দোষ করল? সেখানেও তো একটা সুযোগ নিতে পার। ”
” আমিতো রুয়েটের জন্য প্রস্তুতি নেইনি। শুধু পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। ”
” আমি সাজেশন জোগাড় করেছি। এই কয়দিন ঝামেলার কারনে পাঠাতে পারিনি। কালকে পাঠিয়ে দেব। ডেলিভারিম্যান কোচিং-এ গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সাজেশনগুলো ফলো করলে আশা করি নিরাশ হবেনা। তবে রুয়েটের জন্যও একটু আধটু পড়াশোনা কর। যেখানে চান্স পাবে, সেখানেই ভর্তি হবে। ”
” আচ্ছা। আমি কালকেই স্যারের সাথে কথা বলব। স্যার যদি সাজেশন জোগাড় করে দিতে পারে, তবে ভালো হবে। ”
” আমি রুয়েটের সাজেশনও জোগাড় করেছি। তারপরও তোমার স্যারের সাথে কথা বলে দেখ। ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে নিরবে হাসল। মানুষটা দূরে গিয়েও ওর সাথে ছায়ার মত রয়ে গেছে
আগলে রাখছে কুহুকে।
” আপনি রাতে খেয়েছেন? কোথায় আছেন এখন? ”
” এখনও খাইনি। বর্তমানে একটা পার্কের ঘাসে শুয়ে আকাশের তারা গুনছি। দেখছি আকাশের গায়ে তারারা কেমন করে লেপ্টে থেকে, আকাশের ভালোবাসা নিজেদের শরীরে মেখে নিচ্ছে। বুঝলে মেয়ে, আকাশের সাথে তারাদের গভীর প্রনয় রয়েছে। ওরা একে-অপরকে ছাড়া শূন্য। যেমন আমি শূন্য এক শ্যাসাঙ্গীনিকে ছাড়া। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর হিয়ার মাঝে দোলা দেয় প্রশান্তির মৃদুমন্দ মলয়। মন বাগিচায় পাখনা মেলে উড়তে থাকে রংবেরংয়ের প্রজাপতি। ওর মন বলছে, তোর জীবনে সে এসেছে সুখের পরশ নিয়ে। তোর জীবনকে পরশপাথরের ছোঁয়ায় পাল্টে দেবে সে। তুই তার, তুই একান্তই তার। তুই তার শ্যামাঙ্গীনি।
চলবে…