প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_২৭ জাওয়াদ জামী জামী

0
211

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_২৭
জাওয়াদ জামী জামী

” আমার হলদে পাখি । ” তাহমিদ আনমনেই বলে উঠল.
দেয়ালের গা বেয়ে বেড়ে উঠা হলুদ অলকানন্দা গাছের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুহু। গাছ ভর্তি হলুদ অলকানন্দার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যও অতটা মোহিত করতে পারলনা তাহমিদকে, ও যতটা মোহিত হয়েছে তার শ্যামাঙ্গীনির রূপে। কুহুর পরনে কাঁচা হলুদ রংয়ের থ্রি-পিস। তাহমিদ বিমোহিত নয়নে দেখছে তার চঞ্চলা পাখিকে। যার প্রনয়ে সে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চায়। তার প্রনয়ের পরশ মাখতে চায় নিজের তনু-মনে। সেই প্রনয়কে নিজের অস্তিত্বে বেঁধে রাখতে চায় আজীবন।
কুহু দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। রায়হান আহমেদ সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।

অনেকদিন পর বাড়িটা যেন প্রান ফিরে পেয়েছে। সোহানী পারভিন ছোট ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের কাছে পেয়ে খুশিতে কেঁদে ফেললেন। রিশা, নিশো চুপটি মে’রে ফুপুর কাছে বসে থাকল।

সাইদ আহমেদের ছেলেমেয়ে সিহা আর সাদমানও এই বাড়িতে এসেছে। কুহুরা আসার পর থেকেই ওরা এখানে বেশি সময় কাটাচ্ছে। শিরিন আক্তার ওদের বাঁধা দিলেও, ওরা তার কোন নিষেধই মানছেনা। ওরা তাদের কুহুপু আর বড় ফুপুর আশেপাশেই থাকতে চায়।

গভীর রাত। ধরনীর বুকে আঁধার তার রাজত্ব শুরু করেছে। ধরনীও আঁধারকে শরীরে মেখে নিয়ে দিনকে ঘুম পারিয়েছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কোথাও কোন শব্দ নেই। মাঝেমধ্যে রাতচোরা পাখি ডেকে উঠছে কোন গাছের শাখা-প্রশাখার আড়াল থেকে। থেকে থেকে ঝিঁঝিঁরা তারস্বরে গান শুনিয়ে রজনীকে শান্ত করছে।
অম্বরে রুপালী সুধাকর ধরনীকে সাজাতে তার আলোর পসরা উজার করে ঢেলে দিয়েছে।

তাহমিদ উঠানে পেতে রাখা মাদুরে সটান হয়ে শুয়ে উর্দ্ধাকাশে নিনির্মেষ তাকিয়ে দেখছে আলো-আঁধারির খেলা। থেকে থেকেই চাঁদকে ঢেকে দিচ্ছে এক টুকরো মেঘ। আবার পাগলা হাওয়ার দল হুট করেই মেঘেদের গায়ে আছড়ে পরে, তাদেরকে সরিয়ে দিচ্ছে। নিয়মিত বিরতিতে চাঁদ, মেঘ আর বাতাসের লুকোচুরি চলছে।

” নিন আপনার বিখ্যাত কালো কফি। ” হুট করেই কুহু এসে বসল তাহমিদের পাশে। ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে কফির পাত্র।

তাহমিদ যেন জানত কুহু উঠানে আসবেই। তাই ও কুহুর আগমনে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়না। শুধু মৃদু হেসে শোয়া থেকে উঠে বসল।

” কালো কফি! তোমাকে যতটা চুপচাপ মনে করতাম, ততটা চুপচাপ তুমি নও। বরং একটু বেশিই চঞ্চল। তো, কালো কফি শুধু আমার জন্যই এনেছ? তোমারটা কই? ”

” আমি এসব খাইনা। কি তেঁতো। এসব গরু-ছাগলের খাবার। আমি বাপু সাধারন মানুষ। ”

” মানে পরোক্ষভাবে তুমি আমাকে গরু-ছাগল বলছ! আজকেই শেষ। এরপর জীবনেও আর কফি পান করবনা। এতবড় অপমান মেনে নেয়া যায়না। ” কথা বলতে বলতে তাহমিদ পাশ থেকে ডার্ক চকলেট বক্স হাতে নিয়ে কুহুর দিকে বাড়িয়ে দেয়।

কুহু অসময়ে চকলেট দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে।

” চকলেট কেন! আপনি কি চকলেট সাথে নিয়ে চলাফেরা করেন? ”

” উহু। একজনকে এখনও তার অর্জনের জন্য মিষ্টিমুখ করানো হয়নি। তাই এই সামান্য আয়োজন। সে যদি এই সামান্য উপহার গ্রহন করে তবে কৃতার্থ হই। ”

তাহমিদের কথার ধরনে কুহু হাসল। ডান হাত বাড়িয়ে চকলেটের বক্স নেয়।

” ধন্যবাদ। ”

” রাজশাহীতে কবে ফিরছ? ”

” চাচা যদি কালকে থেকে যায়, তবে পরশুদিন ফিরব। আপনি থাকবেননা? ”

” আমি সকালেই বেরিয়ে যাব। জরুরী কাজ আছে। ”

” ঢাকা ফিরে যাবেন? ” ম্লান গলায় বলল কুহু। চোখের কোনে চিকচিক করছে অশ্রু।

” নাহ্। চার-পাঁচদিন আছি। তারাতারি ফিরে যেও। পরশুদিন বেলা এগারোটার মধ্যে তোমাকে রাজশাহীতে দেখতে চাই। ”

তাহমিদের কথায় অধিকারবোধ স্পষ্ট। যা কুহুর কর্নকুহরে ঠিক পৌঁছে গেছে।

” চাচা যদি যেতে দেরি করে তখন আমি কি করব! আমিতো তাকে তারাতারি যাওয়ার কথা বলতে পারবনা। ”

” কোচিং বন্ধ আছে? নাকি ছেড়ে দিয়েছ? ” কুহুর কথার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।

” ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই আসেনা, ছুটি নিয়েছি। ”

” কাল সারাদিন শান্তি করে ঘুরে বেড়াও। আত্মীয় স্বজনদের সাথে সময় কাটাও। ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু হয়ে গেলে, আর সেসবের সুযোগ পাবেনা। ”

কুহু তাহমিদের কথা আপাতত শুনছেনা। ও তাহমিদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা আগের থেকে একটু যেন শুকিয়ে গেছে। গায়ের রংটাও কেমন মলিন হয়ে গেছে। তবে নিজেকে পরিপাটি করে রাখায় পরিবর্তনটা খুব একটা ধরা যাচ্ছেনা। হঠাৎ করেই কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। কি হয়েছে তার?

” আপনি কি অসুস্থ? ”

হঠাৎ অপ্রাসংঙ্গিক প্রশ্ন করায় তাহমিদ ভুরু কুঁচকে কুহুর দিকে তাকায়।

” হঠাৎ এমনটা মনে হলো কেন? যেখানে আমাকে দেখে মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে পরে, ইভেন বাসে আসার সময়ও একজন এ্যাড্রেস নিয়েছে। সেখানে তুমি আমাকে অসুস্থ বানিয়ে দিলে! তাহমিদ সব সময়ই ফিট থাকে বুঝলে? কোন অসুস্থতা তাকে ছুঁতে পারেনা। সত্যি বলতে কি জানো, সুন্দর মানুষদের কখনো অসুখ হয়না। ”

তাহমিদের এমন আবোলতাবোল উত্তর শুনে কুহু রে’গে যায়। মানুষটা এমন কেন!

” যদি অসুস্থই না হবেন, তবে চেহারা এমন শুকিয়ে গেছে কেন? নিয়মিত খাওয়াদাওয়া করেননি? এবার সোজাসুজি উত্তর দেবেন। আমি কোন আবোলতাবোল উত্তর শুনতে রাজি নই। ”

” শুনেছি মেয়েদের সংসার করতে ইচ্ছে করলে, এমন অনেক জিনিসই আছে উল্টাপাল্টা দেখে। তাদের চোখে সংসারের স্বপ্ন এমনভাবে সেঁটে যায় যে সাধারণ জিনিসের মাঝেও খুঁত খুঁজে পায়। তোমার কি এখন সংসার করতে ইচ্ছে করছে? পাত্র দেখব? কেমন পাত্র পছন্দ? ”

” আবারও উল্টাপাল্টা বকছেন? আমি ঘরে গেলাম। আপনি এখানে একা একাই দেবদাসের মত শুয়ে থাকেন। ” কুহু বিরক্ত হয়ে গেছে।

” তো, আমি কোন রোমিও! আমিতো দেবদাসই। জীবনে কোন রং নেই। সাধ-আহ্লাদ নেই। একটা প্রেমিকা নেই, একটা বউ নেই। দুই গন্ডা ছেলেপুলে নেই। দুই-চারটা শালা-শালী নেই। একটা শ্বশুর বাড়ি নেই। আমি শুকিয়ে শুটকি হবনাতো কে হবে? বেঁচে আছি এই ঢের। জীবনে একটা বউয়ের বড্ড অভাব বুঝলে? বউ ছাড়া জীবনটা পানসে। একজন পুরুষের জীবনে বউই রং এনে দিতে পারে। কিন্তু আমার ভাগ্য দেখ। এই বয়সে এসেও বউয়ের জন্য হাহাকার করতে হয়। ”

তাহমিদের মুখভঙ্গি দেখে কুহু হাসতে থাকে।

” বউ ছাড়াই যখন এত বছর কাটিয়ে দিলেন। তবে এখন কেন বউয়ের জন্য হাহাকার করছেন? বাকিটা জীবন এইভাবেই কাটিয়ে দিন। স্বাধীনভাবে বউ শূন্য জীবন উপভোগ করুন। ”

” বউ শূন্য ব্যাক্তিরা কত যে অসহায় তা তুমি কিভাবে বুঝবে নিষ্ঠুর মেয়ে। বউ শূণ্য জীবন আমি কাটাবো কেন? এর থেকে বড় শাস্তি জীবনে আর দ্বিতীয়টি নেই। ঐটা আমার শত্রুর সাথেও যেন না ঘটে। বউয়ের উপকারিতা সম্পর্কে তোমাকে একটু ধারণা দেয়া দরকার। তবেই যদি তুমি বুঝতে পার। ”

” থাক, এত বুঝে আমার কাজ নেই। এখন ঘুমাতে যান। নাকি সারারাত মশাদের গান শোনার জন্য উঠানেই বসে থাকবেন? ”

” অন্য কেউ যদি আমার দুঃখের কথা না শোনে, তবে মশাদের গান শুনতে শুনতে নাহয় নিজের দুঃখের কথা শেয়ার করি। এখন মশারাই আমার বউ শূন্য জীবনের সঙ্গী। ” দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল তাহমিদ।

কুহুর এই মুহূর্তে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে হাসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বাড়িতে এখন সবাই আছে। ওর হাসির শব্দে কেউ যদি বাহিরে আসে, তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাই অনেক কষ্টে হাসি দমিয়ে রাখল।

” রুমে গিয়ে মশাদের সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করবেন। প্রয়োজনে মশারী খুলে রাখবেন। এখন রুমে যান। অনেক রাত হয়েছে। আর বাহিরে থাকবেননা। ”

” হাহ্ তাহমিদ ভাই, তোর আসলেই পো’ড়া কপাল। কেউই তোর দুঃখ বোঝেনা। কি আর করার, যাই ভেতরেই যাই। ” কথার মাঝেই তাহমিদ পকেট হাতড়ে কিছু একটা বের করল। আচমকা চেপে ধরল কুহুর হাত। চোখের ইশারায় ওকে শান্ত থাকতে বলল।

কুহু দেখল তাহমিদ একটা ছোট প্যাকেট বের করেছে। মেয়েটা স্থির চোখে তাকিয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। চাঁদের আলো তার মুখাবয়বে আছড়ে পরেছে। আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে তার সুন্দর মুখশ্রী। কুহু তাহমিদের মুখের প্রতিটি শিরা-উপশিরা মনযোগ দিয়ে দেখছে। হঠাৎই ওর চোখ পরল তাহমিদের ডানদিকের ভ্রুর নিচে। সেখানে একটা কা’টা দাগ স্পষ্ট। অথচ আগেও সেখানে কোন কা’টা দাগ দেখেনি কুহু। কি হয়েছিল তার? কুহু কেবলই জিজ্ঞেস করতেই মুখ খুলবে, ঠিক তখনই কুহু ওর পায়ে কোন কিছুর শীতল ছোঁয়া অনুভব করল। ভয়ে ভয়ে পায়ের দিকে তাকাতেই ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। তাহমিদ যত্ন করে ওর পায়ে নুপুর পরিয়ে দিচ্ছে!

কুহু নিনির্মেষ নেত্রে চেয়ে দেখছে সামনের মানুষটাকে। মানুষটা ওকে এত বোঝে কেন! কেন এভাবে আগলে রাখে! আর কেনইবা ওর কথা ভাবে!

” শ্যামাঙ্গীনি তার অনেক বড় অর্জনের জন্য আমার কাছ থেকে ছোট একটা উপহার ডিজার্ভ করে। তার প্রতিটা অর্জনেই কিছুনা কিছু উপহার তার জন্য বরাদ্দ থাকবে। সে যেন নির্দিধায়, নিঃসংকোচে আমার উপহার গ্রহন করে। ”

তাহমিদের কথার প্রত্যুত্তরে কি বলবে কুহু। এমন কথার প্রত্যুত্তর ওর জানা নেই৷ ও নীরব হেসে তাকিয়ে থাকে সুদর্শন যুবকের দিকে। কিন্তু আবারও ওর চোখ যায় ভ্রুর নিচে কা’টা দাগের দিকে। নিমেষেই ওর মুখ কালো হয়ে যায়।

” ভ্রুর নিচে কি হয়েছে? কা’টা দাগ কেন? আগেতো এটা ছিলনা। ”

কুহুর কথা শুনে তাহমিদ মুখ তুলে তাকায় মেয়েটার দিকে। ওর চোখমুখ বিস্ময় খেলে যায়।

” তুমি আমার চেহারার দিকে তাকিয়েছ! মাই গড! আমার কি সৌভাগ্য। তারমানে আমি নিশ্চয়ই সুদর্শন। তাই তোমার দয়া হয়েছে আমার প্রতি। ”

” খবরদার কথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবেননা। কি হয়েছিল আপনার? সোজাসাপটা উত্তর দিন। “।

কুহুর কন্ঠে কিছু একটা ছিল, যা শুনে থমকায় তাহমিদ। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ভেতর থেকে উছলে পরা অনুভূতিদের সামাল দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করল।

” মাস খানেক আগে ছোট্ট একটা এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল। একটা সিএনজি ধাক্কা দিয়েছিল। রাস্তায় পরে গিয়েছিলাম। তখনই কিছু একটা লেগে কেটে গিয়েছিল। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহুর বুকের ভেতর ছলকে উঠে ব্যথারা। এতকিছু ঘটে গেছে তা-ও সে একবারও জানায়নি! এত চাপা কেন মানুষটা! সবাইকে ভালো রাখতে নিজেকে উজার করে। কিন্তু নিজের বেলায় কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। কেন এমন সে?

” কই আমাদের তো কিছুই জানাননি! খালাও নিশ্চয়ই জানেননা। এমন কেন আপনি? ” কুহুর গলা কাঁপছে।

” এই সামান্য বিষয়ে তোমাদের জানিয়ে কি নিজেই বিপদে পরতাম। খালাকে জানানোর সাথে সাথে সে কান্নাকাটি শুরু করত। আর তাকে শান্ত করতে আমাকেই রাজশাহী আসতে হত। নিজের কাজ ফেলে সেটা করা সম্ভব ছিলনা, তাই জানাইনি। ”

” আপনি ঘরে যান। অনেকক্ষণ ধরে বাহিরে আছি। কেউ দেখলে লজ্জায় পরে যাব। ” কুহু আর উঠানে থাকলনা। চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরে চলে গেল।

তাহমিদ বুঝতে পারছে কুহু বেশ রা’গ করেছে। তাই এমনভাবে উঠে চলে গেল। সে-ও ম্লান হেসে রুমের দিকে পা বাড়ায়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here