প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_৩১ জাওয়াদ জামী জামী

0
296

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩১
জাওয়াদ জামী জামী

কুহু তাহমিদের সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু গত পনেরদিন থেকে তাহমিদের কোনও খবর নেই। এদিকে কুহু রাজিয়া খালার কাছ থেকে জানতে পেরেছে তাহমিদ এরইমধ্যে দুই দিন খালার কাছে ফোন দিয়েছে। এই কথা শোনার পর কুহু আরও ভেঙে পরেছে। সেই সাথে ভয়ও হচ্ছে। তবে কি সে কুহুর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! এখন কুহুর নিজের ওপর রা’গ হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, কেন সে আগে তাকে নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার আগে জানালনা। সে সবকিছু শোনার পর রা’গ করত, তারপর একসময় ঠিক হয়ে যেত। কিন্তু এখন কুহু কিভাবে সবকিছু ঠিক করবে? কষ্টের তীব্রতায় কুহু ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তবে কি ওর না বলা ভালোবাসা সমূলেই বিনাশ হতে চলেছে! কুহু দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে তাহমিদকে ফোন করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে নিরাশ হতে হয়।

হঠাৎ করেই বড় ফুপুকে বাসায় দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। সোহানী পারভিন সাইদ আহমেদের সাথে কুহুর কাছে এসেছেন। এতদিন তাদের ভাতিজা-ভাতিজী ছোট ভাইয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকায় তারা সেখানে যেতে পারেননি। কারন তারা জানতেন, নায়লা আঞ্জুম তাদের পছন্দ করেনা। সোহানী পারভিন অনেক জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন ওদের জন্য। এই দুঃসময়ে আপনজনদের কাছে পেয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল কুহু। সোহানী পারভিন পরম আদরে ভাইয়ের মেয়েকে বুকে জরিয়ে নিলেন।

সাইদ আহমেদ পরদিন সকালে বড় বোনকে কুহুদের কাছে রেখে গ্রামে ফিরে গেলেন। সোহানী পারভিন কয়েকদিন এখানে থাকবেন।

সেদিন বিকেলে রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েদের সাথে নিয়ে কুহুদের বাসায় আসলেন। মুহূর্তেই বাসাটা যেন চাঁদের হাটে পরিনত হয়েছে। কুহু গিয়ে পাশের ফ্ল্যাট থেকে দাদুকে নিয়ে এসেছে। বৃদ্ধাও আজকে ভীষণ খুশি হয়েছেন। তার ছেলেমেয়েও থাকার পরও তিনি সব আনন্দ থেকে বঞ্চিত। আজ তিনি এদের সাথে আনন্দ করে, নিজের অপূর্ন স্বপ্নকে পূরন করছেন।

চারদিন পর সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেলেন। সৃজন কুহু চেয়েছিল তাদের ফুপু আরও কয়েকটা দিন থেকে যাক। কিন্তু বাড়িতে কাজ পরে যাওয়ায় তাকে চলে যেতে হয়।

একদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ কুহুর কাছে আসলেন। তিনি ওদের জন্য কিছু ফলমূল এনেছেন। সেগুলো কুহুর হাতে দিয়ে তিনি কুুহুর রুমে গিয়ে বসলেন।

” কুহু মা, আজকে একটা দরকারে তোর কাছে এসেছি। তুই মনযোগ দিয়ে আমার কথা শোন। ”

” কি হয়েছে চাচা? কিছু হয়েছে? ”

” তেমন কিছুই হয়নি, আবার অনেক কিছুই হয়েছে। যেহেতু ভাই-ভাবী বেঁচে নেই, এখন তোর অভিভাবক বলতে আমরা তিন ভাইবোনই আছি। তাই যে কথা তোকে ভাবীর বলা দরকার ছিল, সেই কথা আমাকে বলতে হচ্ছে। ”

কুহু চাচার কথার সারমর্ম বোঝার চেষ্টা করছে। এদিকে রায়হান আহমেদ একমনে কথা বলেই চলেছে,

” বুঝলি মা , মেয়েরা বড় হলে বাবা-মা’ র দুশ্চিন্তা হয়। তেমনি আজকাল আমাদেরও তোর জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে। তুই সব ছেড়ে একা সৃজনকে নিয়ে থাকছিস। এটা আমাদেরকে আরও বেশি ভাবাচ্ছে। ”

” চাচা, তুমি কি বলতে চাইছ! আমি বুঝতে পারছিনা। আমাদের জন্য এত চিন্তা করতে হবেনা, চাচা। ” কুহু ভ্রকুটি করে বলল।

” মা রে, তুই বুঝবিনা আমাদের দুশ্চিন্তা। যতদিন তোকে একটা ভালো পরিবারে, একজন সৎ মানুষের হাতে তুলে দিতে না পারছি, ততদিন আমাদের স্বস্তি নেই। আর সেই ভালো পরিবার আর সৎ মানুষের সন্ধান আমরা পেয়েছি। ”

চাচার কথা শুনে কুহুর পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। চাচা কার কথা বলছে? এবার ও কি করবে!

” তু..তুমি ক..কি বলছ, চাচা? ” কুহু মনে হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে মাথা ঘুরে পরে যাবে। এসব কি শুনছে ও!

” আমি ঠিকই বলছি, মা। আমার কলিগের ভাইয়ের ছেলে আশিক। সে কানাডা থাকে। মন্ট্রিল ইউনিভার্সিটিতে পিএচডি করছে। আমার কলিগ একদিন তোকে কোচিং-এ দেখেছিল। তখনই তোকে পছন্দ করেছিল। সে-ই তার ভাতিজার সাথে তোর বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। আমি তখন তাকে কিছুই বলিনি। গোপনে ছেলের সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিলাম। এবং রেজাল্ট পজিটিভ। সবাই তাদের পরিবারকে ভালো বলেই আখ্যায়িত করেছে। কিন্তু আমি তোর কাছে না জেনে তাদেরকে কিছুই বলতে পারছিনা। অবশ্য তোকে এখন কিছুই জানাতে হবেনা। তুই দুইদিন সময় নে। এরপর আমাকে জানাস। ”

কুহু চাচার কথার প্রত্তুত্যরে কিছুই বলতে পারলনা। ঠোঁট কামড়ে দীর্ঘশ্বাস গোপন করার বৃথা চেষ্টা করল।

রায়হান আহমেদ আরও কিছুক্ষণ সৃজন কুহুর সাথে গল্প করে বিদায় নিলেন।

পরদিন ফজরের নামাজের পর কুহু নাশতা তৈরী করছে। তখনই বড় ফুপুর ফোন আসল। কুহু মলিন হেসে ফুপুর সাথে কথা বলতে শুরু করল।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর, সোহানী পারভিন জানালেন তিনি ও সাইদ আহমেদ কুহুর বিয়ের ব্যাপারে ছোট ভাইয়ের সাথে একমত হয়েছেন। ছেলে ও তার পরিবার সম্পর্কে সবকিছু শোনার পর তারাও চান সেখানেই কুহুর বিয়ে হোক। এছাড়া সাইদ আহমেদ নিজে গিয়েছিলেন ছেলের গ্রামে। তিনিই সবকিছু শুনে এসেছেন।

এবার কুহু যেন অকুল পাথারে পরল। ওর শেষ ভরসাটুকুও কর্পূরের ন্যায় উবে গেল। ও ভেবেছিল, বড় ফুপুকে বুঝিয়ে চাচাকে ওর বিয়ে নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে নিষেধ করবে। কিন্তু ও এখন দেখছে বড় ফুপু আর মেজো চাচাও ছোট চাচার সাথে বিয়েতে মত দিয়েছে!

কুহু দিশেহারা হয়ে গেছে। ও এখন কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। চোখ দিয়ে আপনাআপনিই শ্রাবনের ধারার ন্যায় অশ্রু ঝরতে থাকল।

আরও তিনদিন কেটে গেছে। কুহু অনেকবার তাহমিদের কাছে ফোন দিয়েছে, কিন্তু ওকে এবারও হতাশ হতে হয়। বাধ্য হয়ে ও দাদুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে, লাজলজ্জা ভুলে তাহমিদকে ফোন দেয়। কিন্তু এবার ফোন সুইচড অফ দেখায়। পরপর দুইদিন দাদুর ফোন দিয়ে তাহমিদকে ফোন দেয়, এবং দুইদিনই ফোন সুইচড অফ দেখায়।
কুহু এবার রাজিয়া খালাকে ফোন করে সবটা জানায়। খালা সব শুনে বললেন, তিনদিন থেকে তাহমিদ তার কাছেও ফোন দেয়নি। তিনিও তাহমিদের কোনও খোঁজ জানেননা।

পরবর্তী কয়েকদিন কুহু উন্মাদের মত আচরণ করেছে। এদিকে বড় ফুপু প্রতিদিনই ওকে ফোন দিয়ে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। ওর মত আছে কিনা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু কুহু কোন উত্তর না দিয়ে চুপ থেকেছে। যেখানে তাহমিদেরই কোন খোঁজ নেই, সেখানে সে কিভাবে সবাইকে তার কথা বলবে! যদি তাহমিদ ওর সাথে যোগাযোগ করত, তবে ও অবশ্যই চাচা-ফুপুকে বিয়ে বন্ধ করতে বলত।
কিন্তু তাই বলে ও নিজের জীবনে তাহমিদ ছাড়া অন্য কাউকে কল্পনা করতে পারেনা।

সেদিন সন্ধ্যায় রায়হান আহমেদ আসলেন কুহুর সাথে কথা বলতে। কুহু নত মস্তকে বসে আছে। ও জানে চাচা কি বলতে চায়।

” মা, কি সিদ্ধান্ত নিলি? আশিকের বাবা আর অপেক্ষা করতে চাইছেননা। তিনি চাইছেন এখনই বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে। আপাতত ফোনে বিয়ে হবে। আর তিন বছর পর আশিক দেশে আসলে বড় আয়োজন করে তারা পুত্রবধূকে ঘরে তুলবেন। এবার তোর ওপর নির্ভর করছে সবকিছু। তবে আমরা করছি তুই আমাদের নিরাশ করবিনা। ”

” চাচা, আমি সৃজনকে ছেড়ে থাকতে পারবনা। আর সৃজুও সেটা পারবেনা। ও এখনও অনেক ছোট। নিজের ভালো এখনো বুঝতে শেখেনি। ওকে এই অবস্থায় একা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ”

” সৃজনের চিন্তা তোকে করতে হবেনা। আগামী তিন বছর তোরা এখানেই থাকবি। শুধু মাঝেমধ্যে আশিকের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বেড়িয়ে আসবি। তিন বছর পর আশিক তোকে আর সৃজনকে নিয়ে কানাডা চলে যাবে। ”

ধীরে ধীরে যেন কুহুর সব পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে কি ও কোন অচেনা আগন্তুকের সাথে বাঁধা পরতে চলেছে!
যাকে কভু বলা হয়নি ‘ ভালোবাসি ‘ তবুও প্রতিনিয়ত যে ওকে বুঝিয়েছে ভালোবাসা না বললেও হয়ে যায়। মুখে বলতে হয়না। মনের সাথে মন মিলে গেলেই ভালোবাসা নীরবেই ধরা দেয়। তবে কি সেই মানুষটার সাথে বিচ্ছেদ আসন্ন!

পরদিন সকালেই সোহানী পারভিন রাজশাহী আসলেন। তাকে দেখে কুহু অবাক হয়ে গেছে। আজ ফুপুকে দেখে ওর মনে খুশির দোলা লাগলনা। মুখের ভেতর তিক্ত স্বাদ অনুভব করছে।
সোহানী পারভিন প্রতিটা কথায় কুহুকে বুঝিয়ে দিলেন তারা সবাই চাচ্ছে এখানেই কুহুর বিয়ে হোক। তিনি কুহুকে অনেক বোঝালেন। সেই সাথে তিনি আজ কুহুকে কোচিং-এ যেতে নিষেধ করে দিলেন। কারন আজ বিকেলে আশিকের বাবা-মা, দুই বোন কুহুকে দেখতে আসবে। সেরকম হলে আজকেই তারা বিয়ের দিন ঠিক করবেন।

এবার কুহু ফুপুর কোলে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সোহানী পারভিন ভাবলেন বাবা-মা হারা মেয়েটা মৃ’ত বাবা-মা’কে স্মরণ করেই কাঁদছে। তিনি নানানভাবে কুহুকে শান্তনা দিলেন। ওকে থামানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কুহু কিছুতেই কান্না থামায়না। ও যেন আজ নিজের সব কষ্টকে অশ্রুবিন্দুতেই উজার করে দিচ্ছে।

কিছুক্ষণ পর কুহু ফোন নিয়ে লনে এসে দাঁড়ায়। ফোন করল রাজিয়া খালার কাছে। একটাবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায়।

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here