প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_৩৩ জাওয়াদ জামী জামী

0
307

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৩
জাওয়াদ জামী জামী

এই সকালে তাহমিদকে দেখে রায়হান আহমেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। তিনি এত সকালে তাহমিদকে আশা করেননি। তাহমিদ সকাল ছয়টায় যখন তাকে ফোন দিয়ে বাসার সামনের কফিশপে ডেকেছে, তখনই তিনি চরমমাত্রায় বিস্মিত হয়েছেন। এত সকালে কফিশপ খোলা নেই তাই তারা কফিশপের পাশের চায়ের দোকানে বসেছে।

” তাহমিদ, তুমি এস্তোনিয়া থেকে কবে এসেছ! গত কয়েকদিন তোমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু তোমার ফোন বন্ধ পেয়েছি। এই সকালে হঠাৎ করে আমাকে ডাকলে যে! কোন সমস্যা? ”

” অনেক সমস্যা। তো এই অধমকে মনে করার কারন কি! অধমকে তো আর আপনাদের কোনও কাজে লাগবেনা। এই অধম শুধু নামেই মানুষ। ”

” এভাবে বারবার নিজেকে অধম বলছ কেন! তুমি হলে গিয়ে খাঁটি সোনা। ”

” খাঁটি সোনা হলে, আপনার চোখ কানাডা প্রবাসীর দিকে পড়তনা। খাঁটি সোনাকেই আপন করে নিতে চাইতেন। আপনারা মনে করেন, পাত্র প্রবাসী হলেই সে যোগ্য, ভালো, সৎ ব্লা ব্লা। তাদের দশটা গার্লফ্রেন্ড থাকলেও তারা ভালো। এদিকে আমার মত হতভাগারা সারাজীবন গার্লফ্রেন্ডহীনতায় কাটিয়েও আপনাদের মন পাইনা। তাই চোখের সামনে উপযুক্ত ছেলেকে আপনাদের নজরে পরেনা। আপনারা মেয়েদের জন্য যদি প্রবাসী ছেলেই খুঁজবেন, তবে দেশের বাবা-মা’ দের জানিয়ে দিতেন তাদের ছেলেদের কষ্ট করে পড়াশোনা না করাতে। তাহলে আমার মত বেচারা ছেলেগুলো একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলত। তাদের সময়ে-অসময়ে এভাবে ছুটে আসতে হতোনা। নির্বিঘ্নে বিদেশে বসে নিজের কাজ করতে পারত। ”

তাহমিদের কথা শুনে রায়হান আহমেদ হা হয়ে গেছেন। সহসাই তার মুখে কোনও কথা জোগায়না। তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন তাহমিদের কথার মর্মার্থ। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি ধাতস্থ হয়ে মুখ খুললেন।

” তুমি কি বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছ নাকি আমাকে থ্রেইড দিছ? ”

” যেটা মনে করবেন সেটাই। থ্রেইড যদি মনে করেন, তবে শুনে রাখুন, আমি আপনার ভাইয়ের মেয়েকে তুলে নিয়ে বিয়ে করব, যদি আপনারা রাজি না থাকেন। আর যদি প্রস্তাব মনে করেন, তবে আমি আপনার সেই মেয়েটিকে রানী করে নিজের ঘরে নিয়ে যাব আপনাদের সম্মতিতে। আমার প্রস্তাব আমি দিয়েছি এবং দুই ভাবেই দিয়েছি। এখন কোনভাবে আপনি রাজি হবেন সেটা আপনার ব্যাপার। ”

” এইভাবে কেউ কখনো বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সেটা আমি বাপের জন্মেও দেখিনি! ”

” কি করব বলুন, আপনার মত একজন অভিজ্ঞ মানুষ যদি ঐ বাচ্চা মেয়েটার মনের কথা বুঝতে না পারেন, তবে আমাকে এমন উপায়ই অবলম্বন করতে হবে। বাপের জন্মে এমন প্রস্তাব দেখেননিতো কি হয়েছে! নিজের জন্মে দেখেন। যেকোন একজন্মে দেখলেই হল। দুই জন্মেরই শেষ ফলাফল একটাই ‘ বিয়ে ‘। ”

” তবে আর দেরি কেন? সব যখন ঠিক করেই ফেলেছ, তবে ডেইটও তুমিই ঠিক কর। ” রায়হান আহমেদ হেসে বললেন।

” আমি কি আপনার কথা সত্যি বলে ধরে নিব? সেই প্রবাসীর পরিবারকে কি বলবেনে? ”

” চোখের সামনে এমন যোগ্য প্রার্থী রেখে আমি দূর দেশে মেয়েকে পাঠাতে যাব কোন দুঃখে! যাকে অনেক বছর যাবৎ চিনে এসেছি, যার সাথে সুখ-দুঃখের গল্প করেছি। যে আমার ভাতিজীর জন্য এমন ঝুঁকি নিতে পারে, তাকে না করি কিভাবে! আর রইল আশিকের পরিবার। তাদেরকে আমি এক্ষুনি না করে দেব। কুহুর সুখের জন্য আমি সব করতে পারি। ”

” ওকে, তবে আপনার ভাইবোনকে ডেকে নিয়ে আসুন। আমার বউ তার চাচা-ফুপুর দোয়া নিয়েই নতুন জীবন শুরু করবে। চারঘন্টা সময় দিলাম আপনাকে। চারঘণ্টা পর আমার শ্বশুর জন্য হবার প্রস্তুত হোন। ”

মায়ার ফোন পেয়ে কুহু একটু অবাকই হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটায় মায়া ওকে কেন ফোন দিয়েছে! আর সেই মানুষটাই বা কোথায় হাওয়া হয়েছে! সে সেই যে বেরিয়ে গেল, এতক্ষণ হয়ে গেছে তবু তার দেখা নেই! কপালে চিন্তার ভাঁজ নিয়েই কুহু ফোন রিসিভ করলে মায়া ওকে জানালো, সে গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তার কথা শুনে কুহু গেইটে গিয়ে দারোয়ান চাচাকে গেইট খুলে দিতে বলল। মায়া হাসিমুখে ভেতরে এসে কুহুকে জড়িয়ে ধরল।

দুই ঘন্টা পর কুহু বসে বসে মায়ার কাজ দেখছে। সে কুহুকে জোড় করিয়ে গোসল করিয়ে নিয়েছে। এরপর ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছে।

আর কিছুক্ষণ পর যখন রিশা, নিশো আসল তখন কুহু শুধু ভাবছে ওরা এখন কেন এসেছে?

সজলকে সাথে নিয়ে তাহমিদ যখন বাসায় আসল, তখন ওর হাতে একটা ন্যাপসাক। সজল কুহুকে দেখে মিটিমিটি হাসছে।

রাজিয়া খালাকে দেখে কুহু তাকে জড়িয়ে ধরল।এই মানুষটার জন্য আজ ও তাহমিদকে ফিরে পেয়েছে। খালার সাথে সৈকত আহমেদ তার স্ত্রী-সন্তানদের এসেছে। এত বছর পর নিজের বাড়িতে এসে যে বড় ভাগ্নের বিয়েতে থাকতে পারবে একথা সে কল্পনাই করতে পারেনি। সবাইকে দেখে ভালো লাগলেও একটা চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। চাচারা আর ফুপু যদি রাজি না হয়! কিন্তু ওর বুকের ওপর থেকে মস্ত একটা পাথর সরে গেলে, যখন দেখল বড় ফুপু, চাচা গ্রাম থেকে এসেছে। সাথে সিহা আর সাদমানও আছে। বড় ফুপু তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে। বাসায় এসেই সোহানী পারভিন কুহুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি মুখে কৃত্রিম রা’গ এনে বললেন,

” তাহমিদে কথা আমাকে বললে কি হত? আমরা কি তোর কথা শুনতামনা! আমরা তোকে সুখী দেখতে চাই। তোর সুখ আমাদের প্রথম চাওয়া। ”

ফুপুর কথা শুনে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করল৷

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কুহু নিজেকে দেখছে। পার্লার থেকে কয়েকজন এসে ওকে একঘন্টা ধরে সাজিয়েছে। এখন ও নিজেকে চিনতেই পারছেনা। ও কতবার মায়া আপুকে নিষেধ করেছে, সাজতে চায়না। কিন্তু মায়া সেকথা শুনলেতো।

গাঢ় বেগুনি রঙের বেনারসিতে ওকে যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কুসুমের ন্যায় লাগছে। মানুষটা এত তারাতারি শপিং করছে ভাবতেই কুহুর মন প্রেমহিল্লোলে ছেয়ে যাচ্ছে। হালকা জুয়েলারিও কিনেছে মানুষটা। কুহুর পোশাকের সাথে মিল রেখে নিজের জন্যও শেরওয়ানি কিনেছে। অবশ্য সে কিনতে চায়নি, সজলের জোরাজুরিতে কিনতো হয়েছে।

অনেকটা ঘোরের মধ্যেই ‘ কুবল ‘ শব্দটি উচ্চারিত হলো কুহুর কন্ঠা থেকে। ও এখনও বিশ্বাস করতে পারছেনা, আজকে ও অন্য কারো অর্ধাঙ্গীনি হলো! মানুষটা সকাল সকাল ওকে এতবড় সারপ্রাইজ দিবে তা ওর কল্পনায়ও ছিলনা।

বিকেলেই সাইদ আহমেদ ছেলেমেয়েদের নিয়ে গ্রামে ফিরে যান। রাজিয়া খালাও সন্ধ্যায় ফিরে গেলেন। তবে সোহানী পারভিন থেকে গেলেন।

রায়হান আহমেদও রাতের খাবার পর রিশা, নিশোকে নিয়ে ফিরে গেলেন।

সৃজন ভাবতেই পারছেনা ওর আপুর সাথে তাহমিদের বিয়ে হয়েছে। তাহমিদ অল্পদিনেই তার প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিল। এবার তার সাথেই বোনের বিয়ে হতে দেখে ওর খুশির সীমা রইলনা। ও সারাক্ষণ তাহমিদের সাথে লেপ্টে রইল। তাহমিদ ওর জন্যও শপিং করেছে। সেই পোশাক পরেই ছেলেটা আনন্দ করেছে।

রাতে বাসায় ফেরার পূর্বেই মায়া কুহুকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। কুহু তাদেরকে থাকবার জন্য অনুরোধ করেছে, কিন্তু সকালে সজলের ক্লাস আছে জন্য তাদের যেতে হচ্ছে।

রাত বারোটা পঞ্চাশ। কুহু ব্যালকোনিতে বসে আছে। ভারি শাড়িতে ওর প্রান যাই যাই অবস্থা। আজকের আগে খুব একটা শাড়ি পরেনি মেয়েটা। সেজন্যই এত অস্বস্তি লাগছে। এদিকে রুমে যাওয়ার ও সাহস পাচ্ছেনা। সেখানে তাহমিদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সৃজনের রুমে ফুপু শুয়েছে। ও একবার ভাবছে ফুপুকে ডেকে তুলবে কিনা। পরক্ষনেই আবার ভাবছে সারাদিন ফুপু অনেক পরিশ্রম করেছে, এখন তাকে ডাক দেয়া ঠিক হবেনা। নানান চিন্তা করছে আর দাঁত দিয়ে নখ কাটছে মেয়েটা।

” এভাবে নখ কাটছ কেন! এখন থেকে মাথার একটা চুলও ফেলার আগে আমার হুকুম নিবে। আমি আমার নিঁখুত বউকে চাই। এত চিন্তা কিসের? কাল থেকে যখন চিন্তা করতে ইচ্ছে করবে, তখন আমাকে জিজ্ঞেস করে নিবে। আমি বললেই তবে চিন্তা করবে। ”

হঠাৎই তাহমিদের গলা শুনে কুহু চমকে উঠল।

” আ..আপনি! আপনি না ঘুমিয়ে ছিলেন! ”

” ঘুমিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন জেগে গেছি। তুমি এতরাতে এখানে বসে আছ কেন? রুমে যাওয়ার ইচ্ছে নেই? মায়া তোমাকে কিছু শেখায়নি! ”

কুহু তাহমিদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই হাসি আসছেনা। কুহুকে নীরব থাকতে দেখে তাহমিদ আবারও বলে উঠল,

” আজকের রাতটা কি এখানেই কাটিয়ে দেবে ভাবছ। তবে কি ঐতিহাসিক এই বাসর বারান্দায় হবে? বারান্দায় হোক আর ছাদেই হোক, আমি রাজি। যেকোন এক জায়গায় হলেই হয়। আগেই বলেছি, আমি টাইম ফুল ফর্মে থাকি। তবে দেরি কেন, কাছে এস। ”

তাহমিদের কথা কানে যেতেই কুহু লাফিয়ে চেয়ার ছাড়ল।

” কি..কিসব ব..বলছেন! আমার ঘুম পেয়েছে। ” কুহু কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।

” তো! আমি কি বলেছি তোমাকে ঘুমাতে দেবনা! বেয়াদব মেয়ে, সকালেতো খুব কলিজার ওপর আছড়ে পরেছিলে। তখন সার্টিফিকেট বিহীন আপনজন ছিলে। কিন্তু তখন ভয় পাওনি। অথচ এখন যখন তুমি আমার সার্টিফিকেটধারী বউ, কোথায় এখন নির্ভয়ে কলিজার মধ্যে ঢুকে যাবে, সেটা না করে ভয়ে তো তো করে তোতলাচ্ছ? যা করার আমাকেই করতে হবে দেখছি। এত সাধনার বউ আমার, এত সাধের বাসর রাত আমাদের। এই সাধের রাত আমি বিনা কাজে কাটাতে রাজি নই। আমি আবার পরিশ্রমি জীব কিনা। ” কথাটা বলেই এক ঝটকায় তাহমিদ কুহুকে কোলে তুলে নেয়।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here