#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৬
জাওয়াদ জামী জামী
” আপনি কি সত্যিই খালামনিকে ডিভোর্স দেবেন! বিষয়টা আরেকবার চিন্তা করে দেখলে হতোনা। আরেকটা সুযোগ তাকে দিতে পারেননা? লাস্ট একটা সুযোগ। ” তাহমিদ অনুনয় করে বলল রায়হান আহমেদকে।
ওরা দু’জন বাগানের এক কোনায় বসে কথা বলছে। নায়লা আঞ্জুমের সাথে কথা কাটাকাটির পর রায়হান আহমেদ ছেলেমেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে সৈকত ও তার স্ত্রী স্মৃতি তাকে জোড় করে আটকে রেখেছে।
” তুমি কি আমাকে এতটাই বোকা আর নির্দয় মনে কর, তাহমিদ! আর যাইহোক নিজের সংসার নিজের হাতে নষ্ট করার মত মানুষ আমি নই। আমি শুধু নায়লাকে একটু শিক্ষা দিতে চাই। ওকে সংসারের মায়া বুঝতে হবে, দ্বায়িত্ব পালন করতে শিখতে হবে। এতদিন যা যা ভুল করেছি সেসব শুধরে নিতে চাই। আর সেই সাথে নায়লাকেও তার ভুলগুলো উপলব্ধি করাতে চাই। নায়লাকে তার ভুলগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাই। আমার সন্তানদের একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে চাই। ”
রায়হান আহমেদের কথা শুনে তাহমিদ মৃদু হাসল। ওর পাশে বসে থাকা মানুষটা যে নিজের পরিবারের প্রতি সদয়, সেটা আরেকবার উপলব্ধি করল।
” আপনি আজ খালামনিকে নিজের সাথে নিয়ে যাবেননা। তাকে এখানেই রেখে যান। আর এই বিষয়ে মামা কিংবা মামীকে কিছুই বলার দরকার নেই। তাদেরকে আগে কিছু বললে, খালামনির আপ্যায়ন ঠিকঠাক হবেনা। তাকে আগে কিছুদিন বাবার বাড়িতে রাজকীয়ভাবে কাটাতে দিন। ”
” তুমি ঠিকই বলেছ। সৈকত যদি জানে, আমি নায়লাকে শিক্ষা দিতে এখানে রেখে যাচ্ছি, তবে তারা হয়তো নায়লার প্রতি নমনীয় হবে। কিন্তু আমি এটা হতে দেবনা। এমনকি এই কথাটা রিশা , নিশোকেও জানানো যাবেনা। এসব কথা এখন থাক। এক কাজ কর, আগামীকাল তুমি কুহু, আপা, সৃজনকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। কাল সারাদিন তোমরা সেখানে আনন্দ কর। ”
” মেয়ে আর জামাইকে কেউ এভাবে দাওয়াত দেয়, সেটাতো জানতামনা! কোথায় বংশের একমাত্র জামাইকে ইনিয়েবিনিয়ে দাওয়াত করবেন। কিন্তু সেটা না করে মুখে নিমপাতা ঢেলে কথা বলছেন। এটাই বুঝি চাচা শ্বশুরের আসল রূপ! ”
তাহমিদের এমন অভিযোগ শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন রায়হান আহমেদ। তবে তাহমিদ যে তার সাথে মজা করেছে, এটা তিনি বুঝতে পারছেন।
” ভুল হয়ে গেছে, জামাইবাবা। তুমি আগামীকাল সকালে তোমার স্ত্রী, শালাবাবু আর ফুপু শ্বাশুড়িকে নিয়ে আমার বাসায় চলে এস। সারাদিন সেখানে খাওয়াদাওয়া কর, আনন্দ উল্লাস কর। তোমার পছন্দের খাবার রান্না করতে বলব আমার বড় বোনকে। তুমি কবজি ডুবিয়ে খেও। ” রায়হান আহমেদও ঠাট্টার ছলে বললেন।
” সাব্বাশ। এই না হলে শ্বশুর মশাই। তবে একটু বেশি করে বাজার করবেন। জামাইতো আর আপনার বাসায় খালি হাতে যাবেনা। ফল-মিষ্টি, ঠান্ডা, গরম কত কিছুই নিতে হবে। জামাই অনেক কিছু নিয়ে যাবে, কিন্তু শ্বশুর বাজার কম করল। বিষয়টা একটু দৃষ্টিকটু। ”
” জামাইকে আর কষ্ট করে ফল মিষ্টি নিতে হবেনা। শুধু তারা গেলেই চলবে। প্রয়োজনে আমি জামাইকে সাথে করে বাজারে নিয়ে গিয়ে, তার পছন্দমত বাজার করব। ভালো হবেনা? ”
” আমরা যে এত প্ল্যান করছি, আপনার স্ত্রী জানলে কি হবে বলুনতো? ভদ্রমহিলা শোকে যদি স্ট্রোক করে বসে! ” ভাবুক চেহারায় জিজ্ঞেস করল তাহমিদ।
” তার কলিজা নরমাল মানুষের মত নয়। তার কৈ মাছের কলিজা। সহজে কিছু হবেনা। আমাদের তো কলিজা নয় যেন চায়না প্রোডাক্ট। ওয়ারেন্টি, গ্যারান্টি কিছুই নেই। সেক্ষেত্রে আমার বউয়ের কলিজায় দম আছে। আজ সতের বছর ধরে সংসার করছি, কিন্তু এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়নি তার কলিজায় কোনও আঁচড় পরেছে। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পার। ভালো কথা মনে হয়েছে, তুমি কি তোমার বাবাকে বিয়ের কথা জানিয়েছ? ”
” নাহ্, এখোনো জানাইনি। ভাবছি কুহুকে ঢাকায় নিয়ে গিয়েই তাকে সারপ্রাইজ দেব। আগেই তার ব্লাড প্রেশার বাড়াতে চাইনা। আমি সামনাসামনি দেখতে চাই, আমার বউ দেখে তার অবস্থা কেমন হয়। ”
” আমার কিন্তু টেনশন হচ্ছে। সে যদি কুহুকে মেনে না নেয়? মেয়েটা জীবনে কম কষ্ট পায়নি। আমি আর ওকে কষ্ট পেতে দেখতে পারবনা। ”
” কুহু আমার স্ত্রী। আর স্ত্রী’কে সকল দুঃখ-কষ্ট, অপমান, অসম্মানের হাত থেকে হেফাজত করার দ্বায়িত্ব তার স্বামীকেই পালন করতে হয়। এই বিষয়ে আশা করছি আমি আপনাকে নিরাশ করবনা। ”
” আমি জানি তুমি যা করবে ভেবেচিন্তে করবে। তোমার ওপর এই বিশ্বাস আমার আছে। তাই একবাক্যে কুহুকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আমি জানি তুমিই ওর উপযুক্ত। তো ঢাকা ফিরছ কবে? ”
” আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। কুহুর কোন অমর্যাদা হতে আমি দেবনা। তিনদিন পর কুহুকে নিয়ে ঢাকা যাব। ওকে ওর শ্বশুর বাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসব। ”
দুপুর বেলা সবাই মিলে খেতে বসলে নায়লা আঞ্জুমকে ডাকতে যান রাজিয়া খালা। নায়লা আঞ্জুম তার পূর্বের রুমেই ছিল। রাজিয়া খালাকে দেখামাত্রই সে খেঁকিয়ে উঠল। সে সাফ জানিয়ে দেয়, কারও সাথে সে খাবেনা। রাজিয়া খালা সেকথা বাহিরে এসে জানালে নায়লা আঞ্জুমকে ছাড়াই সবাই খেয়ে নেয়।
রিশা, নিশো সকালের পর মায়ের কাছে ঘেঁষেনি। এখন আবার রাজিয়া খালার কাছে সব শুনে ওদের ভিষণ রা’গ হয়। রিশা মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, ও আর মা’য়ের আশেপাশে যাবেনা।
সন্ধ্যার পরে সবাই বিদায় নেয়। তাহমিদ কুহুকে নিয়ে চলে যায়। আর রায়হান আহমেদ তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলে যান নিজের বাসায়। তিনি যাবার আগে তাহমিদকে আগামীকাল তার বাসায় যাওয়ার কথা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। তিনি এ-ও বললেন, তাহমিদ যেন বাসায় পৌঁছেই সোহানী পারভিন আর সৃজনকে তার বাসায় পাঠিয়ে দেয়। তিনি সোহানী পারভিনের সাথে আগেই কথা বলেছেন। আগামীকাল তার বাসায় সোহানী পারভিন না থাকলে চলবেনা। তাহমিদ তার কথায় রাজি হয়।
বাসায় এসে তাহমিদ নিজে সোহানী পারভিন আর সৃজনকে রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছে দেয়। সোহানী পারভিন তাহমিদকে খুব পছন্দ করেছেন। তিনি মন থেকে ওকে দোয়া করলেন।
কুহু বাসায় এসে দেখল ফুপু রাতের খাবার রান্না করেই রেখেছেন। ওকে আর কষ্ট করে রান্না করতে হলোনা।
নায়লা আঞ্জুম সেইযে সকালে রুমে ঢুকেছে, সারাদিন বের হয়নি। রাতে সবার খাওয়া শেষ হলেই তবে সে রুম থেকে বের হয়। রাজিয়া খালা তার জন্য খাবার টেবিলেই রেখেছেন। সে রুম থেকে বেরিয়ে খাবার খেয়ে আবার রুমে চলে যায়। দুপুরে স্মৃতি তাকে খাওয়ার জন্য রাজিয়া খালাকে ডাকতে পাঠালেও, রাতে তাকে কেউ-ই ডাকতে যায়নি। এই বিষয় নিয়েও নায়লা আঞ্জুম রে’গে আছে। এত বছরেও তার সাথে যা ঘটেনি, আজ তা-ই ঘটেছে। এ কথা যখনই তার মনে হচ্ছে, ততবারই সে সৈকত, স্মৃতি আর কুহুকে অভিশাপ দিচ্ছে। সেই সাথে তাহমিদকেও লাগাতার গালিগালাজ করেই যাচ্ছে। সে সব কিছুর জন্য তাহমিদকে একতরফা দায়ী করছে।
কুহু অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে বিছানার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড়চোপড় আর জুয়েলারির দিকে। তাহমিদ সোহানী পারভিনকে রেখে আসার পথে কুহুর জন্য শাড়ি, থ্রিপিস, জুয়েলারি কিনে এনেছে।
” এসব কি করেছেন! গতকালই না কত শপিং করেছেন। আবার আজকে কেন? ”
” আমার একটা বউয়ের জন্য সামান্য কিছুই এনেছি। এতে তোমার এত কথা কেন? বিয়ের দুইদিন পূর্তি উপলক্ষ্যে সামান্য কেনাকাটা করেছি। দশটা নয় পাঁচটা নয়, একটামাত্র বউ আমার। তার এতটুকু তো করতেই পারি। ”
” আজকে দুইদিন, তাহলে কালকে তো তিনদিন হবে। তিনদিন পূর্তি উপলক্ষ্যেও কি তবে কেনাকাটা করবেন? এরপর চারদিন, পাঁচদিন, এভাবে একমাস, পাঁচমাস, দশমাস। এভাবে চলতেই থাকবে? আর মানুষের বউ কয়টা হয় শুনি? ”
” ভালো আইডিয়া দিলে তো। আমার কাছে প্রতিদিনই স্পেশাল। তাই প্রতিদিনই এমন শপিং চলতেই থাকবে। যদিও আমাদের প্রতিবেশি আংকেলের তিনটা বউ। তবে সে কিন্তু তিন বউকেই সমান প্রাধান্য দেয়। কিন্তু আমার আপাতত একটা। তাই একটার জন্যই যথাসাধ্য করার চেষ্টা করছি, করব। ”
” আপাতত একটা মানে? আপনার কি আরও কয়েকটা বিয়ে করার ইচ্ছে আছে! ” কুহু সবিস্ময়ে জানতে চাইল।
” আপাতত সেরকম কোন ইচ্ছেই নেই। ইন ফিউচার বউ যদি কম কম ভালোবাসে তবে করতেই পারি। আমার মনে হয় কপালে আরেকটা বউয়ের আদর আছে। এই বউটা আমাকে একদমই ভালোবাসেনা। ” তাহমিদ ভয়ে ভয়ে বলল।
” কিহ্! আপনি আবার বিয়ে করবেন? আমি আপনাকে ভালোবাসিনা! ” কুহুর গলা ভয়ে কাঁপছে।
” এখন করব সেটা বলিনি তো। বলেছি ভবিষ্যৎ করতেও পারি। তোমাকে রাতে কতবার করে বললাম, একটা চুমু দাও। তুমি কি আমার কথা শুনেছ? আবার এখন বাহিরে এসে তোমাকে চুমু দিলাম, বিনিময়ে তুমি কি আমাকে কিছু দিয়েছ? আমারও তো আদর পেতে ইচ্ছে করে। এখন আমার সেই প্রাপ্য আদর যদি তুমি না দাও, তবে আমাকে বাধ্য হয়েই আরেকবার শুভ কাজ করতে হবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু কিছু বলার ভাষা হারিয়েছে। ওর বরটা যে একটা বেশরম সেটা বুঝতে ওর বাকি নেই। তাই ও তাহমিদের কথার উত্তর না দিয়ে চুপচাপ কাপড়চোপড় গোছাতে শুরু করল।
এদিকে তাহমিদ কুহুকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসল। হঠাৎই ও এক ঝটকায় কুহুর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলল। পরক্ষণেই কুহুকে নিজের কাছে টেনে ওর অধরে অধর মিশিয়ে দেয়। অনেকক্ষণ পর তাহমিদের আক্রমন থেকে মুক্তি পেয়ে কুহু হাঁপাতে থাকে। কিন্তু তাহমিদ এখনও ওকে জাপ্টে ধরে রেখেছে। কুহু ছাড়া পেতে মোচড়ামুচড়ি করলেও তাহমিদের মনে একটুও দয়া হয়না। বরং ও আরও শক্ত করে ধরে কুহুকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়। ঘোর লাগা গলায় বলে,
” আমার বউ পাখিটা বুঝি রা ‘ গ করেছে? রাগলে তাকে ব্যাপক এ্যাট্রাকটিভ লাগে, সেটা কি সে জানে? মনে হয়, আস্ত একটা রসগোল্লা আমার সামনে এসে বলছে ‘ ভক্ষণ কর ‘। আমি আবার ভিষণ দয়ালু। তার এমন নিরব আবদার ফেলতে কষ্ট হয়। তাইতো সময়ে-অসময়ে তাকে রা’ গি ‘য়ে দিয়ে রসগোল্লা ভক্ষণের পায়তারা করি। ”
তাহমিদের এহেন নির্লজ্জ বাক্যে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করে। লজ্জায় আরক্তিম মুখে সে তাহমিদ আচমকা অত্যাচারের হাত থেকে নিস্তার পেতে চাইল। কিন্তু ওর যে নিস্তার নেই, তা বোধহয় এখনও বুঝতে পারেনি। ও এখন সম্পূর্ণরূপে তাহমিদের অধীনে। মোচড়ামুচড়ি করেও লাভ হলোনা। তাহমিদ ওকে জড়িয়ে নিল মধুমাখা ভালোবাসার চাদরে। যে ভালোবাসায় কোন খাঁদ নেই। যে ভালোবাসা পেলে কোন নারী কখনো ছেড়ে যাবেনা। একান্ত পুরুষের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেতে উদগ্রীব হয়ে থাকে হাজারও রমনী। কুহুও না চাইতেই আরেকবার পেতে চলেছে সেই ভালোবাসা।
চলেছে…