প্রিয়াঙ্গন #পার্ট_৩৯ জাওয়াদ জামী জামী

0
337

#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৯
জাওয়াদ জামী জামী

” এভাবে কি দেখছ! আমাকে কি আগে কখনো দেখনি? ” কহু তাহমিদের রুমে এসে আরেক দফা অবাক হয়ে তাহমিদের দিকেই তাকিয়ে থাকে। কহুকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয় তাহমিদ।

” দেখছিনা, ভাবছি। ”

” কি ভাবছ! ”

” যে মানুষটা এত বড় বাড়ির ছেলে, রাজকীয় যার রুম, সে আমাদের গ্রামের বাড়ির এক সাদামাটা রুমে কিভাবে কাটিয়েছে! তার কি কোনও কষ্ট হয়নি! ”

” মেয়ে, তুমি কি তোমার মুখটা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখবে? তোমাকে আগেই বলেছি, এটা আমার বাড়ি নয়। আর এই রুমের মালিকও আমি নই। তাই এসব আজেবাজে চিন্তা করে আয়ু কমানোর কোন মানেই হয়না। তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো চলে আসবে। খেয়েদেয়ে জম্পেশ ঘুম দেবে। যাও ফ্রেশ হয়ে এস। ” তাহমিদ কুহুকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দেয়।

কুহু ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল তাহমিদ বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে আছে। মনযোগ দিয়ে ফোন দেখছে। তাহমিদকে এই অবস্থায় দেখে ওকে বিরক্ত করার ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল কুহুর। এ ওয়াশরুমে গিয়ে দু হাতের আঁজলায় পানি নিয়ে এসে তাহমিদের শরীরে ছিটিয়ে দিল।

হঠাৎই শরীরে পানি পরতেই কুহু ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। কুহুর দিকে তাকাতেই দেখল, মেয়েটার ঠোঁটের কোনে দুষ্টুমির হাসি।

” বউ দেখছি আমার সাথে দুষ্টুমি করতেও শিখে গেছে! অথচ আমি আমার বউটাকে নাদান বালিকা ভেবে, পারলে সারাদিন-রাত কোলে নিয়ে বসে থাকার চিন্তায় বিভোর থাকি! আর এই মেয়ে কিনা আমাকেই ঘোল খাওয়ানোতে পটু। ”

তাহমিদের কথা শুনে কুহু খিলখিল করে হাসতে থাকে। ও তাহমিদের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া চেহারা দেখে মজা পাচ্ছে।

” তবে রে মেয়ে, আমাকে বিপর্যস্থ হতে দেখে মজা নিচ্ছ! ওয়েট, আমিও এখন মজা নিব। তার আগে তোমাকে বাথটাবে কিছুক্ষণ চুবিয়ে রাখব। ” তাহমিদ বিছানা থেকে নেমে কুহুকে ধরতে গেলেই মেয়েটা দৌড়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।

” আপনি আর এক ধাপ সামনে এগোলে আমি দরজা খুলে বাহিরে চলে যাব। সোজা আমার শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে গল্প করতে বসে যাব। গল্প করতে করতে সারারাত কাটিয়ে দেব। বিষয়টা খুব একটা খারাপ হবেনা তাইনা? ”

কুহুর হুমকিতে তাহমিদ মোটেও ভয় পায়না। তবে এই মুহুর্তে ওর মেয়েটাকে ধরতে হবে। তাই কায়দা করে কুহুর কথা শোনার ভান করল। একবার ওকে ধরতে পারলেই কেল্লাফতে। ওকে আর পায় কে।

” তুমি এইভাবে আমাকে হুমকি দিচ্ছ, বউ? আমার মত এমন ইনোসেন্ট জামাইকে তুমি এভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে পারনা। এটা অন্যায়। শুধু অন্যায়ই নয় মহাঅন্যায়। আর একজন পতিব্রতা রমনী হিসেবে এটা তোমার আচরণের পরিপন্থী হয়ে যায়। এই অসহায় মানুষটার ওপর তোমার কি একটুও দয়া হয়না? যদিও তুমি তোমার নামমাত্র শ্বাশুড়ির কাছে গিয়ে পাত্তা পাবেনা। তবুও তোমার কথা শুনে আমার কেমন যেন কষ্ট কষ্ট ফিল হচ্ছে। ” তাহমিদ কাঁদোকাঁদো গলায় বলল।

” হয়েছে আর অভিনয় করতে হবেনা। সাধে তো আর বলিনা, অভিনয়ের জন্য আপনি কয়েকটা অস্কার ডিজার্ভ করেন। এতে অস্কারও ধন্য হয়। অস্কারও আপনাকে মনেপ্রাণে কামনা করছে। ”

” তুমি আমাকে বিশ্বাস করলেনাতো, বউ! এই দুঃখ আমি কোথায় রাখি। তাহমিদ ভাই, তুই সত্যিই হতভাগা। বউ তোকে বিশ্বাস করেনা। ” তাহমিদ কথা বলত বলতে গুটিগুটি পায়ে কুহুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

কুহু সেটা বুঝতে পেরে দরজা খুলতে চাইলেই কেউ বাহির থেকে দরজায় নক করল।

” তাহমিদ , আব্বা, তুমি ফ্রি আছ? ” বাহিরে শাহানা আক্তারের গলা শুনতে পেয়েই কুহু থেমে যায়। ও দরজা খোলার অনুমতি নিতে তাকায় তাহমিদের দিকে।

তাহমিদ ইশারা করলে কুহু দরজা খুলে দেয়।

” ভেতরে এস, ফুপু। ”

” আব্বা, আজকে তুমি আর বউমা তোমার বাবার সাথে খাবে। রাশেদ তোমাদের কিছুক্ষণের মধ্যেই নিচে যেতে বলেছে। ” শাহানা আক্তার ভেতরে এসে বললেন।

” ফুপু, তুমি সবকিছুই জানো। তারপরও কেন এমন আবদার করছ! এমন আবদার কেন কর, যেটা আমি রাখতে পারবনা। আর আমি খাবার অর্ডার দিয়েছি। ডেলিভারি বয় রাস্তায় আছে। কয়ে মিনিটের মধ্যেই সে পৌঁছে যাবে। ”

” আব্বা, রাশেদের ইচ্ছে সে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। এটা তার আবদার, আমার নয়। আসুক ডেলিভারি বয়। খাবার আমি রিসিভ করব। আমরা সবাই মিলে সেগুলো খাব। ” শাহানা আক্তার বায়না করলেন।

” আজ হঠাৎ তার এমন ইচ্ছের কারন কি? তার স্ত্রী-সন্তানেরা আছে। তাদের পাশে আমার স্ত্রী বেমানান। নাকি আমার স্ত্রী’ কে অপমান করতেই এই আয়োজন? ”

” তাহমিদ, তুমি রাশেদের প্রথম সন্তান। আজ তুমি নতুন বউ নিয়ে বাসায় এসেছ। সে কিন্তু বিনাবাক্যে বউমাকে মেনে নিয়েছে। বউমাকে দেখার পর থেকেই ওকে বেশ খুশি খুশি লাগছে। ওর তো ইচ্ছে করতেই পারে বউমাকে সাথে নিয়ে খাবে। তুমি আর না করোনা, আব্বা। ”

” না গেলে হয়না, ফুপু ? তুমি তো জানো, কত বছর আমি তার সাথে খাইনা। ”

” আমার কথা শোন। আজকে রাতে একসাথে খাও। তুমি যদি দেখ, তোমাদের সামান্যতমও অসম্মান হচ্ছে, তবে আর খেওনা। আর তখন তুমি প্রতিবাদ করলেও আমি কিছুই বলবনা। আমার এই অনুরোধ রাখ, আব্বা ”

” তুমি আমাকে অনুরোধ নয়, আদেশ করবে, ফুপু। তোমার আদেশ মেনে আজ তোমার ভাইয়ের সাথেই খাব। তবে সে যেন আমাকে না খোঁ’চা’য়। তাকে বলে দিও। ”

” আমি এখনই রাশেদকে গিয়ে বলছি। তোমরা তারাতারি নিচে এস। বউমা , আমি গিয়ে তোমার শ্বশুরকে বলছি। তোমরা দেরি করোনা কেমন? আমার রান্নাও শেষের দিকে। ” শাহানা আক্তার হেসে রুম ত্যাগ করলেন।

আরও আধাঘন্টা পর তাহমিদ কুহুকে নিয়ে নিচে আসল। ততক্ষণে রাশেদ কুরাইশি ডাইনিং টেবিলে এসেছেন। তিনি একা বসে আছেন। চোখের সামনে ফোন নিয়ে মনযোগ সহকারে কিছু দেখছেন। অনেকদিন পর ডাইনিং এরিয়ায় এসে তাহমিদের সংকোচবোধ হচ্ছে। ও চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসল। শাহানা আক্তার কুহুকে বসতে বললেই, রাশেদ কুরাইশি তাকালেন কুহুর দিকে। কুহু তাহমিদের পাশের চেয়ারে বসতে গেলেইস, রাশেদ কুরাইশির ডাকে ও থমকে দাঁড়ায়।

” বউমা, তুমি আমার পাশে এসে বস। ” রাশেদ কুরাইশি কুহুকে চেয়ার দেখিয়ে দিল কুহু সেখানে গিয়ে বসল।

তাহমিদ চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে রাশেদ কুরাইশির দিকে। ওর বাবা হঠাৎ কেন এমন নমনীয় আচরণ করছে, সেটা ওর বোধগম্য হচ্ছেনা।

শাহানা আক্তার এসে একে একে সবাইকে খাবার পরিবেশন করেছেন। তবে তাহমিদের বাঁধায় তাকে থামতে হল। তাকেও ওদের সাথে খেতে বসতে হল।

এভাবে সবার সাথে খেতে কুহুর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আচরণে ও মুগ্ধ। তিনি নিজ হাতে এটাসেটা কুহুর পাতে তুলে দিচ্ছেন। কুহু খেতে না চাইলেও তিনি জোর করে দিচ্ছেন।

শাহানা আক্তার খাওয়ার ফাঁকে তাহমিদের প্লেটে রুই মাছের মাথা তুলে দিতে গেলেই রাশেদ কুরাইশির কথায় তিনি থেমে যান।

” আপা, তুমি ওকে সর্ষে ইলিশ দাও। ও মাছের মাথা খেতে পারেনা। ও রুই মাছ অতটা পছন্দও করেনা। সর্ষে ইলিশ খাওয়া হলে, চিংড়ির মালাইকারি দিও। ” রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে শাহানা আক্তার হেসে তাহমিদের প্লেটে সর্ষে ইলিশ তুলে দিলেন।

তাহমিদ বাবার কথা শুনে বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ওর পছন্দ-অপছন্দ ওর বাবা জানে! সে কিভাবে জানল, তাহমিদের সর্ষে ইলিশ পছন্দ? আবার চিংড়ির মালাইকারি কথা সে জানল কিভাবে!

হঠাৎই তাহমিদ অনুভব করল ওর চোখের পাতা ভিজে উঠেছে। যেই বাবা কখনো তার ছেলের ভালোমন্দ খেয়াল রাখেনি, সে-ই বাবাই আজ তার ছেলের পছন্দের কথা বলছে! তাহমিদ অতি সন্তর্পনে চোখ মুছে খাবারে মনযোগ দেয়।

” বাবা, আপনাকে একটু মালাইকারি দেই? আপনিতো শুধু করলা ভাজি দিয়েই খাচ্ছেন। ” কুহু সাহস করে রাশেদ কুরাইশিকে বলল।

” বউমা, আমার ডায়বেটিস আছে। তাই তিন বেলাই করলা খাই। ইচ্ছে থাকলেও এসব খেতে সাহস হয়না। ”

রাশেদ কুরাইশির কথা শুনে কুহুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। ও মৃদুস্বরে বলল,

” একবেলা খেলে কিছুই হবেনা, বাবা। আমি আপনার প্লেটে অল্প একটু তুলে দিচ্ছি। আপনি খান। ” কুহু ওর শ্বশুরের প্লেটে চিংড়ির মালাইকারি তুলে দিলে রাশেদ কুরাইশি আগ্রহ নিয়ে খেতে থাকলেন।

কুহুরা বেশ কিছুক্ষণ হয় খেতে বসেছে। এরমধ্যে ডেইজি কুরাইশিকে সে কোথাও দেখেনি। ও বুঝতে পারছে ওরা খেতে এসেছে জন্যই বোধহয় সে এখানে আসেনি। বিষয়টা কুুহুর কাছে ভালো লাগলনা। নিজেকে কেমন উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে। তবে রাশেদ কুরাইশির আন্তরিকতায় কোন কৃত্রিমতা নেই। যেটা কুহুকে আকৃষ্ট করেছে।

” তুমি রান্না করতে পার, বউমা? ” খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলেন রাশেদ কুরাইশি।

” জ্বি, বাবা। সব রান্নাই মোটামুটি পারি। ”

” কালকে দুপুরে আমি বাসায় খাব। তুমি কালকে আপার সাথে রান্না করতে পারবে? আমি কিন্তু ভোজনরসিক। কিন্তু ডায়াবেটিস শরীরে আক্রমণ করার পর থেকে খাওয়াদাওয়া সব শিকেয় তুলেছি। কিন্তু তুমি যদি রান্না কর, তবে রিস্ক একটা নেয়াই যায়। ”

” ঠিক আছে বাবা, আমি রান্না করব। আপন শুধু বলুন কি কি খাবেন? ”

” আমি সবই খাই। তুমি তোমার পছন্দমত রান্না কর। তবে এই ভদ্রলোক কি খাবে সেটাও জিজ্ঞেস নিও। তার পছন্দের খাবারও রান্না কর। ” রাশেদ কুরাইশি তাহমিদকে ইংগিত করে বললেন।

” ধন্যবাদ। আমি কাল ভার্সিটি থেকে কোচিং-এ ক্লাস নিতে যাব। তাই দুপুরে বাসায় আসতে পারবনা। আপনিই বরং কবজি ডুবিয়ে খেয়েন। ”

” আমিতো খাবই। বউমা প্রথমবার আমার জন্য রান্না করবে। আমি প্রয়োজনের থেকে একটু বেশিই খাব। ”

শাহানা আক্তার বাবা-ছেলের কথপোকথন শুনে হাসলেন। তবে রাশেদ কুরাইশিকে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে তার খুব শান্তি লাগছে। তবে কি বাবা-ছেলের সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে?

বিঃদ্রঃ গত তিনদিন ধরে আম ভিষণ অসুস্থ। ফোনের দিকে তাকানোর অবস্থায় ছিলামনা। তাই লিখতেও পারিনি। তিনদিন থেকে স্লিপিং পিল খেয়ে বেঘোরে ঘুমিয়েছি। আজ একটু সুস্থ হওয়ায় এতটুকু লিখতে পেরেছি। আপনারা কষ্ট করে এতটুকুই পড়ুন। ভালোবাসা পাঠকমহলকে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here