#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩২
জাওয়াদ জামী জামী
” বাহ্ মামনির দেখছি দীঘল কালো চুল! আমার দুই মেয়ের কারও চুল এত বড় নয়। ” কুহুর হাঁটু সমান চুল দেখে আশিকের মা আয়িশা নার্গিস সবিস্ময়ে বললেন।
” কি আম্মু, তুমি এখানে পাত্রী দেখতে এসেও আমাদের দূর্নাম করবে! এটা কিন্তু ভারি অন্যায়। তোমার দুই মেয়ের চুল লম্বা না হলেও, তৃতীয় মেয়েরতো চুল লম্বা হবে। এটা নিয়েই আপাতত খুশি থাক। এখন আবার জিজ্ঞেস করোনা এই তৃতীয় মেয়ে আবার কে। ছেলের বউকে মেয়ের চোখে দেখলেই কিন্তু তুমি আরেকটা মেয়ের মা হয়ে যাবে। ” আশিকের বড় বোন তিশা হাসিমুখে বলল।
তিশার এমন আন্তরিক কথাবার্তা শুনে রুমে উপস্থিত সকলে ভিষণ খুশি হয়েছে। সোহানী পারভিন বুঝতে পারছেন কুহু এই পরিবারে বউ হয়ে গেলে সুখী হবে। এরা মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। রায়হান আহমেদ এবং সাইদ আহমেদের মুখেও হাসির রেশ। অবশেষে তাদের মেয়ে একটা ভালো পরিবারে যাবে, একথা ভাবতেই তাদের চোখ ভিজে উঠছে।
আশিকের পরিবার বিদায় নেয়ার আগে জানিয়ে যায়, কুুহুকে তাদের পছন্দ হয়েছে। তারা বাসায় গিয়ে ছেলের সাথে কথা বলে বিয়ের দিন ঠিক করবে। তবে সেটা আগামী সাতদিনের মধ্যেই হবে। তারা চাচ্ছেন যত তারাতারি সম্ভব কুহুকে ছেলের বউ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যেতে।
আশিকের পরিবার বিদায় নিলে কুহু ফোন নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়। ও কাঁদতে কাঁদতে রাজিয়া খালাকে ফোন দিয়ে সবটা জানায়। সব শুনে খালাও ভিষণ চিন্তিত হয়ে গেছেন। তিনি জানালেন, এখন পর্যন্ত তাহমিদ তাকে ফোন দেয়নি।
কুহু দিনরাত কান্নাকাটি করছে। সোহানী পারভিন গ্রামে ফিরে গেছেন। তিনি জানিয়েছেন, বিয়ের আগেরদিন তিনি রাজশাহী আসবেন।
কুহু নিয়মিত ক্নাস নিচ্ছে। ওর ও ক্লাস শুরু হতে দেরি নেই। সৃজন মন দিয়ে পড়াশোনা করছে। তবে ওর মনটা খুব ভালো নেই। বাবা-মা’ কে হারানোর পর এই বোনই ওকে আগলে রেখেছিল। এখন সেই বোনেরও বিয়ে হয়ে যাবে! ও যে বড্ড একা হয়ে যাবে। কিভাবে থাকবে সে বোনকে ছাড়া! যখনই ছেলেটার এসব কথা মনে হয়, তখনই লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। কখনোই কুহুকে বুঝতে দেয়না।
রাজশাহী থেকে যাওয়ার পর আশিকের পরিবারের সবাই কুহুর সাথে ফোনে কথা বলেছে। আশিকের বড় বোন কুহুকে বলেছিল, আশিক ওর সাথে কথা বলতে চায়। কিন্তু কুহু তার প্রস্তাবকে সুকৌশলে এড়িয়ে গেছে। ওর আশিক নামক মানুষটার সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে নেই। যে রমনীর হিয়ার মাঝে, প্রতিটি হৃৎস্পন্দনে তার একান্ত পুরুষটির নাম সগৌরবে বিরাজ করছে, তার মন কিভাবে চাইবে এক অচেনা মানুষের সাথে বাক্যবিনিময় করতে!
কুহু প্রতিদিন তাহমিদের ফোনে ট্রাই করে, কিন্তু সে তাকে পেতে ব্যর্থ হয়েছে বারবারই। এদিকে আশিকের পরিবার থেকে জানিয়েছেন তারা আগামী শুক্রবার বর ছাড়াই বরযাত্রা নিয়ে হাজির হতে চায়। কুহু এবার সচকিত হয়ে বড় ফুপুর কাছে আঁইগুই করে জানায়, সে এখনই বিয়ে করবেনা। কিন্তু সোহানী পারভিন ওর কথায় পাত্তা দেননি। কারন তারা মন থেকে চান তাদের মেয়েটা সুখী হোক। কুহুর ইচ্ছে থাকলেও তাকে তাহমিদের কথা জানাতে পারলনা। কারন ও যেখানে তাহমিদের খোঁজই পাচ্ছেনা, সেখানে কিভাবে তার কথা জানাবে! এরপর সব লাজলজ্জা ভুলে রায়হান আহমেদকে জানায়, ও এখন বিয়ে করতে চায়না। কিন্তু রায়হান আহমেদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নানানভাবে বুঝালেন। তারা মন থেকে কুহুর ভালো চাইছেন।
কুহু অকুল পাথারে হাবুডুবু খাচ্ছে। ও সত্যি কথা না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সহ্য করতে। এদিকে আজ সোমবার। মাঝখানে আর তিনদিন সময় আছে। এরইমধ্যে যদি তাহমিদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারে, তবে ওকে চিরদিনের জন্য অন্য কোন সংসারের অংশ হতে হবে।
সেদিন বিকেলে রাজিয়া খালা আসলেন কুহুর সাথে দেখা করতে। কুহু এই অবস্থায় খালাকে কাছে পেয়ে কিছুটা আশার আলো দেখল। ও খালার ফোন দিয়ে বারবার তাহমিদকে ট্রাই করতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই ওকে হতাশ হতে হয়।
রাজিয়া খালা বুঝতে পারছেননা তাহমিদের কি হয়েছে। তার ফোন বন্ধ কেন! তিনি কুহুকে খুব করে বোঝালেন। তিনি বুঝতে পারছেননা এই মুহূর্তে তার কি করা উচিত। তবুও তিনি কুহুকে চিন্তা করতে নিষেধ করলেন। এরপর সন্ধ্যায় তিনি কুহুর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেলেন।
মঙ্গলবারও পেরিয়ে যায়। কুহুর সব আশা যেন নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ও আর নতুনকরে কিছুই ভাবতে পারছেনা। কয়েকদিন থেকে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করতে পারেনি মেয়েটা। কান্নারা দলা পাকিয়ে বারবার হানা দিচ্ছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে এই কয়দিনে। শুকিয়েও গেছে বেশ কিছুটা। ফজরের আযান দিতেই বিছানা ছাড়ল সে। গত কয়েকদিন থেকে রাতে ঘুমাতে পারছেনা। তাই মাথা থেকে থেকেই ব্যথা করছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলোনা। গত রাতেই বড় ফুপু জানিয়েছেন তিনি আগামীকাল সকালেই আসবেন। তিনি কুহুকে কোচিং থেকে কয়েকদিন ছুটি নিতে বলেছিলেন। তিনি চাননি বিয়ের আগে মেয়েটা দৌড়াদৌড়ি করুক। কিন্তু কুহু ফুপুকে অনেক বুঝিয়ে আজ বুধবার পর্যন্ত ক্লাস নেয়ার অনুমতি নিয়েছে।
কিছুক্ষণ বিছানায় ঝিম মেরে বসে থেকে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। নামাজ আদায় করে, সকাল-দুপুরের খাবার তৈরি করতে হবে।
জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতেই কলিংবেল বেজে উঠল। কুহু অবাক হয়ে কলিংবেলের আওয়াজ শুনছে। এই অসময়ে কে আসল! এ সময়তো কারও আসার কথা নয়! এবার একটু ভয় পায় মেয়েটা। এদিকে কলিং বেল বেজেই চলেছে। ও ধীর পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। পিপ হোলে চোখ রেখেও কাউকে দেখতে পায়না। আগন্তুক বোধহয় একপাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দোটানায় ভুগতে থাকে মেয়েটা। ওর এখন কি করা উচিত সেটা ভেবে পায়না। হঠাৎই মনে হল নিশ্চয়ই বিল্ডিংয়ের কেউ এসেছে। হয়তো জরুরী কোন দরকার আছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার ভাবে, বিল্ডিংয়ের কারও ওর কাছে কি দরকার থাকতে পারে? এবার ভয়ের চোরা স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নামতে থাকে। ভিষণ অসহায় বোধ হচ্ছে। এদিকে নিয়মিত বিরতিতে কলিং বেল বেজেই চলেছে।
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর সাহস করে দরজা খুলে দেয়। চিন্তা করে রেখেছে খারাপ কিছু হতে দেখলেই চিৎকার দেবে। দরজা খোলার সাথে সাথে ওর নিঃশ্বাস আটকে যায়। এতদিন পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে। সে দরজার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো উসকোখুসকো, গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। চোখদুটোয় রাজ্যের ক্লান্তি। গায়ে লেপ্টে থাকা টি-শার্ট কুঁচকে আছে। এত অসামঞ্জস্যতার মধ্যেও তার ঠোঁটের স্নিগ্ধ হাসি দেখে অশান্ত মন নিমেষেই শান্ত হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই মানুষটাও ওকে পরম ভালোবেসে বুকে জরিয়ে নেয়।
” এই মেয়ে, এভাবে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আমার কলিজার ওপর হুমড়ি খেয়ে পরলে কেন! তোমার দুই মন ওজন আমার মত অসহায় মানুষ কিভাবে সামাল দেবে? ছাড়ো দেখি। আর এভাবে কেঁদেকেটেই বা কেন আমার বুক ভাসাচ্ছ ? ” মৃদু ভৎর্সনা খেলে যায় মানুষটির কন্ঠায়।
কুহু তার কথার উত্তর না দিয়ে কেঁদেই চলেছে। তাহমিদ আর কিছু না বলে মেয়েটাকে জড়িয়ে রাখে। যে আজ স্বেচ্ছায় ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তাকে কেউ দেখে ফেলার ভয়ে দূরে ঠেলে দেয়ার মত বোকা সে নয়।
কুহুর কান্না কিছুতেই থামছেনা। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত যাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছে, এই মুহূর্তে তাকে পাওয়ার আনন্দে কাঁদছে। আর হারানোর ভয়ে ওকে কাঁদতে হবেনা।
” কান্না না থামালে এই মুহুর্তে আমি চলে যাব। তোমার চোখের পানি দেখার জন্য আমি পা’গ’লে’র মত দেশে ছুটে আসিনি। ”
” আপনি খুব খারাপ। খুব নিষ্ঠুর। ”
” সেকথা আজ জানলে! ”
” আমার নম্বর ব্লক করেছিলেন কেন? ”
” মনের সুখে। খুব শান্তিতে ছিলাম কয়েকদিন। ”
” আপনি সত্যিই খুব খারাপ। ”
” নতুন কিছু বল। ”
” চাচারা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। ” কুহু ফুঁপিয়ে উঠল।
” কনগ্রেচুলেশন। তা সৌভাগ্যবানটি কে? ”
” আমি বিয়ে করবনা। ”
” কেন! তুমি কি এখনও নাদান বাচ্চা আছ, যে বিয়ে করবেনা? সময়মত বিয়ে হলে, আজ তিন বাচ্চার মা থাকতে। সুযোগ যখন এসেছে বিয়েটা করেই নাও। আমিও তোমার বাচ্চাদের মুখে মামা ডাক শুনে কলিজা জুড়াই। ”
” ভালোবাসি। ” তাহমিদের কথা পাত্তা না দিয়ে বলল কুহু।
” কাকে? বাচ্চাদের বাবাকে? ”
” উহু, বাচ্চাদের মামাকে। ”
” তাহলে সত্যিই বিয়েটা করছ! সংসার করবে বাচ্চাদের বাবার সাথে, আর ভালোবাসবে বাচ্চাদের মামাকে? বেয়াদব মেয়ে, ঠাঁটিয়ে কানের নিচে দেব। ছাড় আমাকে। সরে যাও আমার কলিজার ওপর থেকে। ”
” আমি বাচ্চাদের বাবাকেই ভালোবাসিতো। ” কথাটা বলেই দাঁত দিয়ে জিভ কাটল কুহু। আবেগের বশে কি ভুলটাই না করল সে!
” তো আমার কলিজায় এমন হুমড়ি খেয়ে পরে আছ কেন? যাও বাচ্চাদের বাবার কাছেই যাও। তাকে গিয়ে সেকেন্ডে দশবার ভালোবাসি বল। এই দুইমাসে নিজের চরিত্রের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে! আমার মত অসহায় মানুষের কলিজায় চেপে বসেছে! মানুষজনের দেখে ফেলার ভয় করছেনা। ”
” সরি। এভাবে রাগবেননা। ভালোবাসি তো। ”
” আমি কি কখোনো বলেছি ‘ ভালোবাসি ‘? কখনো বলিনি বলবওনা। এবার ছাড়ো। তুমি তোমার ঐ আশিক বানায়া আপ্নেকে ভালোবাসি বল।” তাহমিদ মৃদু গলায় বলল।
” আমার বয়েই গেছে আপনাকে জড়িয়ে ধরতে। তিনি নিজেই আমাকে জড়িয়ে রেখেছে। আবার ধমকায়ও আমাকেই। আর আমার যাকে ‘ভালোবাসি ‘ বলার তাকেই বলে দিয়েছি। কোন আশিক ফাশিককে আমি চিনিনা। ” কুহু তাহমিদের কাছ থেকে সরে আসতে চাইলেই, তাহমিদ দু’হাতে ওর কোমড় ধরে নিজের সাথে আরেকবার জড়িয়ে নেয়।
” তার কাছ থেকে কি কখনো ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা শুনেছ? না শুনেই এতদূর! ”
” কিছু না বলা কথা বুঝতে হলে কোনও শব্দের দরকার হয়না। শুধু বুঝে নিলেই কাজ হয়ে যায়। আমি অনেক আগেই সবটা বুঝে নিয়েছি। এখন আপনি অস্বীকার করলেও আমি কিছুতেই মানবনা। ”
” এই সাতসকালে আমাকে বাহিরেই দাঁড় করিয়ে রাখবে? কাল সারাদিন খাওয়া হয়নি, গোসল হয়নি আবার রাতে ঘুমও হয়নি। তোমার কি একটু দয়া হবে, এই অসহায়ের ওপর?”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু চমকে উঠে তার মুখের দিকে তাকায়। তাহমিদের হাত ধরে ওকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলে, তাহমিদ দু’হাতের আঁজলায় কুহুর মুখটা তুলে ধরল। গলায় রাজ্যের ভালোবাসা এনে বলল,
” এমন ভালোবাসা অস্বীকার করার সাধ্য কার? তোমার একজীবনের ভালোবাসা দূরে ঠেলার সাধ্য, আমার সাতজন্মেও হবেনা। তুমিই আমার ভালোবাসার সাতমহল। ‘ভালোবাসি’ মেয়ে অনেক ‘ ভালোবাসি ‘তোমাকে। এক অতলস্পর্শী ভালোবাসায় তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই আজীবন। এতটা ভালোবাসতে চাই তোমাকে, যে ভালোবাসার তল খুঁজে পাবেনা হাজার জনমেও। হবে কি আমার? ”
তাহমিদের আবেগে জড়ানো কথা শুনে কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওর চোখ ছলছল করছে।
ওকে অবাক করে দিয়ে তাহমিদ আবারও কথা বলে।
” আমার কথা আমি বলে দিয়েছি। এখন সিদ্ধান্ত তোমার। তুমি যদি চাও তবে আমাকে বাচ্চাদের বাবা বানাতে পার। আর না চাইলে অগত্যা আমাকে মামা হয়েই নিজেকে শান্তনা দিতে হবে। তবুও কিছু একটা হতেই হবে। এতেই পুরুষ জনমের স্বার্থকতা। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু ফিক করে হেসে উঠল।
চলবে…