#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২১
#ইশরাত_জাহান
🦋
“এগুলো আপনার ছেলের জন্য।”
বলেই কিছু চকলেট অভ্রর হাতে দিয়ে চলে যায়।যাওয়ার সময় নীরব এক পলক তাকায় দীপান্বিতার দিকে।কিন্তু কোনো কথা বলে না। দীপান্বিতাও আজ চুপচাপ।
দ্বীপ নীরাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে আসে।নীরা ও কেয়া নিজেদের মতো করে সিট খুঁজতে চলে যায়।দ্বীপের নিজস্ব কলেজেও আজ গার্ড দিতে হবে।তাই দ্বীপ চলে যায়।যাওয়ার আগে নীরাকে বলে,”আমি না আসা অব্দি দাড়িয়ে থাকবে।একটু দেরি হবে কিন্তু তুমি কোথাও যাবে না।”
নীরা মাথা নাড়িয়ে হ্যা বোঝায়।রিক কেয়াকে ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে দ্বীপের সাথে চলে যায়।
পরীক্ষা শুরু হয়েছে।একদিকে নীরা পরীক্ষা দিচ্ছে তো অন্যদিকে দ্বীপ অন্য পরীক্ষার্থীদের গার্ড দিচ্ছে।পরীক্ষায় গার্ড দিলেও দ্বীপ শুধু নীরাকে নিয়ে ভাবছে।নীরা ঠিকভাবে পরীক্ষা দিচ্ছে কি না!কোনো সমস্যা হলো কি না এগুলো ভাবতে থাকে দ্বীপ।
দুপুরে,
নীরার পরীক্ষার সময় শেষ।খাতা জমা দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে কেয়ার সাথে। কেয়াও দাড়িয়ে আছে রিকের জন্য।দ্বীপ ছাত্রছাত্রীদের খাতা জমা নিয়ে ওগুলো ভালোভাবে মিলিয়ে তারপর গেলো নীরার কাছে।রিক চলে এসেছে বাইক নিয়ে।এখন কেয়া ও রিক বাইকে করে যাবে আর নীরা ও দ্বীপ তাদের গাড়িতে করে যাবে।
গাড়িতে ওঠার পর দ্বীপ বলে,”পরীক্ষা কেমন হয়েছে?”
“খুব খুব খুব সহজ প্রশ্ন এসেছে।কিন্তু জানি না সঠিক লিখেছি নাকি ভুল।”
“কেনো?তুমি কি লিখেছো তুমি নিজেও জানো না!”
“অতগুলো চেপটার মাথায় রাখাটাও তো লাগবে।তিন ঘণ্টা পরীক্ষা দিয়েছি।লেখার তালেই ছিলাম।যেমন করছে হাত ব্যাথা তেমন করছে মাথা ভনভন।”
“খুদা লেগেছে খুব?”
নীরা মাথা উচু নিচু করে হ্যা বুঝিয়ে দিলো।দ্বীপ এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দেয়।তারপর নীরাকে বলে,”চলো তোমার প্রিয় ফুসকা খাওয়া যাক।”
নীরা খুশি হয়ে নেমে যায়।গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয় ফুসকার দোকানে।দ্বীপ কিছু বলে ওঠার আগেই নীরা বলে,”বেশি বেশি ঝাল দিয়ে ফুসকা বানিয়ে দিন।”
দ্বীপ চোখ রাঙিয়ে বলে,”তোমার এখন পরীক্ষা।এই সময় এতো বেশি ঝাল খেলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“আরে কিছু হবে না।কতদিন পর আজ ফুসকা খাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আর আপনি কি না আমাকে বাধা দিচ্ছেন।”(বলেই কাদো কাদো ফেস করে)
দ্বীপ আর বাধা দেয় না।ফুসকা রেডি হলে দোকানদার নীরাকে ফুসকা দেয়।নীরা ফুসকা খেতে খেতে দ্বীপকে বলে,”আপনি খাবেন না?”
“না,তুমি খাও।আমি এসব খাই না।”
“আরে,আজকে একটু খেয়েই দেখেন।অনেক মজা হয় ফুসকা।”
বলেই দ্বীপের দিকে একটি ফুসকা এগিয়ে দেয়।যেই দ্বীপ হা করে নীরার হাতের ফুসকা খেতে যাবে ওমনি নীরা ওটা দ্বীপের সামনে থেকে নিয়ে নিজের গালে দেয়।দ্বীপ অবাক হয়ে আশপাশ দেখতে থাকে।নীরা হা হা করে হেসে বলে,”আপনি তো ফুসকা খান না।তাই আর জোর করলাম না।”
দ্বীপ কোনো রিয়েকশন না দেখিয়ে নীরার খাওয়া হয়ে গেলে দোকানদারকে টাকা দিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে নেয়।ঠিক তখন নীরা একটি আইস ক্রিম স্টল দেখতে পায়।সাথে সাথে নীরা বলে,”আমি আইস ক্রিম খাবো।”
“এই শীতে একদম কোনো আইস ক্রিম হবে না।পরশু তোমার পরীক্ষা।আমি যেনো ঠান্ডা জ্বর আসতে না দেখি।”
“প্লিজ প্লিজ প্লিজ”(বলেই দ্বীপের হাত ধরে লাফাতে থাকে)
অগত্যা দ্বীপকে আইস ক্রিম কিনতে হয়।পুরো পরিবারের সবার জন্যই দ্বীপ আইস ক্রিম কিনে নেয়।বাসায় এসে সবাই মিলে আইস ক্রিম উপভোগ করে।
মিসেস সাদিয়া এসেছেন আজ।এতদিন গ্রামে নিজের শশুর বাড়িতে ছিলেন।মিসেস সাদিয়া এসে সবাইকে বলেন,”আমার মেয়েটা কি এতই বোঝা হয়ে গেছে?যে এখন তাকে মামার বাড়িতে না থেকে হোস্টেলে থাকতে হবে।”
কেউ কিছু বুঝে উঠতে পারে না।ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে পিংকি এসে তার মাকে দেখে।মিসেস সাদিয়াকে দেখে পিংকি অবাক হয়ে বলে,”তুমি এখানে কেনো,মা?”
শাড়ির আচল মুখে গুজে কান্নার ভান করে মিসেস সাদিয়া বলেন,”আমার মেয়ে একা একা হোস্টেলে থাকবে।আমি মা হয়ে কিভাবে সহ্য করবো।তাই ছুটে এসেছি।”
মিস্টার সমুদ্র দুপুরে খেতে এসেছেন।খাওয়া দাওয়ার পরই আইস ক্রিম খাচ্ছিলেন।তার পরই এই কাহিনী।মিস্টার সমুদ্র অবাক হয়ে পিংকির কাছে এসে বলেন,”তুমি হোস্টেলে যাচ্ছো!কই আমাদের তো বলোনি?”
“আসলে আমি ভেবে দেখেছি আমার এখানে থাকা উচিত হবে না। আর এমনিতেও আমি বড় হয়েছি।কতশত মেয়ে হোস্টেলে থাকে।আমি কেনো থাকতে পারবো না?”
“মেয়ের কি মাথাটা গেছে।এসব বলছে কেনো?এগুলো বললে তো সম্পত্তি পাবে না।”(মনে মনে বলেন মিসেস সাদিয়া)
পিংকিকে বলে ওঠে,”তুই এসব কি বলছিস?হোস্টেলে কেনোই বা যেতে হবে?কে কি বলেছে তোকে?”
“আমি একদম ঠিক বলেছি আর ঠিক কাজ করেছি মা। আর চিন্তা করো না তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছা পূরণ না হলেও অর্ধেক ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।”
কেউ কিছু বুঝলো না শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে।পিংকি ঘর থেকে সম্পত্তির কাগজ এনে মিসেস সাদিয়ার হাতে দিয়ে বলে,”গ্রামের সম্পূর্ণ অধিকার এখন তোমার আর আমার।মামা আমার নামেও কিছু অংশ লিখেছে।শুধু তোমার চাহিদার ভিতর ঢাকার সম্পত্তি পেলে না। আর পেতে বলেও মনে হয় না মা।কারণ দ্বীপ বে (আর না বলে) ভাই এত বড় শিক্ষিত একজন মানুষ আর মামা নিশ্চয়ই ছেলেমেয়েদের না দেখে খালি আমার একার দিকে দেখতো না।”
মিস্টার সমুদ্র খুশি হন।তার কথাগুলো পিংকির বিবেকে লেগেছে।এটাই তো অনেক। কত মানুষ আছে ভালো কথার মূল্য দেয় না।সেখানে পিংকি নিজে থেকে বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।সব কাজে বাধা দিতে নেই।তাই আজ কেউ পিংকির কাজে বাধা দিচ্ছে না।
মিসেস সাদিয়া মেয়েকে দেখে অবাক হচ্ছেন।মেয়ের তার এত পরিবর্তন।কিভাবে সম্ভব?এইতো কালকেও তারা কত কুবুদ্ধি দেওয়া নেওয়া করছিলো।আজ এক রাতে কি হয়ে গেলো?
পিংকি সবাইকে দেখে আবার বলে,”আমি হোস্টেল ঠিক করেছি। কাল উঠে যাবো সেখানে।এখানে যত থাকবো হয়তো আমি খারাপ কিছুই করবো।”(দ্বীপের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে)
নীরার কাছে এসে নীরার হাত দুটি ধরে পিংকি বলে,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে আসাটা যেমন লোকের চোখে দৃষ্টিকটু,ঠিক তেমনই তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে থাকাটা অনেক কষ্টকর।আমি এতদিনে এটা বুঝেছি।কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তির কাছে সবকিছু লোপ পেয়েছিলো।ভাগ্যিস তুমি স্ট্রং একজন মানুষ। আর বাসার সবাই তোমাকে অঢেল ভালোবাসে।তাই তো আজ আমার মতো তৃতীয় ব্যাক্তির সমাপ্তি হতে যাচ্ছে।পারলে ক্ষমা করে দিও ভাবী।”
নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজে থাকে দূরে সরে যাচ্ছে।তাই নীরা নিজেই আজ পিংকিকে জড়িয়ে ধরে।সবাই আজ খুশি হয়।মিসেস সাদিয়া কিছু বলেন না।মেয়ে তার ভালো এখন বুঝতে শিখেছে। আর এখন নীরাকে যা বললো তারপর তার কোনো কথা বলা মানায় না।মিসেস সাদিয়া এসে ক্ষমা চাইলো মিস্টার সমুদ্রর কাছে।মিস্টার সমুদ্র বোনকে ক্ষমা করে দেন।
পিংকি এসে দাঁড়ায় মিসেস সাবিনার কাছে।বলে,”আমার মায়ের জন্য তুমি সুখে থাকতে পারনি মামী।শুরু থেকে সুখ না পাও শেষ বয়সে এসে আশা করি তুমি হবে শ্রেষ্ঠ সুখী। এত ভালো বউমা হয়েছে তোমার।রূপবতী গুনবতী আবার চঞ্চল।হয়তো ওর জন্যই আজ আমার বিবেকবোধ ফিরে এলো।”
মিসেস সাবিনা জড়িয়ে ধরে পিংকিকে বলেন,”তোকে কখনও পর ভাবিনি মা।তুই আমার পরিবারের এক অংশ ছিলি থাকবি।”
আজ পিংকিও কান্না করে দেয় মিসেস সাবিনার কোলে মাথা গুঁজে। লোভে পড়ে এখানে থাকলেও মায়া তো মানুষের মনের মধ্যে বিরাজ করে।তাই তো পিংকির মনে এখন এই পরিবারের সবার জন্য ভালোবাসার টান কাজ করছে।পিংকির সপ্ন মিসেস সাদিয়ার থেকে ভিন্ন ছিলো।পিংকি ভেবেছিলো সে দ্বীপের বউ হয়ে শশুর শাশুড়ির সেবা করবে।মায়ের হক বুঝিয়ে সেও তার মতো সংসারী হবে।কিন্তু ভালো চিন্তার সাথে অসৎ উদ্দেশ্য থাকলে তা কখনও সম্পূর্ণ হয় না।
চলবে…?
কেমন লাগলো আজকের পর্ব জানাবেন।আমি কোনো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি পছন্দ করি না।তাই সেভাবে তৃতীয় ব্যাক্তির শয়তানি কাজ ফুটিয়ে তুলতে পারি না।আমার কাছে মনে হয় সম্পর্ক টিকে স্বামী স্ত্রীর নিজেদের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে।এখানে তৃতীয় ব্যাক্তি আসবে যাবে কিন্তু নিজে ঠিক থাকলে তৃতীয় ব্যাক্তি কিছুই করতে পারে না।যেমন দ্বীপ নীরার জীবনে হয়েছে। আশা করি গল্পটি আপনাদের ভালো লেগেছে।ভালোবাসা আমার লুকোচুরি গল্প প্রেমীদের।