গোলকধাঁধা
৪.
কয়েকদিন যাবত বেশ উদ্ভট একটা ঘটনা ঘটছে। আমি যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন জানালার ধারে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, এমন মনে হয়। চাইলেও চোখ খুলে দেখতে পারি না। প্রচণ্ড গরমের জন্যই জানালা খুলে ঘুমাতে বাধ্য হই। আজকে শক্ত করে জানালা আটকে সিলিং ফ্যান আর চার্জার ফ্যান ছেড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম। তখন ছাদে কারো হাঁটার শব্দ পেলাম। চিরাচরিত ভূতের ভয় দেখানোর নিয়ম। তবে ভয় লাগতেছে একেবারেই কম। আয়াতুল কুরসি পড়ে শরীর বন্ধক দিলে ভয় পাওয়া কারণ নেই। হয়তোবা আশপাশ দিয়ে ঘোরাঘুরি করবে কিন্তু কিচ্ছু করতে পারবে না। রোকাইয়া কথা গুলো এমনভাবে বলতো যেন, সে নিজেই ভূত শ্রেণির কেউ। অবশ্য সেও তো মাঝেমাঝে এমন ভাবে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকতো যে তাকে ওই শ্রেণির মনে হতো। হঠাৎ হঠাৎ একেবারেই চুপ হয়ে যেত। নিজে থেকে কোনোদিন সে বেশি কথা বলতো না। আর তখন তো একেবারেই। কাঁথা ফেলে দিয়ে এয়ারফোন কানে দিয়ে গান শোনার চেষ্টা করলাম কিন্তু মন বসলো না। তিষাকে ফোন দিলাম। ও দ্বিতীয় বার রিং বাজার পরে রিসিভ করলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ” তুহিন, এতো রাতে?”
” ঘুম আসছিল না। ”
” তুমি, আমাকে মিস করছ তাই না?”
” হ্যাঁ, অনেক বেশি। ”
” শুনো, তুহিন?”
” বলো শুনছি আমি। ”
” বাবা, তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। তুমি কবে নাগাত আসতে পারবে?”
” আমার সামনের শুক্রবারে একটা ছুটি আছে। ”
” তাহলে তুমি সরাসরি আমাদের বাসায় আসবে দুপুরে। বাবা তোমাকে দুপুরে আমাদের সাথে খেতে বলেছেন। ”
” তিষু?” তিষা আমার এই ডাক খুব পছন্দ করে। প্রত্যেক মেয়েই চায় তার বিশেষ মানুষ তাকে বিশেষ নামে ডাকুক৷
” হুম, বলো। ”
” আম্মু কি আচার পাঠিয়েছেন?”
” হ্যাঁ, এতো আচার দিয়ে কী করবো? আমি একা খেতে পারবো না। ”
” সবাইকে দিয়ে খাবে। আর বলবে, আমার হবু শ্বাশুড়ির হাতের আচার। রোকাইয়াও খুব পছন্দ করতো। ” শিট, কী বলে বসলাম!
তারপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা পালনের পরে তিষা বলল, ” আমি ভাবলাম তুমি আমাকে মিস করতেছ তাই ফোন দিয়েছ। আসলে তুমি তোমার এক্সকে মিস করতেছিলা। ”
” না, আমি তাকে মিস করছি না। আমি কথার পৃষ্ঠে বলে ফেলছি। ”
” তুহিন, একটা কথা বলবে?”
” বলো, তুমি বললে হাজারটা বলবো। কৃপণতা আমার ধর্ম না৷ ”
” তুমি এখনো রোকাইয়াকে ভুলতে পারোনি, তাই না?”
” আসলে মনে রেখেছি ওই একটা ঘটনার জন্য। ”
” ওই ঘটনার জন্য তোমার তাকে ভুলে যাওয়া উচিৎ। ওর জন্য তোমাকে কতো বিপদের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে! ”
” ঠিকই বলেছ। বেঈমান আর ধোঁকাবাজ একটা মেয়েকে মনে না রাখাই বেটার। ”
” তুমি কি আমাকে ওর জায়গায় বসাতে পারবে না?” তিষার প্রশ্নে অভিমান।
আমার দিক থেকে উত্তর না পেয়ে তিষা বলল, ” তুমি কিন্তু আমার প্রথম ভালোবাসা, তুহিন। তুমি প্রচণ্ড ভালো না বাসলেও আমি বাসি। ”
” তুমি আমার পুরোটা জুড়ে তিষা। রোকাইয়া তো কবেই আউট হয়ে গেছে। ”
তারপর জীবনের সেরা উদ্ভট ঘটনার সম্মুখীন হলাম। কেউ একজন পুরো ছাদ জুড়ে খিলখিল করে হাসছে আর দৌড়াতে শুরু করলো। বুঝলাম না, এই কাজ কি সত্যি কেউ করছে নাকি আমার অলস মস্তিষ্কের বানানো কিছু? হতেও পারে। একদিন তো মনে হলো, রোকাইয়া আমার পাশে বসে আছে তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে। আমি বাস্তব মনে করে স্পর্শ করতে যাবো তখনই সে উধাও হয়ে গেল। যেমনটা আগে তাকে স্পর্শ করতে গেলে সরে যেত। এদিক থেকে তিষা অন্যরকম। আয়াতুল কুরসি পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। ভূতের ভয় লাগছে না৷ লাগছে, বাড়িওয়ালার কথার। উনি আমাকে দোষারোপ না করে বসেন।
*****
রহমানের নাম্বার থেকে ফোন আসা দেখে অফিস থেকে বের হয়ে এক কানাগলিতে এলাম। এতক্ষণে অবশ্য ফোন কেটে গেছে। ফোন ব্যাক করলাম। রহমান কুশল বিনিময়ের ধার না ধেরে সরাসরি প্রসঙ্গে আসলো।
” ভাই, খুঁইজা পাইছি। ”
” ঠিকানা বলো। ”
” ভাই, আগে পেমেন্ট। আমি গরীব মানুষ। এইসব কইরাই খাই। ”
” রহমান, তোমার টাকা আমি কখনো মাইরা খাইছি?”
” ভাই,আমার আপন রক্তের ভাই আমারে ধোঁয়া দিয়া সব সম্পত্তি নিয়া নিছে। আর সেইখানে আপনি তো আপন ভাই না। ” এই হলো সমস্যা রহমানরে নিয়ে। কিছু হলেই তার ভাইয়ের কর্মকাণ্ড টেনে নিয়ে আসবে।
” তোমার বিকাশ নাম্বারে কতো পাঠাব, বলো?”
” আপনে দুই খানা বড় নোট পাঠান। ”
ফোন কেটে দিয়ে বিকাশ করে আবার ফোন দিলাম। এবার রহমানের কথার ধরন পালটে গেল।
” ভাই, আপনার জন্য আমি দোনোরই ঠিকানা, নাম্বার জোগাড় করছি। কিন্তু আপনি এদের দিয়ে করবেন কী?”
” ঠিকানা বল। ”
রহমানের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে অফিসে ফিরে আসলাম।
অফিস ছুটির পরে আমার স্যার এবং ভার্সিটির সিনিয়রের সাথে বাসায় ফিরছিলাম। যদিও উনার ঠিকানা আমার ঠিকানার বিপরীতে। জানিনা কেন আমার সঙ্গী হলেন।
” তুমি এখানে কেন এসেছ, ইমতিয়াজ? ”
” চাকরি করতে। ” স্বাভাবিকভাবেই বললাম।
” তিষার সাথে আমার কথা হয়েছে। ও বলল, এই চাকরির থেকেও ভালো ভালো চাকরি হয়েছিল। সেগুলো রেখে এই মফস্বলে কেন এলে?”
” আমার আসলে শহরের কোলাহল ভালো লাগছিল না। তাই এখানে আসা। ” স্যার এবার আগের তুলনায় ভারী গলায় বললেন, ” ইমতিয়াজ, তুমি তো কখনো মিথ্যা কথা বলতে না। ”
” স্যার, আমি মিথ্যা বলছি না। ”
” এখন অফিস টাইম না। তুমি শফিক ভাই ডাকতে পারো। গত কয়েকদিন যাবত দেখছি, তুমি অফিস টাইম শেষ হওয়ার আগেই উধাও হয়ে যাও। আর কাজেও তোমার মন নেই। সবসময় অন্যমনস্ক থাকো। ব্যাপারটা কী?”
” স্যার, আসলে নতুন জায়গা তো। আবার ওই বাড়িতে ভূত আছে। গভীর রাত হলে, জ্বালা যন্ত্রণা শুরু করে। রাতে ঘুম ভালো হয়না। তাই কাজে মন বসে না। ” এতো সুন্দর করে সব দোষ ভূতের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া ঠিক হলো কী? আজকে আমাকে কাচ্চা চাবায়া না ফালায়!
” ইমতিয়াজ, আমাকে মিথ্যা বলবা না। তুমি তিষাকে মিথ্যা বলে পটিয়ে রাখতে পারো। কিন্তু আমাকে পারবে না। ”
” শফিক ভাই, রাতের ঘুম না হওয়ার জন্যই। ”
” রোকাইয়া কি এইখানের কোথাও থাকে? খোঁজ পেয়েছ? ”
” রোকাইয়া কে ভাই? ” শফিক ভাই এবার চরম বিরক্ত হলেন। কঠিন চোখে আমার দিকে তাকালেন।
” আমার মনে হয় ও এই মফস্বলের কোথাও থাকে। আমার ওকে কয়েকটা প্রশ্ন করার আছে। উত্তর পেলেই আমি ওকে খোঁজা বন্ধ করে দিব।
” দেখো ইমতিয়াজ একটা সত্য কথা বলি। জানি, তোমার ভালো লাগবে না। তারপরও তিষার জন্যই বলতেছি, ওই মেয়ে শিয়ালের মতো ধূর্ত ছিল আর ম্যানা মানুষ বুঝো না। ম্যানারা তেনা ছেড়ে, বাংলায় প্রবাদ আছে একটা। ওর আসলে উদ্দেশ্যে ছিল, তোমাকে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া। এবং সফল হয়েছে৷ দেখোনা, ঘটনার পরের দিন থেকে ও উধাও। ”
” জানি, ভাই। তিষাই আমার সব। রোকাইয়ার কাছে কয়েকটা প্রশ্ন আছে। তাই খুঁজে ফিরছি। ”
” আমার তো মনে হয় না, এখানে শুধু কয়েকটা প্রশ্নের ব্যাপার। আজ ৫ বছরের মতো তুমি ওকে খুঁজে ফিরছ। ”
মূল ফটক দিয়ে ঢুকতে যাব তখন বুঝতে পারলাম কেউ একজন নিঃশব্দে বাড়ির পেছনে চলে গেল। বৃদ্ধ আর বৃদ্ধার যেকোনো একজনই হবে। নাকি চোর? ভূত সামনে আসবে নাকি? এতদিন তো মধ্যরাতে উৎপাত করতো। আর এখন কি এই রাতেও শিফট শুরু করবে?
চলবে…
~ Maria Kabir