উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২০||

0
637

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২০||

৩৬।
নগরী আজ বাদল ধারায় সিক্ত। যাত্রী ছাউনি আর দোকানের বাইরে ছোটখাটো জটলা। যে যেভাবে পারছে নিজেদের বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কেউ কেউ ছাতা হাতে নিয়ে দম্ভভরে হেঁটে চলে যাচ্ছে যার যার কাজে। আহি তাদের বিপরীত। টানা এক সপ্তাহ ক্লাসে না গিয়ে আজ সে বাধ্য হয়েই বের হয়েছে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। অর্ধেক যেতেই গাড়ি বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর সে গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার চাচার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে গাড়ি ঠিক করে বাসায় চলে যেতে বলল। ড্রাইভার চাচা রিকশা ঠিক করে দিতে চাইলে আহি না সূচক মাথা নেড়ে চলে এলো। ভারী বর্ষণে ভিজে নুইয়ে পড়েছে আহি। আজও তার ক্যাম্পাসের যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আফিফকে দেখলে যদি দুর্বল হয়ে পড়ে? কিন্তু কেন যে সে বাসা থেকে বের হয়েছে তা আহি নিজেও জানে না। তাকে দেখে মনে হচ্ছে উদ্দেশ্যহীন যাত্রায় নেমেছে। বৃষ্টিতে তার পরণের জামাটা আঁটসাঁট হয়ে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। আহি সজ্ঞানে নেই। তার মনে হচ্ছে সে আফিফের পিছু পিছু হাঁটছে। কেমন যেন শরীরটা ভারী ভারী লাগছে তার৷ মাথাটাও ভন ভন করছে। আহির মনে হচ্ছে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। সে কয়েক পা পিছিয়ে যেতেই তার পিঠটা কারো শরীরের সাথে ঠেকলো। আহি দুর্বল কন্ঠে বললো, “সরি।”

আহি পেছন ফিরে দেখলো তার পেছনে রেইনকোট আর হেলমেট পরা একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। আহি তার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“বৃষ্টির প্রতিটি বিন্দু সাক্ষী, আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসেছি।”

আফিফ আহির হাত ধরে ঝাঁকুনি দিতেই আহির জ্ঞান ফিরলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“কে আপনি? আর এভাবে আমার হাত ধরে আছেন কেন?”

আফিফের হাত থেকে আহি নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতেই আফিফ তার হেলমেটটি আংশিক খুলে বলল,
“এখন চিনতে পেরেছো?”

আহি মনে মনে বলল,
“আমি তো তোমাকে আগেই চিনে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভেবেছি আমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছিলো। হায় আল্লাহ! কি লজ্জায় পড়তে হচ্ছে আমাকে। আল্লাহ, মানুষটা না বুঝুক কিছু।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এভাবে হাঁটছো কেন?”

আহি বিরক্তির সুরে বলল, “কীভাবে হাঁটছি আমি!”

আফিফ শান্ত কন্ঠে বললো, “বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছো।”

“তো!”

আফিফ আহির পালটা উত্তরে দমে গেলো। সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“ছাতা নিয়ে বের হও নি?”

“ছাতা থাকলে কি এভাবে ভিজতে হতো?”

আফিফ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল,
“ক্যাম্পাসে যাচ্ছো?”

“হ্যাঁ, এতো সকাল সকাল এই ঝড়-বৃষ্টির দিনে কেউ ঘুরতে তো অবশ্যই বের হবে না।”

আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “বাইকে উঠো।”

“কেন?”

“আমিও ক্যাম্পাসে যাচ্ছি তাই।”

“রিকশা নিয়েই যাবো আমি। বাইকের পেছনে বসলে আমার সমস্যা হয়।”

আফিফ আহির কথা শুনে মিনিটের মধ্যেই একটা রিকশা ঠিক করে আহিকে উঠতে বলল। আহি তাড়াতাড়ি রিকশায় উঠে জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো।

(***)

ক্যাম্পাসের সামনে নেমেই এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো আহি। এমন ভেজা কাপড়ে কোনো মেয়ে কোনো কালে ক্লাস কর‍তে এসেছে কি-না সন্দেহ। রিকশায় রাদকে ফোন করে পুরো ঘটনাটা জানিয়েছিলো সে। রাদ ততোক্ষণে বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। সে আবার বাসায় ফেরত গিয়ে তার বোনের এক সেট জামা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে চলে এলো। আহি রিকশা থেকে নামতেই রাদ ছাতা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। আফিফও তখন ক্যাম্পাসে তার মোটরসাইকেল নিয়ে ঢুকলো। তাকে মাত্র পৌঁছাতে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকালো। মোটরসাইকেলে চড়ে আফিফের পৌঁছাতে এতো সময় লাগলো কেন? সে কি তাহলে আহির রিকশার পিছু পিছু এসেছিল? এদিকে রাদ ব্যাগ থেকে তার বোনের জামাটি বের করে দিয়ে বলল,
“তোর মতো ছাগলী আমি জীবনে একটাও দেখি নি।”

আহি মুখ ছোট করে বলল,
“আমার মাথা ঠিক ছিল না, রাদ। তুই তো জানিস আমি পাগল!”

“তুই পাগল না, তুই হচ্ছিস মাথামোটা। পাগল কখনো নিজেকে পাগল বলে না। এখন তুই নিজের বোকামি ঢাকার জন্য পাগলের আশ্রয় নিচ্ছিস।”

“দোস্ত, তুই এভাবে বকিস না। ঠান্ডা লাগছে আমার।”

“তো যা না। কুম্ভকর্ণের মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামা দিলাম তো। গিয়ে চেঞ্জ করে আয়। না-কি এখন কোলে করে নিয়ে যেতে হবে।”

আহি মুখ বাঁকিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে পড়লো।

(***)

প্রথম টাইম স্লট শেষ হতেই আহি ক্লাসে ঢুকলো। ক্লাসে ঢুকতেই আহির চোখ পড়লো মাঝখানের সারির প্রথম বেঞ্চে। আফিফ মনোযোগ দিয়ে কি যেন লিখছে। আহি তার দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। আহির জন্য প্রথম বেঞ্চটা খালি রেখে দিয়েছে তার সহপাঠীগণ। প্রতিদিনই দ্বিতীয় বেঞ্চ থেকে বসা শুরু করে সবাই। প্রথম বেঞ্চ মানেই অতি মনোযোগী শিক্ষার্থী। এতো মনোযোগী ক্লাসের কেউই হতে চায় না। আর ভাগ্যক্রমে সেই মনোযোগী শিক্ষার্থীদের কাতারে পড়েছে আহি আর আফিফ। দু’জনেই দেরীতে ক্লাসে আসে বিধায় প্রথম বেঞ্চেই সিট খালি পায়৷

আহি আফিফের পাশের সারিতেই বসেছে। আহির উপস্থিতি টের পেয়ে আফিফ তার দিকে ফিরে তাকালো। আহিও আঁড়চোখে আফিফকে খেয়াল করলো। তার মন এখনো কচকচ করছে। ঘোরের মধ্যে সে আফিফকে যা বলেছিল, তা আফিফ না শুনলেই হলো।

কিছুক্ষণ পর ক্লাসে স্যার চলে এলো। দ্বিতীয় স্লটের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আহি চুপচাপ বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। স্যার পৃষ্ঠা উলটে শেকসপিয়ারের সনেট ১৪৭ পড়তে লাগলেন।

“𝙈𝙮 𝙇𝙤𝙫𝙚 𝙄𝙨 𝘼𝙨 𝙖 𝙁𝙚𝙫𝙚𝙧, 𝙇𝙤𝙣𝙜𝙞𝙣𝙜 𝙎𝙩𝙞𝙡𝙡”
𝑴𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆 𝒊𝒔 𝒂𝒔 𝒂 𝒇𝒆𝒗𝒆𝒓, 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒊𝒏𝒈 𝒔𝒕𝒊𝒍𝒍
𝑭𝒐𝒓 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒍𝒐𝒏𝒈𝒆𝒓 𝒏𝒖𝒓𝒔𝒆𝒕𝒉 𝒕𝒉𝒆 𝒅𝒊𝒔𝒆𝒂𝒔𝒆;
𝑭𝒆𝒆𝒅𝒊𝒏𝒈 𝒐𝒏 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒅𝒐𝒕𝒉 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒆𝒓𝒗𝒆 𝒕𝒉𝒆 𝒔𝒊𝒍𝒍,
𝑻𝒉𝒆 𝒖𝒏𝒄𝒆𝒓𝒕𝒂𝒊𝒏 𝒔𝒊𝒄𝒌𝒍𝒚 𝒂𝒑𝒑𝒆𝒕𝒊𝒕𝒆 𝒕𝒐 𝒑𝒍𝒆𝒂𝒔𝒆.
𝑴𝒚 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏, 𝒕𝒉𝒆 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄𝒊𝒂𝒏 𝒕𝒐 𝒎𝒚 𝒍𝒐𝒗𝒆,
𝑨𝒏𝒈𝒓𝒚 𝒕𝒉𝒂𝒕 𝒉𝒊𝒔 𝒑𝒓𝒆𝒔𝒄𝒓𝒊𝒑𝒕𝒊𝒐𝒏𝒔 𝒂𝒓𝒆 𝒏𝒐𝒕 𝒌𝒆𝒑𝒕,
𝑯𝒂𝒕𝒉 𝒍𝒆𝒇𝒕 𝒎𝒆, 𝒂𝒏𝒅 𝑰 𝒅𝒆𝒔𝒑𝒆𝒓𝒂𝒕𝒆 𝒏𝒐𝒘 𝒂𝒑𝒑𝒓𝒐𝒗𝒆
𝑫𝒆𝒔𝒊𝒓𝒆 𝒊𝒔 𝒅𝒆𝒂𝒕𝒉, 𝒘𝒉𝒊𝒄𝒉 𝒑𝒉𝒚𝒔𝒊𝒄 𝒅𝒊𝒅 𝒆𝒙𝒄𝒆𝒑𝒕.
𝑷𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒖𝒓𝒆 𝑰 𝒂𝒎, 𝒏𝒐𝒘 𝒓𝒆𝒂𝒔𝒐𝒏 𝒊𝒔 𝒑𝒂𝒔𝒕 𝒄𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒏𝒅 𝒇𝒓𝒂𝒏𝒕𝒊𝒄-𝒎𝒂𝒅 𝒘𝒊𝒕𝒉 𝒆𝒗𝒆𝒓𝒎𝒐𝒓𝒆 𝒖𝒏𝒓𝒆𝒔𝒕;
𝑴𝒚 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕𝒔 𝒂𝒏𝒅 𝒎𝒚 𝒅𝒊𝒔𝒄𝒐𝒖𝒓𝒔𝒆 𝒂𝒔 𝒎𝒂𝒅𝒎𝒆𝒏’𝒔 𝒂𝒓𝒆,
𝑨𝒕 𝒓𝒂𝒏𝒅𝒐𝒎 𝒇𝒓𝒐𝒎 𝒕𝒉𝒆 𝒕𝒓𝒖𝒕𝒉 𝒗𝒂𝒊𝒏𝒍𝒚 𝒆𝒙𝒑𝒓𝒆𝒔𝒔’𝒅;
𝑭𝒐𝒓 𝑰 𝒉𝒂𝒗𝒆 𝒔𝒘𝒐𝒓𝒏 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒇𝒂𝒊𝒓 𝒂𝒏𝒅 𝒕𝒉𝒐𝒖𝒈𝒉𝒕 𝒕𝒉𝒆𝒆 𝒃𝒓𝒊𝒈𝒉𝒕,
𝑾𝒉𝒐 𝒂𝒓𝒕 𝒂𝒔 𝒃𝒍𝒂𝒄𝒌 𝒂𝒔 𝒉𝒆𝒍𝒍, 𝒂𝒔 𝒅𝒂𝒓𝒌 𝒂𝒔 𝒏𝒊𝒈𝒉𝒕.

কবিতাটি শুনে আহির ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো। সে একনজর আফিফের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“তোমার প্রতি ভালোবাসাও হয়তো আমার রোগ। যেই রোগ আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তবুও সেই রোগ থেকে আমি নিজেকে মুক্ত কর‍তে চাই না। সবাই বলেছে ভুলে যেতে, কিন্তু আমার জন্য তোমাকে ভুলে যাওয়া এতো সহজ নয়। কিছু ভালোবাসা রক্তের সাথে মিশে যায়। আমার মৃত্যুতেই হয়তো এই ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে। আমি না হয় মানসিক রোগী হয়েই থাকি। কতো কবি তার প্রেমিকাদের ভুলতে পারেন নি। বিচ্ছেদের পরও শেকসপিয়ার তার প্রেমিকাকে নিয়েই কবিতা লিখেছিলেন। সেই হিসেবে আমি তো কিছুই না। তার মতো সৎ সাহস নেই আমার। সবার সামনে গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করে বলতে পারবো না আমি আমার এআরকে এখনো ভালোবাসি। তারা তো প্রেমের কবিতা লিখে নিজের প্রেম প্রকাশ করেছেন। তাদের তো প্রকাশের ভাষা ছিল, মাধ্যম ছিল। তাদের কষ্ট তারা ভাগ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমার আশেপাশের কেউই সেই ভাষা বুঝবে না। কারণ এই সমাজে কষ্টের ভাগ নিতে কেউ জানে না। সবাই শুধু উপহাস করতে জানে। সবাই শুধু সমালোচনা করতে জানে। আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলতে তাদের দু’মিনিটও লাগবে না। আমার মতো প্রেমে পরুক না হয় একবার। কতোটা কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি অনুভব করে দেখুক। দু’দিনও বাঁচতে ইচ্ছে করবে না। আফিফ, আমি তো তোমার প্রেমে উন্মাদ প্রেমিকা হয়ে গেছি। যেখানে আমার কিছুই নেই। সবই তোমার অভ্যাসের দাস।”

(***)

ক্লাস শেষ হতেই সবাই একে একে বেরিয়ে পড়লো। আহি এখনো চুপচাপ তার বেঞ্চে বসে আছে। আফিফও বেরিয়ে পড়েছে। এদিকে দশ মিনিট আহি নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসে ছিল। সে আফিফকে চলে যাওয়ার সময় দিচ্ছিলো। এতোক্ষণে হয়তো সে চলেও গেছে। সিঁড়িতে তার মুখোমুখি হতে চায় না আহি। তাই এতোক্ষণ ক্লাসে বসে ছিল।

ক্লাস এই মুহূর্তে একদম খালি। আহি তার জিনিসপত্র গুছিয়ে আফিফের বসা বেঞ্চটির কাছে গেলো। আলতো করে বেঞ্চটি স্পর্শ করে বলল,
“তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না। কিন্তু এভাবে পরোক্ষভাবে তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়াটাও মিস করতে পারি না।”

আহি আফিফের বসা বেঞ্চটিতে বসলো। মাথাটা ডেস্কের উপর রাখলো। হঠাৎ সেই ভাস্কর্যের কথাটা মনে পড়ে গেলো তার। মিসেস লাবণি কি নির্মম ভাবে ভেঙে দিয়েছিলো সেই ভাস্কর্যটি! আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনমিনিয়ে বলল,
“এভাবে আর পারছি না আমি। আমার জীবনে তোমার উপস্থিতি, তোমার অধিকার আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হবে। কিন্তু মানুষ নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য পাগলের মতো ছুটতে থাকে, আর আমার এমন এক লক্ষ্য যার জন্য আমি ছুটা তো বহুদূর, চিন্তাও করতে পারি না।”

(***)

আফিফ মোটরসাইকেলে উঠেই চাবি ঘুরাতে যাবে তখনই খেয়াল করলো তার হাত ঘড়িটা নেই। বৃষ্টির ছাঁট না লাগার জন্য ঘড়িটা পলিথিনে মুড়িয়ে পকেটে রেখেছিল। পকেটে হাত দিতেই তার মনে পড়লো, ক্লাসের ডেস্কের নিচে রেখেছিল ঘড়িটা। সে মোটরসাইকেল থেকে নেমে আবার ডিপার্টমেন্টের দিকে চলে গেলো।

ক্লাস রুমে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালো আফিফ। তার বেঞ্চে একটা মেয়ে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে। মেয়েটা যে আহি তা জামা দেখেই চিনে ফেলেছে আফিফ। সে আর সামনে আগালো না। ধীর পায়ে পিছিয়ে ক্লাসের বাইরের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। সকালে আহির বলা কথাটি সে শুনে ফেলেছিল। কিন্তু কথাটা যে তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, সেটা বুঝতে পারে নি আফিফ। তাহলে কি আহি এখনো তাকে ভালোবাসে?

ধীরে ধীরে আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠল। তার চোখের সামনে ভেসে এলো তার ছোট বোনের ক্রন্দনরত মুখ, তার বড় বোনের ফ্যানে ঝুলে থাকা নিথর দেহ আর তার মায়ের আহাজারি। আফিফ দেয়ালে মাথা ঠুকালো বার কয়েক। তার হাত মুঠো হয়ে এলো। শার্টের হাতায় চোখ মুছলো সে। এরপর ক্লাসের বাইরে থাকা ফুলদানিটি হালকা ধাক্কা দিলো। সেটা গড়িয়ে নিচে পড়তেই আফিফ সরে দাঁড়ালো। এদিকে শব্দ শুনে আহি বেঞ্চ থেকে মাথা তুললো। সে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো। নিজের ব্যাগ নিয়ে কৌতূহলী মনে ক্লাসের বাইরে এসে দেখলো টুলের উপর রাখা ফুলদানিটি নিচে পড়ে আছে। আহি ভীত দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকালো। লাবীব দু’দিন আগে বলেছিল খালি ক্যাম্পাসে অস্বাভাবিক সব ঘটনা ঘটে। আহির এই কথা মনে পড়তেই সে দ্রুতপায়ে নিচে নেমে পড়লো।
আহিকে চলে যেতে দেখে আফিফ ক্লাসে ঢুকলো। নিজের বেঞ্চের ডেস্কে হাত রাখতেই দেখলো পানির মতো কিছু তার হাতে লেগেছে। সে বুঝতে পারলো আহি এতোক্ষণ কান্না করেছিল। আফিফ পকেট থেকে রুমাল বের করে ডেস্কের উপরে স্থান করে নেওয়া আহির অশ্রুকণাগুলো মুছে নিলো। তারপর নিচের ডেস্ক থেকে তার ঘড়িটি বের করে রুমালটির সাথে ঘড়িটিও পকেটে ঢুকিয়ে নিলো।

৩৭।

আজকের দিনটি আহির জন্য চমৎকার একটি দিন। কারণ আজ সে অনেক বছর পর তার মায়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির এবং মিসেস লাবণি দু’জনই এক সপ্তাহের জন্য দেশের বাইরে গেছেন। আর এই সুযোগটা আহি কোনো ভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। সে প্রথমদিনই মায়ের সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলো।

এই মুহূর্তে শহরের কম দামী রেস্টুরেন্টে বসে আছে আহি। খোলা পরিবেশটা ভালোই লাগছে তার। তাজওয়ার তার বন্ধুদের নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে চলে যায়। তাই সে এমন রেস্টুরেন্টে এসেছে, যেখানে তাজওয়ার কখনোই আসবে না। প্রায় দশ মিনিট অপেক্ষা করার পর কাঙ্ক্ষিত মানুষটির আগমন ঘটলো। আহি সালমা ফাওজিয়াকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

(***)

পরণে কালো সুতির শাড়ি, গায়ে গাঢ় বাদামি বর্ণের চাদর, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মাথায় কালো হিজাব, হাতে একটা ছোট ব্যাগ, ঠোঁটের ফাঁকে প্রশস্ত হাসি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে এগিয়ে আসতেই আহি মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আলতো করে তার হাত ধরলেন। আহি মায়ের স্পর্শ পেয়ে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারবো?”

সালমা ফাওজিয়া তার হাতের ব্যাগটি টেবিলের উপর রেখে নিজেই আহিকে জড়িয়ে ধরলেন। আহি মায়ের বুকে মাথা রাখতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। মিনিট খানিক পর সালমা ফাওজিয়া আহিকে ছেড়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খেলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“অনেকদিন পর মনে হচ্ছে, আমি মন থেকে খুশি। মনে হচ্ছে আজ এই মুহূর্তে আমার চেয়ে সুখী কেউ নেই।”

সালমা ফাওজিয়া এবার চেয়ার টেনে আহিকে বসালেন। নিজেও আহির পাশে এসে বসলেন। এরপর আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“মা, শুকিয়ে যাচ্ছো তুমি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করো না?”

আহি মাথা নেড়ে বলল,
“হুম ঠিকভাবেই খাই আমি। মুনিয়া খালাকে তো আমার জন্য রেখে গিয়েছিলে। খালা আমার অনেক খেয়াল রাখেন।”

“আচ্ছা! মুনিয়ার মেয়েটা আছে?”

“হ্যাঁ, চুনি আছে তো। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“আচ্ছা, ভালো। আর মোজাম্মেল? সে কি এখনো ও বাড়িতে কাজ করে?”

“হ্যাঁ চাচা তো বলে দিয়েছেন, যতোদিন আমি শ্বশুড় বাড়ি যাবো না উনি চাকরি ছাড়বেন না। এখন তো চাচা ঠিক করেছেন, তিনি চুনির বিয়ে দেবেন তার ভাইয়ের ছেলের সাথে।”

“বাহ! বেশ তো। এবার তোমার কথা বলো। মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছো?”

“হুম।”

“ক্লাস কেমন যায়?”

“ভালোই। তুমি কোথায় কাজ করো?”

“একটা এনজিওতে। ছোট একটা ব্যবসাও আছে।”

“বাহ, বিজনেস উইমেন।”

সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। মেয়ের গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“আমার মা’টা অনেক সুন্দর হয়ে গেছে।”

“তোমার মতো। তুমিও অনেক সুন্দর হয়ে গেছো।”

“তোমার বাবার ছত্রছায়া থেকে মুক্তি পেয়েছি তাই নিজের যত্ন নিতে পারছি।”

আহি হাসলো। বলল,
“তাহলে আমি মুক্তি পেলে এর চেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে যাবো।”

সালমা ফাওজিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার চোখে অশ্রু ভীড় করতে লাগলো। এদিকে আহি মেন্যু দেখায় মনোযোগ দিলো। সে মায়ের দিকে মেন্যুটা এগিয়ে দিতে গেলেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি খাবার অর্ডার করো। আজ আমার মেয়ের পছন্দের খাবারই আমি খাবো।”

আহি মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে খাবার অর্ডার করলো। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির হাত ধরে বললেন,
“তোমার নানু তোমার ছোট মামার বাসায় গেছে। এমনিতে আমার সাথেই থাকে। আমি তো ট্রেনিং থেকে ফিরেছি বেশিদিন হচ্ছে না। উনি না-কি আরো কিছুদিন ওখানে থাকবেন। তোমার ছোট মামার দু’টো জমজ বাচ্চা হয়েছে তো, তাই।”

“ভালো তো।”

“বলছি কি, তুমি না হয় দু’দিন আমার সাথে থাকবে। চলো!”

আহি মলিন মুখে বললো, “বাবা যদি জেনে যায়?”

“আইনগত ভাবে সপ্তাহে দু’দিন তুমি আমার সাথে থাকতেই পারো। কিন্তু মিস্টার রিজওয়ান কবির তো আইন মানেন না। তাই বলবো, তাকে মিথ্যে বলে এসো। ঘুরতে যাচ্ছি বলবে।”

সালমা ফাওজিয়া কথাটি বলেই ফুঁপিয়ে উঠলেন। মেয়ের হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
“কি কপাল আমার! নিজের মেয়ের সাথে সময় কাটানোর জন্য পৃথিবীর সাথে ছলনা করতে হচ্ছে। একদিকে তোমার নানু জানলে আমাকে বকবেন। অন্যদিকে তোমার বাবা জানলে তোমার সমস্যা হবে।”

আহি মায়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
“আমি মিথ্যে বলবো। নিজের ভালো থাকার জন্য একটা মিথ্যে বলা যায়। এমনিতেই কতো মিথ্যে বলি।”

সালমা ফাওজিয়া আহির থুতনিতে হাত রাখলেন। বললেন,
“সত্যিই আমার মেয়েটা সুন্দর হয়ে গেছে। চুলগুলোও অনেক লম্বা হয়েছে। বেণি কে করে দেয়?”

“আমিই করি। মা তো আমার পাশে নেই৷ তাই নিজের কাজ নিজেই করি।”

মেয়ের কথায় সালমা ফাওজিয়ার বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। মনে মনে বললেন,
“আমার রাজকন্যাকে আমি সেই ফেরাউনের হাত থেকে কখন মুক্ত কর‍তে পারবো?”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here