#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২১||
৩৮।
আহি রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে বের হতেই থমকে দাঁড়ালো। তার সামনের টেবিলে পদ্ম আর আফিফ বসে আছে। আর পদ্ম আফিফকে নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে। আহি সেকেন্ড খানিক সেদিকে তাকিয়ে সামনে পা বাড়াতে যাবে তখনই পদ্ম তাকে দেখতে পেলো। পদ্ম আহির নাম ধরে ডাক দিতেই আফিফ থতমত খেয়ে গেলো। সে সামনে তাকিয়ে আহিকে দেখে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি পদ্মের ডাক শুনে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেও তাদের টেবিলের কাছে গেলো না। পদ্ম এবার নিজেই উঠে এলো। এরপর আহির কাছে এসে তার হাত ধরে বলল,
“কি রে, আমাকে দেখেও দেখছিস না মনে হচ্ছে।”
আহি হালকা হেসে বলল,
“আরেহ, এমন কিছু না। কেমন আছিস তুই?”
“ভালো রে। তুই কেমন আছিস?”
আহি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। পদ্ম একনজর আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“একটা খুশির খবর আছে জানিস?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “তুই প্রেগন্যান্ট!”
পদ্ম মলিন মুখে বলল, “না রে। অন্য একটা।”
আহি পদ্মের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
“সরি। বল না, কি খবর?”
পদ্ম আহির হাত ধরে তাকে আফিফের সামনে নিয়ে এলো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। আফিফও প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো। এবার পদ্ম আহিকে বলল,
“আফিফের চাকরি হয়ে গেছে।”
আহি মৃদু হেসে বলল, “বাহ। ভালো তো!”
“হ্যাঁ রে। তবে যেমন তেমন চাকরি নয়। চট্টগ্রামের নামকরা কোম্পানিতে চাকরি হয়েছে। আফিফ তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন।”
আহি শুকনো মুখে আফিফের দিকে তাকালো। এদিকে আফিফ কিছুক্ষণ পর পর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে। পদ্ম আফিফের পাশে বসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?”
আফিফ পদ্মের কথা শুনে জোরপূর্বক হাসলো। আহি তা দেখে বলল,
“আচ্ছা, আমি তাহলে যাই।”
পদ্ম বলল,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস? চল না একসাথেই লাঞ্চ করি।”
“না, আসলে আমি একা আসি নি।”
পদ্ম মজার ছলে বলল,
“ওহো, তাই না-কি? কেউ এসেছে তাহলে! কে সে? আমার বান্ধবীর এআর?”
আফিফ চোখ-মুখ কুঁচকে পদ্মের দিকে তাকালো। আহি আফিফের দিকে একনজর তাকিয়ে শুকনো হেসে বলল,
“মায়ের সাথে এসেছি।”
পদ্ম অবাক হয়ে বলল,
“তাই না-কি! আন্টিকে অনেক দিন দেখি নি। আচ্ছা, তুই যা। আন্টি অপেক্ষা করছেন হয়তো।”
আহি মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে নিজের টেবিলে চলে এলো।
(***)
সালমা ফাওজিয়া অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছেন আহি ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসার পরই তার চোখে-মুখে অস্থিরতা বিরাজ করছে। তিনি আহির হাত ধরে বললেন,
“আমার মায়ের কি হয়েছে?”
আহি হালকা হেসে বলল,
“কিছু হয় নি। চলো খাই।”
সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। আহি চামচ নিতে যাবে, তখনই সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে বললেন,
“আজ আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে খাইয়ে দেবো।”
মায়ের কথা শুনে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সালমা ফাওজিয়া হাত ধুয়ে এসে আহির মুখের সামনে খাবার মেখে ধরলেন। আহি আশেপাশে তাকাতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“আশেপাশে কি দেখছো, আহি? আমার মেয়েকে আমি খাইয়ে দিচ্ছি। কতো বছর পর আমি আবার মা হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। এই অনুভূতি কেউ বুঝবে না।এখন কি আমি আমার মেয়েকে একটু আদর করে খাইয়ে দিতে পারবো না?”
আহি মায়ের কথা শুনে মৃদু হেসে মুখ খুললো। তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহির চোখ মুছে দিলেন। এদিকে পদ্ম আর আফিফের খাওয়া শেষ হতেই পদ্ম আফিফের সামনে একটা বক্স বের করে রাখলো। আফিফ বক্সটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি এটা!”
পদ্ম লাজুক হেসে বলল,
“আমি আপনার জন্য কেক বানিয়েছি। আপনি যখন বললেন নতুন চাকরি উপলক্ষে আজ আমরা বাইরে খাবো, তখনই এই কেকটা বানিয়েছিলাম। ভেবেছি একসাথে কাটবো। চলুন না ওখানে গিয়ে কাটি!”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো, “কোথায়?”
“আহি আর আন্টিও তো আছেন। অনেক বছর আন্টিকে দেখি নি। উনার সাথেও দেখা হয়ে যাবে। আপনার সাথেও উনার পরিচয় করিয়ে দেবো।”
“কি দরকার, পদ্ম?”
“চলুন না। উঠুন তো!”
আফিফ যেতে না চাইলেও পদ্ম তাকে জোর করে আহিদের টেবিলের সামনে নিয়ে গেলো। সেখানে গিয়ে তারা দেখলো সালমা ফাওজিয়া নিজ হাতে আহিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। পদ্ম আর আফিফকে দেখে আহি নিজের চোখ মুছে নিলো। পদ্ম সালমা ফাওজিয়াকে সালাম দিয়ে বলল,
“কেমন আছেন আন্টি?”
সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললেন, “পদ্ম?”
পদ্ম লাজুক হেসে বলল, “জ্বি।”
সালমা ফাওজিয়া হেসে বললেন,
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, মা?”
“আমিও ভালো।”
“বসো, বসো।”
পদ্ম আফিফের হাত ধরে তাকে জোর করে বসালো। সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে আফিফের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আমি তোমাকে আগে কোথাও দেখেছি!”
আহি ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“মা পদ্মের হাজবেন্ড। ছবিতে দেখেছো হয়তো।”
সালমা ফাওজিয়া আহির কথায় আফিফের দিকে তাকালেন। আফিফ শুকনো হেসে সালাম দিলো। সালমা ফাওজিয়া সালামের উত্তর নিয়ে এবার আহির দিকে তাকালেন। তিনি খেয়াল করলেন আফিফকে দেখে আহি বার-বার তার দুই হাত ঘষছে। তিনি বুঝতে পারলেন, এই ছেলেটাই সে-ই, যাকে আহি ভালোবাসতো। আহি নিজেই তাকে আফিফের কথা বলেছিল। আর তিনি মুনিয়া খালার কাছে শুনেছিলেন, পদ্মের বিয়ে থেকে ফেরার পরই আহির শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। ডাক্তারও তখন জানিয়েছিলো, আহির মানসিক অবস্থা ওতোটা ভালো নয়। তাহলে আফিফকে পদ্মের স্বামী হিসেবে দেখেই সেদিন আহির এমন অবনতি হয়েছিলো?
সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরলেন। আহি মায়ের দিকে তাকালো। তখনই পদ্ম কেকটা সামনে রেখে বলল,
“আন্টি, উনার চাকরি হয়েছে। তাই আমি নিজের হাতে এই কেক বানিয়েছিলাম। চলুন না, একসাথে কাটি।”
সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে আফিফকে বললেন,
“কংগ্রাচুলেশনস। কোথায় চাকরি হয়েছে?”
আফিফ বলল, “খানস গ্রুপে।”
সালমা ফাওজিয়া আর আহি দু’জনই অবাক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকালো।
(***)
তমসাচ্ছন্ন গগন, বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ, মৃদু সমীরণে বাগানের ফুটন্ত অলকানন্দাগুলো দোল খাচ্ছে। আহি বারান্দার স্লাইডিং ডোর খুলে দিয়ে তার এক পা বের করে রাখলো। বৃষ্টির ছাঁট তার সেই পায়ে এসে পড়ছে। আর আহি চোখ বুজে সেই স্পর্শ অনুভব করছে।
আহি অলকানন্দা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“এআর, খুব তো সুখেই আছো। তুমি কি কখনো গভীর রাতে বৃষ্টি দেখতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলে?”
আহি পরক্ষণেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“কেনই বা দাঁড়াবে? তোমার শরীরে উষ্ণ স্পর্শ দেওয়ার মানুষ তো তোমার পাশেই আছে। তুমি তো আর আমার মতো একাকীত্বে নেই, যে গভীর রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখবে। এআর দেখো, আজ আকাশে কতো শত মেঘ ভীড় জমিয়েছে। ঠিক সেই রাতের মতো। এমনই এক রাতে আমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলাম। একদম নিঃস্ব।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো হতাশার অশ্রু।
(***)
বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আফিফ। বৃষ্টি আসায় বারান্দার মেঝেতে পানি জমে গেছে। আফিফ রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে সেই জমে থাকা পানিগুলোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তার চোখে শূণ্যতা। মনটা ভারী হয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আহির অশ্রুসিক্ত চোখ। চার বছর আগে সে প্রথম সেই মেয়েটিকে দেখেছিল, যে তার জীবনের ক্ষণকালীন খেয়াল হিসেবে এসেছিল। কিন্তু সেই মুহূর্তগুলো আফিফের কাছে ভীষণ চমৎকার ছিল।
কিছু সুন্দর মুহূর্ত চোখের পলকে হারিয়ে যায়। আফিফও হারিয়ে ফেলেছিল সেই বেনামী চিরকুটের মেয়েটিকে। তবে হারিয়ে ফেলে নি, ইচ্ছে করেই হারাতে চেয়েছিল। চাইলে তো সে ধরে রাখতে পারতো। কিন্তু ধরতে পারে নি। আফিফের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে রেলিঙে পিঠ ঠেকিয়ে তার মাথাটা বারান্দার বাইরে বের করে দিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। আফিফের মুখে সেই বৃষ্টির ছিঁটেফোঁটা জায়গা করে নিচ্ছে।
(***)
আহি বারান্দায় এসে রেলিঙে হাত রাখলো। রেলিঙে জমে থাকা পানিগুলো স্পর্শ করতে করতে বলল,
“এই বৃষ্টি তোমাকে স্পর্শ করলে বুঝবে, আমি তোমাকে স্পর্শ করছি। আমি তো আর বৃষ্টি হয়ে তোমাকে স্পর্শ করতে পারছি না। কিন্তু এই আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে আমার ভালোবাসার গল্প। আর আমার সেই গল্পটাই মেঘ হয়ে তোমাকে ছুঁয়ে দেবে। এভাবে যদি তোমাকে পাওয়া যায়, তাহলে এভাবেই হোক।”
আহি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মেঘ, যাও না ও বাড়ি। তোমার সখী পবনমালাকে বলো, ঘুমন্ত এআরকে স্পর্শ করে দিয়ে আসতে। পবনমালার স্পর্শে একটু যদি তার চোখের পাতা নড়ে উঠে, এক রাত যদি সে আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখে, যেই স্বপ্নে তুমি তাকে জানিয়ে দেবে আমি ভালো নেই। আমি তাকে ভালোবেসে মরুভূমি হয়ে গেছি। যেই মরুভূমিতে বৃষ্টির স্পর্শ মরীচিকার মতো। যা ধরতে গেলেই মিথ্যে হয়ে যাবে।”
(***)
আফিফের মুখে বিন্দু বিন্দু জল। আহির মেঘমালা হয়তো নিজে এসেই তার আবদার পূরণ করে দিয়েছে। ছুঁয়ে দিয়েছে আহির প্রিয় অলকানন্দকে। আফিফ চোখ খুলে শূণ্য আকাশের দিকে তাকালো। মনে মনে বলল,
“কেন আমাকে মনে রেখেছো, খেয়াল? আমি তো তোমাকে কখনোই ভালোবাসতে পারি নি। তাহলে কেন মনে রেখেছো আমায়? কেন কষ্ট দিচ্ছো নিজেকে? আমি তো ভেবেছি, তুমি আমাকে মনেই রাখো নি। এতো বছর হয়ে গেছে। আমি তো পদ্মফুলকে নিয়ে ভালোই আছি। তুমি শুধু কিছু বেনামি পত্রের ভীড়েই রয়ে গেছো। পদ্মফুল আমার জীবনে আসার পর থেকে কোনো নারী আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারে নি। তোমার জায়গাটা আমার জীবনে ক্ষণকালের জন্য ছিল। কিছু চিরকুটের ভীড়ে, কিছু বইয়ের পাতায়, কিছু রঙের ফাঁকে। আমি এখন সেগুলো স্পর্শও করি না। কারণ আমার পদ্মফুল আছে। আমি চাই তোমার জীবনেও এমন কেউ আসুক, যে তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তখন তুমি আমাকে মনে করার আর সময় পাবে না।”
(***)
আহি একটি অলকানন্দা ফুল স্পর্শ করলো। আর মলিন হেসে বলল,
“যতোবার তোমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, ততোবারই দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার এই অশ্রুগুলো ঝরে গিয়েই তো আমাকে শান্তি দিচ্ছে। আমার জীবনে যদি একটু শান্তি থাকতো, তাহলে আমি হয়তো তোমাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে পারতাম। কিন্তু দেখো না, তুমি তো নেই-ই, মাও নেই, লিনাশা নেই, পদ্ম থেকেও নেই, কারণ ওকে দেখলেই মনে হয়, তুমি আর আমার নও। যারা আছে তারা শুধু আমার মনটা আরো ভেঙে দেওয়ার জন্যই আছে। অসুস্থ বাড়িতে, অসুস্থ মানুষের ভীড়ে, আমি এক অসুস্থ প্রেমিকা। তাহলে কীভাবে ভুলবো তোমাকে, বলো? একটু তো সুখী হতে পারি আমি। কোনো এক দিক দিয়ে তো সৃষ্টিকর্তা আমাকে পরিপূর্ণ করতে পারতেন। আমার জীবনটা এখন একটা পরিহাস! যা-ই আমি চাইবো, তা-ই কুয়াশার মতো মিলিয়ে যাবে, আর দিয়ে যাবে শিশির কণার মতো দুঃখ। যেই দুঃখ কেউ স্পর্শ করতে এলেই ধ্বংস হয়ে যাবে।”
(***)
আহি সকালে উঠেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে পুষ্পকে ফোন করলো। কাল ক্যাম্পাসেই সে আজকের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছিলো পুষ্পকে। পুষ্প আহির বাসায় আসতেই রিজওয়ান কবিরকে ফোন করলো আহি। ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“বাবা, পুষ্পের কাজিনের বিয়ে। ও আমাকে ইনভাইট করেছে। বলছে সব প্রোগ্রামে যাতে থাকি।”
রিজওয়ান কবির বললেন,
“থাকো। এটা তো জানানোর বিষয় না।”
“থাকি বলতে, আমি কিছুদিনের জন্য ওখানেই শিফট হচ্ছি।”
“কোথায়?”
“পুষ্পের দাদার বাড়ি।”
“কোথায় ওর দাদার বাড়ি?”
“সিলেট।”
আহি হাতের ইশারা করতেই পুষ্প ওপাশ থেকে ন্যাকা কান্না জুড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আহি, চল না, দোস্ত। লিনাশার সাথেও যোগাযোগ হয় না। পদ্ম তো এখন বিয়ে করে ফেলেছে। ও কি স্বামী ছাড়া আসতে পারবে? তুই চল না, প্লিজ। তুই ছাড়া আমার তো কোনো বন্ধুই নেই।”
আহি রিজওয়ান কবিরকে শুনিয়েই গলার স্বর নামিয়ে বলল,
“বাবাকে জানাচ্ছি। ওরা তো দেশে নেই।”
“আংকেল তো ভালোই। উনি বারণ করবেন না। তুই-ই যেতে চাচ্ছিস না। তাই তো কাল থেকে আমাকে ইগ্নোর করছিস। কি আছে এ বাড়িতে? আংকেল-আন্টিও নেই।”
আহি পুষ্পের কথায় মুখ চেপে হাসলো। পুষ্পও হাসছে। তাদের দেখে মুনিয়া খালা নিঃশব্দে হাসছেন আর চুনিকে নিয়ে কিছু বক্সে খাবার বাড়ছেন। এদিকে ওপাশ থেকে রিজওয়ান কবির বললেন,
“আহি, তুমি পুষ্পের সাথেই চলে যেও। সিলেটও ঘুরে আসবে। প্রোগ্রাম শেষ হলে আমি তাজওয়ারকে বলবো তোমাকে নিয়ে আসতে।”
আহি বাবার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। আহি ইশারায় পুষ্পকে থামিয়ে বাবাকে বলল,
“ও না আসলেও হয়। আমার ফ্রেন্ডের বাড়ির লোকেরা দেখলে কি ভাববে? যা-ই হোক, আমি যাচ্ছি তাহলে। আজই বের হবো। পুষ্প আমাকে আজই নিয়ে যাবে। সন্ধ্যায় না-কি সিলেটের জন্য বাসে উঠবে।”
আহি কথাটি বলেই কল কেটে দিলো। পুষ্প বলল,
“কথা শেষ?”
“হুম।”
“মুখটা বাঁকিয়ে ফেলেছিস কেন? আংকেল তো রাজী হয়েছে!”
“তাজওয়ারকে পাঠাবে আমাকে নিয়ে আসার জন্য।”
“তাজওয়ার, মানে তোর বাবার বন্ধুর ছেলে? আংকেল যার সাথে তোর বিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ।”
“এখন কি করবি? তোকে তো এবার মিথ্যেমিথ্যি সিলেট যেতেই হবে।”
“যাবো, না হয়। কিন্তু তোর বোনের বিয়ে মিথ্যেমিথ্যি কীভাবে হবে?”
পুষ্প কিছু একটা ভেবে বলল,
“আরেহ ওটা নিয়ে ভাবিস না। আমাকে বলিস কোনদিন সিলেট যাবি, আমি চলে যাবো। আমার দু’জন কাজিন ওখানেই থাকে। উজ্জ্বল ভাইয়া আর তৃষা আপু। আপু তো ওখানেই চাকরি করে। একা থাকে। আমি ওখানেই উঠবো। তুইও ওখানে চলে আসবি। তারপর উজ্জ্বল ভাইয়াকে ফোন করবো। উনি আমাদের স্টেশনে নামিয়ে দেবেন। আর তুই তাজওয়ারকে সেই ঠিকানায় দিস। সেখান থেকে নিয়ে গেলে সন্দেহ করার কোনো চান্সই থাকবে না।”
আহি হেসে বলল,
“ঠান্ডা মস্তিষ্কের মানুষগুলোর মাথায় অনেক কিছু থাকে।”
আহি এবার তৈরী হয়ে এলো। মুনিয়া খালা তার হাতে বক্সগুলো ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলা বড় মেডামের জন্য। ছোড মা, তুমি কইয়ো মেডামরে, আমরা তারে এহনো মনে রাখছি। তারে ছাড়া এই বাড়ি খালি খালি লাগে।”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“হুম, আর খালা, আপনি আর চুনি ছাড়া কেউ জানে না আমি মায়ের কাছে যাচ্ছি। চাচাকেও বলবেন না। উনার বয়স হয়েছে। যদি ভুলে কাউকে বলে দেন, তাহলে অনেক ঝামেলা হবে।”
“চিন্তা কইরো না। আমরা কাউরে কিছু কমু না। তুমি যাও, মা। মায়ের লগে ভালো সময় কাটাইয়া আসো।”
আহি পুষ্পের সাথে বেরিয়ে পড়লো। সালমা ফাওজিয়া আহিকে কলেজ রোডের সামনে থেকে এসেই নিয়ে গেলেন। মায়ের সাথে রিকশায় বসে আছে আহি। বৃষ্টি ভেজা শহরে রিকশায় চড়ার প্রশান্তি অনুভব করছে আহি। কারণ পাশে একজন বিশ্বস্ত মানুষ আছে। আহি জানে, সামনের এই কয়েকটা দিন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো হতে যাচ্ছে।
চলবে-