#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২২||
৩৯।
শূণ্যতা কেটে গেছে নতুন আবেশে। বায়বীয় জগতে যোগ হয়েছে নতুন ছন্দ। আর আহি বাঁধছে নতুন সুর। সেই সুরে সালমা ফাওজিয়ার আঁধার ঘেরা ফ্ল্যাটে ঠিকরে পড়ছে রবিকর।
সূর্যের আলো আহির চোখে এসে পড়তেই আবার আলোটা মিলিয়ে গেলো। আহি আধো চোখ মেলে জানালার দিকে তাকাতেই দেখলো সালমা ফাওজিয়া পর্দা টেনে দিচ্ছেন। আহি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“তুমি আরেকটু ঘুমিয়ে নাও।”
আহি উঠে বসে বলল,
“অনেক বছর পর কাল রাতেই আমি শান্তিতে ঘুমিয়েছি। মনে হচ্ছিলো, এতো ভালো ঘুম আমার কখনোই হয় নি। মা, তুমি তো দেখছি শুধুই মেডিসিন নও, একদম এন্টিবায়োটিক।”
সালমা ফাওজিয়া হাসলেন। আহি তার হাত ধরে তাকে বিছানায় বসিয়ে তার কোলে মাথা রাখলো। সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। আহি মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“মা, তুমি কি আমাকে এভাবেই তোমার কাছে রেখে দিতে পারবে না?”
সালমা ফাওজিয়া মলিন হাসলেন। মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,
“একদিন অবশ্যই পারবো। তোমার জন্যই তো এতো পরিশ্রম করছি।”
আহি মাথা তুলে সালমা ফাওজিয়ার হাত ধরে বলল,
“এর আগে যদি তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হয়ে যায়?”
“তোমার অনুমতি ব্যতীত তোমাকে বিয়ে দেওয়ার সাধ্য কারো নেই।”
“আমার ইচ্ছায় আজ পর্যন্ত কিছুই হয় নি। ওরা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে। কখনো তোমার ক্ষতি করবে বলে, কখনো রাদ আর লাবীবের ক্ষতি করবে বলে। লিনাশাকে হারিয়ে ফেলার পর রাদ আমার খুব কাছের বন্ধু। সাড়ে চার বছর আগে আমার জন্যই লিনাশার জীবনের দুর্ভোগ নেমে এসেছিল। রাদের সাথেও যদি এমন কিছু হয়, তাহলে আমি আরো নিঃস্ব হয়ে যাবো।”
সালমা ফাওজিয়া মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“রাদের কিছু হবে না। ওরা শুধু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আহি। তোমাকে আরো স্ট্রং হতে হবে। এখন উঠো, নাস্তা দিচ্ছি আমি।”
(***)
আজ আকাশ পরিষ্কার। মিষ্টি রোদ বারান্দা ছুঁয়ে দিচ্ছে। আহি সেই মিষ্টি রোদ তার গায়ে মাখানোর জন্য বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সালমা ফাওজিয়াও কিছুক্ষণ পর আহির পেছনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আহির চুলে হাত রেখেই বললেন,
“এতো অযত্ন কেন, আহি? আসো, আমি তোমার চুলে তেল লাগিয়ে দেই।”
আহি বাধ্য মেয়ের মতো মায়ের পিছু পিছু চলে এলো। সালমা ফাওজিয়া তেল নিয়ে সোফায় বসলেন। আর আহি মেঝেতে বসলো। সালমা ফাওজিয়া হাতে তেল মেখে আহির মাথায় লাগিয়ে দিতে লাগলেন। আহি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। আহি তেল দেওয়া একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু আজ সে নিষেধ করবে না। কারণ এই মুহূর্তগুলোই তার কাছে অমূল্য।
সালমা ফাওজিয়া আহির চুলে তেল লাগিয়ে দিয়ে তার চুলে বেণি করে দিলেন। আহি পেছন ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল,
“এভাবে যদি রোজ তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে, তাহলে আমার মাথাটা ঠান্ডা থাকতো।”
“আচ্ছা? এতোদিন বুঝি গরম ছিল?”
“উহুম, নষ্ট ছিল।”
(***)
বিকেলে সালমা ফাওজিয়া একটি ক্যাসেট নিয়ে এলেন। আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মুভি?”
সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন,
“হুম। খুব সুন্দর মুভি।”
“কি নাম?”
“নাম ছাড়া মুভি। দেখার পর বরং তুমিই নাম ঠিক করো।”
আহি টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে। সালমা ফাওজিয়া ক্যাসেটটি চালু করতেই স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আহির ছোটবেলার ছবি। সালমা ফাওজিয়া এবার আহির পাশে এসে বসলেন। দু’জন বসে সেই ভিডিও গুলো দেখতে লাগলো। আহির জন্মের আগে সালমা ফাওজিয়া প্রতি মাসে একটা করে ভিডিও তৈরী করেছিলেন। প্রতি মাসে আহির বেড়ে উঠার অনুভূতিটা কেমন সেটা তিনি ভিডিওতে ধারণ করেছিলেন। ভিডিওগুলো দেখেই আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের কোলে মাথা রাখলো। এরপর স্ক্রিনে ভেসে উঠতে লাগলো আহির হাসপাতাল থেকে প্রথম ঘরে ফেরা, তার প্রথম হামাগুড়ি দেওয়া, বসতে শেখা, দেয়াল ধরে দাঁড়ানো, কাঁপা কাঁপা পায়ে হেঁটে সালমা ফাওজিয়ার কোলে ঝাপিয়ে পড়া। এসব দেখে আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“দিনগুলো অনেক সুন্দর ছিল, তাই না? আমি আবার কখন তোমাকে আগের মতো করে কাছে পাবো? আমি বাবার সাথে থাকতে চাই না।”
“আমিও তো তোমাকে নিজের কাছেই আনতে চেয়েছি। কিন্তু তোমার বাবা তোমাকে কখনোই হাতছাড়া করবেন না।”
আহি রাগী স্বরে বলল,
“সব ঝামেলার মূল ওই তাজওয়ার খান৷ ওর জন্যই বাবা আমাকে বন্দি করে রেখেছে।”
সালমা ফাওজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বললেন,
“কি বলছো, আহি? তাজওয়ারের জন্য কেন বন্দি করবে?”
“তুমি জানো না?”
“না।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মনে আছে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন থেকেই তাজওয়ার আমার পিছু নিতো! বাবা তো তখন থেকেই ওকে পছন্দ করতো। আমাকে বলতো আমি যাতে তার সাথে বন্ধুত্ব করি। কিন্তু আমি যখন স্কুলে, ওর তখন পড়াশুনা শেষের দিকে। এতো বড় ছেলের সাথে তো আমি কখনোই বন্ধুত্ব করবো না। আর তুমি যতোদিন বাসায় ছিলে, ততোদিন তাজওয়ারও বাসায় আসার সাহস পায় নি। কিন্তু তুমি চলে যাওয়ার পর খানদের বাসায় আসা যাওয়া যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিলো। বাবাকে তখন থেকেই আমি সহ্য করতে পারতাম না। বাবা সেই ছেলেকে হুটহাট আমার রুমে পাঠিয়ে দিতো। আর ছেলেটাও আমার অনুমতি ছাড়া আমার বিছানায় শুয়ে পড়তো। এমন ভাব দেখাতো, যেন আমার উপর একমাত্র তারই অধিকার। এসবে আমি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তুমি তো জানো, আমি এসব একদমই পছন্দ করি না। এমন অভদ্র ছেলের সাথে বাবা তখনই আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। সিরাজ খান না-কি আলটিমেটাম দিয়েছেন, আমার সাথে তাজওয়ারের বিয়ে দিলে, খানস গ্রুপের ত্রিশ ভাগ অংশ বাবার নামে লিখে দেবেন। আর তাজওয়ার তার সবকিছু আমার নামে লিখে দেবে। আর এরপর থেকেই বাবা পালটে গেছে। মা, তাজওয়ারের কাছে থাকলে আমি একদম সেইফ ফিল করি না। ও কেমন যেন! ওর সম্পর্কে অনেক খারাপ তথ্য পেয়েছি। রিসেন্টলি ওর প্রাক্তন প্রেমিকা আমাকে ফোন করে জানিয়েছে, তাজওয়ার না-কি তার সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভ ছিল। এরপর আমি ইউকে থেকে ফেরার পর তাজওয়ার আর সম্পর্ক রাখতে চায় নি। কিন্তু মেয়েটা ওকে ছাড়ছিল না, তাই ওর বন্ধুদের দিয়ে মেয়েটার সাথে অনেক জঘন্য কাজ করেছে, যেটা তোমাকে বলতেই পারছি না।”
আহি কিছুক্ষণ থেমে বলল,
“মা, তুমিই বলো, এমন একটা ছেলের সাথে কোনো বাবা কি তার মেয়েকে বিয়ে দিতে চায়?”
সালমা ফাওজিয়া চুপ করে রইলেন। আহি আবার বলল,
“এমনিতেই আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে হারিয়ে ফেলেছি। সেই ট্রমা থেকে এখনো বের হতে পারছি না। তাহলে নতুন করে তাজওয়ার নামক টক্সিক মানুষটাকে আমার জীবনে এনে আমি কেন আরো ট্রমার মধ্যে থাকবো? মা, আমি ওই বাড়িতে গেলে পাগল হয়ে যাবো। ওপেনলি ওরা বাড়িতে মেয়ে এনে, যাচ্ছেতাই করে। এমন পরিবেশে আমি বিয়ে করবো, আমার সন্তান আসবে, এটা আমি মানতেই পারছি না। যেখানে তোমার আর বাবার অসুস্থ সম্পর্কের কারণে আমার কৈশোরকাল, যৌবনকাল সব শেষ হয়ে গেছে। আমি আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সেই একই পরিবেশ দিতে চাই না।”
সালমা ফাওজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তোমার বাবাই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। তাজওয়ার সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না। কিন্তু সিরাজ খান ভালো মানুষ নয়, এটা অনেকেই জানে। তাহলে তার ছেলে আর কেমনই বা ভালো হবে? কিন্তু তোমার বাবা সেই শুরু থেকেই তোমাকে ব্যবহার করছে।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো, “মানে?”
“তোমার মনে আছে, তোমার বাবা আমাকে একবার বেধড়ক পিটিয়েছিল, আর এরপর আমি আমার আট মাসের বাচ্চাটা হারিয়ে ফেলেছিলাম?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার বাবা আমাকে কেন মেরেছে জানো?”
“কেন?”
“কারণ তিনি জেনে গিয়েছিলেন, তোমার দাদা তার নামে কোনো সম্পত্তি লিখে দেন নি। আগ্রাবাদে তোমার দাদার একটা বাড়ি আছে। বিশাল বাড়ি। তাছাড়া ঢাকায় তিনি অনেকগুলো জায়গা কিনেছেন। মৃত্যুর আগে তিনি এমন উইল করেছিলেন, যেখানে লেখা ছিল তোমার বাবার সন্তানরাই শুধু সেই সম্পত্তির মালিক হতে পারবে। তোমার বাবা কিছুই পাবেন না। তাই তিনি ছেলে চান নি। যেখানে বাবা-মা নিজ সন্তানের জন্য খেটেখুটে টাকা সঞ্চয় করে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে দেওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে পড়ে, সেখানে তোমার বাবা সম্পদ ভাগাভাগি না হওয়ার জন্য সন্তান নেন নি। তোমার বাবা শুধু টাকা ভালোবাসেন। নিজে তো অনেক বড় ব্যবসায়ী। চাইলে তার বাবার সম্পদ ছাড় দিতে পারতো। কিন্তু তার ক্ষোভ জন্মেছিল। তার ইগোতে আঘাত এসেছিল। কেন তার নামে লিখে না দিয়ে তার সন্তানের নামে লিখে দিয়েছে! আর তাই মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাচ্চাকে আর পৃথিবীতেই আসতে দেন নি। এখন বাকি তুমি। তুমি মেয়ে, তোমার সাথে যার বিয়ে হবে সেও সেই সম্পত্তির মালিক হবে। আর তোমার বাবা এজন্যই তোমাকে আমার সাথে থাকতে দিচ্ছে না। আর তাজওয়ারের সাথে বিয়ে হলে তোমার বাবা এমনিতেই যে-কোনো ভাবে সেই সম্পত্তি পেয়ে যাবে। আর না পেলেও তার কিছুই আসে যায় না। সে তো এমনিতেই অনেক টাকার মালিক।”
“মা, আমি যদি বাবাকে সেই জায়গা আর বাড়িটা লিখে দেই, তখন কি আমি মুক্তি পাবো?”
“না। তোমার বাবার তো সেই জায়গা লাগবেই না। তার কিসের অভাব আছে, বলো? তোমার বাবা আসলে তোমার দাদাকে হারাতে চায়ছে। তার ইগো তখনই সেটিস্ফাইড হবে, যখন সে তোমাকে কষ্ট দিতে পারবে। যদি তোমার দাদা সেই উইলটা না করতেন, তাহলে তোমার বাবা তোমাকে আর ধরে রাখতো না। আর তার এতোটা পরিবর্তনও হতো না। হয়তো লাবণীর প্রতি সে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মানুষটা এতোটা নিচু মনের ছিল না। হয়তো বা ছিল, ভালোবাসতাম বলে তাকে চিনতে পারি নি। কিন্তু তোমার বাবা আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি, কারণ আমি তার দৃষ্টিতে নিতান্তই সাধারণ ছিলাম। আমি তার চোখে মডার্ন নারী ছিলাম না। কিন্তু লাবণি ছিল ইয়াং মেয়ে, তার ফ্যাশন সেন্স ভালো, সে জিন্স-টপস পরে, দশজন ছেলের সাথে সহজে ওঠাবসা করতে পারে। আমি পারতাম না। আমি শাড়ি পরি, সাধারণ ভাবে চলি। আর আমাদের মতেরও অমিল হতো। আমি অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি। শুধু তোমার জন্যই সেই বাড়িতে পড়েছিলাম। এখন দেখো, তোমাকেও সেভাবে চালাচ্ছে।”
আহি মাথা নিচু করে রইলো। সালমা ফাওজিয়া আহির গালে হাত রেখে বললেন,
“অনেক বড় হয়ে গেছো তুমি। এখন একটু শালীন ভাবে চলাফেরা করতে হবে। এই সমাজটা এতোটাও ভালো না, আহি। এই দেশের সংস্কৃতির সাথে তোমার এই পোশাক যায় না। জানি তোমার বাবা তোমাকে এভাবেই চলতে বাধ্য করছে। কিন্তু নিজের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিতে পারো। একটু স্ট্রং হও। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে তুমি তোমার জন্য স্ট্যান্ড নিতে পারো। এতোটুকু স্ট্যান্ড নিতে না পারলে, তুমি কীভাবে তোমার বিয়ে আটকানোর সাহস দেখাবে? কীভাবে বলছো যে তুমি ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে? আগে নিজেকে শক্ত করো। তুমি শক্ত হলে, তোমার পাশে দাঁড়ানোর অনেকেই আছে। তোমার মা আছে।”
আহি সালমা ফাওজিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। তিনি আহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি অনেক সুন্দর আহি। তোমাকে শাড়ি পরলে, সেলোয়ার-কামিজ পরলে ভালোই লাগবে৷ অন্তত লং টপস পরতে পারো, গায়ে ওড়না ঝুলাতে পারো। আর স্লিভলেস পোশাক তো একদমই বেমানান।”
“আমি তো স্লিভলেস পরতে চাই না, ওড়না ঝুলিয়েই আমি বাসা থেকে বের হই। কিন্তু মাঝে মাঝে মিসেস লাবণির পিএ সুনেহরাহ এসেই আমার জামা-কাপড় সিলেক্ট করে দেয়। আমার খাওয়া, পরা, সবকিছুই তাদের পছন্দে হয়। যদিও ইউকে’তে আমি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পেরেছি। আর ওখানে এমন ড্রেস পড়লে কেউ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে না।”
“তাও, আহি। তোমার বন্ধুরা তো দেশের ছেলে। রাদ, লাবীব, ওরা কি অন্য দেশের? ওরা এই দেশের ছেলে। ওরা তোমাকে সম্মান করে, তাই হয়তো বাজে দৃষ্টিতে তাকায় না। কিন্তু কারো নিয়ত সম্পর্কে তুমি কতোটুকুই বা জানবে?”
“কি করবো আমি এখন?”
“আপতত স্লিভলেস পরো না। ওদিন তুমি এমন পোশাকে রাদের সাথে রিকশা করে কোথায় যেন যাচ্ছিলে। আমি তোমাকে দেখেছিলাম। আমার ভালো লাগে নি, আহি।”
আহি মুখ ছোট করে বলল,
“সরি। আমি হয়তো ভালো না।”
“তুমি ভালো। তুমি অনেক লক্ষী একটা মেয়ে। শুধু তোমার পরিবেশটা খারাপ। আমি চাই, আমার মেয়েটা ভালো পরিবেশে থাকুক। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে তোমার জন্য একজন উত্তম সঙ্গী চাই, যে আমার মেয়ের যত্ন নেবে, তাকে ভালোবাসবে, তার সম্মান করবে, আর তাকে সকল খারাপ দৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে।”
আহি মুচকি হেসে বলল,
“শুনেছি মায়ের দোয়া কবুল হয়ে যায়৷ তুমি আমার জন্য আরেকটা দোয়া করবে?”
“কি!”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি যাতে আফিফকে ভুলে যেতে পারি।”
কথাটি বলতে গিয়েই আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
“তুমি আমার রাজকুমারী। তোমার সব ইচ্ছের জন্য আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে চাইবো। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথেই থাকবে।”
(***)
চারটা দিন আহির খুব ভালোই কেটেছে। এই চার দিনে সালমা ফাওজিয়া আর আহি অনেক গল্প করেছে, একসাথে বই পড়েছে, সালমা ফাওজিয়া রান্না করলে আহি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সাহায্য করেছে, টুকটাক শিখেও নিয়েছে, আর রাতে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। আজ তার এই বাড়িতে শেষ দিন। আহি সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে। এদিকে পুষ্প সিলেট পৌঁছে তাকে কয়েকবার ফোন দিয়ে ফেলেছে। সেখানে তারা দু’দিন থাকবে।
হঠাৎ সালমা ফাওজিয়া এসে আহির মুখে একটা মিষ্টি পুরে দিলেন। আহি মিষ্টি মুখে নিয়েই মায়ের দিকে তাকালো। সালমা ফাওজিয়া একগাল হেসে বললেন,
“কেমন হয়েছে?”
আহি মিষ্টিটা খেয়ে বলল, “ভীষণ মজা!”
“তুমি বললে না, লাবণি তোমাকে মিষ্টি খেতে দেয় না। তাই আমি এটা তোমার জন্য বানিয়েছি।”
“তুমি বানিয়েছো? কখন?”
“তুমি যখন ঘুম ছিলে। ভোরেই বানিয়ে রেখেছি।”
“তুমি মিষ্টিও বানাতে পারো?”
“না, দু’দিনে শিখেছি। কাল বানিয়েছিলাম, কিন্তু ভালো হয় নি, তাই তোমাকে আর দেই নি। আজকেরটা মোটামুটি ভালো হয়েছে।”
আহি মায়ের হাত ধরে বলল,
“ভাবছি, যাদের মা আছে, তারা রোজ এমন যত্ন পাচ্ছে। আর আমি আজ থেকে আবার একা হয়ে যাবো।”
সালমা ফাওজিয়া আহির গালে চুমু খেয়ে বললেন,
“কেন একা হবে? যখনই তোমার মন চায়বে, আমার কাছে চলে আসবে। আর আমি তোমার জন্য নতুন সিম কিনেছি। এখন তুমি আমাকে সেই নম্বর থেকেই ফোন করতে পারো।”
“আচ্ছা।”
সালমা ফাওজিয়া এবার নিজের ঘরে গেলেন। একটা প্যাকেট এনে আহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এটা পরে নাও। তোমাকে নিয়ে বের হবো।”
আহি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল,
“আমরা তাহলে ঘুরতে যাচ্ছি?”
সালমা ফাওজিয়া মুচকি হেসে বললেন, “হুম।”
(***)
লাল হলুদাভ শাড়ি পরে আহির সামনে এসে দাঁড়ালেন সালমা ফাওজিয়া। মায়ের দিকে তাকিয়ে আহি অবাক হয়ে বলল,
“একদম একই শাড়ি!”
সালমা ফাওজিয়া বললেন,
“হুম, তোমার জন্য কিনেছিলাম। তার সাথে মিলিয়ে আমিও একটা কিনেছি। মা-মেয়ের টুইনিং হয়ে গেলো।”
“বাহ! আমার মা তো দেখছি বেশ স্মার্ট।”
“তা তুমি শাড়িটা পরো নি কেন?”
আহি মুখ ছোট করে বলল, “পরতে পারি না।”
সালমা ফাওজিয়া আহির হাত ধরে তাকে নিজের সামনে দাঁড় করালেন। এরপর শাড়িটা হাতে নিয়ে আহির হাতে দিলেন। তারপর শাড়ির কুঁচি ধরে আহিকে শিখিয়ে দিতে লাগলেন।
(***)
শূণ্য আকাশে কালো মেঘেরা ভাসছে। সেই সাথে বাতাবরণে যোগ হয়েছে শীতল হাওয়া। হাওয়ার তালে বারান্দার পর্দাটি দোল খাচ্ছে।
নিস্তব্ধ ঘরে দাঁড়িয়ে আছে আহি। সালমা ফাওজিয়া মেয়ের সামনে বসে কুঁচি ঠিক করছেন। তাদের কথোপকথনে নীরব ঘরটিতে মৃদু গুঞ্জন সৃষ্টি হলো। পুরো ফ্ল্যাটে সেই গুঞ্জন বাতাসের তালে ছড়িয়ে পড়েছে, আর প্রতি কোণায় গিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে আজ বিদায় বেলা।
মেয়েকে আয়নার সামনে বসিয়ে খোঁপা বেঁধে দিলেন সালমা ফাওজিয়া। তারপর নিজ হাতে সেই খোঁপায় গাদা ফুলের মালা লাগিয়ে দিলেন। আহি মায়ের হাত ধরে বসালো। মাকে নিজ হাতে সাজিয়ে দিলো সে। এবার সালমা ফাওজিয়া আহির হাতে হলুদ ও লাল কাচের চুড়ি পরিয়ে দিলেন। আর আহি মায়ের জুতার ফিতা বেঁধে দিলো। দু’জনই হাত ধরে নেমে পড়লো ভেজা রাস্তায়। ফুটপাত ধরে হাঁটলো কিছুক্ষণ। তারপর টংয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দু’জনই চা খেলো। রিকশা নিয়ে সদ্যস্নাত শহরে মধ্যাহ্নবেলা উপভোগ করলো।
এরপর সালমা ফাওজিয়া আহিকে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলেন। দু’জনই নৌকায় উঠে বসলো। মাঝিকে বললেন পাড় ঘুরিয়ে আনতে। আহি নৌকার পাঠাতনে বসে আঙ্গুল ডুবিয়ে স্রোতস্বতীকে অনুভব করতে লাগলো। সালমা ফাওজিয়া মনে মনে বললেন,
“এই নদী আজ সার্থক হয়েছে। কারণ মা তার সন্তানকে কাছে পেয়েছে। এই চারটি দিন আমার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার দিন হয়ে থাকবে। আমি আমার সাধ্যের মধ্যে আমার মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে পেরেছি। যদি রিজওয়ান কবিরকে দেখাতে পারতাম, সব সুখ টাকা দিয়ে কেনা যায় না, কিছু সুখ ভালোবাসা দিয়েও কেনা যায়, তাহলে আমি পুরোপুরি সার্থক হতাম।”
মা-মেয়ে নদীর পাড়ে হেঁটে সূর্যাস্তের সময়টুকু পার করলো। তারপর ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দু’জনই ফুচকা খেয়ে বাসায় ফিরলো। বাসায় এসেই আহি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিলো। এরপর কাপড় পাল্টে এসে ব্যাগ নিয়ে বের হতেই দেখলো, সালমা ফাওজিয়া সোফায় বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আহি মাকে কাঁদতে দেখে আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। তারপর দু’জনই অনেকক্ষণ কাঁদলো। এরপর আহি চোখ মুছে বললো,
“ট্রেন ধরতে হবে আমাকে।”
সালমা ফাওজিয়া আর কিছু বললেন না। আহি এবার মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“এই চারদিনে আমার নিজেকে একটুও একা মনে হয় নি। আমার মনে যতো দুঃখ জমানো ছিল, আমার মধ্যে থাকা সব হতাশা, আক্ষেপ সবকিছুই আমি ভুলে গিয়েছিলাম। মা, আমার সুখী হওয়ার সবচেয়ে বড় মেডিসিন তুমিই। তোমাকে পেলে আমার আর কিচ্ছু লাগবে না। আমরা এখান থেকে পালিয়ে যদি বাইরের দেশে সেটেল্ড হয়ে যাই, তখন বাবা আমাদের কিছুই করতে পারবে না। তার সব দাপট দেশেই। বাইরের দেশে সে কিছুই না।”
সালমা ফাওজিয়া মলিন মুখে বললেন,
“বাইরের দেশে যাওয়া, চাকরি নেওয়া, খরচ, এতো টাকা কোথায় পাবো? তোমার বাবার টাকায় তুমি ইউকে থেকে পড়াশুনা করে এসেছো। তোমার নিজের কিছুই নেই।”
আহি সালমা ফাওজিয়ার কথায় দমে গেলো। সে মনে মনে ভাবতে লাগলো, কখন তার জীবনে আশার আলো ফিরে আসবে! কখন সে মুক্তি পাবে এই হিংস্র মানুষগুলোর হাত থেকে!
(***)
নয়টার ট্রেনে উঠে পড়লো আহি। সালমা ফাওজিয়া ট্রেন ছাড়া অব্ধি স্টেশনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যেতেই তার বুকটা খালি হয়ে গেলো। আহিও নিঃশব্দে অশ্রু ফেললো।
মা-সন্তানের এমন বিচ্ছেদও কি হয়? প্রবাসী সন্তানকে বিদায় দিতে এসে কতো মা নীরবে কাঁদেন, হোস্টেল ফেরা সন্তানদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কতো মা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। কিন্তু এই বিচ্ছেদের যন্ত্রণা ভয়ংকর। যেখানে মা-মেয়ে একই শহরে থেকেও অনেকদূরে, যেখানে দু’দন্ড কথা বলতে গেলে শকুনের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে হয়। স্বাধীন দেশে, এমন পরাধীন জীবনটাই যে ভয়ংকর। যেখানে একটাই ভীতি, যদি প্রিয় মানুষটিকে কাছে পেতে চাইলে, তার নিথর শরীর ফেরত আসে?
(বিঃদ্রঃ আজকের এই পর্বটা আমি সব মায়েদের উৎসর্গ করলাম। অনেক দিন ধরেই মা মেয়ের এমন ছোটখাটো অনুভূতি আমি লিখে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। আর উধয়রনী আমাকে সেই সুযোগটা দিয়ে দিলো। তাই এই পর্বটা লিখেছি।)
চলবে-