#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৩||
৪০।
ভারী পুরুষালী স্বর কর্ণগোচর হতেই আহির ঘুম ভেঙে গেলো। সে গায়ে জড়ানো কাঁথাটা হালকা সরিয়েই ভ্রূ কুঁচকালো। এরপর রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো, দরজা খোলা। আহি বার কয়েক পুষ্পকে ডাকলো। কিন্তু পুষ্পের সাড়াশব্দ নেই। আহি এবার কোমরে কাঁথাটা পেঁচিয়ে দরজার কাছে আসতে যাবে তখনই একজন অপরিচিত ছেলের মুখোমুখি হলো। আহি তার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসলো। আগন্তুক ছেলেটি ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো। সে আহির হাসির কারণ বুঝতে না পেরে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি নিজের হাসি গিলে এক পা এক পা করে সামনে এগিয়ে ছেলেটির মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো। দরজা বন্ধ করেই কাঁথাটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারলো আহি। দাঁতে দাঁত চেপে মনে মনে পুষ্পকে কিছুক্ষণ বকলো। তার এক বদভ্যাস, রাতে ঘুমানোর সময় হাঁটু অব্ধি প্যান্ট পরেই সে ঘুমায়। এখানে এসেও আহি এমনই করেছে। গতকালই পুষ্পের আপুর বাসায় উঠেছে আহি। তৃষা আপু বাসায় একা থাকেন। তার স্বামী মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি বাসায় খুব একটা আসতে পারেন না। কয়েক মাস পর পরই আসেন। তাই আহি নিজের বাসায় যেভাবে ঘুমায়, এখানেও ওভাবেই ঘুমিয়েছিলো।
জামা-কাপড় পালটে বিছানায় শান্ত হয়ে বসলো আহি। নিজের কপালে নিজেই চাপড় মারলো সে। মায়ের কথাগুলো মনে পড়তেই সে ভাবলো, অন্তত বাইরে তাকে একটু শালীন ভাবে চলতে হবে। আজ যদি এই অপরিচিত ছেলেটা তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলতো, তাহলে ভীষণ লজ্জায় পড়তে হতো আহিকে।
(***)
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই আহি দরজা খুলে দিলো। পুষ্প রুমে ঢুকে বলল,
“উঠেছিস তাহলে?”
আহি রাগী স্বরে বলল,
“দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলি কেন? তুই জানিস না আমি ঘুমাচ্ছিলাম? ছেলে একটা কোথা থেকে চলে এসেছে!”
পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“সরি আহি। হুড়োহুড়ি করে ছাদে গিয়েছিলাম। আমার জামাগুলো ওখানে শুকানোর জন্য দিয়ে এসেছি। আপুর বারান্দা তো অনেক ছোট। আর আপু অফিসে চলে যাচ্ছিল। ছাদের চাবিটা না-কি বাড়ির মালিককে দিয়ে দিতে হয়। আমি তো মালিককে চিনি না। আপুই দিয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, কিন্তু ছেলেটা কে?”
“আরেহ, উনি উজ্জ্বল ভাইয়া।”
“এখানে কেন এসেছে?”
“আমি আসতে বলেছি তাই।”
“কেন আসতে বলেছিস? আমরা তো বাসায় পরশু যাচ্ছি।”
“তো আমরা এখানে এসেছি, একটু ঘুরবো না?”
“তো!”
“আরেহ ভাইয়ায় আমাদের ঘুরাবে। আমি তো এখানকার পথঘাট চিনি না। আর তুইও চিনিস না।”
উজ্জ্বলের কন্ঠে পুষ্প বেরিয়ে পড়লো। আহি মায়ের দেওয়া সেলোয়ার-কামিজ পরেই রুম থেকে বের হলো। উজ্জ্বল আহিকে দেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি উজ্জ্বলের তাকানো দেখে হালকা হাসলো। আহিকে হাসতে দেখে সেও হাসি ফেরত দিলো। এদিকে পুষ্প রান্নাঘর থেকে নাস্তা এনে ডায়নিংয়ে রেখে আহির দিকে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। আহি ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, কি?
পুষ্প জোরেই বলল,
“আহি তুই উলটো জামা পরেছিস?”
আহি চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। তারপর মুখ ছোট করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। দেখলো উজ্জ্বল মুখ চেপে হাসছে। আহি তা দেখে দ্রুত পায়ে হেঁটে আবার রুমে ঢুকে পড়লো। আহি রুমে ঢুকতেই উজ্জ্বল হাসতে লাগলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“ভাইয়া, তুই হাসিস না তো। তখন মেয়েটা আর ঘুরতেই বের হবে না।”
উজ্জ্বল হাসি আটকে বলল,
“তোর বান্ধবীর মাথা নষ্ট!”
“চুপ কর, আমার বান্ধবীকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলবি না।”
এদিকে আহি জামাটা ঠিকভাবে পরে রুমের দরজা হালকা খুলে পুষ্পকে ডাকলো। পুষ্প আসতেই সে বলল,
“ভাই, আমার নাস্তাটা এদিকে পাঠিয়ে দে। আমি তোর ওই ভাইয়ার সামনে আর যেতে পারবো না।”
পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আহি, রিল্যাক্স। এটা স্বাভাবিক।”
পুষ্প টেনে আহিকে রুম থেকে বের করে ডায়নিংয়ে নিয়ে এলো। আহি চেয়ার টেনে বসতেই উজ্জ্বলও তার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
পুষ্প ডায়নিংয়ে নীরবতা দেখে একনজর আহির দিকে তাকালো, আরেক নজর উজ্জ্বলের দিকে। সে বুঝতে পারলো আহি ইতস্ততবোধ করছে। তাই আহিকে স্বাভাবিক করার জন্য সে বলল,
“আহি, তোকে একটা মজার গল্প বলি, শোন।”
উজ্জ্বল খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“তখন আমি স্কুলে পড়তাম। ইদের ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলাম। উজ্জ্বল ভাইয়াও গিয়েছিল। ভাইয়া তখন ভার্সিটিতে পড়তো। আমাদের গ্রামের বাড়িতে গোসলঘরটা বাড়ি থেকে একটু দূরে। ওখানে আবার কাপড় রাখার হ্যান্ডেল থাকে না। জামা-কাপড় দরজায় ঝুলিয়ে রাখতে হয়…..”
উজ্জ্বল গম্ভীরমুখে বলল,
“পুষ্প, খেয়ে নে। খাওয়ার সময় কথা বলিস না।”
পুষ্প বিরক্তির সুরে বলল, “তুই চুপ কর।”
পুষ্প এবার খোশমেজাজে বলল,
“এরপর শোন না আহি। ভাইয়াও গোসল করার জন্য জামা-কাপড় নিয়ে গোসলঘরে চলে গেলো।”
উজ্জ্বল পুষ্পের কথা আটকে দেওয়ার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠে পুষ্পের মুখ চেপে ধরলো। পুষ্প উজ্জ্বলের হাত সরিয়ে দিয়ে গলা উঁচু করে বলল,
“তারপর আমাদের গ্রামের এক চাচা, ভাইয়ার জামা আর প্যান্ট দরজার উপর থেকে নিয়ে পালিয়ে গেলো।”
উজ্জ্বল চোখ রাঙিয়ে পুষ্পের দিকে তাকালো। আর তাকে ধরার জন্য ডায়নিংয়ের চারপাশে ঘুরতে লাগলো। পুষ্পও ডায়নিংয়ের চারদিকে ঘুরছে আর উজ্জ্বলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। আহি উৎসুক দৃষ্টিতে দুই ভাই-বোনের খুঁনসুঁটি দেখছে। পুষ্প দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বলল,
“তারপর ভাইয়া তো পড়লো এক বিপদে। সেখানে দাঁড়িয়েই সে সবার নাম ধরে ডাকছিল। কিন্তু কেউই সাড়া দিলো না। শেষমেশ কি হলো জানিস?”
পুষ্প কিছুক্ষণ হাসলো। তারপর বলল,
“গোসলঘরের উপরে একটা কলা গাছ ছিল। ভাইয়া ওখান থেকে কলাপাতার ডাল ছিঁড়ে কিভাবে যেন কোমরে পেঁচিয়ে, সেখান থেকে বের হয়েছিল।”
উজ্জ্বল এবার থেমে গেলো। সে আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি শব্দ করে হাসছে। সে এবার পুষ্পের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। এদিকে আহি উজ্জ্বলকে অবাক করে দিয়ে উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কলাপাতা কেন লাগিয়েছে? যেই কাপড় পরে গোসলঘরে গিয়েছিলো, ওটাই পরে বের হয়ে আসতে পারতো।”
উজ্জ্বল আহির আগ্রহ দেখে সেখানে আর দাঁড়ালো না। সে অন্য রুমে চলে গেলো। পুষ্প উজ্জ্বলকে চলে যেতে দেখে গলার স্বর উঁচু করে বলল,
“ওটাও দরজায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। তাই কলাপাতায় তার একমাত্র আশ্রয়স্থল ছিল।”
আহি উজ্জ্বলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এবার পুষ্পের হাত ধরে চাপা স্বরে বলল,
“পুষ্প, থাম। তোর ভাইয়া হয়তো রাগ করেছে। তোর এভাবে বলা উচিত হয় নি। আমি তো অপরিচিত একজন। এসব কথা বাইরের কাউকে বলে না।”
“আরেহ, রিল্যাক্স।”
“না, কীসের রিল্যাক্স? সরি বলে আয়।”
পুষ্প চোখ ছোট করে বলল,
“মায়ের চেয়ে দেখছি মাসির দরদ বেশি।”
উজ্জ্বল যেই রুমে গিয়েছে আহি পুষ্পকে সেদিকে ঠেলে পাঠিয়ে বলল, “যা না।”
পুষ্প বাধ্য হয়ে উজ্জ্বলের কাছে গেলো। এদিকে উজ্জ্বল পুষ্পকে দেখে বলল,
“কেন এসেছিস? তোকে নিয়ে আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। আমি এখন নিজের কাজেই বের হবো।”
পুষ্প ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“সরি, সরি, সরি। ভাইয়া, তুই না আমার লক্ষী ভাইয়া। প্লিজ রাগ করিস না। আহি খুব ইতস্ততবোধ করছিল। আর তুইও ওর উপর হেসেছিস। তাই তোর সিক্রেট বলে কাটাকাটি করে ফেললাম।”
“এভাবে কেউ কাটাকাটি করে? ওর কিছুই কাটে নি, উলটো আমার পুরো নাকটাই কেটে দিয়েছিস।”
পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের নাকের দিকে তাকিয়ে রইলো। উজ্জ্বল বিরক্তির সুরে বলল,
“কি দেখছিস?”
“দেখছি, নাকটা তো আগের জায়গায় আছে।”
উজ্জ্বল বলল,
“যা এখন, বিরক্ত করিস না। আমি এখন আর বের হবো না মানে, হবো না।”
হঠাৎ আহি দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পুষ্পের সেই স্কুল থেকেই তার ছেঁড়া। কোথায় কি বলতে হয়, ও জানেই না। আপনি ওর কথায় কিছু মনে করবেন না। আর এসব ছোটখাটো ঘটনা সবার সাথেই ঘটে। আসলে আমার হাতে বেশিদিন সময় নেই। সিলেট অনেক বড় শহর। এটা তো দু’দিনে ঘুরে দেখা সম্ভব না। তাই দু’দিনে যতোটুকু ঘুরে দেখা যায়। আর আপনি যদি আমাদের নিয়ে না যান, তাহলে আমরা যদি পথে হারিয়ে যাই?”
উজ্জ্বল আহির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। আহি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ।”
উজ্জ্বল আহির মুখের ভাব দেখে মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা, তোমরা তৈরী হয়ে নাও।”
পুষ্প আহির কাছে এসে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ! বাহ, বাহ, বাহ! বেশ তো পটিয়ে ফেলেছিস আমার ভাইকে।”
আহি মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আহির কথা কেউ সহজে ফেলতে পারে না।”
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আহির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। পুষ্প তা দেখে বলল,
“আবার মুখটাকে অন্ধকার করে ফেলেছিস কেন?”
আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নেড়ে মৃদু হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“শুধু তারাই আমার কথা রাখে নি, যাদের আমি খুব বেশিই গুরুত্ব দিয়েছিলাম।”
চলবে-