#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(২য় ভাগ)||
৪৩।
আহি সিঁড়ি বেয়ে নেমে দেখলো উজ্জ্বল একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আহিকে দেখে উজ্জ্বল মৃদু হাসলো। উজ্জ্বল তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বন্ধু রইস।”
আহি রইসের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিলো। রইসও হালকা হেসে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। রইসের কৌতূকময় চাহনি দেখে উজ্জ্বল চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো। রইস তা দেখে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এদিকে পুষ্প নিচে নেমে রইসকে দেখে বলল,
“ভাইয়া আপনিও যাচ্ছেন?”
রইস হেসে বলল, “হ্যাঁ।”
পুষ্প এক গাল হেসে মনে মনে বলল,
“ভালোই হয়েছে। রইস ভাইয়াকে বললে উনি নিশ্চিত আমার ছবি উঠিয়ে দেবেন।”
(***)
রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট পৌঁছাতেই আহির ফোন বেজে উঠলো। আহি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো তাজওয়ারের পঁচাত্তরতম কল। কাল সারারাত ফোন দিয়েছে সে। আহি ফোন সাইলেন্ট করেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। সকাল থেকেই অনবরত কল দিচ্ছে তাজওয়ার। একটুও বিরতি দিচ্ছে না। আহি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে তার কল দেখে। এরই মধ্যে মিসেস লাবণিও কয়েক বার ফোন করেছেন। আহি ফোনের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তখনই উজ্জ্বল বলে উঠলো,
“নৌকা ভাড়া করে ফেলেছি। চলো।”
আহি নৌকায় উঠেই একপাশে গিয়ে বসলো। তখনই আবার ফোন বেজে উঠলো। পুষ্প বলল,
“বার বার তোকে কে কল করছে?”
আহি ফোনটা বের করে কাটতে যাবে, দেখলো রিজওয়ান কবির কল দিয়েছেন। বাবার কল দেখেই আহি পুষ্পের দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলল। এদিকে উজ্জ্বল আহির ভীত আঁখি জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছে। আহি কল রিসিভ করতেই রিজওয়ান কবির বাজখাঁই সুরে বললেন,
“তাজওয়ার তোমাকে কল দিচ্ছে তুমি ধরছো না কেন?”
আহি মলিন মুখে বললো,
“এই মাত্র ফোন হাতে নিয়েছি। ফোনটা ব্যাগে ছিল। বিয়ে বাড়ি বলে কথা।”
উজ্জ্বল আর রইস ভ্রূ কুঁচকে আহির দিকে তাকালো। আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। রিজওয়ান কবির বললেন,
“তাজওয়ার সিলেট পৌঁছে গেছে। তুমি ওকে এড্রেস দাও, তোমাকে নিতে যাবে।”
“এখন?”
“হ্যাঁ।”
“বাবা, আমি পুষ্পের সাথে ঘুরতে বের হয়েছি। বাসায় ফিরে দেই?”
“কার বাসায়?”
“আই মিন বাড়িতে। পুষ্পের বাড়িতে গিয়েই দেবো।”
“এখন অন্তত তাজওয়ারকে জানিয়ে দাও। ও অস্থির হয়ে যাচ্ছে।”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অস্থির হলে হোক!”
“কি?”
“আচ্ছা, আমি কল ব্যাক করছি ওকে।”
আহি বাবার কল কাটতেই পুষ্প জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলেছে আংকেল?”
আহি বিরক্তির সুরে বলল,
“তাজওয়ার আমাকে নিতে সিলেট চলে এসেছে।”
তখনই আবার আহির ফোনে কল এলো। আহি এবার কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে তাজওয়ার বলল,
“তোমার এই এ্যাটিটিউড তোমাকে নিয়েই ডুববে।”
আহি শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমি ফোনের কাছে ছিলাম না।”
তাজওয়ার আহির কন্ঠ শুনেই চুপ হয়ে গেলো। আহি কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে বলল, “মরে গেছো?”
তাজওয়ার হালকা হেসে বলল,
“কাইন্ড অব। তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শুনলে আমার হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়।”
“তাহলে তোমার ডাক্তার দেখানো উচিত।”
“তুমিই তো আমার ডাক্তার।”
“সো স্টুপিড।”
তাজওয়ার গম্ভীরমুখে বলল,
“আহি, বাইরে আছো মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ।”
“বাইরে আমার সাথে এমন ভাষায় কথা বলবে না। আই ডোন্ট লাইক ইট।”
আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“এন্ড আই ডোন্ট কেয়া’র।”
আহি কল কেটে দিয়েই ফোনটা বন্ধ করে দিলো। পুষ্প আহির হাত ধরে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। এখন এসব না ভেবে সময়টা উপভোগ কর।”
আহি নৌকার পাঠাতনের উপর উঠে বসলো। সরু খাল বেয়ে নৌকাটি জলাবনে ঢুকে পড়লো। বৃষ্টি পড়ায় পানির পরিমাণ বেড়ে গেছে। ভেজা গাছের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। হালকা সমীরণ বয়ে যাচ্ছে। সকালে বৃষ্টি পড়েছিল তাই স্যাঁতসেঁতে ভাবটা এখনো কাটেনি। উজ্জ্বল এবার আহির সামনে এসে বসলো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“জায়গাটা সুন্দর।”
উজ্জ্বল বলল,
“কিন্তু তোমার মুখভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বিরক্তিকর জায়গা দ্বিতীয়টা নেই।”
“আমার বন ভালো লাগে। আর এখানে তো বন আর জলের স্বাদ এক সাথেই পাওয়া যাচ্ছে।”
উজ্জ্বল মুচকি হাসলো। পুষ্প বলল,
“আহি একটা গান কর না। অনেক দিন তোর কন্ঠে গান শুনি না।”
উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “গানও পারো তাহলে?”
আহি বলল, “না। স্কুলে হালকা-পাতলা গেয়েছি।”
“হালকা-পাতলা গান গাওয়া যায় না-কি!”
পুষ্প শব্দ করে হাসলো আর বলল,
“আহি ভালোই গান করতো। চর্চায় থাকলে সংগীত শিল্পীদের হার মানতে হতো।”
এবার রইস বলল,
“তাহলে শুনিয়ে দাও, বনভূমির মাঝখানে জল। সেই জলে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। নৌকায় বসে আছে এক তরুণী। তার কন্ঠে মিষ্টি মধুর গান।”
উজ্জ্বল বলল, “আর তার হাত আঁকছে অজানা গল্প।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল তার ব্যাগ থেকে ছোট একটা ক্যানভাস আর কিছু রং ও তুলি বের করলো। পুষ্প মুখে হাত দিয়ে বলল,
“ভাইয়া তুই তো সে-ই কাজ করেছিস।”
আহি ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“আমি অনেকদিন ছবি আঁকি নি।”
উজ্জ্বল বলল,
“আজ আঁকবে। শিল্পীদের মন হালকা হয় ছবি এঁকে।”
উজ্জ্বলের জোরাজোরিতে আহি ক্যানভাসটি হাতে নিলো। গাছপালার শাখা-প্রশাখায় ঢেকে আছে শূন্য আকাশের অনেকাংশ। আহি সেই ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখার চেষ্টা করছে। রইস বলল,
“আহি পাশাপাশি গানও গেয়ো।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে এবার পাঠাতনের উল্টোদিকে ঘুরে পা দু’টি ঝুলিয়ে বসলো। সবাই আহির দিকে তাকিয়ে আছে। আহি চোখ বন্ধ করলো।
চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই এক্সিভিশনের দিন, যেদিন আফিফ তার ছবি এঁকেছিল।
আহি এবার কন্ঠে গান ধরলো।
“সবকিছু বদলে গেলো এক রাতের নিমিষে,
তুমি হারিয়ে যাবে বলেছিলে কবে?
আজ তোমায় হারিয়ে আমি একা এই রাতে,
ভাবনাতে তোমাকে খুজেছি কি তবে?
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোবনা, ফিরে আসো না,
আসো না, ফিরে আসো না।”
(***)
আফিফ ক্যাম্পাসের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। অনেক দিন আহি ক্লাসে আসে নি। মেয়েটা হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে, আফিফ বুঝতে পারছে না। বার-বার তার মনে একটা প্রশ্নই হানা দিচ্ছে,
“আহি কি ভালো আছে?”
আজ চট্টগ্রামের আকাশ মেঘলা। ভোর থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আফিফ সেই বৃষ্টির ধারার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে আহির সেই কান্না ভেজা চোখ দু’টি। মনে হচ্ছে আকাশটাই আহি, মেঘগুলো তার চোখ আর বৃষ্টির ধারা তার অশ্রুকণা।
এদিকে রাদ আজ ক্যাম্পাসে যায় নি। সেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখছে। আর তার কানে বাজছে সে একই গান।
“ফিরে এসেছি, ভালোবেসে,
তোমায় আমি প্রতিটিবার,
সব ব্যথা ভুলে, সব কষ্ট ফেলে,
এসেছি আজি আমি তোমার কাছে,
তবু তুমি নেই আজ আমার পাশে,
হারিয়ে গেছো তুমি বহুদুরে।
.
ভাবি তুমি আসবে ফিরে,
ধরবে হাতগুলো,
বলবে তুমি কেঁদো না,
ফিরে এসেছি এই দেখো।
আর বলবে কেঁদো না তুমি,
এবারই তো শেষ কান্না,
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোনা, ফিরে আসোনা,
আসোনা, ফিরে আসোনা।”
তিন জোড়া চোখ, বিষন্ন মন, এক আকাশের নীচে।
রাদ বৃষ্টি স্পর্শ করে বলল,
“আহি, তুই কি কখনো আমার হয়ে ফিরবি?”
এদিকে আহি রং মেখে তুলিটা রাঙিয়ে নিলো আর মনে মনে বলল,
“জানি, তুমি কখনোই ফিরে আসবে না।”
অন্যদিকে আফিফ কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে আনমনে বলল,
“তোমাকে নিয়ে ভাবার অধিকার নেই। তবুও ভাবছি। কারণ সেই দিনগুলোতে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।”
৪৪।
আহি হাত ধুয়ে ক্যানভাসটি নৌকায় রেখেই নেমে পড়লো। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“রেখে যাচ্ছো!”
আহি পেছন ফিরে ক্যানভাসটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই স্মৃতি ক্ষণিকের। আমি এটা এখানেই রেখে যেতে চাই।”
আহি কথাটি বলেই চলে গেলো। উজ্জ্বল আহির আঁকা ছবিটির দিকে তাকালো। খুব এলোমেলো একটা ছবি৷ হিজিবিজি রং মাখানো। উজ্জ্বলের কাছে কেন যেন মনে হলো এই ছবির কোনো বিশেষ অর্থ আছে। আরো গভীরভাবে ছবিটি দেখলে এর অর্থ বোঝা যাবে। উজ্জ্বল ক্যানভাসটি একটা পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো।
(***)
সন্ধ্যায় ব্যাগপত্র গুছিয়ে তৃষা আপুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নামলো আহি আর পুষ্প। আহির চোখেমুখে বিরক্তি রেখা ফুটে উঠেছে। উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পকে জিজ্ঞেস করলো,
“আহির কি হয়েছে?”
পুষ্প মুখ ছোট করে বলল,
“তাজওয়ার খান নিতে আসবে না-কি!”
“তোর সাথেই তো ফিরতে পারতো।”
“সেটাই তো ভাই। কেউ যদি আংকেলকে এই সহজ কথাটা বোঝাতে পারতো!”
আহি গাড়িতে বসেই চুপ করে রইলো। গন্তব্য রেল স্টেশন। নীরবতা বিরাজ করছে সবার মাঝে। উজ্জ্বল ড্রাইভারের পাশে বসে আছে। পুষ্প আর আহি পেছনে বসে আছে। আহি শক্ত করে পুষ্পের হাত ধরে রেখেছে। পুষ্প ঠিক বুঝতে পারছে, আহি তাজওয়ারের সাথে যেতে চায়ছে না।
হঠাৎ আহির ফোনটা বেজে উঠলো। আহি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো তাজওয়ারই কল দিয়েছে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাজওয়ার বলল,
“কোথায় তুমি?”
আহি ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “স্টেশনে যাচ্ছি।”
“আমিও এখানে আছি। টিকেট করে ফেলেছি।”
আহি ‘হুম’ বলেই কলটা কেটে দিয়ে পুষ্পের কোলে মাথা রাখলো। পুষ্প আহির চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আজ আবার আহির দম বন্ধ লাগছে। তার মনে হচ্ছে তাকে জেলখানায় আটকে রাখার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই কয়েকদিন তার ভালোই সময় কেটেছিল। কিন্তু ফিরে গিয়ে আবার সেই আবদ্ধ রুম, আফিফের স্মৃতি ঘেরা শহর, স্বয়ং আফিফই তার সামনে থাকবে। পাশাপাশি তার জীবনকে আরো বিভীষিকাময় করে তোলার জন্য তাজওয়ার খান আর লাবণি মেহেরার প্রভাবটাও ভুলে যাওয়া যায় না।
(***)
গাড়ি স্টেশনে এসে থামতেই আহি ধীর পায়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। ড্রাইভার ব্যাগপত্র নামিয়ে রাখতেই একটা আগন্তুক লোক তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আহি লোকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বললো, “আপনি কে?”
লোকটি বলল,
“স্যার আপনার ব্যাগ ট্রেনে উঠিয়ে দিতে বলেছেন!”
আহি তার ব্যাগটা শক্ত হাতে ধরে রাখলো আর বলল,
“আমার কাজ আমিই করতে পারবো।”
এরপর আহি উজ্জ্বলের সামনে এসে দাঁড়ালো আর মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ আমাদের সিলেট ঘুরে দেখিয়েছেন।”
উজ্জ্বলও মুচকি হাসি ফেরত দিলো। হঠাৎ একটা হাত আহির কাঁধ শক্ত করে স্পর্শ করতেই আহি পেছন ফিরে দেখলো তাজওয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তাজওয়ার উজ্জ্বল আর পুষ্পের সামনেই আহিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে হুট করে তার গালে অধর জোড়া ছুঁইয়ে দিলো।আহি চোখ বড় বড় করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার পুষ্পের দিকে তাকিয়ে বলল,
“হাই।”
পুষ্প হাঁ করে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে আছে। উজ্জ্বল পুষ্পের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। এবার তাজওয়ার আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আহি, তোমার ফ্রেন্ডের হয়তো আমাকে পছন্দ হয়েছে।”
আহি এবার ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প একবার না সূচক, আরেকবার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তাজওয়ার তা দেখে শব্দ করে হাসলো। এবার উজ্জ্বল বলল,
“পুষ্প ট্রেন ছেড়ে দেবে। উঠে যা।”
তাজওয়ার উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে বলল, “ইউ!”
“আমি পুষ্পের কাজিন।”
“তোমার বিয়ে ছিল?”
পুষ্প আর আহি চোখ বড় বড় করে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো এখানে কোনো একটা ঘাপলা আছে। সে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“না, আমার বিয়ে ছিল না। অন্য কাজিনের বিয়ে ছিল।”
আহি উজ্জ্বলের উত্তরে আরো অবাক হলো। সে কী সুন্দর করে গুছিয়ে মিথ্যেটা বললো? উজ্জ্বল তো জানেই না আহি এখানে পুষ্পের কাজিনের বিয়ে বলে ঘুরতে এসেছে। তারপরও উজ্জ্বলের উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করতে মন চায়ছে তার। কিন্তু তাজওয়ারের উপস্থিতিতে সেটাও করতে পারছে না।
(***)
তাজওয়ার আহিকে নিয়ে ট্রেনে উঠলো। আহি কেবিন দেখে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “আলাদা কেবিন?”
তাজওয়ার আহির কাছে এসে বলল,
“আমি তোমাকে আলাদা কেবিনে রাখবো? তুমি আর আমি একসাথেই থাকবো।”
আহি রাগী দৃষ্টিতে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে কেবিনে ঢুকে পড়লো। ঢুকেই দেখলো পাশাপাশি দু’টো বার্থ। আহি তার ব্যাগ উপরে উঠাতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার পেছনে এসে দাঁড়িয়ে তার ব্যাগটা উপরে তুলে দিলো। আহি সরে দাঁড়াতে যাবে তখনই তাজওয়ার তার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আহি তাজওয়ারকে সরানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু সে তো আহিকে ছাড়ছেই না। আহি জোরে জোরে তাজওয়ারকে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহির চোখেমুখে রাগ। চোখ দু’টিও ছলছল করছে। আহিকে এভাবে দেখে তাজওয়ারের মুখ রাগে লাল হয়ে গেলো। সে এবার কেবিনের দরজা লক করে আহিকে দরজায় ঠেকালো। আহি সরে যেতে নিবে তার আগেই তাজওয়ার তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ালো। আহি এবার দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুমি যদি আমার কাছে আসার চেষ্টা করো, তাহলে অনেক খারাপ হবে।”
তাজওয়ার আহির কথার তোয়াক্কা করলো না। সে আহির অধর ছুঁইছুঁই দূরত্বে এসে থামলো। আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আর তাজওয়ার সেই অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে নেশা জড়ানো কন্ঠে বলল,
“আই লাভ ইউ, আহি।”
তাজওয়ার হুট করেই আহির ঘাড়ে তার অধর ছুঁয়ে দিলো। আহি সাথে সাথেই তাজওয়ারের চুলগুলো খুব জোরে টেনে ধরতেই তাজওয়ার বিরক্ত মুখে বলল,
“আমার চুল ধরার সাহস করবে না, আহি।”
“তুমিও আমাকে স্পর্শ করার সাহস দেখাবে না।”
তাজওয়ার আহির কোমড় জড়িয়ে ধরে বলল,
“দেখাবো সাহস। কি করবে তুমি?”
আহির উত্তরের অপেক্ষা না করে তাজওয়ার আহির হাত ধরে তাকে বার্থে বসিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। আহি এবার রাগী স্বরে বলল,
“দেখো, আমাদের এখনো বিয়ে হয় নি।”
তাজওয়ার আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে চলো, এখনই বিয়ে করে ফেলি।”
“আমি তোমাকে কখনোই বিয়ে করবো না।”
“আমার মধ্যে তো কোনো সমস্যা নেই। আমি যথেষ্ট কুল এন্ড হ্যান্ডসাম।”
আহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“তুমি একটা অসভ্য লোক। মেয়েদের সাথে নষ্টামি করা বেড়াও। কোন মেয়ে অন্তত তোমার মতো ক্যারেক্টারলেস ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসেবে চাইবে না।”
তাজওয়ারের এবার রাগ উঠে গেলো। সে আহির কোল থেকে মাথা তুলে আহির চুল টেনে ধরলো। আহি তাজওয়ারের হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে বলল,
“তাজওয়ার, চুল ছাড়ো আমার।”
“কেন, বেশি ব্যথা লাগছে?”
আহির চোখ ছলছল করে উঠলো। তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“আমারও লেগেছিল। কিন্তু আমি সহ্য করেছি। কারণ প্রেমিকার দেওয়া আঘাতও মিষ্টি হয়। আমারটা কি মিষ্টি লাগছে না?”
আহি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “বিষধর লাগছে।”
তাজওয়ার আহির চুল ছেড়ে দিয়ে বলল,
“ভালোবাসতে পারো নি তাই। কিন্তু তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই আমার। আমিই তোমাকে ভালোবাসবো। আমার ভালোবাসায় সব ব্যালেন্স হয়ে যাবে।”
আহি চেঁচিয়ে বলল,
“আমারও তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। তোমার মতো অসভ্য লোকের ভালোবাসা চাই না আমি। ছাড়ো আমাকে। তুমি একটা রেপিস্ট।”
তাজওয়ার আহিকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর শান্ত ভঙ্গিতে নিজের বার্থে এসে বসলো। আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তাজওয়ার শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি তো জানোই আহি, রাজার অনেক রানী থাকে। আবার অনেক দাসীও থাকে। আর রানীদের এতে কোনো আপত্তিও থাকে না। কিন্তু তোমার আপত্তির শেষ নেই। জেলাস না-কি তুমি?”
আহি অবাক হয়ে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার আবার বলল,
“আর রাজার যতো রানীই থাকুক, রাজা কিন্তু এক রানীতেই আসক্ত। যেমন সম্রাট আকবর শুধু তার যোধা বেগমকেই ভালোবেসেছিল।”
আহি শীতল কণ্ঠে বলল,
“কীসের সাথে কীসের তুলনা করছো? তারা অন্তত নারীদের সম্মান করতো। যারা দাসী ছিল, তারা স্বেচ্ছায় দাসী হয়েছিলো। আর তুমি হিংস্র পশু, যে বিনা অনুমতিতেই মেয়েদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক করো।”
তাজওয়ার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“চাইলে এখনই আমি তোমার এই অহংকর গুঁড়িয়ে দিতে পারি। এই চলন্ত ট্রেন থেকে তোমার লাফিয়ে পড়ারও সুযোগ নেই। আর আমার শক্তির সাথে তোমার এই কোমলপ্রাণ শরীর জিতবেও না। কিন্তু আমি ধৈর্য ধরছি। তোমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করার জন্য আমার একটা গভীর সম্পর্ক দরকার, যেখানে কোনো চেঁচামেচি, জোরাজোরি থাকবে না। তুমি স্বেচ্ছায় আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে। আমি সেই সম্পর্কের অপেক্ষায় আছি, আহি। তবুও তুমি আমার উপর দোষ দিয়ে যাচ্ছো।”
তাজওয়ার এবার শান্ত ভঙ্গিতে বসে বলল,
“আমি রেপিস্ট নই। যা করেছে আমার বন্ধুরা করেছে। আমি কাউকে জোর করি নি। যারা আমার জীবন এসেছিল, দাসীর মতো স্বেচ্ছায় এসেছিল। কিন্তু তুমি তো আমার রানী। আমার প্রিয় রানী।”
আহি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আহির গা ছাড়া হাবভাব তাজওয়ারের পছন্দ হলো না। সে হুট করে রেগে গেলো। আহির কাছে এসে তার দুই বাহু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“চাইলে আমি এখনি তোমাকে বিবস্ত্র করে এই ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে পারি, আমার কিচ্ছু হবে না। কিন্তু তুমি পুরো সমাজের চোখে কলংকিত হয়ে যাবে। তোমার এই সভ্য সমাজের মানুষগুলো যতোই বলুক, আমি, তাজওয়ার খান, অসভ্য লোক। তাদের বিন্দুমাত্র সাহস নেই আমার চরিত্রে আঙ্গুল তোলার। কিন্তু তারাই তোমাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। সভ্য লোকেদের কটাক্ষ শুনতে শুনতে তুমি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু তোমার সামনে থাকা এই অসভ্য লোকটা এমন করবে না। আহি, আমি অন্য কারো সাথে যেমনই করি, তোমার সাথে কিছুই করবো না। কারণ আমি তোমাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি করতে পারবো না এমন কিছুই নেই। যেই আমাদের মাঝখানে আসবে, আমি তার জীবনটাই ধ্বংস করে দেবো। আমি এমন করতে পারি, আহি।”
তাজওয়ার আহির দুই বাহু খুব শক্ত করেই ধরে রেখেছিল। যার দরুন ব্যথায় আহি চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। তাজওয়ার বুঝতে পেরে আহিকে ছেড়ে দিয়ে আহির কোলে মাথা রেখে বলল,
“সরি, আহি। এন্ড আই লাভ ইউ সো মাচ।”
আহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“এন্ড আই হেইট ইউ সো মাচ। তুমি নিজেকে যতোই রাজা দাবী করো, আমার রাজ্যে তুমি ভিখেরী মাত্র। আর যদি আমি রানী হয়েই থাকি, তাহলে এই রানী তোমাকে চ্যালেঞ্জ করছে, সে তার সম্মান, তার অভিমান কারো সামনে নত হতে দেবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা, মিস্টার তাজওয়ার খান। আমি তোমাকে হারিয়ে তোমার উপর জয় লাভ করবো।”
তাজওয়ার আহির কথা শুনে হাসলো। বিদঘুটে সেই হাসি। আহি শক্ত হয়ে বসে আছে। তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তাজওয়ার তা দেখে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। এরপর আহির কোলে মাথা রেখেই তার ফোন বের করে একটা মেয়েকে কল করলো। ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই তাজওয়ার বলল,
“কাল রাতে তোমার ফ্ল্যাটে আসবো আমি। ভীষণ রাগ উঠেছে আমার। কাল সারারাত রাগ ঝাড়বো তোমার উপর।”
কল কেটে আহির মুখের উপর ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,
“চাইলেই তো আর ফুল স্পর্শ করা যায় না। একদিন ঠিকই ভ্রমর হয়ে ফুল ছুঁয়ে দেবো।”
আহি মুখ চেপে রেখেছে। তাজওয়ার আহির হাত সরিয়ে দিয়ে বলল,
“এই ধোঁয়া সহ্য করতে না পারলে তাজওয়ার খানকে চ্যালেঞ্জ করো না। বাই দা ওয়ে, আই লাইক ইট। ভেরি ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জ। আর একটা কথা মনে রেখো, বাঘ শিকার শেষে বাঘিনীর কাছেই ফিরে আসে। আর বাঘিনীদের শুধু বাঘের সাথেই মানায়। তোমার এই স্টেটমেন্ট শুনে মনে হচ্ছে আমরাই পারফেক্ট ম্যাচ।”
চলবে-