গোলকধাঁধা ৩.

0
167

গোলকধাঁধা

৩.

পাঁচ বছর পরে…

” জ্বি, স্যার বলুন। ”
” ইমতিয়াজ, তোমার কালকের ছুটি ক্যান্সেল করা হয়েছে। ”
” স্যার, কালকে আমার নতুন বাসায় উঠতে হবে৷ মালামালও চলে এসেছে। আমার এখানে চেনাজানা কেউ নেই যে তাকে দায়িত্ব দিয়ে আসবো। ”
” পরশুদিন ছুটি নিও। আমি বাধ্য হয়েই তোমাকে আসতে বলছি। কোনোভাবে ম্যানেজ করে আসো। ”
” স্যার, তাহলে দশটার পরে আসি? মালামাল অন্ততপক্ষে কুরিয়ার থেকে এনে রেখেই চলে আসবো। ”
” তোমাকে কিন্তু আমি বাসা খুঁজে দিয়েছি বেশ ঝোলাঝুলি করে। উনি বাসা ভাড়া দিবেনই না।আমি নিজের জন্যও এতো রিকুয়েস্ট কাউকে করিনি, ইমতিয়াজ। উনার পায়ে ধরা বাদ ছিল শুধু৷ তাই তুমি আমার কথা রাখতে বাধ্য এখন৷ যদি কাল না আসো তাহলে আমি তোমার বাড়িওয়ালাকে নিষেধ করে দিব। ”

এই এক যন্ত্রণা চাকরি করার।স্যার আমাকে এখন রীতিমতো থ্রেট দিচ্ছেন৷ এতদূর জার্নি করে এসে একটু রেস্ট নেয়ার সময় পেলাম। আজকেও অফিসে যেতে হয়েছে।
” স্যার, এভাবে একজন মুসাফিরকে আপনি থ্রেট দিচ্ছেন? আমি নিতান্তই বিপদে পড়েছি৷ আপনিও সেই বিপদের ফায়দা নিচ্ছেন?”
” আগামীকাল এমডি আসবেন আমাদের হাল দেখতে। এটা টপ সিক্রেট ইনফরমেশন। এখন তোমার ইচ্ছা। ”
” ঠিকাছে স্যার। আমি আসবো। এমডি আসবেন কখন? ”
” দশটার পরেই আসবেন৷ তুমি যে সুন্দর করে কথা বলতে জানো! তাতে এমডি পটে ক্ষীর হয়ে যাবেন৷ ”
এই হলো মূল ঘটনা! এমডিকে অবশ্য খুশি করে আমাদেরই লাভ। বেতন বা বোনাসের অংকটা বাড়বে৷

মেস ঠিক করেছিলাম এখানে আসার এক মাস আগে হালিমের মারফত। গতকাল মেসে গিয়ে শুনি, অন্য একজন নিয়ে নিয়েছে। তাহলে আমার অগ্রিম টাকাটা ফেরত দিয়ে দিক। কিন্তু ম্যানেজার সেটাও ফেরত দিলেন না। সরাসরি বললেন, টাকা নাকি তিনি পাননি। অফিসের পিয়ন হালিমকে এই বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাতে বত্রিশটা দাঁত বের করে বললেন, ” ওই ম্যানেজার ব্যাটার জাতই খারাপ। কালকেই আমি যাইয়া ওরে টাইট দিয়া আসুম। আপনি ওইখানেই থাকতে পারবেন৷ ”
পরে অবশ্য আমি না করেছি। যে ব্যক্তি আমি আসার আগেই টাকা মেরে দিয়েছেন। সেই ব্যক্তি আমি থাকা অবস্থায় আমার টাকাপয়সা, জিনিসপত্র যে মেরে দিবে না। এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমার বসই শেষ ভরসা। সম্পর্কে উনি আমার ইউনিভার্সিটির সিনিয়র ছিলেন। এই সম্পর্কের জোরেই দুটো কাজ হলো৷ এক. একটা ভালো চাকরি। দুই. থাকার নিরাপদ স্থান। তবে সমস্যা হলো নিজের হাতে রান্না করে খেতে হবে। যা অতি উৎকৃষ্ট মানের অখাদ্য ছাড়া কিছু না।

*****

মালামাল যখন রেখে এলাম তখন বাড়ির মূল ভবন দেখে অনেকটা ভয় পেলাম। আরো বেশি ভয় পেলাম পুরো বাড়ির এরিয়া দেখে। ঝকঝকে রৌদজ্জ্বল একটা দিন কিন্তু বাড়ির প্রাঙ্গণ আধোঘুমে ব্যস্ত৷ অতিরিক্ত গাছপালা থাকার কারণেই বাড়ির প্রাঙ্গণে এমনকি বাড়ির ছাদেও তেমন রোদ আসে না। আমার ঘরটা ছাদেরই একপাশে। একটা বড় ঘর, সাথে বাথরুম আর রান্নাঘর। পরিষ্কার করা হয়েছে গতকাল বা ভোরে। কারণ এখনো মেঝে ভেজা। তবে এই ঘরে যে বহুদিন কোনো ভাড়াটিয়া আসেনি, সেটা স্পষ্ট। এই বাড়িতে কীভাবে থাকবো এটা ভাবতে ভাবতেই অফিসের কাজ করলাম। এমডি সাহেবের ছায়াও আসলো না। শুধু শুধু আমার ছুটিটা গেল। সাইফুল ভাই ওরফে আমার বস আমাকে কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। তারমধ্যে প্রথমটা ছিল, ” ভুলেও ওই বাড়ির নিচতলায় উঁকি ঝুকি করতে যাবা না। ” আমি কি বাচ্চা নাকি টিনএইজ? যে বাড়িওয়ালার বাসায় উঁকি ঝুকি করতে যাবো?
দ্বিতীয়টা, ” বাড়ির কোনো গাছের ফল ছিঁড়তে যাবা না। ”
তৃতীয়টা, ” লম্ফঝম্প কম কম করবা আর গার্লফ্রেন্ডকে আনা যাবে না। বিয়ে করে বউ আনতে পারো বাট অন্য কোনো মেয়েছেলে না। ”
” স্যার, আপনি কি পাগল? আমার প্রেমিকা এখানে আসবে কোথা থেকে? ও ঢাকায় পড়াশোনা করে। ” স্যার আমার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, ” তোমার গার্লফ্রেন্ড তো আর ইউরোপ থাকে না। থাকে ঢাকায়। ব্যাপারটা বুঝে নাও। আর আমি তো সিঙ্গেল মানুষ না যে বুঝবো না। আমার জনও কয়েক সপ্তাহ পর এসে ঘুরেফিরে যায়। ওই বাড়ির মালিক কিন্তু হাইস্কুলের হেডমাস্টারদের মতো। ডিসিপ্লিন তাদের প্রথম ও শেষ কথা! ” মনে হচ্ছে এখানে চাকরির সময়টা মরুভূমিতেই কাটবে।

সে যাইহোক। তখন মনে পড়লো আমি সারাদিন আমার রমনীকে কল বা ম্যাসেজ দেয়া হয়নি। আজকের মতো হোটেল থেকে খাবার কিনে বাসায় ফেরার পথে রমনীকে কল দিলাম। কয়েক বার রিং বাজার পরে তিনি ম্যাসেজ করে জানালেন, ” তুমি থাকো তোমার চাকরি নিয়ে। আমাকে ফোন দিবা না। ”
এই নারীকে আমি কীভাবে বুঝাই। আমি কোথায় এসে পড়েছি। মফস্বল হলেও এখানে ভাড়াবাড়ি আর মেস বাড়ি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অচেনা একটা জায়গায় আসার পরে যে হাজারটা কাজ থাকে, এই রমনী কি সেটা বুঝবে না?
আমি তাকে জীবনানন্দের একটা কবিতা রেকর্ড করে পাঠালাম। আমি দুইশো পার্সেন্ট শিওর যে, এই রেকর্ড শোনার পরে আমার রমনী বাধ্য হবে আমাকে কল ব্যাক করতে। জীবনানন্দের বিখ্যাত সেই বনলতা সেন কবিতা কোন প্রেমিকা উপেক্ষা করতে পারে?
দশ বারো মিনিট পরে তিষার নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি কিছু না বলে ফোন কানে ধরে রাখলাম। তিষা বলল, ” তুহিন, তুমি এমন কেন?”
” তিষা, তুমি এতো দূরে কেন বলো তো? ”
” কাছে হলে কী করতে?”
” তোমার বুকে মাথা রেখে ক্লান্তি দূর করতাম। ”
তিষা মনে হলো লজ্জা পেয়েছে৷ মেয়েটা অসম্ভব রকমের সুন্দর। যখন লজ্জা পায় তখন ফরশা গাল লাল হয়ে যায়। রোকাইয়ার অবশ্য এমন হতো না। তামাটে বর্ণের হওয়ায় তার লজ্জা পাওয়ার ব্যাপারটা গালে প্রকাশ পেত না।
কথা বলতে বলতে ছাদে কোন সময় এলাম বুঝতেও পারিনি। ছাদে সোডিয়াম লাইট জ্বালানো। পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এই বাড়ির প্রধান বৈশিষ্ট্য। ঝিঝি পোকার ডাক ছাড়া কোনো শব্দ কানে আসছে না। হঠাৎ হঠাৎ একদল কুকুর চেচামেচি শুরু করে। আবার থেমে যায়। এই বাড়িতে মাত্র দুজন বাস করে। বৃদ্ধ দম্পতি, ছেলেমেয়ে সবাই কাজের জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ এই বাসায় ভাড়া না দেয়ার মূল কারণ হচ্ছে, একবার এক ভাড়াটে নাকি মদ খেয়ে বিশাল ঝামেলা করেছিল। পরে বাড়িতে পুলিশও এসেছিল। আমি যখন বাড়ির ছাদ আর ঘরের চাবি নেয়ার জন্য তাদের দারস্থ হলাম। তখন বৃদ্ধা দরজা খুলেছিলেন তাও পুরোপুরি না। যতটুকু খুললে একজন মানুষকে হাত বাড়িয়ে দুটো চাবি দেয়া যায় ঠিক ততটুকু। একবারও ভেতরে আসতে বললেন না। আমার আম্মা তো ভাড়াটিয়াদের ঘরে বসিয়ে নাস্তাপানিও দেন। যাইহোক বিপদের সময় ঠাই পেয়েছি তাই কম কোথায়। তিষার সাথে কথা বলা শেষ করে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটের ধোয়ায় পুরনো অতীত কাটানোর চেষ্টা আরকি।
একটা ঘটনা, ছোট্ট নাকি বিশাল আমার মস্তিষ্ক সেটা ধরতে পারে না। রোকাইয়া পাগলের মতো দৌড়ে ক্যাম্পাসের দিকে আসছে। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে আর দৌড়াচ্ছে। তার হাত পা কেটে রক্তাক্ত অবস্থা। আমি তাকে এভাবে আসতে দেখে ভড়কে গেলাম। তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। সে শান্তও হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে কী যেন হয়ে গেল তার। আমাকে হাবিজাবি এক নাগাড়ে বলতে শুরু করলো। যার কোনো কূল বা কিনারা ছিল না৷ প্রচণ্ড চুপচাপ স্বভাবের মেয়ের মধ্যে ঝড় বসে ছিল, কে জানত!
আমার কিছু প্রশ্ন রয়ে গেছে। উত্তরের জন্য তাকে অনেক খুঁজেছি কিন্তু পাইনি। জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ কীভাবে যেন উধাও হয়ে গেল। তার পরিবারের নাগাল তো পেলামই না। ওর তেমন ক্লোজ ফ্রেন্ডও ছিল না। তার সাথে আমার শেষ দেখা ছিল, সেই ঘটনার দিন। সে আমার দিকে ঘৃণার চোখে তাকিয়ে ছিল। আমি কী এমন করেছিলাম যে তার চোখে আমার জন্য ঘৃণা জন্মেছিল? একটা মানুষ কোনো কিছু না বলে এভাবে চলে যেতে পারে না।
নিকোটিনের ধোয়ার মতো সেও বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে। যেন, এই মানুষটা কোনোদিন ছিলোও না। তার ছবি গুলো এখনো ফোনের টপ সিক্রেট জায়গায় পড়ে আছে। কিন্তু সে নেই! তিষার নাম্বার থেকে ফোন আসলো। আমি রিসিভ করে বললাম, ” তোমাকে খুব মিস করছি। ”
মনে হলো মিথ্যা বললাম নিজের সাথেই। আমি মিস করছি কিন্তু তিষাকে না। অন্য কাউকে। এমন কাউকে যার চোখে আমার জন্য ঘৃণা ছাড়া কিছু নেই। মাঝেমাঝে স্বপ্নে দেখি, সে দূরে সাদাকালো ঘাসের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে যাওয়ার আগেই সে হাওয়া হয়ে যায়। আমি তাকে স্বপ্নেও ছুঁয়ে দেখতে পারিনা। যেমনটা বাস্তবে পারিনি।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here