#মেঘের_শহর
#পর্ব_১৩
Saji Afroz
.
ছাদে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাইয়ারা।
এখন তার দিনগুলো কাটে অন্যরকম। আগে ছাদে আসতো অন্তরা আহম্মেদের আচার চুরি করতে। আর এখন আসে মেঘের খোঁজে।
সকাল থেকে বেশ কয়েকবার ছাদে এসেছে সে৷ উঠোনে বা ছাদে কোথাও মেঘ কে দেখা যাচ্ছে না৷ তাকে দেখতে না পেয়ে সাইয়ারার মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে। ইচ্ছে করছে তার বাসায় গিয়ে দেখে আসতে। কিন্তু অন্তরা আহম্মেদ তাকে এখন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। তাই যখন তখন ও বাড়ি যাওয়া মোটেও ঠিক হবে না। তার মনে কি চলছে জানতে দেওয়া যাবে না কাউকে।
এসব ভেবে আকাশের দিকে নজর পড়লো তার। এখন আকাশ টা মনে হচ্ছে হলুদ! আকাশের রঙ বুঝি বারবার বদলায়। কখনো সাদা, কখনো নীল, কখনো বা লাল। মাঝে মাঝে যখন সাদা কালো মেঘগুলো সারা আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকে আর সোনালি সূর্যের আভা সহস্ৰ মেঘের গায়ে এসে পড়ে তখন মনে হয় আকাশের রঙ কেবল একটি নয়, অনেক!
.
.
.
জিকো ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মোখলেস। কালো সালোয়ার কামিজ টায় ভালো মানিয়েছে তাকে। যদিও চুলগুলো এলোমেলো তবে এমনি থাকলে যেন ভালো লাগবে তাকে!
মোখলেস হালকা কেশে তাকে বলল, আপনি তৈরী হয়ে নিন। আমি বাইরে আছি।
.
জিকো হুম বলতেই মোখলেস বেরুলো রুম ছেড়ে। বুকের উপরের ওড়না টা বিছানার উপরে রেখে হাতে চিরুনি নিলো জিকো। এক রাতে কোমর সমান লম্বা চুল গজালো কিভাবে তার জানা নেই। অবশ্য এক রাতে শুধু চুলই লম্বা হয়েছে এমন নয়! সবই তো বদলে গেছে।
বিরক্তি ভরা মুখটা নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো জিকো। ভালোভাবে চুলটাও আঁচড়াতে সে পারেনা। অথচ রাস্তাঘাটে মেয়েদের দেখে কত রকমের স্টাইল করে তারা চুল বাঁধে। তাদের মতো বাঁধতে জানলে নিশ্চয় তাকেও দেখতে আরো ভালো লাগতো!
কিছুক্ষণ ভেবে মোবাইল টা হাতে নিয়ে ইউটিউবে চুল কিভাবে বাঁধে সার্চ দিলো সে। এত এত ভিডিও দেখে তার মাথা ঘুরে উঠল। মোখলেস তার জন্য অপেক্ষা করছে। অন্য সময় নাহয় এসব দেখা যাবে ভেবে কোনোরকমে চুল বেঁধে নিলো সে। বিছানার উপর থেকে ওড়নাটা নিয়ে শরীরে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল।
মোখলেস ও জিকো কিছুদূর পথ নীরবে হেঁটে এল পাশাপাশি। আরো কিছু পথ পেরিয়ে এসে মোখলেস বলল-
আমার সাথে রিকশায় চড়তে সমস্যা নেই তো? না মানে এর আগে আপনাকে আমার বাসায় সিএনজি তে চড়ে নিয়েছিলাম। আজ ইচ্ছে করছে রিকশায় চড়তে।
.
মোখেলেসের কথা শুনে জিকো আপনমনে বলল-
ওরে মোখলাইস্সা! তোর সাথে রিকশায় আমি হাজার বার চড়েছি। এক বিছানায় ঘুমিয়েছি। এসব জানলে তুই না আবার টমেটো গাছের সাথে ঝুলে ফাঁসি খেতে চাস!
-সমস্যা হবে আপনার?
.
মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে জিকো বলল-
নাহ।
.
একটায় রিকশায় চড়ে বসলো ওরা। রিকশাতে একসাথে বসার ইচ্ছেটা মোখলেসের থাকলেও এখন তার কেমন যেন লাগছে। পছন্দের মানুষটির সাথে পাশাপাশি রিকশায় বসার অনুভূতি টায় যেন অন্যরকম। তাছাড়া
কোনো মেয়ের সঙ্গে রিক্সায় চড়ার তার অভিজ্ঞতা এই প্ৰথম। মোখলেসের মনে হচ্ছে এই রিকশাটি অন্যান্য রিকশার গুলোর তুলনায় ছোট। তাই তাদের ঘেষাঘেষি করে বসতে হয়েছে। এখন বড্ড অস্বস্তি বােধ করছে সে। কপালে জমেছে মৃদু ঘাম। নিশ্চয় মেয়েটিরও এমন লাগছে? এটা ভেবে মোখলেস
ওর কাছ থেকে সরে বসার চেষ্টা করছে। তা দেখে মুখ টিপে হাসছে জিকো। মোখলেস সহজসরল, ভদ্র তার জানা ছিল। কিন্তু এতটাও জানা ছিল না।
জিকো বুঝতে পেরেছে, সে এখন লজ্জা পাচ্ছে! যেখানে মেয়ে হয়ে তার লজ্জা পাওয়ার কথা। অবশ্য শরীর বদলালেও মন তো বদলায়নি জিকোর। তাই অন্যান্য মেয়েদের মতো তার লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ নেই।
জিকো বলল-
আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন?
.
মোখলেস অপ্ৰস্তুত গলায় বলল-
না তো।
.
লজ্জা কাটিয়ে জিকোর সাথে সহজ হবার চেষ্টা করলো মোখলেস। জিকো আবারো কথা তুললো-
আমরা যাচ্ছি কোথায়?
-একটু পরেই জানবেন।
.
বড় রাস্তা পেরিয়ে রিক্সাটা গলির মধ্যে ঢুকতেই মোখলেস বলল-
আমি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি?
-তুই করেই বল।
.
কথাটি বলে জিভে কামড় বসালো জিকো। এই কি বলে ফেললো সে! ভুলবশত তুই বলে ফেলল তো!
.
মোখলেস একটু অবাক হয়ে বলল-
মানে?
-না মানে আপনি চাইলে তুই করেও বলতে পারেন। আপনার বন্ধুরই বোন আমি। সমস্যা নেই।
-তা ঠিক। কিন্তু বন্ধুর বোন হলেই যে তুই বলতে হবে কথা নেই। বন্ধুর বোন তো আর আমার বোন হবে না।
.
জিকো বুঝতে পারলো সে এমন কেনো বলেছে। তার এখন একটা কথাই বলতে ইচ্ছে করছে। যেটা বাড়িওয়ালার ছলনা বুয়া কথায় কথায় বলতে থাকে। তা হলো-
আহা মরণ!
.
.
.
বাসায় এসে দরজা টা বন্ধ করে বিছানার উপরে ধপাস বসে পড়লো হুরায়রা। বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে আবারো উঠে দাঁড়ালো সে। মেঘের চোখ কে ফাঁকি দিয়ে বাসায় আসতে তার খুব বেশি কষ্ট না হলেও বিষয় টা ভালো লাগছে না। মনেহচ্ছে মেঘ তার পিছু নিয়ে বাসাটা চিনে নিলেই ভালো হত।
মাঝেমাঝে দরজা খুলেই না হয় দেখা পেত মেঘের!
এসব ভেবে টেবিলের কাছে এসে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো সে। ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল-
বদলে যাচ্ছি আমি।
.
.
.
রিকশা থেকে নামলো জিকো ও মোখলেস। একটা তিন তলা বাড়ির দিকে দেখিয়ে দিয়ে মোখলেস বলল-
চলো ভেতরে।
.
এই বাড়িটি জিকোর অচেনা নয়। এর আগেও মোখলেসের সাথে সে এখানে এসেছিল। এটি একটি অনাথ আশ্রম। মোখলেসের চাচার স্বপ্ন ছিল এসব অসহায় শিশুদের পাশে থাকা। তার উদ্যোগেই এই আশ্রমটি তৈরী করা হয়। মোখলেসের চাচাতো ভাইরা এর দেখাশোনা করলেও মাঝেমধ্যে সে এসে এখানে সময় কাটায়। ভালোই লাগে তার বাচ্চা গুলোর সাথে সময় কাটাতে।
মোখলেসের সাথে ভেতরে এল জিকো। একটা রুমে জিকো কে নিয়ে ভেতরে এল সে। সাথে সাথে কিছু ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো মোখলেস কে। মোখলেস তাদের আদর করে জিকো কে দেখিয়ে বলল-
এটা তোমাদের আপু হয়। ওর নাম জেসিকা।
.
কথাটি বলতেই বাচ্চাগুলো ঝাপিয়ে পড়লো জিকোর উপরে। তাদের সরিয়ে মোখলেস বলল-
যাও এখন খেলা করো। আমি আবার পরে আসছি।
.
রুমটি থেকে বেরিয়ে এসে হাঁটতে থাকলো মোখলেস৷ তার পাশে হাঁটছে জিকো। মোখলেস বলল-
এটা অনাথ আশ্রম।
-জানি আমি।
-কিভাবে? না মানে তোমার তো জানার কথা নয়।
-বাড়ির সামনেই তো কত বড় করে লেখা আছে।
-ও হ্যাঁ! এবার বলো এখানে কেনো এনেছি তোমাকে?
-কেনো?
-তোমার একটা কাজের প্রয়োজন ছিল। এখানেও একজন নতুন ম্যাডামের প্রয়োজন বাচ্চাগুলোকে পড়ানোর জন্য। ভাবলাম তোমাকে দায়িত্ব দিই। বেতন নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। ভালোই পাবে।
.
বাচ্চাকাচ্চার চেঁচামেচি জিকোর একেবারেই পছন্দ নয়। কিন্তু এখন এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
নিরূপায় হয়ে জিকো বলল-
খুব ভালো! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব ওদের মন দিয়ে পড়াতে।
.
.
.
চুলোয় তরকারি বসিয়েছেন অন্তরা আহম্মেদ। তরকারি গরম করছেন তিনি। মিন্নী ও মেঘ বাসায় এসেছে বেশকিছুক্ষণ হয়েছে। গোসল সেরে নামাজ পড়তে পড়তে খানিকটা দেরী হয়ে গেল তার টেবিলে খাবার সাজাতে।
তরকারী গরম করে চটজলদি টেবিল সাজিয়ে ছেলে মেয়ের সাথে বসলেন অন্তরা আহম্মেদ।
মেঘের প্লেটে ভাত, তরকারি দিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিলেন। নিজেদের প্লেটে নিয়ে খেতে শুরু করলেন অন্তরা আহম্মেদ ও মিন্নী। কিন্ত মেঘ চুপচাপ বসে কিছু একটা ভাবছে। একটুও মুখে খাবার তুলেনি সে। বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে তাকে। অন্তরা আহম্মেদ তার নাম ধরে ডাকলে মেঘ বলল-
হুম মা বলো?
-খাচ্ছিস না কেনো? কি এত ভাবছিস?
.
সেই কথার উত্তর না দিয়ে খেতে শুরু করলো মেঘ।
কিন্তু ভাবনায় এখনো বিভোর সে। তখন হুট করে হুরায়রা যে কোথায় চলে গেল! সে কি দেখে ফেলেছিল মেঘ কে?
হতেও পারে। কিন্তু মেঘও হাল ছাড়ার পাত্র নয়। সে ঠিকই বের করে ছাড়বে হুরায়রার বাসার ঠিকানা। তার বাসায় কে কে আছে জানা প্রয়োজন তার।
.
.
.
সকাল সকাল দরজায় নক পড়ার শব্দে ঘুম ভেংগে যায় হুরায়রার। কাল রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভেবেছিল, আজ ক্লাসে না যাওয়া অবধি ঘুমোবে সে। কারণ কাল রাতে পড়তে পড়তে অনেক রাত হয়ে যায়। তাই এখন শোয়া থেকে উঠতে ইচ্ছে না করলেও উঠতে হলো তাকে।
দরজা খুলতেই দেখতে পায় খাকি পোশাক পরিহিত পরিচিত সেই ডাকপিয়ন কে। ডাকপিয়নটি তার ঝুলি থেকে একটা চিঠির খাম বের করে হুরায়রার দিকে এগিয়ে দিয়ে তার খবরাখবর জানতে চাইলো। হুরায়রা মৃদু হেসে জবাব দিলো। কিছুক্ষণ তার সাথে কথা বলার পর বিছানায় এসে বসলো হুরায়রা।
“বিষণ্ণ শহর” থেকে চিঠি এসেছে। চিঠিটা পাঠিয়েছে পুনম। বছর খানেক আগে এই মেয়েটি “আনন্দ নগর” এ বেড়াতে এসেছিল। তখনি তার হুরায়রার সাথে পরিচয় হয়। বেশ মিশুক মেয়ে পুনম। খুব কম সময়েই তাদের মাঝে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। নিজের শহরে ফেরার আগে পুনম বলেছিল-
মাঝে মাঝেই তোমার নামে চিঠি আসবে বিষণ্ণ শহর থেকে। তোমায় কখনো ভুলব না হুরায়রা।
.
আসলেই সে ভুলেনি তার কথা। ভুলেনি হুরায়রা কে। হুটহাট চিঠি পাঠায়। হুরায়রারও ভালো লাগে তার চিঠি পেতে।
চিঠি খুলে পড়তে শুরু করলো সে-
কেমন আছ হুরায়রা? তুমি তো সবসময় ভালো থাকো, এটা আমার অজানা নয়। তবুও প্রতিবার জিজ্ঞাসা করে বসি।
পড়াশোনার কি অবস্থা? সারাক্ষণ লেখাপড়ায় এতটায় ডুবে থাকো যে নিজ থেকে একটা বার চিঠি পাঠাতে পারো না৷ আমি পাঠালেই তুমি পাঠাও। মানলাম বলেছিলাম আমি পাঠাব। কিন্তু কখনো তো তুমি পাঠিয়ে আমায় চমকে দিতে পারো!
অবশ্য অন্যভাবেও চমকাতে পারো আমাকে। একদিন হুট করে আমার শহরে এসে। কি? আসবে তো? আচ্ছা থাক বলো না সেটা। বললে তো আর চমকাবো না!
.
পুনমের চিঠি পড়তে পড়তে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো হুরায়রার। পুরো চিঠিটা শেষ করে সেও কাগজ, কলম নিয়ে বসলো।
লিখতে থাকলো-
শুনেছি তোমার শহর বিষণ্ণতায় ভরপুর। আনন্দ নগরের আনন্দ ছেড়ে বিষণ্ণতায় ডুব দেয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
.
কিছু একটা ভেবে লেখা বন্ধ করলো হুরায়রা। এই কয়েকদিন তার মনটা অস্থিরতায় কাটছে। অস্থিরতা কমানোর জন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসা প্রয়োজন। সেটা যদি হয় বিষণ্ণ শহর তবে মন্দ কি?
এসব ভেবে কাগজ কলম এক পাশে রেখে দিলো সে। নাস্তা বানানোর জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। এখন আর ঘুম হবে না তার।
.
চলবে