#মেঘের_শহর
#পর্ব_১৯
Saji Afroz
.
বিছানায় শুয়ে আছে মোখলেস। বেশ কয়েকবার জিকোর ফোন নাম্বারে ডায়াল করেছে সে। সাড়া না পেয়ে মেসেজও করেছে। কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো রিপ্লাই না পেয়ে হতাশ হলো সে।
জেসিকার ব্যাপারে কথা বলার জন্যই জিকো কে ফোন করে চলেছে মোখলেস।
আজকাল জেসিকা কে নিয়ে বড্ড ভাবছে সে। ভালোবাসা তো আছেই৷ তবে মূলে রয়েছে তার পরিবার৷ রোজ একবার করে বিয়ের জন্য তাড়া দিচ্ছে তাকে। মা তো বলতেই থাকেন, খুব তাড়াতাড়ি পুত্রবধু ঘরে আনতে চান৷ আর বিয়ের কথা উঠলেই জেসিকা ছাড়া মোখলেস অন্য কারো কথা ভাবতেই পারে না। একমাত্র জেসিকাই তার স্ত্রী হয়ে এ বাড়িতে আসবে। অন্য কেউ নয়।
শোয়া থেকে উঠে পড়ল মোখলেস। হঠাৎ মনের মাঝে অস্থিরতা কাজ করছে। জানালার পাশে এসে পর্দা টা সরালো। রাত বেশি হয়নি। রাস্তায় এখনো কত লোক হাঁটছে, কথা বলছে। কেউ কেউ নীরবে বসে আছে। আবার কেউ তার মতো জানালার ধারে দাঁড়িয়! যারা হয়তো ভাবছে কারো কথা। কারো স্বপ্ন আঁকছে আপনমনে।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তার রুমে আসলো শাপলা।
শাপলা তার দূরসম্পর্কের বোন। মা মরা মেয়ে সে। কিছুদিন আগে তার বাবা ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে যায়। মোখলেসের মা যখন জানতে পারলেন শাপলা বাসায় একা থাকছে, তখনই তাকে এই বাসায় নিয়ে আসেন তিনি। মায়ের মতে শাপলা বড় ভালো মেয়ে। যেই বাড়িতে যাবে আনন্দে ভরিয়ে রাখবে।
শাপলা ভেতরে আসতে চাইলে মোখলেস বলল-
এসো শাপলা।
.
টেবিলের উপরে কাপ টা রেখে শাপলা বলল-
খালা বলেছেন খাবারের পর এক কাপ চা খাওয়া আপনার অভ্যাস। তাই নিয়ে এলাম।
-তুমি এই বাড়ির মেহমান। কাজ করছ কেনো?
-আমার কাজ করতে ভালো লাগে।
.
শাপলা কে বসতে বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলো মোখলেস। স্বাদ নিয়ে বলল-
বাহ! দারুণ বানিয়েছ।
-ধন্যবাদ।
-শুনেছি রাত চা খেলে ঘুম আসেনা। তবুও আপনি খান কেনো? রাতে না ঘুমিয়ে কি করেন?
-বই পড়ি, ব্যবসার হিসাব দেখি। তবে আমার ক্ষেত্রে এমন হয় না। যখন মনেহয় ঘুমানো উচিত তখনি ঘুমোতে যাই৷ ঘুমও চলে আসে।
-ওহ!
.
চেয়ার টেনে বসলো মোখলেস। শাপলা উঠতে চাইলে সে বলল-
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
.
শাপলা বিস্ময় চোখে তাকালো তার দিকে। মোখলেস ভাবলো কথাটি কিভাবে বলা যেতে পারে।
শাপলা ডাকলে ঘোর কাটলো তার। মৃদু হেসে বলল-
তোমার বাবা যাওয়ার আগে একটা কথা বলে গেছেন।
-কি?
-তোমার বিয়ে ঠিক করেছেন তিনি। এসেই ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু আমি চাই তুমি পাত্র কে দেখো। তুমি রাজি থাকলে পাত্রকে দেখার ব্যবস্থা আমি করে দিতে পারি।
.
শাপলা কোনো জবাব দিলো না। চায়ের কাপ থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো মোখলেস। তার চোখ দুটি ছলছলে। মোখলেস তাকিয়েছে দেখে উঠে সে চলে যাচ্ছে।
মোখলেস তাকে থামিয়ে বলল-
কিছু তো বলে যাও?
.
শাপলা দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। এবার আর তাকালো না মোখলেস। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল-
বুঝতে পেরেছি তুমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছ। সময় নিয়ে সিদ্ধান্ত জানাও। তোমার বাবা আসতে সময় আছে। ঠিক আছে?
.
শাপলা নড়েচড়ে দাঁড়ালে দরজায় ক্যাচ করে শব্দ করে উঠল। শব্দ শুনে মোখলেস তার দিকে তাকাতেই সে হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নেড়ে চলে গেল।
.
.
.
বিছানার উপরে পা তুলে খাতা কলম নিয়ে বসে আছে সাইয়ারা। মেঘের নামে একটা চিঠি লিখেছে সে—
প্রিয় মেঘ। ভালোবাসা কাকে বলে তা আমি আপনার মাধ্যমেই বুঝেছি। এখন নিশ্চয় আপনি বলবেন, আপনি আমায় বুঝিয়েছেন কখন? নিজের অজান্তেই আপনি আমাকে ভালোবাসার মানে বুঝিয়েছেন। প্রেম ভালোবাসা নিয়ে অনীহা আমার ছিল না। কিন্তু আমি কারো জন্য এতটাও পাগল হয়ে যাব ভাবিনি। তবে একদিন আপনাকে বলেছিলাম, এমন একজন কে চাই আমি যার পেছনে আমি ঘুরতে থাকব। সে আমায় পাত্তাই দিবে না।
ওটা কেবলই মজার ছলে বলেছিলাম। কিন্তু আজ দেখুন, আমার জীবনে এটাই ঘটেছে। কি ঘটেছে? এই যে আমি আপনার পেছনে ঘুরেছি আর আপনি আমাকে পাত্তা দিলেন না।
এখনো বুঝেন নি কিছু? না বোঝবার ই কথা। এতদিন পাশে থেকেও যেটা বুঝেন নি এখন আমার এই ঘোরানো প্যাচানো কথায় কি করে বুঝবেন!
তবে বুঝিয়েই বলি।
মেঘ সাহেব, আমি আপনাকে ভালোবাসি। ঠিক ততটা, যতটা আপনি আপনার মনের মানুষ কে বাসেন।
হুরায়রার কথা যখন শুনেছি বড্ড রাগ হয়েছিল আমার। কিন্তু হুরায়রার প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে আমার সব রাগ গায়েব হয়ে গেল।
আমি না পাই আপনাকে, আপনি তো পাচ্ছেন নিজের মনের মানুষ কে। আমি নাহয় দূর থেকেই ভালোবাসবো। ভালোবাসলেই কাছে পেতে হয়না। প্রিয় মানুষটির সুখে সুখী হতে হয়। যা আজ আমি হয়েছি।
.
আর কি লিখবে ভাবছে সাইয়ারা। তবে এই চিঠি কেনো লিখছে সে জানে না। চিঠি টা মেঘের হাতে দিবে কি না তাও জানে না। লিখতে ইচ্ছে করছে তাই লিখছে। এখন আবার ইচ্ছেও করছে না!
চিঠি শেষ না করে ডায়েরির পাতা উল্টালো সে।
একটা পাতায় বড় করে মেঘের নাম লিখলো।
.
পরমুহূর্তেই হেসে নামটা কেটে দিলো সে। ডায়েরির পাতার মতো তার জীবন থেকেও মেঘের নাম টা কেটে দিতে হবে সারাজীবনের জন্য!
.
.
.
আজও ক্লাস শেষে মোখলেসের দেখা পেল জিকো। আজ দুপুরেও রেস্টুরেন্টে খেতে পারবে বলে মুখে হাসি ফুটলো তার। মোখলেসের পাশে এসে বলল-
আজও নিশ্চয় রেস্টুরেন্টে নিতে এসেছেন আমায়?
.
কথাটি বলে জিভে কামড় বসালো সে। লোভ সামলানো দরকার। নাহলে মোখলেসের কাছে ছোট হয়ে যাবে সে।
জিকো আবারো বলল-
না মানে আজ আর দরকার নেই। তার চেয়ে বরং আমার বাসায় চলুন। রান্না করে খাওয়াব আপনাকে।
.
রেস্টুরেন্টে যাওয়ার জন্যই মোখলেস এসেছে। ভেবেছে আজ মনের কথা জানিয়েই দিবে। যার জন্য একটা নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন। এখন জেসিকা নিজ থেকেই তার বাসার কথা বলেছে। এই যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! ওখানেই নাহয় বলা যাবে।
মোখলেস রাজি হয়ে গেলে জিকো বিরক্ত হলো। কোথায় ভেবেছিল রেস্টুরেন্টে বসে কালকের মতো মোরগ পোলাও খাবে এখন কি না রান্না করে খেতে হবে! অসহ্যকর। বাসায় বাজার করাও নেই। জিকো নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-
চলুন যাওয়া যাক। তার আগে আমাকে কিছু বাজার করতে হবে। আসলে বাসায় বাজার করা নেই। রান্না করতে ইচ্ছে করে না। একা মানুষ তো। ডিম ভাজি, আলু ভাজি, ডাল এসব দিয়েই খেয়ে ফেলি।
-সমস্যা নেই। আজ আপনার সাথে ডিম ভাজি দিয়েই নাহয় ভাত খাব। বাজারের প্রয়োজন নেই।
-না না। সে কি করে হয়! একটা মুরগি কিনে নিই।
-সে নাহয় আমিই কিনে নিচ্ছি।
-আরে না। তার প্রয়োজন নেই।
-তবে নেয়ারও প্রয়োজন নেই। আমার খুব করে ডিম খেতে ইচ্ছে করছে।
.
মোখলেসের কথা শুনে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো জিকো। এখন কিছু রান্না করার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটায় তার নেই।
দুজনে একটা রিকশা ঠিক করে বাসার দিকে রওনা হলো।
বাসায় পৌঁছে মোখলেস কে বসতে বলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো জিকো। বেরিয়ে এসে একটা তোয়ালে এগিয়ে দিয়ে মোখলেস কেও ফ্রেশ হয়ে নিতে বলল সে। এরপর সে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
মোখলেস বের হতে হতে চুলোয় চাল বসালো জিকো। ভাত রান্না করছে সে।
চাল বসিয়ে মোখলেসের সাথে সে গল্প করতে লাগলো। এ কথায় সেই কথায় মোখলেস নানাভাবে জিকো কে বোঝানোর চেষ্টা করলো, সে তাকে পছন্দ করে। জিকো বুঝেও না বোঝার ভান করলো। এদিকে বেচারা মোখলেস মুখ ফুটে বলতেও পারছে না মনের কথা।
ভাত রান্না হয়ে গেলে ডিম ভেজে নিলো জিকো। কাল রাতের রান্না করা ডালও গরম করে নিলো। এরপর দুজনে বসে একসাথে খেল।
খাওয়া শেষে রান্নাঘরে এসে থালাবাসন পরিষ্কার করছে জিকো। মোখলেস এসে দাঁড়ালো তার পাশে।
জিকো বলল-
আপনাকে শুধু ডিম ভেজে ভাত দিয়েছি। ভালো লাগছে না আমার।
.
মনে সাহস জুগিয়ে বলেই ফেলল মোখলেস-
সারাজীবন তোমার হাতের ডিম ভাজি খেতে চাই। সেই সুযোগ টা দিবে?
.
হাতের প্লেট টা বেসিনের মাঝে রেখে চোখ জোড়া বড় বড় করে মোখলেসের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তে তাকালো সে।
মোখলেস বলল-
তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি আমি। বাড়ির বউ করে নিয়ে যেতে চাই। আজীবন ডিম ভাজি করে খাওয়াতে চাইলেও কোনো সমস্যা নেই। তুমি শুধু হ্যাঁ বলে দাও প্লিজ!
.
.
.
মাত্রই খাওয়া দাওয়া শেষ করে উঠেছে মেঘের পরিবার। এরই মাঝে ফোন এল অন্তরা আহম্মেদের নাম্বারে। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলেন, জাফর শেখের ফোন!
তিনি চটজলদি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানালো, হুরায়রা ফিরে আসবে আজই। তারা চাইলে তাকে এসে দেখে যেতে পারে।
.
কথাটি শুনে অন্তরা আহম্মেদ ভীষণ খুশি হলেন। তার একটা ইচ্ছে আছে। তবে এখনই জাফর শেখ কে জানালেন না। কিছু সময় পরে ফোন করবেন বলে লাইন কাটলেন তিনি।
মেঘ কে কথাটি জানাতেই খুশিতে আত্মহারা হওয়ার উপক্রম তার।
কিন্তু তা প্রকাশ করলো না। অন্তরা আহম্মেদ বললেন-
হুরায়রা কে দেখতে তো যাবই। তবে আরো একটা কাজ সেরে ফেলতে চাই আমি।
-কি মা?
-পারিবারিক ভাবে তোদের এনগেজমেন্ট করাতে চাই।
.
মিন্নী একটু গম্ভীর স্বরে বলল-
আগে তো দেখো মেয়েটাকে!
-আমার ছেলের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।
.
মেঘ মৃদু হেসে বলল-
তুমি যা ভালো বুঝো করো মা।
.
জাফর শেখ কে অন্তরা আহম্মেদ এই প্রস্তাব টি দিতেই তিনি খুশি হয়ে যান। তারও এই বিয়ে নিয়ে বেশ তাড়া আছে। কখন আবার হুরায়রা বেঁকে বসে বলা যায় না।
তিনি তাদের যত দ্রুত সম্ভব আসতে বললেন।
অন্তরা আহম্মেদ কালই যাবে বলে জানালেন। তিনি কোনো আপত্তি জানালেন না। বরং খুশিই হলেন।
এদিকে মেঘ খুশির সাথে সাথে অবাকও হয়েছে!
হুরায়রা তাকে এত সহজে পছন্দ করে ফেলবে ভাবেনি। কাল দেখা হলেই বলবে-
পছন্দ যদি করতেই এত অভিনয় করলে কেনো?
.
চলবে