উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-১৭(২য় ভাগ)||

0
676

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-১৭(২য় ভাগ)||

২৮।
পেছনের চাকা থেকে ধোঁয়া বের করতে করতে একটা মোটর সাইকেল ক্যাম্পাসে ঢুকলো। পদ্ম আর আফিফ ক্যাম্পাসের মাঠেই দাঁড়ানো ছিল। মোটর সাইকেলের ধোঁয়াগুলো সব পদ্মের নাকে-মুখে ঢুকে গেছে। পদ্ম হাত নাড়িয়ে ধোঁয়াগুলো তাড়াতে লাগলো। বাইকটি ক্যাম্পাসে ঢুকে প্রশাসনিক ভবনের সামনে কয়েক চক্কর দিয়ে থামলো। আহি আর পুষ্প বাইকারটির দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পুষ্প রীতিমতো বাইকারটির চেহারা দেখার জন্য উদগ্রীব। কি চমৎকার ভাবেই না বাইকারটা রোলিং বার্নআউট স্টান্ট করলো! পুষ্পের বরাবরই স্টান্ট বাইকারদের উপর প্রবল আকর্ষণ। আর যদি তার হাতের নাগালেই এমন ছেলে থাকে, তাহলে তাকে পটাতে সে ভীষণ আগ্রহী হবে। কিন্তু পরক্ষণেই পুষ্প ভাবতে লাগলো, সে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। আর এই বাইকারটি যদি অনার্স পড়ুয়া ছাত্র হয়, তাহলে তো তার সব আশা জলে যাবে।

বাইক থামিয়ে হেলমেট খুলতেই বাইকারের চেহারা দৃশ্যমান হলো। পুষ্প বাইকারকে দেখে ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আরেহ, এটা তো লাবীব!”

লাবীব বাইকের হ্যান্ডেলে দুই হাত উঠিয়ে হালকা ঝুঁকে বলল,
“কেন ক্লাসের ব্যাকবেঞ্চারদের কি এমন স্কিল থাকতে পারে না?”

লাবীবের কথায় পুষ্পের সেদিন রেস্টুরেন্টে বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো। পুষ্পের মুখটা ছোট হয়ে যেতে দেখেই লাবীব হাসলো।
এদিকে আফিফকে লাবীবের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে রাদ আর আহি ভ্রূ কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। পদ্ম আফিফকে বার-বার আটকানোর চেষ্টা করছে। আহি বুঝতে পারলো আফিফ ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু হঠাৎ তার রেগে যাওয়ার কারণ কি?

(***)

লাবীব বাইক থেকে নামতে যাবে তখনই পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে আফিফ বলে উঠলো,
“ক্যাম্পাসের মতো সুন্দর পরিবেশে এমন অভদ্র ভাবে প্রবেশ করার কি খুব প্রয়োজন ছিল?”

লাবীব পেছন ফিরে আফিফের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুঁচকে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”

“এটা বাইক স্টান্টের জায়গা নয়। এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।”

“তো! আপনার সমস্যা কোথায়?”

“তোমার বাইকের ধোঁয়া অন্যদের বিরক্তির কারণ হয়েছে।”

“এই দেশে এতো ধোঁয়া উড়ছে, আর আপনি এসেছেন আমার বাইকের ধোঁয়া নিয়ে কথা বলতে।”

“ভদ্র ভাবে কথা বলো। বাইক আমাদেরও আছে। আমরা তো এভাবে চালাই না।”

“চালাতে জানলেই তো চালাবেন।”

রাদ লাবীবের উত্তর শুনে ভবনের পিলারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে দাঁড়ালো। তার ঠোঁটে হাসি। আহি রাদের কাছে এসে বলল,
“রাদ, লাবীবকে গিয়ে থামা।”

রাদ চাপা স্বরে বলল,
“তোর আলগা পিরিত দেখাতে হবে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সিনেমা দেখ।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। রাদ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
“আমার এই সিনেমা খুব ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে এই বছরের হিট সিনেমা হবে এটা।”

রাদ মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে আহির হাতে দিয়ে বলল,
“যা পপকর্ন কিনে নিয়ে আয়। তারপর আমরা একসাথে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো।”

আহি টাকাটা রাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে লাবীবের সামনে এসে দাঁড়ালো। আফিফ লাবীবের অভদ্রতা দেখে আরো রেগে যাচ্ছিলো, তখনই আহি লাবীবকে বলল,
“তুই প্রথম দিনেই ঝামেলা করবি?”

লাবীব আফিফের দিকে আঙ্গুল তাক করে বলল,
“উনি আমাকে ভদ্রতার জ্ঞান দিচ্ছে, সেটা দেখছিস না?”

পুষ্প আফিফের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভাইয়া, আমরা দুঃখিত। ও আসলে বুঝে নি ব্যাপারটা। এতো বছর দেশের বাইরে ছিল। এসব ওখানে স্বাভাবিক। লাবীব পদ্মকে বিরক্ত করতে চাই নি।”

লাবীব আহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“কে এটা!”

আহি ভ্রূ কুঁচকে বলল, “পদ্মের হাসবেন্ড।”

“তোর ফ্রেন্ড, পদ্ম?”

“হ্যাঁ।”

লাবীব বাইক থেকে নামতে নামতে বলল,
“ওত্তেরি, আমি কি সবসময় ভুল সময়েই এন্ট্রি নেই না-কি? এখন হিরো সাজতে গিয়ে জিরো হয়ে যাবো না তো!”

“সরি বলে দে। ঝামেলা শেষ।”

লাবীব আফিফের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,
“সরি শ্রদ্ধেয় দুলাভাই।”

লাবীবের সম্বোধনে পুষ্প অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। রাদ হাই তুলতে তুলতে বিড়বিড় করে বলল,
“আহিনি, এতো সুন্দর হিট হওয়া সিনেমাটাই তুই ফ্লপ করে দিলি। সব মজা এক নিমেষেই শেষ করে দিলি। ইচ্ছে করছে তোকে আর তোর নিরামিষ তেলোপোকাকে এখনই আমিষ হীন জাদুঘরে রেখে আসতে। ধুর, ভাল্লাগে না।”

এদিকে আফিফ লাবীবকে আর কিছু বললো না। লাবীব এবার পদ্মের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আরেহ, তুই তো আমাদের স্কুলের সেই টু’জি ডিভাইসটা! দেখেছিস, আমার মেমোরি খুব শার্প।”

পদ্ম লাবীবের সম্বোধনে ইতস্ততবোধ করতে লাগলো। সে একটু পর পর আফিফের দিকে তাকাচ্ছে। আহি বুঝতে পেরে লাবীবের হাত ধরলো। আফিফ ভ্রূ কুঁচকে সেই হাতের দিকে তাকালো। আহি তার নখগুলো দিয়ে লাবীবের হাতে আঁচড় দিয়ে তাকে চুপ করতে ইশারা করছিলো। কিন্তু লাবীব সেই ইশারা বুঝলো না। সে আহির হাত সরিয়ে দিয়ে পদ্মকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“পদ্ম, ইউর কিলিং আইজ।”

লাবীব এই কথা বলে বুকে হাত রাখলো। পদ্ম লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। লাবীব এবার জিজ্ঞেস করলো,
“তো মিস. ভদ্রমহিলা, কেমন আছেন?”

পদ্ম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। আফিফ পদ্মের হাত ধরে বলল,
“বাসায় চলো। দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

পদ্ম মাথা নেড়ে আহি আর পুষ্পের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। এরপর আফিফের পিছু পিছু চলে গেলো। এদিকে রাদ এসব দেখে হাসছে। আফিফ আর পদ্ম চলে যেতেই পুষ্প রাগী দৃষ্টিতে লাবীবের দিকে তাকালো। লাবীব পুষ্পের চাহনি দেখে বলল,
“খেয়ে ফেলবে না-কি আমাকে?”

“তুমি কোথায় কি বলতে হয় জানো না?”

“আমি আবার কি করলাম?”

“পদ্মের হাসবেন্ডের সামনে অন্তত ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতে।”

“আমি কি পদ্মের গালে চড় লাগিয়েছি না-কি!”

আহি লাবীবকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“লাবীব, মেয়েটা তোর কথায় অস্বস্তি বোধ করছিলো, তুই খেয়াল করিস নি?”

“অদ্ভুত তো! আমি এমন কি করলাম ভাই?”

রাদ লাবীবের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
“ভীষণ ভালো করেছিস। আমি মজা পেয়েছি।”

আহি রাগী দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকালো। পুষ্প ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“তোমার মজা পাওয়ার কারণ কি? এমনিতেই পদ্মের সংসারে ঝামেলার শেষ নেই। এখন ভাইয়া যদি বিষয়টা নেগেটিভলি নেন? পদ্মের হাসবেন্ড একটু কন্সার্ভেটিভ। আর একদম সাদা মনের মানুষ। এসব জিনিস উনি সহজে নিবেন কি-না সন্দেহ!”

আহি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
“আচ্ছা, আমি বাসায় যাই। তোরা থাক। কাল অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে দেখা হবে।”

রাদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি দ্রুত পায়ে চলে গেলো।

(***)

আহি ক্যাম্পাস গেট দিয়ে বেরিয়ে দেখলো আফিফ মোটর সাইকেলে চাবি ঘুরাচ্ছে। আহি দৌঁড়ে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আহিকে দেখে আফিফ ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। পদ্ম সিট থেকে নেমে আহির হাত ধরে বলল,
“কিছু বলবি?”

আহি পদ্মের হাত ধরে আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপনি প্লিজ লাবীবের ব্যবহারে কিছু মনে করবেন না। স্পেশালি পদ্মকে ভুল বুঝবেন না। টু’জি ডিভাইস বলতে ও বুঝিয়েছে ক্লাসে পদ্ম অনেক দেরীতে লেখা শেষ করতো। আর ও ক্লাসে অনেক শান্ত ছিল। চুপচাপ থাকতো। তাই এমন বলেছে।”

আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমি পদ্মকে ভুল বুঝি নি। আমি এতোটাও ডোমিনেটিং নই।”

আহি হালকা হেসে পদ্মের কাছ থেকে বিদায় নিলো। পদ্ম যাওয়ার আগে বলল,
“আবার পালিয়ে যাস না কিন্তু। আমি কিন্তু আফিফ থেকে প্রতিদিন তোর খবর নেবো। এখন তো তুই উনার ক্লাসমেট।”

আফিফ পদ্মের কথা শুনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মোটর সাইকেলে চাবি ঘোরালো। আহি মলিন হেসে হাত নাড়িয়ে পদ্মকে বিদায় দিলো।

রাস্তার মোড়ে যতোক্ষণ আফিফের মোটর সাইকেলটি দেখা যাচ্ছিলো, আহি সেদিকেই তাকিয়ে ছিল। আফিফ আর পদ্ম চোখের আড়াল হতেই আহির চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সে বুকে হাত দিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো একজন নিঃস্ব পথিকের মতো। এদিকে দূর থেকে রাদ আহিকে দেখছে। সেও তখন আহির পিছু নিয়েছিল। আর যখন দেখলো আহি আফিফ আর পদ্মের সাথে কথা বলছে, তখন আর সামনে এগিয়ে যায় নি। রাদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললো,
“শুনেছি ছেলেদের উন্মাদ প্রেমে মেয়েরা ঘায়েল হয়ে যায়। আর এতো চমৎকার একটা মেয়ের এতো সুন্দর করে ভালোবাসতে পারাটা আপনাকে একটুও টানলো না, মিস্টার আফিফ? আপনি ভাগ্যবান হয়েও দুর্ভাগায় রয়ে গেলেন।”

২৯।

পদ্ম আর আফিফ বাসায় ঢুকতেই আফিফা বেগম নাক সিঁটকে বললেন,
“পড়তে গিয়েছিলি, না-কি বউ নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলি।”

আফিফ শান্ত ভঙ্গিতে ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখে মায়ের দুই হাত আলতো করে স্পর্শ করলো। আফিফা বেগম ছেলের নিরব আর উষ্ণ ব্যবহারে আবেগী হয়ে গেলেন। হুট করেই তার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠল। আফিফ মাকে সোফায় বসিয়ে মায়ের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,
“মা, তোমার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়েছিলাম। মাস্টার্সে ভর্তির বাকি টাকাটাও দিয়ে এসেছি। এক বছর পর তুমিও সবাইকে মিষ্টিমুখ করাতে পারবে।”

আফিফা বেগম পদ্মকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন,
“বউকে ঘরে রেখে যেতে পারিস নি?”

“মা, এরপর আমরা ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিলাম। ওকে তো যেতেই হতো।”

আফিফা বেগম উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ডাক্তার কি বললো? আমি দাদী হতে পারবো?”

পদ্ম শাশুড়ির উৎসুক মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলো। আফিফ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আমার সন্তান লাগবে না, মা। তুমি আর পদ্মই আমার সব।”

আফিফা বেগম ছেলের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই অপয়াকে বাঁচাতে চাইছিস? কে সন্তান চাই না, বল? এই মেয়ে তোকে সুখ দিতে পারবে না। তুই আরেকটা বিয়ে করে নে।”

পদ্ম শাশুড়ির কথা শুনে মলিন মুখে নিজের ঘরে চলে গেলো। আফিফ এবার গম্ভীরমুখে বলল,
“আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। ওর বর্তমানে আমি সেই জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না।”

“ভালোবাসলে বাস। তালাক দিতে বলি নি। দুই বউ নিয়ে সংসার করবি!”

“বাস্তবিক দিক দিয়ে আমি একটা সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি। যেখানে আমার চাকরিটাও চলে গেছে। সেখানে আমি দুই জনকে চালাতে পারবো না। আর যদি আমার দিক দিয়েই চিন্তা করো, তাহলে আমি নিজেই একসাথে দুইজনকে সমান ভাবে ভালো রাখতে পারবো না। আমি পদ্মকে ভালোবাসি, মা। নতুন কাউকে সেই জায়গাটা এতো সহজে দিতে পারবো না আমি। আর তখন নতুন জনের সাথেই অন্যায় হবে।”

আফিফা বেগম করুন স্বরে বললেন,
“তুই আমার একমাত্র ছেলে। তোর যদি সন্তান না হয়, আমাকে দাদি বলে ডাকবে কে?”

“তুমি দাদি ডাক শোনার জন্য এমন করছো? আর যে মা ডাক শুনতে পারছে না, তার জন্য কষ্ট হচ্ছে না? তোমার আর আমার চেয়ে পদ্মের কষ্টটা অনেক বেশি। ও আমাকে ভালোবাসে, এই সংসারটাকে ভালোবাসে, তোমাকে ভালোবাসে। তুমি ওর সাথে এমন ব্যবহার করো না।”

আফিফা বেগম ছেলের কথায় দমে গেলেন। কিন্তু তার মন থেকে আফিফকে দ্বিতীয় বিয়ে করানোর সিদ্ধান্তটা এখনো গেলো না। ছেলে মানুষ যেকোনো সুন্দরী মেয়ে দেখলেই বিয়ে করতে আগ্রহী হবে। এখন তিনি মনে মনে ভাবছেন, ছেলের জন্য এবার তাকে সুন্দরী মেয়ে খুঁজতে হবে।

(***)

পদ্ম মেঝেতে বসে কাঁদছে। আফিফকে রুমে ঢুকতে দেখে পদ্ম চোখের পানি মুছে নিলো। আফিফ পদ্মের কাছে এসে পা গুটিয়ে তার সামনে বসে পড়লো। পদ্ম আফিফকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমি তোমাকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না। কিন্তু আমি চাই, তুমি বাবা হও। আমার দুর্বলতাগুলো আমি মেনে নিয়েছি। তুমি এবার বিয়ে করে নাও। কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিও না। আমি এই বাড়ির এক কোণায় পড়ে থাকবো।”

আফিফ হালকা হেসে পদ্মকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
“পদ্মফুলকে ছেড়ে দেওয়া অসম্ভব। পদ্মফুল আমার জীবনে তখন এসেছিল, যখন আমি একদম নিঃস্ব ছিলাম। যখন মনে হয়েছিল, আমি কাউকে পাওয়ার যোগ্য নই। এমন একদিন পদ্মফুল তার লাজুক মুখখানা আমাকে দেখে আড়াল করেছিল। তার মিষ্টি হাসি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি এতোটাও অযোগ্য নই।”

আফিফের চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো। সে পদ্মকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দেয়ালে লাগিয়ে রাখা চিত্রটির দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে তার মন ভারী হয়ে যেতে লাগলো। সে নিজেও জানে না কেন এই ভার তাকে ঝেঁকে ধরেছে। তবে আজ তার মন কাঁদছে। কিন্তু অশ্রুগুলো অদৃশ্য।

(***)

অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে বাদামি শার্ট আর কালো জিন্স পরে এসেছে আহি। আহিকে দেখতেও আজ ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। যদিও আহি তার আজকের পোশাকে একদম সন্তুষ্ট নয়। শার্ট-জিন্স পরতে অভ্যস্ত হলেও সে যতোবারই শার্ট পরেছিল, তার উপরে জ্যাকেট বা কোট পরতো বা গলায় একটা স্কার্ফ থাকতো। কিন্তু আজ সে এসব ছাড়াই বের হয়েছে।স্কার্ফটি পর্যন্ত গলায় ঝুলাতে পারে নি সে। আহি যদিও সেলোয়ার-কামিজ তেমন একটা পরে না। কারণ রিজওয়ান কবির নিজেই চান না মেয়ে দেশীয় পোশাক পরুক। তিনি মনে করেন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরলেই আহিকে বেশি স্মার্ট লাগবে। আর তার বেশভূষায় বোঝা যাবে সে দেশের প্রভাবশালীর মেয়ে। যদিও আহি বাবার এই চিন্তা ভাবনা একদমই পছন্দ করে না। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না। আর আহির আজকের পোশাকটি লাবণি মেহেরার ব্যক্তিগত সহকারী ঠিক করে দিয়েছে। মেয়েটির নাম সুনেহরাহ। প্রচুর গায়ে পড়া স্বভাব আছে মেয়েটির। লাবণির সামনেই রিজওয়ান কবিরের সাথে রসিয়ে রসিয়ে কথাবার্তা বলে। লাবণির এতে কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু আহি এসব দেখলেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সুনেহরাহ আহিকে খুব পছন্দ করে। তার দৃষ্টিতে যেই মেয়েগুলো সুন্দর, তাকে সে নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখতে পারবে। আহি এতোদিন দেশের বাইরে ছিল, তাই সুনেহরাহ তার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারে নি। কিন্তু যখন লাবণি তাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে, আহির আজ অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম আছে, সে সাথে সাথেই সব কাজ ফেলে চলে এসেছে। আহি যদিও তাকে দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছে। আর এসব আদিখ্যেতা তার ভালো লাগে না। সাধারণ একটা প্রোগ্রামের জন্য এতো আয়োজন করার কি আছে সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু লাবণি এসব ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন। আহি একজন প্রভাবশালীর কন্যা। যদি কেউ তার ছবি তুলে রাখে? তাই অন্তত আহিকে আকর্ষণ করার মতো নিজেকে তৈরী করে বের হতে হবে। যদিও রিজওয়ান কবির যে আহির বাবা তা তেমন কেউ জানে না। এমনকি রিজওয়ান কবিরের মেয়ে সম্পর্কেও কোনো তথ্য কারো হাতে নেই।
বাবার জীবনে সে বইয়ের প্রথম পাতা মাত্র। যেখানে কোনো লেখা থাকে না। বিশেষ কারণ ছাড়া যেমন বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠায় পাঠকের অনুভূতি বা লেখকের শুভেচ্ছা স্বাক্ষর পড়ে না। ঠিক তেমনি রিজওয়ান কবিরও বিশেষ কারণ ছাড়া আহির সাথে কথা বলেন না বা তার ব্যাপারে মাথা ঘামান না। তবুও পাঠকের কাছে বইয়ের বাকি পৃষ্ঠাগুলোর মতো প্রথম শূন্য পাতাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি রিজওয়ান কবিরের কাছে আহি সেই পাতা। যাকে তিনি নিজের মতো করেই রাখতে চান। নিজের মতোই তার সাথে ব্যবহার করেন। যা ইচ্ছে তার উপর চাপিয়ে দেন। যেমন আজ সুনেহরাহর কারণে স্কার্ফ ছাড়া তাকে বের হতে হয়েছে। আহি লাবণিকে কয়েকবার বলেছিল, সে অস্বস্তিবোধ করছে। কিন্তু তার কথাটা যেন কোনো মূল্যই পেলো না।

(আরো কিছু লেখার ছিল। কিন্তু সবাই অপেক্ষায় আছেন, তাই দিয়ে দিলাম। আগামীকাল রাতে বোনাস পর্ব দেবো।)

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here