#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৪(১ম ভাগ)||
৪১।
সবুজবিথীর ভীড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি সাদা পরী। উজ্জ্বল স্তব্ধ হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটির সাদা ওড়নাটি হালকা হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ পুষ্প তার চোখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
“প্রেমে-টেমে পড়ে যাচ্ছিস না-কি ভাই?”
উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প এক গাল হেসে বলল,
“আহির প্রেমে পড়বে না এমন ছেলে নেই। মেয়েটা আসলেই ভীষণ মিষ্টি।”
উজ্জ্বল মুচকি হেসে বলল,
“আর আমি মিষ্টি মেয়েদের ভীষণ ভয় পাই।”
“ভাইয়া, সব মেয়ে কিন্তু রীতিকা হয় না।”
“এসব কথা তুলিস না তো।”
“কেন তুলবো না? এতোদিন পর তোর সাথে দেখা হয়েছে। আর আমি এখনো সেই দেবদাসটাকেই দেখছি।”
“ব্রেকাপের পর নতুন সম্পর্কে না যাওয়ার অর্থ এই নয় যে আমি এখনো মুভ অন করতে পারি নি। নিজেকেও সময় দিতে হয়, বুঝলি?”
“বাই দা ওয়ে, রীতিকার কি অবস্থা?”
“বিয়ে করে বরের সাথে সংসার করছে। ওর খবর নেওয়ার সময় আছে না-কি আমার!”
“তৃষা আপু বললো শীঘ্রই তুই মামা হতে যাচ্ছিস।”
উজ্জ্বল বাঁকা চোখে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প হেসে বলল,
“রীতিকার বাচ্চা তো তোকে মামা বলেই ডাকবে। আর যাই বলিস, তোকে বিয়ে করলে সত্যিই কপাল খুলতো ওর।”
উজ্জ্বল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তখন বেকার ছিলাম, তাই চুটিয়ে প্রেম করার সময় পেয়েছি। এখন কাজে ব্যস্ত থাকি, তাই এসব ফাউল কাজে সময় দিতে পারছি না। আর রীতিকার কথা আমাকে বলিস না। ও নিজের সংসারে ভালোই আছে।”
পুষ্প এবার আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আহি কিন্তু সত্যিই মিষ্টি। তুই ট্রাই করতে পারিস।”
“বেশি মিষ্টি মেয়েরা বাবা-মার বাধ্য সন্তান হয়। এমন বাধ্য সন্তানদের প্রেমে পড়ে দ্বিতীয়বার দেবদাস হতে চাই না।”
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যদি আহির ভাগ্য রীতিকার মতো হতো!”
“মানে?”
“ওকে দেখ, চা-বাগানে এসেই কেমন হাসছে! ওকে এভাবে হাসতে দেখি না কতো বছর!”
“কি হয়েছে ওর?”
“অনেক কিছুই হয়েছে। কিছু জানি, কিছু এখনো অজানা। মেয়েটা ভীষণ চাপা স্বভাবের। স্কুলে ওকে যেই রূপে দেখেছি, তখন আর এখনের আহির মধ্যে বিস্তর পার্থক্য।”
“কেমন পার্থক্য!”
“মিস্টার রিজওয়ান কবিরকে চিনিস?”
উজ্জ্বল কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“বিজনেসম্যান রিজওয়ান কবিরের কথা বলছিস?”
“হুম।”
“হুম, চিনি তো। তাকে কে না চেনে!”
“উনি আহির বাবা।”
উজ্জ্বল চোখ বড় বড় করে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প বলল,
“ভীষণ চাপে রেখেছে ওকে। ওর বাবা-মার ডিভোর্স হয়ে গেছে। মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগই পায় না। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করে। এখন খানস গ্রুপের এমডির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে।”
উজ্জ্বল অবাক কন্ঠে বলল, “তাজওয়ার খান!”
“চিনিস না-কি!”
“হ্যাঁ, ক্রিমিনাল একটা! কতোগুলো কেইস জমেছে জানিস? ভীষণ ডেঞ্জারাস লোক।”
পুষ্প উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“ওই ছেলেটার সাথেই আহির বিয়ে দেবে।”
উজ্জ্বল অবাক দৃষ্টিতে আহির দিকে তাকালো। এমন হাস্যোজ্জ্বল একটা মেয়ের জীবনে এতো ঝামেলা!
(***)
লাক্কাতুরা চা-বাগান ঘুরে মালনীছড়া চা-বাগান চলে গেলো তারা। আহি ছোট একটা বেঞ্চে একা একা বসে আছে। পুষ্প ছবি তুলতে ব্যস্ত। উজ্জ্বল খেয়াল করলো আহি একা বসে আছে। সে পুষ্পের হাতে ক্যামেরা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ছবি উঠাচ্ছিস, আর তোর ফ্রেন্ড একা বসে আছে। ওকে ডাক। ওসহ ছবি উঠাক।”
“ডেকেছি। বললো ভালো লাগছে না।”
“তাহলে তুই নিজের ছবি নিজে উঠা। আমি আর তোর ক্যামেরাম্যান হতে পারবো না।”
উজ্জ্বল কিছুক্ষণ পর আহির পাশে এসে বসলো। আহি একনজর উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়েই পুষ্পের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি ছবি তুলবে না?”
“না, ভালো লাগছে না।”
“কেন? জায়গাটা পছন্দ হয় নি?”
“হয়েছে। অনেক সুন্দর।”
আহি কথাটি বলেই মলিন হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“মনে আনন্দ না থাকলে, পৃথিবীর কোনো সৌন্দর্যই মানুষকে আকর্ষণ করতে পারে না।”
উজ্জ্বল কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“বন, পাহাড় আর সমুদ্র এই তিনটির মধ্যে তোমার প্রিয় স্থান কোনটি?”
আহি মুচকি হেসে বলল, “বন।”
“কেন?”
“কারণ বন-বনানীর ভীড়ে অনেক রহস্য লুকিয়ে থাকে।”
“সমুদ্রে বুঝি রহস্য নেই?”
“সমুদ্রের রহস্য ভেদ করা সহজ নয়। কোনো না কোনো অজানা তথ্য থেকেই যায়। আর যেই রহস্য ভেদ করা যায় না, তাকে রহস্য বলা যায় না। তাকে বলতে হয় মায়াজাল। আপনি যতোই সেই জালে নিজেকে জড়াবেন, ততোই হারিয়ে যাবেন। কিন্তু বনভূমির রহস্যগুলো সহজেই খুঁজে বের করা যায়। দরকার শুধু ইচ্ছে শক্তি আর সুযোগ। কিন্তু অনেকেই সেই সুযোগ পায় না বা ইচ্ছেশক্তিই থাকে না।”
উজ্জ্বল ভ্রূ জোড়া কুঁচকে বলল,
“অনেক জটিল কথা। তুমি কি নিয়ে পড়ছো?”
“সাহিত্য নিয়ে।”
“তাই বলি। কথার মধ্যেই আলাদা গভীরতা আছে। সহজ-সরল মানুষ এসব বুঝবে না।”
আহি হাসলো। পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার পড়াশুনা?”
“আমার পড়াশুনা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে আমি একজন লয়ার।”
আহি অবাক হয়ে বলল, “আপনি লয়ার?”
উজ্জ্বল হালকা হেসে বলল,
“হ্যাঁ, অবাক হওয়ার মতো কিছু না।”
আহি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বলল,
“এমন কোনো কেইস পেয়েছেন, যেখানে প্রাপ্ত বয়ষ্ক মেয়ে অভিভাবকের হাতে জিম্মি?”
উজ্জ্বল আহির দিকে তাকালো। সেকেন্ড খানিক পর বলল,
“তোমাকে কেউ জিম্মি করে রেখেছে?”
আহি উজ্জ্বলের প্রশ্ন শুনে মলিন মুখে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“আমি এমন কেইস পাই নি। তবে এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।”
আহি উজ্জ্বলকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। উজ্জ্বল আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“অভিভাবক যদি জিম্মি করে রাখে, তাহলে কেইস করার নিয়ম আছে। এমন কোনো আইন নেই, যেখানে অভিভাবক হলেই তার পক্ষে রায় যাবে। সত্যটাও বিচার করে দেখা হয়। আর অনেক বাবা-মা আছেন, যারা তাদের সন্তানদের জন্য ফেরেশতা হয় না, কিছু জালিমও আছে। তাদের জন্যও আইনগত ব্যবস্থা আছে।”
“প্রভাবশালী কারো জন্য আলাদা আইন আছে?”
আহির কথায় উজ্জ্বল চুপ হয়ে গেলো। এই দেশে প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যায়, এটাই নিয়ম। আহি উজ্জ্বলকে চুপ থাকতে দেখে মলিন হাসলো আর বলল,
“দেখেছেন, আপনি উত্তর দিতে পারলেন না। সত্যটা কি জানেন? আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান নয়। আসামী যদি প্রভাবশালী হয়, তাহলে কোনো ধারায় আপনি তাকে দন্ডিত করতে পারবেন না।”
উজ্জ্বল বলল,
“আধুনিক সমাজে একটা শব্দ খুবই প্রচলিত।”
“কি!”
“ভাইরাল।”
আহি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। উজ্জ্বল বলল,
“মিডিয়া অনেক বড় শক্তি। কেউ যদি ভিক্টিম হয়, আর আইনের দৃষ্টিতে সে যদি সুষ্ঠু বিচার না পায়, তাহলে তার জীবনের একমাত্র শক্তি মিডিয়া আর পাব্লিক। মিডিয়ার দরকার নিউজ, পাব্লিকের দরকার বিনোদন, বিষয় আর হৈ হৈ করার একটা সোর্স। মাঝখানে লাভ হবে সেই ভিক্টিমের। অন্তত কয়েক মাসের জন্য হলেও প্রভাবশালীদের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করা যাবে। আর যদি এর লেজ বের করা যায়, যেমন একটা সূত্র ধরে অন্য একটা তথ্য ফাঁস করার ট্রেন্ড চালু করা যায়। তাহলে অপরাধীর সাহায্যকারীরা তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আর তখন সে টাকা দিয়েও কোনো মানুষকে কিনতে পারবে না।”
আহি উজ্জ্বলের দিকে ঘুরে বসে বলল,
“কীভাবে মিডিয়ার কাছে এমন তথ্য পৌঁছানো যাবে?”
“ভাইরাল হতে হবে। তবে এতোটাও সহজ নয়। অনেক শক্ত প্রমাণ, দৃঢ় মনোবল আর মানসিক শক্তি লাগবে। মিডিয়া নয়তো ভিক্টিমকেই রোস্ট করে ছেড়ে দেবে।”
আহি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এতো শক্তি নেই তার। নিজের জন্য একমাত্র সে-ই জীবিত। কাউকে তার জীবনের ঝামেলায় জড়িয়ে সংকটে ফেলতে চায় না আহি।
৪২।
বিকেলে উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে নিয়ে গেলো ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রে। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই আকাশ মেঘলা হয়ে গেলো। পুষ্প নিজের ক্যামেরা উজ্জ্বলকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“ভাইয়া, তাড়াতাড়ি কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দে। বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে, আমার সিলেট আসাটাই বৃথা হয়ে যাবে।”
উজ্জ্বল একনজর আহির দিকে তাকালো। দেখলো আহি একটা পাথরের উপর বসে স্বচ্ছ পানিতে তার পা দু’টি ডুবিয়ে রেখেছে। আর একটু পর পর সে পা দু’টি ঝাঁকিয়ে পানির সাথে খেলছে। উজ্জ্বল পুষ্পকে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দিয়ে বলল,
“তুই ভীষণ অস্থির। তোর ছবি তুলে দিতে দিতে আমার হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।”
পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে উজ্জ্বলের দিকে তাকালো। আর টান দিয়ে নিজের ক্যামেরাটা নিয়ে নিলো। উজ্জ্বল ক্যামেরাম্যানের পদ থেকে মুক্তি পেয়েই ধীর পায়ে আহির কাছে এসে দাঁড়ালো। আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“ছবি তুলে দিচ্ছেন না যে পুষ্পকে!”
উজ্জ্বল বলল,
“অনেক তো উঠিয়ে দিয়েছি। এখন একটু আশেপাশে ঘুরে দেখুক। এতো ছবি দিয়ে যে কি করবে মেয়েটা!”
আহি নিঃশব্দে হাসলো। উজ্জ্বল বলল,
“তুমি কি ছবি কম উঠাও?”
“হুম, খুব একটা তুলি না। আমার স্ক্যান করতে ভালো লাগে।”
“বেশ তো! স্ক্যান করলে স্মৃতিতে অনেকদিন গেঁথে থাকবে। তবে ছবি একটা তুলে রাখতে হয়।”
আহি হাঁটুতে মাথা রেখে বলল,
“শিল্পীদের ছবি তুলতে হয় না। তারা ছবি বানিয়ে ফেলে।”
উজ্জ্বল আহির পাশে বসে বলল, “তুমি শিল্পী?”
আহি উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। বলল,
“অনেক দিন ছবি আঁকি নি। তবে একটা সময় অনেক ছবি এঁকেছিলাম। ছবি আঁকা আমার স্বপ্ন ছিল, আমার ভালোবাসা ছিল, আমার বেঁচে থাকার শক্তি ছিল।”
“এখন?”
“হারিয়ে ফেলেছি। স্বপ্ন, ভালোবাসা, শক্তি কিছুই আর নেই। আছি শুধু আমি আর আমার অতীত।”
“একটা ছবি এঁকেই না হয় দেখো। দেখবে আবার সব ফিরে পাবে।”
উজ্জ্বলের কথা শুনে আহি চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। উজ্জ্বল আহির চাহনি দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। গভীর আর অস্থির নয়ন জোড়া কিছু একটা তো বলতে চায়ছে। ভাসা ভাসা জল জমেছে সেই নয়ন জোড়ায়। উজ্জ্বল চোখ সরিয়ে নিলো। আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে নিশ্চিত প্রেমে পড়ে যেতো। আহি তার হাঁটু আঁকড়ে ধরে বলল,
“আমি শত ছবি আঁকলেও কিছুই ফিরে পাবো না। যেটা হারিয়ে যায়, সেটা ফিরে আসে না। যদি আসে, তাহলে হারিয়ে যাওয়াটা বেমানান।”
উজ্জ্বল ভাবুক মনে বলল, “যদি আসে?”
“কি আসবে?”
“যেটা হারিয়ে গেছে!”
আহি মলিন হাসলো। বলল,
“আমার হয়ে আসলে, আমি হারিয়ে যেতেই দেবো না।যদি আমার না হয়, তাহলে সেটা আমি ছুঁয়েও দেখবো না। সব জিনিসই আমার একার চাই। কারো স্পর্শ থাকুক, সেটা আমার সহ্য হয় না। যেমন আমি আমার বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। মা-ও আমার একার, বাবাও একদিক দিয়ে আমারই। ভাগ করে নেওয়া আমি শিখি নি। আমার জিনিসের ভাগ আমি কাউকে দেই না। যেহেতু হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন আমার ভাগের ছিল না, তাই আমি যেতে দিয়েছি।”
উজ্জ্বল ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“স্বপ্নটা কি কোনো মানুষকে ঘিরে?”
আহি ভাবুক কন্ঠে বলল,
“স্বপ্নটাই একটা রহস্য। সেটা অজানা থাকাই ভালো!”
“তোমার ফিলোসোফি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে।”
“লয়ার হয়ে এটুকু নিতে পারছেন না, আসামীদের তালগোল পাকানো কথায় তো পেঁচিয়ে যাবেন।”
“ভাগ্যিস আসামীরা তোমার মতো ফিলোসোফি নিয়ে চলে না। তবে আমি তোমার ফিলোসোফি বুঝে নিয়েছি। কিন্তু প্রকাশ করতে চাচ্ছি না। যেটা তুমি জানাতে চাও না, সেটা জেনে যাওয়ার অহংকার আমি রাখবো না।”
আহি শব্দ করে হাসলো। পুষ্প আহির হাসির শব্দ শুনে পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে বাঁকা চোখে তাকালো। উজ্জ্বল পুষ্পের চাহনি দেখে আহির পাশ থেকে একটু সরে বসলো। পুষ্প মনে মনে বলল,
“দেবদাস বাবু দেখছি এবার জুলিয়েট খুঁজে নিয়েছে।”
(***)
সন্ধ্যার পর উজ্জ্বল আহি আর পুষ্পকে তৃষার বাসার সামনে নামিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে উজ্জ্বল গাড়ির কাচ নামিয়ে আহিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কাল কোথায় যাবে?”
আহি পেছন ফিরে উজ্জ্বলের দিকে তাকিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি ফেরত দিয়ে বলল,
“আপনি যেখানে নিয়ে যান।”
পুষ্প গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“ব্যস, ব্যস। অনেক হয়েছে। কাল না হয় দেখা যাবে।”
উজ্জ্বল কপাল কুঁচকে পুষ্পের দিকে তাকালো। পুষ্প গাড়ির কাছে এসে বলল,
“একদিনে রোমিও হওয়া যায় না। একটু সময় নিলে ভালো।”
উজ্জ্বল মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“তোর মাথায় গোবর ছাড়া কিছুই নেই। আমি জাস্ট ফরমালিটি মেইনটেইন করছি।”
“খুব ভালো। তোর ফরমালিন যুক্ত ফরমালিটি দেখাতে হবে না।”
“তোর এতো কেন জ্বলছে? ছবি তুলে দেই নি তাই? না-কি দেবদাস থেকে প্রমোশন পেয়ে রোমিও হয়ে যাচ্ছি, আর তুই রীতিকার নাম ধরে আর জ্বালাতে পারবি না তাই! কোনটা?”
“দু’টোই। একটা ছবিও তুই সুন্দর করে তুলে দিস নি। ইচ্ছে করে করেছিস সব।”
“ভালো করেছি। এবার আমাকে ভবিষ্যতে আর ক্যামেরাম্যান বানাবি না।”
পুষ্প মুখ ছোট করে উপরে চলে এলো। এদিকে আহি ফ্রেশ হয়ে মাত্রই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে তখনই তাজওয়ারের কল এলো। তাজওয়ারের নম্বর দেখেই আহির মেজাজ বিগড়ে গেলো। সে কলটা কেটে রাদের নম্বরে ডায়াল করলো। ওপাশ থেকে সাথে সাথেই কলটা রিসিভ হলো। আহি বলল,
“ফোন হাতে নিয়ে বসে ছিলি না-কি?”
রাদ গম্ভীর কন্ঠে বলল,
“বান্ধবীকে পেয়ে বন্ধুর কথা মনেই রাখিস নি!”
“সরি, সকাল থেকেই বাইরে ছিলাম।”
“কোথায় কোথায় গেলি?”
“চা বাগান, সাদা পাথর এই দুই জায়গায় গেলাম।”
“ভালো তো। এখন, কেমন আছিস বল?”
“ভালো আছি। তবে মাকে মিস করছি।”
“কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
রাদ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। আহিও নীরব। রাদ এবার নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“আহি, তোকে অনেক দিন দেখি নি তাই কেমন যেন অস্থির লাগছে।”
“কেন?”
“জানি না।”
“মন খারাপ তোর?”
রাদ মলিন মুখে বললো, “না।”
“তোর এই না মানেই তো হ্যাঁ। বল না রাদ। কি হয়েছে?”
রাদ প্রসঙ্গ পালটে বলল,”তুই কখন আসবি?”
“আসবো তো আগামীকাল।”
“কয়টায় আসবি?”
“রাত হবে।”
“পুষ্পের সাথে আসবি?”
“আসার তো ইচ্ছে আছে। এখন সিচুয়েশনের উপর নির্ভর করছে। বাবা যদি তাজওয়ারকে পাঠায়, তাহলে ওর সাথেই আসতে হবে।”
“রাতে ওই ছেলের সাথে আসবি? ভালো লাগছে না আহি। আসিস না এভাবে।”
“তুই ভয় পাচ্ছিস?”
“অবশ্যই পাচ্ছি।”
আহি নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“কিছু হবে না আমার। ও আমার সাথে খারাপ কিছু করবে না।”
“ওভার কনফিডেন্স রাখা ভালো না। বাসে করে আসিস। ট্রেনে আসলে ক্যাবিন ভাড়া করিস না। ওই ছেলের সাথে একা এক সেকেন্ডও থাকবি না।”
আহি মিষ্টি হেসে বলল,
“তুই যদি আমার বাবা হতি।”
রাদ শব্দ করে হাসলো। আহি বলল, “হাসছিস কেন?”
“তুই যখন পৃথিবীর আলো দেখেছিস, তখন আমি ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারতাম না।”
“ইশ! যদি তুই আমার বাবা হতি।”
“চুপ কর। তুই যদি আমার মেয়ে হতি কয়েশ বার তোর কান মলে দিতাম।”
“সাহস থাকলে দে। আমিও তোর কান মলে, টেনে, ছিঁড়ে কান ছাড়া করে ছাড়তাম।”
“বাবার সাথে বেয়াদবি! কি দিন দেখতে হচ্ছে!”
“মেয়েকে বেশি শাসন করলে এমনই হয়।”
“ছি! ছি! এমন ব্যবহার দেখার আগে আমি মরে কেন গেলাম না। সন্তানের কাছে এমন ব্যবহার মোটেও কাম্য নয়।”
আহি রাদের কথা শুনে হাসতে লাগলো। রাদ মুচকি হেসে বলল,
“আচ্ছা রেস্ট নে। পরে কথা হবে।”
আহি কল কেটে দিতেই রাদ ফোনটা বুকের উপর রেখে মুচকি হাসলো। আর মনে মনে বলল,
“তোর এই মিষ্টি হাসিটাই আমার মন ভালো করার ওষুধ। মিস ইউ আহি।”
রাদের কল কাটতেই আহির ফোনে আবার তাজওয়ারের কল এলো। এবার আহি ফোন সাইলেন্ট করে দিয়ে মনে মনে বলল,
“শ’খানেক কল দেওয়ার পরই আমি তোমার কল রিসিভ করবো, মিস্টার তাজওয়ার খান। তোমাকে বুঝতে হবে, আহির অ্যাপয়েনমেন্ট পাওয়াও এতো সহজ নয়।”
চলবে-