#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৫||
৪৫।
আহি চট্টগ্রামে ফিরেছে দুই দিন হচ্ছে। এই দুই দিনে আহি একবারো ক্যাম্পাসে যায় নি। কিন্তু আজ তাকে যেতেই হবে। এই মাসে অনেকগুলো ক্লাস বাদ দিয়ে ফেলেছে সে। আগামী সপ্তাহ থেকে ক্লাস টেস্ট শুরু হবে। তাই বাধ্য হয়েই সে ক্যাম্পাসে চলে এলো। আহি ক্লাসে ঢুকতেই আফিফের মুখোমুখি হলো। এতোদিন পর আহিকে দেখে আফিফও চমকে উঠলো।
এদিকে আহি আফিফকে দেখে আবার দুর্বল হয়ে পড়লো। সে এক দৃষ্টিতে আফিফের দিকে তাকিয়ে আছে। আহির এমন চাহনি দেখে আফিফ তাকে পাশ কেটে চলে যেতেই আহির ঘোর কাটলো। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেঞ্চে এসে বসলো।
(***)
আহি ক্লাস চলাকালীন সময়ে একটু পর পর আফিফের দিকে তাকাচ্ছে। আফিফের চোখ-মুখ লাল হয়ে আছে। যদিও আজ রোদ উঠেছে। তবুও বাতাবরণে মিষ্টি হাওয়ার ছোটাছুটি চলছে। আফিফ কি তবে অসুস্থ? আহির মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। সে চোখ বন্ধ করে নিজের বেঞ্চে বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“ভীষণ অস্থির লাগছে আমার। তুমি আমার পাশে থেকেও কেন এতো দূরে? ইচ্ছে করছে যত্নের সাথে তোমার রক্তিম গালটি ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু এই স্পর্শটাও অনুভব করা ছাড়া উপায় নেই।”
ক্লাস শেষ হতেই আফিফ বেরিয়ে পড়লো। লাঞ্চ টাইম শেষে আবার দুই ঘন্টার ক্লাস। আহি আফিফের পিছু পিছু বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্য ক্যান্টিনে গিয়ে দুপুরের খাবার খাওয়া৷ আফিফও ক্যান্টিনেই এসেছে। সে খাবার নিয়ে কোণায় গিয়ে বসে পড়লো। আহিও খাবার নিয়ে আফিফের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। আফিফ আহিকে তার পাশের চেয়ারে বসতে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। আহি বলল,
“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনার অস্থির লাগছে! আপনি কি অসুস্থ?”
আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “হুম।”
“কি হয়েছে?”
“হালকা জ্বর।”
আফিফের জ্বর এসেছে শুনেই আহি হাত এগিয়ে দিতে গিয়েই থেমে গেলো। আফিফ দেখেও যেন দেখলো না। সে চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আহিও ইতস্ততবোধ নিয়ে খেতে লাগলো। মনে মনে বলল,
“কি দরকার ছিল আফিফের পাশে এসে বসার?”
পরক্ষণেই আহি ভাবলো,
“এটা সৌজন্যমূলক প্রশ্ন! এখানে এতো ভাবাভাবির কিছুই নেই। পরিচিত একজন মানুষকে অসুস্থ দেখলে, যে-কেউ পাশে বসে কথা বলবেই।”
আহি এবার নীরবতা কাটিয়ে বলল,
“অফিস আর ক্লাস একসাথে কীভাবে সামলাচ্ছেন?”
“আমি যেই সেক্টরে কাজ করি, ওখানে আপতত ট্রেনিং চলছে। কয়েক মাস পর চাকরি স্থায়ী হবে। ততোদিনে ক্লাস করতে অসুবিধে হবে না।”
“যখন রেগুলার অফিস করতে হবে তখন?”
“হয়তো ক্লাস গ্যাপ হবে। তখন শুধু পরীক্ষাটাই দিতে আসবো।”
আহি গালে হাত দিয়ে আফিফের কথা শুনছে। এতো বছরের এক তরফা ভালোবাসা, আর এই প্রথম আহি আফিফের মুখোমুখি বসে আছে আর কথা বলছে। মুহূর্তটি আহির কাছে ভীষণ সুন্দর মনে হচ্ছে। যদিও আফিফের সাথে আগেও অনেকবার কথা হয়েছিল তার। কিন্তু এই প্রথম বসে শান্তভাবে কথা বলছে। আহি মনে মনে ভাবছে,
“যদি তোমার স্থায়ী শ্রোতা হতে পারতাম। তুমি বর্ষণের মতো তোমার একের পর এক বাক্য ঝরাতে। আর আমি মুগ্ধ হয়ে সেই বাক্যের স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম।”
আফিফ গলা খাঁকারি দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“অনেক দিন ক্লাসে আসো নি!”
আহি মুচকি হেসে বলল, “সিলেট গিয়েছিলাম।”
হঠাৎ পেছন থেকে পদ্মের কন্ঠ শুনে আফিফ আর আহি দু’জনই অবাক হলো। আহি পদ্মকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পদ্ম আহির কাছে এসে বলল,
“কেমন আছিস?”
“আমি তো ভালোই। দেখছি, তোর বর অসুস্থ অনেক।”
“হ্যাঁ, ওর জন্যই তো এলাম।”
পদ্ম আফিফের পাশে বসেই একটা টিফিনবক্স রেখে বলল,
“নাস্তাও করেন নি, আবার লাঞ্চ বক্সটাও না নিয়ে চলে এসেছেন। এখনো রাগ করে আছেন?”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাদের দিকে তাকালো। আফিফ এক নজর আহির দিকে তাকাতেই আহি তার প্লেট হাতে নিয়ে চলে যেতে নিবে তখনই পদ্ম বলল,
“আহি, তুইও বসতে পারবি।”
আহি শুকনো হেসে বলল,
“আরেহ না। আমি ক্লাসে উনাকে অসুস্থ দেখলাম, ভাবলাম খেতে খেতে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে। তাই বসা। এখন তো প্রাইভেসি দিতে হবে।”
পদ্ম বলল,
“এমন কিছুই বলবো না। বসতে পারিস।”
আফিফ পদ্মের হাত ধরে আটকালো। আহি বিষয়টা খেয়াল করতেই তাড়াতাড়ি চলে এলো।
(***)
উল্টোদিকে ফিরে বসেছে আহি। পদ্ম না হয় সৌজন্যমূলক ভাবে বসতে বলেছিল। আহি তো কখনোই তাদের মাঝখানে বসতো না। তাহলে কেন শুধু শুধু পদ্মের হাত ধরে থামাতে হলো আফিফের? বিষয়টা আহির ভীষণ খারাপ লেগেছে। এই মুহূর্তে আহির চোখ দু’টি ছলছল করছে। সে একসাথে খাচ্ছে আর কাঁদছে। আর মনে মনে ভাবছে,
“আমি আর কখনোই নিজ থেকে তোমার সাথে কথা বলতে যাবো না, আফিফ।”
আহি খাওয়া শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পেছনে তাকাতেই দেখলো পদ্ম আফিফের মুখে লেগে থাকা খাবারগুলো টিস্যু দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আহির বুকটা কেমন যেন কাঁপতে লাগলো। সে হাত ধুয়ে নিচে নামতেই তার মনে হলো গলায় কি যেন আটকে আছে। কয়েক পা এগিয়ে সে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো, আর গলগল করে বমি করে দিলো। প্রায় মিনিট দশেক পর আহি দুর্বল শরীরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই দেখলো পদ্ম আর আহি ক্যান্টিন থেকে নামছে। আর পদ্ম আফিফের হাত ধরে রেখেছে। আহি জানে এই হাত ধরার অধিকার পদ্মেরই। কিন্তু তার মনটা তবুও মানছে না। এতোদিন সে ভালোই ছিল। কিন্তু একাকীত্ব আর আফিফের ভাবনা তাকে আবার রোগী বানিয়ে দিয়েছে। এরপর আহি আর পরের ক্লাসগুলো না করেই বাসায় চলে এলো।
বাসায় এসেই আহি বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। নিজের বুকে হাত রেখে বলল,
“বাঁচার জন্য আমার হাতে দুইটা রাস্তা খোলা আছে। এক, আফিফকে ভুলে যাওয়া। দুই, আফিফকে ভুলে থাকার জন্য যা যা করতে হয় সবটাই করা। কিন্তু আমি আফিফকে ভুলে থাকতেই পারছি না। ক্লাসে ওকে দেখা, বাসায় সারাদিন একা একা বসে ওকে ভাবা। যখন মায়ের সাথে ছিলাম, আমি একটুও আফিফকে মনে করে কষ্ট পাই নি। তাহলে আফিফকে ভোলার জন্য আমার মায়ের সাথেই থাকতে হবে। যেটা এই মুহূর্তে মোটেও সম্ভব না। তাহলে আমার হাতে আর একটাই পথ খোলা, সেটা হলো আফিফকেই ভুলে যাওয়া। যেটা আমি পারছি না। কীভাবে ভুলবো আমি ওকে?”
হঠাৎ আহির মনে পড়লো কেউ একজন তাকে বলেছিল,
“মানুষের মন জানালার মতো। জানালা খুলে দিলে যেমন মিষ্টি হাওয়া প্রবেশ করে, তেমনি বন্ধ রাখলে গুমোট বাতাবরণের সৃষ্টি হয়। জীবনটাও ঠিক তেমন। মনের জানালা খুলে দিবেন, সুখ-দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নিবেন, তবেই স্বস্তি পাবেন। আর বন্ধ রাখবেন তো নিজেকেই ধীরে ধীরে হত্যা করবেন।”
কথাটি আহির মনে পড়তেই সে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে তার হ্যান্ডব্যাগটা বের করলো। এরপর ব্যাগ ঘেঁটে সেই কার্ডটি বের করলো, যেটা সেই প্লেনে থাকা আগন্তুকটি তাকে দিয়েছিল। কার্ডের উপর লেখা, নায়ীব তামজিদ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। জামালখানেই তার চেম্বার। আহি এবার রাদকে ফোন করলো। রাদ হ্যালো বলতেই আহি বলল,
“আমি ডাক্তার দেখাতে চাই।”
“হ্যাঁ!”
“আমি ট্রিটমেন্ট শুরু করবো ভাবছি।”
রাদ আনন্দিত কন্ঠে বলল,
“আমি সত্যিই তোর ডিসিশনে অনেক খুশি। ফাইনালি তুই ওই তেলাপোকাকে ভুলে থাকার জন্য একটা স্টেপ তো নিচ্ছিস! আচ্ছা, আমি দেখছি কোন ডাক্তার ভালো হবে।”
“রাদ, আমি আজই যাবো। বাবা দেশে আসার আগেই আমি ডাক্তার দেখিয়ে ফেলতে চাই। আমার কাছে একজন সাইকায়াট্রিস্টের নম্বর আছে। জামালখান বসে। চল সেখানেই যাই।”
“ওকে, আজ সন্ধ্যায় বসবে তো?”
“হ্যাঁ।”
“ওকে, ডান।”
আহি ফোন কেটে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফিফের ছবি হাতে নিয়ে বলল,
“তোমাকে তো আমি কখনোই ভুলবো না, এআর। কিন্তু আমি চাই না, আমার ভালোবাসা দুর্বল হোক। আমি জুলিয়েট হতে চাই না। এমন প্রেমিকা হতে চাই, যে তার ভালোবাসার মানুষকে স্মৃতিতে রেখেও ভালো থাকবে। তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা আমার দুর্বলতা না হোক, আমার শক্তি হোক। যেটা এতোদিন আমি শক্তি ভেবেছি, সেটাই আমার দুর্বলতা ছিল। তোমাকে দেখার পর থেকে আমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়ছি। তোমার আর পদ্মের কাছাকাছি আসা আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমি এখনো শক্ত হতে পারি নি। অন্তত তোমার সুখের জন্য আমি শক্ত হবো। আমি চাই না, পদ্ম কখনো জানুক, তুমিই আমার এআর।”
চলবে-