মেঘের_শহর #পর্ব_১৭ Saji Afroz .

0
135

#মেঘের_শহর
#পর্ব_১৭
Saji Afroz
.
.

জিকো ক্লাস করাবে বলেও ক্লাসে যায়নি গতকাল।
মোখলেসের জোরাজোরি তে সে অনাথ আশ্রমে আসতে বাধ্য হলো আজ। তার কোনো ইচ্ছেই ছিল না এখানে আসার। কিন্তু শেষমেশ না এসে পারেনি। মোখলেস তাকে বুঝিয়েছে। এছাড়া আর কোনো কাজের ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে না। আর এখন থেকে কোনো সমস্যা হবে না জিকোর। মোখলেসের কথায় ভরসা পেয়ে সে এখানে এসেছে।
ধীরপায়ে মোখলেসের সাথে হেঁটে ক্লাস রুমে প্রবেশ করলো জিকো। ক্লাসের সবাই তাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়লে মোখলেস সবাই কে বসতে বলল। সবার সাথে জিকো কে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল-
ম্যাডাম কে যদি জ্বালাতন করো তবে আমি ভীষণ কষ্ট পাব। আর আসবোই না তোমাদের সাথে দেখা করতে। ভালো বাচ্চাদের মতো চুপচাপ পড়বা। কিছু না বুঝলে জিজ্ঞাসা করবা। কোনো দুষ্টুমি নয়।

.
সকলে একইসাথে বলে উঠল-
আচ্ছা ভাইয়া।
.
বাচ্চা গুলোকে এত শান্ত দেখে অবাক হলো জিকো। তারা কি শুধু মোখলেসের সামনেই ভালো সেজে আছে না কি আসলেই ভালো হয়ে গেছে?
-তবে আমি আসি? কেউ দুষ্টুমি করলে তার নামটা শুধু আমাকে বলবে। আমি তার সাথে কথাই বলব না।
-আচ্ছা।
.
মোখলেস চলে গেলে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকালো জিকো। সবাই নিশ্চুপ। ব্যাগ থেকে বই, খাতা, পেন্সিল বের করতে ব্যস্ত।
জিকো সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চেঁচিয়ে বলল-
ভালো আছ সবাই?
.
সকলে বলল-
জি। আপনি?
-ভালো। তবে এবার ক্লাস শুরু করা যাক?
-জি।
.
জিকো ক্লাস শুরু করলো। আশ্চর্য! সকলে মনোযোগ সহকারে পড়ছে। কেউ কোনো দুষ্টুমি করছে না। মোখলেসের মাঝে এমন কি আছে যার কারণে সবাই তাকে এত ভালোবেসে তার কথা শুনে?
-ম্যাডাম?
.
পাশ ফিরে সেই বাচ্চাটিকে দেখলো জিকো, যে কি না সেদিন ক্লাসে বাথরুম সেরেছে।
-ম্যাডাম আমার পটি এসেছে।
.
জিকো তাড়াহুড়ো করে বলল-
চলো আমি নিয়ে যাই।
-আমি নিজেই করতে পারব।
.
এই বলে বাচ্চাটি দৌড়ে চলে গেল।
জিকো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস সেদিনের মতো ক্লাসেই কাজ সারেনি বাচ্চাটি।

.
.
.

বেলী শেখ দুপুরের খাবারের জন্য টেবিল সাজাচ্ছেন। চেয়ার টেনে বসলেন জাফর শেখ। তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।
বেলী শেখ তার চিন্তার কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন-
হুরের কথা ভাবছি৷ মেয়েটার কাছে ছবি পাঠানো তো হয়েছে। রাজি হবে কি না ভাবছি।
-এই বিষয়ে আমিও ভাবছিলাম। প্রথম প্রেমিক কে সে ভুলতে পারেনি এখনো।
-একজন মৃত ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে জীবিত মেয়েটা কতদিন ভালো থাকতে পারবে?
-সেই চিন্তা আমারো। কিন্তু কি করব? সে তো কিছুই বুঝে না। অবশ্য ছেলেটাও তাকে ভীষণ ভালোবাস তো।
-তাই তো তার নাম দিয়েছিলাম আমি মজনু। ভালোই ছিল ছেলেটা। পরিবারও ভালো। সব ঠিকঠাক। মাঝখানে এক্সিডেন্ট টা হয়ে অকালে প্রাণ হারালো সে।
-আর আমাদের মেয়ে জীবিত থেকেও মৃত হয়ে গেল।
-কেমন হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি মনে আছে? নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছিল। সেই তখন থেকেই তাকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি আমি।
-বিয়ে না করার অজুহাতে পড়াশোনার দিকে ঝুকেছে।
-নিজের সব কাজ গুলোও নিজেই করে। এমন কি রান্নাটাও।
-এসব করে সময় কাটিয়ে ছেলেটি কে ভুলে থাকতে চায় সে।
-কিন্তু আর কতদিন? দুই বছর তো হলো।
.
বেলী শেখের দুচোখ পানিতে ভরে উঠেছে। এখুনি যেন বৃষ্টির মতো ঝরে পড়বে। তিনি নিজের চোখের পানি আড়াল করার জন্য রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। জাফর শেখ বুঝতে পারলেন, তার স্ত্রী এখন নিরবে চোখের জল ফেলবেন।
বেলী শেখ রান্নাঘরে এসে মুখে শাড়ির আঁচল টা চেপে কাঁদতে লাগলেন।
এই পর্যন্ত হুরায়রা কে বিয়ে দেয়ার কম চেষ্টা তারা করেনি। আগে গোপনে চেষ্টা করলেও ইদানীং এলাকার সবার কানে কথাটি গিয়েছে যে, হুরায়রার জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে। যার কারণে তার জন্য প্রায় বিয়ের প্রস্তাব আসে। এতে হুরায়রা বিরক্ত হয়। এই তো সেদিনই একটা পরিবার কে অপমান করেছে সে। আর সেইজন্য বেলী শেখের এত চিন্তা। মেঘের পরিবারের সাথেও না আবার এসব করে বসে সে।
.
.
.

ভার্সিটি থেকে এসে গোসল করে ছাদে এসেছে সাইয়ারা কাপড় শুকোতে দিতে। মেঘ কে দেখে তার ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠল। দু’জনের চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিলো সাইয়ারা। চুলে পেঁচানো তোয়ালে টা খুলে চুল মুছতে মুছতে ভাবলো, আজ সে নিজ থেকে মেঘের সাথে কথা বলবে না। আজ দেখবে মেঘ কি করে।
মেঘও এসেছে কাপড় শুকোতে দিতে। সাইয়ারা আজ কথা বলেনি দেখে খানিকটা অবাক হলো সে। তাই তাকে ডেকে বলল-
আজ কি তোমার মেজাজ ভালো নেই?
.
ভ্রু কুচকে সাইয়ারা বলল-
কেনো বলুন তো?
-চুপচাপ আছ তাই বললাম।
-কার সাথে কথা বলব এখানে?
-আমাকে কি মানুষ মনে হয় না?
-কথা বলার মতন না।
.
মেঘ বুঝতে পারলো সাইয়ারা এমন কেনো বলছে। তাকে এড়িয়ে চলার কারণেই সে এসব বলছে।
মেঘ দুটো কারণে তাকে এড়িয়ে চলেছিল। এক, তার মা তাকে ভুল বুঝেছে। দুই, সে হুরায়রার বিষয়ে বিষণ্ণ ছিল।
মায়ের দিক টা সমাধান হলেও হুরায়রার দিক টা এখনো হয়নি। ওবাড়ি থেকে এখনো কোনো খবর আসে নি। হুরায়রা কে কি ছবি এখনো পাঠানো হয় নি? ছবি দেখলে সে মেঘ কে চিনে ফেলবে। তখন কি হবে? সে কি রাজি হবে না কি বলবে, মেঘ ছেলেটা কে আমার পছন্দ নয়!
-কি ভাবছেন?
.
সাইয়ারারব প্রশ্নে ঘোর কাটলো মেঘের। সে বলল-
কিছু না। ক্লাসে গিয়েছিলে আজ?
-হু। কেনো?
-এমনিতেই জানতে চেয়েছি। প্রায় তো তোমাকে বাসায় দেখা যায়।
-আমি হুরায়রা না যে প্রতিদিন ক্লাস করব।
.
সাইয়ারার মুখে হুরায়রার নাম শুনে চমকে উঠল মেঘ। মেঘ বলল-
বুঝলাম না?
-না বুঝাই স্বাভাবিক। আমাদের ক্লাসে এক মেয়ে আছে যার নাম হুরায়রা। নিয়মিত ক্লাসে আসে সে। আপনি জেনে অবাক হবেন, সে এই দুই বছরে কখনো ক্লাস মিস দেয়নি। কিন্তু…
-কি?
-গতকাল এবং আজ সে ক্লাসে আসেনি। ক্লাসের অন্যান্য স্টুডেন্ট দের সাথে স্যার ও ম্যাডাম রাও বেশ অবাক হয়েছে। খবর নেয়ার জন্য তার নাম্বারে ফোনও দিয়েছে মিরাজ স্যার। কিন্তু ফোন নাম্বার বন্ধ। নিয়মিত স্টুডেন্ট বলে দুইদিন না আসতেই সবাই টেনশন করছে। আমি ভাবছি আমিও নিয়মিত ক্লাস করা শুরু করব। তখনও সবাই অবাক হয়ে যাবে। বলবে সাইয়ারা কিভাবে নিয়মিত ক্লাস করছে!
.
কথাটি বলে হাসতে থাকলো সাইয়ারা। কিন্তু মেঘ গভীর ভাবনায় মগ্ন। এই হুরায়রা কি তার হুরায়রা?
.
হাসি থামিয়ে সাইয়ারা বলল-
আবার কি ভাবছেন?
.
মেঘ ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে বলল-
আচ্ছা তুমি যার কথা বললে সে কি ভীষণ চুপচাপ?
-হ্যাঁ। কারো সাথে মিশেনা। তার কোনো বন্ধু বান্ধবও নেই।
-দেখতে অনেক সুন্দরী?
-হু। সবসময় লম্বা চুল গুলো খোলা থাকে।
.
মেঘের আর বুঝতে বাকি রইলো না সে তার হুরায়রার কথাই বলছে।
সাইয়ারা একটু থেমে বলল-
এক সেকেন্ড! আপনি কি করে এত কিছু জানেন?
.
মেঘ কিছু বলার আগেই অন্তরা আহম্মেদ দ্রুত গতিতে মেঘের পাশে এসে বললেন-
মেঘ, ওবাড়ি থেকে ফোন এসেছিল।
.
ছুটে আসার কারণে অন্তরা আহম্মেদ হাঁপিয়ে উঠেছেন। তবুও তার চোখেমুখে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। বরং আনন্দের ছাপ বিদ্যমান।
মেঘ কপালে চিন্তার রেখা টেনে বলল-
কি বলেছে?
-হুরায়রা এই বিয়ে তে রাজি হয়েছে।
.
কথাটি নিজের কানে শুনেও যেন মেঘ বিশ্বাস করতে পারছে না। খুশিতে সে অন্তরা আহম্মেদ কে জড়িয়ে ধরলে সাইয়ারা বলল-
কে কার বিয়ে তে রাজি হয়েছে?
.
মেঘ কে ছেড়ে অন্তরা আহম্মেদ তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। তিনি সাইয়ারা কে খেয়ালই করেন নি। মেঘের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন-
তুই বল ওকে আমি মিন্নী কে খবর টা দিই। ফোন পেয়েই এখানে চলে এসেছি। যার কারণে বলা হয়নি।
.
অন্তরা আহম্মেদ ছুটে নিচে চলে গেলেন।
সাইয়ারা হেসে বলল-
আমাকেও তো বলেন আপনারা এত খুশি কেনো?
-এতক্ষণ তুমি যে হুরায়রার কথা বলেছ, তাকে আমি ভালোবাসি। তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলাম। রাজি হয়েছে সকলে।
.
চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here