পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ বাইশ

0
286

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ বাইশ

অবাক জোছনায় ভরা রজনী। ক্যানভাসের মতন যেন রং-তুলিতে এঁকেছে রাত। টানা সপ্তাহখানেক বর্ষণের পর আজ প্রকৃতি ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত। পৃথিবীতে ঢেলে দেওয়ার জন্য যেন এ বিশাল আকাশের বুকে কোনো জলবিন্দু অবশিষ্ট নেই। তাই সে বিশাল বর্ষণের পর ছুটি নিয়ে জোৎস্না ভরা রাত্রি উপহার দিয়েছে ধরণীর বুকে।

জায়গাটা ঠিক সিলেটের জাফলং। প্রকৃতির কন্যা বলা হয় যাকে। কী তার যৌবনা! সৌন্দর্যতা! তাকে দেখলে মনে হয় যেন কোনো অষ্টাদশীর হাসি। মনে হয় স্বপ্নের কোণে যত্নে গড়া বিলাসিতার প্রাচুর্য। বড় বড় পাহাড় ভেদ করে যখন অবাক জোৎস্না ছড়ায় চাঁদ, তখন মনেহয় সৃষ্টিকর্তা বড় যত্ন করে গড়িয়াছে এ প্রকৃতি। তবে প্রকৃতির কন্যা আজ বিধ্বস্ত, বন্যায় ভেসে গেছে তার অর্ধেক প্রাচুর্য। কী যে মূমুর্ষ অবস্থা তার! তার কোলে বেঁচে থাকা প্রাণ গুলো আজ বাস ভূমি হারা, হাহাকার মিশে গেছে বিশাল পাহাড়ের কানায় কানায়। তাদের একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেই পুরো দেশের জায়গা জায়গা থেকে ছুটে আসছে মানুষ। কেউ খাদ্য, কেউ বস্ত্র,কেউ চিকিৎসার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সে বাড়িয়ে দেওয়া হাত গুলোর মাঝে দর্শিনী, দৃষ্টান্ত,তৃণা,মৃত্যুঞ্জয়, বিহঙ্গিনী সহ আরও কত যুবক যুবতীর হাত আছে। যারা এ প্রাণ গুলোকে দিতে চাচ্ছে নিরাপত্তা।

জাফলং জিরো পয়েন্টে বন্যা হওয়াতে দর্শিনীরা ক্যাম্পিং করেছে এখানে। বিগত পাঁচদিন যাবত তারা এখানেই আছে। অক্লান্ত পরিশ্রম দিয়ে গেছে বন্যায় ভুক্তভোগী মানুষের পিছে। পরিস্থিতি কিছুটা এখন হাতের মুঠোয়।

ঘড়ি কাটায় সময় এখন তিনটা পনেরো। দর্শিনী দাঁড়িয়ে আছে তাদের তাবুর বাহিরে। তাবুর পূর্ব দিকে বিশাল ঝর্ণা। অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে সেদিক থেকে। দর্শিনীর দৃষ্টি সেখানেই নিবদ্ধ। মনের মাঝে তার বিশাল দ্বন্দ্ব। সেদিন বাচ্চাটার কথা শোনার পর কেউ বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেয় নি বরং তার আদর যত্ন একটু বেড়েছে। তবে মা আর নিপা বৌদি কেমন থম মেরে আছে। এটা অবশ্য জানা কথা যে মা আর বৌদি এমন কিছুই করবে। দর্শিনী তো ভেবে ছিলো এর চেয়ে বেশি কিছুই করবে। কিন্তু না,তেমন কিছুই হয় নি। এর জন্য সে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে হাজার বার।

“ঘুমান নি কেনো, প্রিয়দর্শিনী? এত রাত অব্দি জেগে আছেন যে?”

রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠটা ঝংকার তুললো যেন প্রকৃতিতে। সামান্য কেঁপে উঠলো রমনী। ভাবনায় ব্যস্ত থাকা অক্ষি গুলোর কোণায় চিকচিক করা অশ্রুবিন্দু গুলোকে বার কয়েক চোখের পাপড়ি ঝাপটিয়ে নিরুদ্দেশ করে দেওয়ার চেষ্টা চালালো। অতঃপর পিছনে ঘুরে দৃষ্টি দিলো সুঠাম দেহী পুরুষটার দিকে। ছেলেটার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে নির্দ্বিধায়। কিন্তু চোখ মুখে এখনো যেন চব্বিশের লাবণ্যতা। মুখমন্ডলে ফুটে আছে ভিনদেশী ভাব। শরীরে রং একটু বেশিই সুন্দর। যেন এই আঁধার রাতেও দীপ্ত দিছে কেমন অবলীলায়।

দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মৃত্যঞ্জয় এগিয়ে এলো আরও দু’কদম। কণ্ঠের গাম্ভীর্যতা আরেকটু বাড়িয়ে বললো,
“এত বাতাসের মাঝে এখানে এমন দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? আর রাত কত হয়েছে সে খেয়াল আছে? নাকি দেবদাসী হয়ে ঘোরা ছাড়া কোনো খেয়ালই আপনার মাথায় থাকে না?”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথায় দর্শিনী ক্ষাণিকটা ভ্রু কুঁচকালো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“আমি দেবদাসী হয়ে কখন ঘুরলাম?”

“এখন সেটাও আমাকে বলে দিতে হবে? আপনার চাল-চলন হাবভাবে এখনও দেবদাসীর ছোঁয়া। কেনো? একটু হাসতে পারেন না নাকি? অদ্ভুত!”

“আজকাল দেখছি আপনার মুখেও বেশ কথা ফুটেছে! আগে তো ভাবতাম আপনি তত কথা বলতে জানেন না।”

মৃত্যুঞ্জয় গম্ভীরমুখে কিছু বলতে গিয়েও দর্শিনীর কথায় হেসে উঠেছে। অনবরত গড়িয়ে পড়তে থাকা ঝর্ণার স্বচ্ছ, সুন্দর জলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
“আগে আমার কথা আপনার শোনার প্রয়োজন মনে হতো না, আমি বললেও আপনি হয়তো এখনের মতন মনযোগ দিয়ে শুনতেন না, তাই বলি নি।”

মৃত্যুঞ্জয়ের এমন উত্তরে দর্শিনীর যেন ভাষা কেড়ে নিলো। সে অবাকের সপ্তম পর্যায়ে উঠে বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে আমার মুডের উপর ডিপেন্ড করে আপনার শব্দকণিকারা বাক্য বুনে? বাহ্! ইন্টারেস্টিং।”

“আপনার কাছে ইন্টারেস্টিং হতে পেরে আমার হৃদয়ও পিঞ্জিরা ছলাৎ করে উঠলো। আমি ধন্য যে, মেডাম।”

দর্শিনী খিলখিল করে হেসে উঠলো। হাসির সাথে দোল খেলো যেন শক্ত পাহাড়ের কোণ থেকে শুরু করে সুঠাম দেহী মানবের বক্ষ। এই বিধ্বস্ত জাফলংও যেন রঙিন হলো।

_

“এটা কী চাঁদ দেখানোর সময়,তৃণা?”

ঘুমঘুম বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লো দৃষ্টান্ত। তৃণা দৃষ্টান্তের বাহু আঁকড়ে ধরে মিষ্টি হেসে বললো,
“হ্যাঁ, এখনই চাঁদ দেখার সময় দৃষ্টান্ত দা। দিনের বেলা তো আর চাঁদ থাকে না, চাঁদ তো রাতের বেলাতেই পাওয়া যায় তাই না? আর তাছাড়া আজ কতগুলো দিন পর চাঁদ উঠেছে,সে খেয়াল আছে তোমার? একটু দেখো না, চোখের কোণা থেকে কেমন করে জোৎস্না গড়িয়ে পড়ে।”

তৃণার আকুতি মাখা কণ্ঠে ঘুম ছুটে দৃষ্টান্তের। তৃণার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে নরম কণ্ঠে বলে,
“আমার হৃদয় আঙিনায় তো রোজ নিয়ম করে তৃণা নামক চন্দ্রিমা জোৎস্না ছড়ায়। সে জোৎস্নার কাছে এ জোৎস্না যে কিছুই না মোর, তৃণশয্যা।”

তৃণা লজ্জা পায়, আরেকটু গুটিয়ে যায় দৃষ্টান্তের বক্ষ মাঝে। চাঁদ তার জোৎস্নার রঙ আরেকটু বাড়িয়ে দেয় কপোত-কপোতীদের মিষ্টি প্রেম দেখে। তৃণা মৃদু হাসে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশাল ধন্যবাদ দেয় এক নারীকে। সে মানবী অবুঝ হয়েছিলো বলেই হয়তো আজ দৃষ্টান্ত তার।

_

মায়া কলেজ যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। গত সপ্তাহেই সে এখানের একটা বেশ খ্যাতনামা কলেজে ভর্তি হয়েছে। বিপ্রতীপ নিজে গিয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়ে এসেছে। বাড়িটা কেমন যেন মৃত্যুপুরীর মতন ঠেকছে মায়ার কাছে। কেমন নিস্তব্ধতা ঘেরা। মোহনা মাঝে মাঝে হুংকার না দিলে বোঝা’ই যায় না বাড়িটাতে মানুষজন যে বাস করে। কেমন অদ্ভুত বাড়ি!

বিপ্রতীপ গলার টাই বাঁধতে ব্যস্ত। সেও একটু পর অফিসের জন্য বের হবে। মায়াও নিজেকে পরিপাটি করে নিচ্ছে কলেজ যাওয়ার জন্য। কিন্তু চুল বাঁধতে গিয়ে বাঁধলো বিপত্তি। গতকাল ভাঙা কাচের গ্লাসের টুকরো উঠাতে গিয়ে তার ডান হাত বিশ্রী ভাবে কেটে গিয়েছে। এখন সে হাতে জোর দিয়ে মাথায় চিড়ুনি চালান করতে পারছে না।

মায়া কতক্ষণ চেষ্টা করে অবশেষে হতাশার শ্বাস ফেললো। নাহ্,তার দ্বারা এ কাজ সম্ভব না। মন খারাপ করে যেই চিড়ুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে যাবে তখনই বিপ্রতীপ মায়ার কাছ থেকে চিড়ুনিটা নিয়ে নেয়। মায়া অবাক হয়ে যায়। মায়াকে আরও এক ধাপ অবাক করে দিয়ে বিপ্রতীপ নিজের হাতের চিড়ুনিটা মায়ার মাথায় চালান করে। খুব ধীরে,যত্নে গুছিয়ে দেয় মায়ার এলোমেলো চুল। মায়ার যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার উপক্রম। সে বিষ্ময়ে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে। আজকাল বিপ্রতীপের ব্যবহার তার কাছে অদ্ভুত লাগে। কেমন যেন মাঝে মাঝে ঘোর লেগে যায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এ লোকটার মোহে পড়ে যাচ্ছে সে। এ কেমন অনুভূতি! এমন অনুভূতির কারণই বা কী!

মায়া সামলে নেয় নিজেকে। যতটা সম্ভব নিজেকে ধাতস্থ করে ধীর কণ্ঠে শুধায়,
“ছোট দি’র কোনে খোঁজ পেলেন? কোথায় আছে সে?”

“সামান্য একটা পুচকির খোঁজ পাবো না আমি? সে যেখানে আছে, ভালোই আছে।”

মায়ার চুলের দিকে তাকিয়েই বিপ্রতীপের সহজসরল স্বীকারোক্তি। মায়া আবারও অবাক হলো। যে বিপ্রতীপকে সে দেখে এ বাড়িতে পা রেখেছিলো, সে বিপ্রতীপ আর এ বিপ্রতীপের মাঝে আজ বিশাল তফাৎ। এতটা বদল কেনো? মায়াকেও প্রিয়দর্শিনীর মতন বশে আনার চেষ্টা’ই কি এটা? মায়া নিজেকে শীতল রেখে তীক্ষ্ণ স্বরে আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“ছোট দি’র খবর জানেন,অথচ তাকে বাসায় আনছেন না। কেমন অদ্ভুত না ব্যাপার টা?”

বিপ্রতীপ হাসে। মায়ার চুলে খুব সুন্দর ভাবে বেনী করে দিয়ে নিঃশব্দে চিড়ুনিটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। ধীর গলায় বলে,
“যে যেভাবে খুশি থাকে,তাকে সেভাবে খুশি থাকতে দেওয়া উচিত।”

“ওহ্ আচ্ছা! তাহলে সইয়ের খুশির সময় এ কথা খানা কোথায় ছিলো?”

“মায়ার মোহে আটকে ছিলো।”

মায়ার তাচ্ছিল্য মাখা প্রশ্নে বিপ্রতীপের আবার নিবিড় জবাব। জবাব দিয়ে অবশ্য এক সেকেন্ডও দাঁড়ায় না বিপ্রতীপ। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মায়া হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন বেড়াজালে আটকাচ্ছে সে? তবে তার সমাপ্তিও কী দর্শিনীর মতন!

_

বিছাকান্দির বড় সড়ক পথে দাঁড়িয়ে আছে কত গুলো যুবক-যুবতী। মোটামুটি সবার হাতেই এপ্রন। দুপুরের কড়া তীর্যক রশ্মি খাড়াখাড়ি ভাবে পড়ছে তাদের উপর। একেকটা মানুষের মুখ গুলো কেমন শুকিয়ে লাল হয়ে আছে গরমে। কে বলবে, গতকয়েকদিন অব্দি এখানে তুমুল বর্ষণ ছিলো! রোদের তেজে যেন বন্যার, বর্ষণের আমাজে থিতিয়ে পড়েছে।

দর্শিনী নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। আরও দশ পনেরো মিনিটের মতন হেঁটে গেলেই তারা তাদের গন্তব্যে পৌঁছাবে। জলের তৃষ্ণায় দর্শিনীর মুখটা শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। বিহঙ্গিনী,তৃণা,দর্শিনী পাশাপাশি হাঁটছে। টুকটাক কথাও বলছে। হঠাৎ কিছু বুঝে উঠার আগেই বিহঙ্গিনী চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠে। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে যায় রাস্তার অপরপাশে। হন্ন হয়ে কী যেন খুঁজতে শুরু করে দেয়। রাস্তার এপাশের মানুষ গুলো কেবল অবাক চোখে সে দৃশ্য দেখে যায়।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here