পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ দশ

0
305

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ দশ

“ডিভোর্স দিয়েছেন!”

মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠে ভীষণ বিস্ময়। দর্শিনী সামান্য হাসলো। সামনের চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে নরম কণ্ঠে বললো,
“না, দেই নি। তবে ব্যবস্থা করে এসেছি।”

“ব্যবস্থা করে এসেছেন মানে?”

“আমি ডিভোর্স পেপারে সাইন দিয়ে এসেছি। উকিল সাহেব আজকালের ভিতরে হয়তো কাগজ ওর কাছে পাঠাবে। যে আমার না তাকে অকারণে বেঁধে রেখে তো লাভ নেই তাই মুক্তি দেওয়ার সমস্ত ব্যবস্থা করে এসেছি।”

মৃত্যুঞ্জয় ভারী অবাক হলো দর্শিনীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখে। এমন একটা মেয়েকে যে হাতছাড়া করেছে সে যে কতটা বোকা, ভাবনার বাহিরে। নিশ্চুপ ভাবে অতিক্রান্ত হওয়া সময়ে ভাইব্রেট করে বেজে উঠলো দর্শিনীর ফোন খানা। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে যেতেই দর্শিনী ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আজ আমি আসি তবে? আবার দেখা হবে। বাবা কল দিচ্ছে।”

দর্শিনীর কথায় মাথা নাড়িয়ে বিদায় জানালো মৃত্যুঞ্জয়। হঠাৎ কী মনে করে ভ্রু কুঁচকে ফেললো সে। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনার না সেদিন ফোন ছিলো না? তবে,আজ ফোন আসলো কীভাবে?”

মৃত্যুঞ্জয়ের কথার ধরণে হেসে ফেললো দর্শিনী। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
“এটা বড় বৌদির মোবাইল। বৌদি আমার হাতের মোবাইল আনি নি বলে এটা দিয়েছে। জানেনই তো,বড় বৌদি আমায় কত ভালোবাসে।”

মৃত্যুঞ্জয়ের অবাক ভাব কাটলো। দর্শিনীকে বাড়ির দরজা অব্দি এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো নিজ গন্তব্যে। দর্শিনী বাড়িতে পা রাখতে যাবে সে মুহূর্তে তার মনে আকষ্মিক প্রশ্ন জেগে উঠলো। বড় বৌদির ফোনে গতকাল রাতে মায়া কল করেছিলো। কিন্তু মায়া নাম্বারটা পেলো কীভাবে! মৃত্যুঞ্জয় না বললে তো এই কথাটা মাথাতেই আসতো না। দর্শিনী দ্রুত বাড়ির ভিতরে চলে গেলো। উদ্দেশ্য, বড় বৌদিকে প্রশ্ন করে দ্বিধা পরিষ্কার করবে। মনের মাঝে জেগে উঠলো অপ্রত্যাশিত ভয়। উদ্ভট ভাবনার উদয় হলো হৃদয় মাঝে। বৌদি কী তবে তাকে না জানিয়ে অন্য কিছু করেছে!

দর্শিনী যে উত্তেজনা নিয়ে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করেছিলো, সে উত্তেজনা মিইয়ে গেলো এক নিমিষেই। সদ্য কিশোরী থেকে যৌবনে পা দেওয়া এক নারী ছুটে এলো দর্শিনীর কাছে। জড়িয়ে ধরলো আবেশে। উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“কেমন আছো, প্রিয় দি? কতদিন পর তোমার দেখা! মনে আছে তো আমায়?”

“তোরে ভুলে যাবো,আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা আছে বল তো? তা কেমন আছে আমার তৃণশয্যা?”

“তোমায় ছাড়া ভীষণ খারাপ ছিলাম। কিন্তু এখন পুরো দারুণ আছি। তাড়াতাড়ি আসো,বসো। জল খাবে? কোথায় গিয়েছিলে?”

মেয়েটার কণ্ঠে উচ্ছ্বাসিত ভাবখানা একটুও কমে নি। বরং তা বেড়েছে। কতদিন পর তার প্রিয় দিদিকে কাছে পেলো। নিধির বিয়ের পর থেকেই তো দুজনের গলায় গলায় ভাব ছিলো। দর্শিনীকে ছাড়া কিছুই বুঝতো না তৃণশয্যা। নিধির বোন হলেও নিজের বোনের চেয়েও বেশি জানে দর্শিনী। এতদিন মেয়েটা মামার বাড়ি ছিলো কিন্তু দর্শিনী বাড়ি ফিরেছে শুনেই চলে এসেছে এ বাড়ি।

দু জনের কথার মাঝেই এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত নিয়ে হাজির হলো নিধি। দর্শিনীর দিকে শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে দর্শিনীর মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু আঁচল দিয়ে মুছে দিতে দিতে বললো,
“কোথায় ছিলি রে? সকাল হতেই নিরুদ্দেশ। সকালের নাস্তা কে করবে শুনি?”

দর্শিনী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই সুন্দর রমনী’র পানে। এত যত্ন করা মানুষটাকে নিয়ে সে একটু আগে কত উল্টোপাল্টা না ভেবেছিলো। আর এ মানুষ টা কত সাবলীল ভাবে যত্ন করছে তাকে! দর্শিনী মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো বড় বৌদিকে। আদুরে কণ্ঠে বললো,
“এইতো কাছেপিঠেই ছিলুম। তুমি এত ভালো কেনো, বৌদি?”

দর্শিনীর প্রশ্নে খিলখিল করে হেসে উঠলো নিধি আর তৃণা। দর্শিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি কণ্ঠে নিধি বললো,
“তুই ভালো বলেই আমি ভালো। এবার চুপচাপ শরবতটা খেয়ে নাস্তা খেতে আয়। তৃণাও তোর জন্য বসে আছে কখন থেকে। চল তাড়াতাড়ি।”

_

“শাশুড়ী, সকালের নাস্তা এখনো হয় নি? কতক্ষণ লাগবে আর?”

মায়ার কণ্ঠে বিরক্তের ভাব স্পষ্ট। খাবার টেবিলে বসে আছে বিহঙ্গিনী, শ্বশুর, বিপ্রতীপ। মায়ার কথার পরিপ্রেক্ষিতে বিপ্রতীপ কপাল কুঁচকে বলে উঠলো,
“মাকে এভাবে কাজের কথা বলছো,নিজে গিয়ে করতে পারছো না? দর্শিনী আর যাই করুক কখনোই এভাবে মাকে কাজের আদেশ করতো না।”

মায়া তখন কেবল আপেলের এক কোণায় কামড় বসিয়েছে। বিপ্রতীপের কথা শুনে তার মুখ থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে ফেলে আপনা-আপনি। সরু চোখে বিপ্রতীপের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে,
“আমি প্রথমেই বলেছি-আমি মায়া, প্রিয়দর্শিনী না। আর এতই যখন সে মানবী ভালো ছিলো তবে আবার ঘরে আরেকজনকে আনলেন কেনো? আসলে আপনাদের জন্য একটা প্রচলিত কথা মানানসই, ‘অতি প্রেমে মধুও বিষ,স্বল্প প্রেমে তক্তাও বালিশ’। সই আপনাদের প্রতি অতি প্রেম দেখিয়েছিলো তাই তার এ দশা। আমার কাছে আবার ওসব পাবেন না৷ আমি স্বল্প প্রেম দেওয়া মানুষ। মানিয়ে নিতে পারলে ভালো, নাহয় গলার কাটা হয়ে আটকে থাকবো। অতি প্রেম আমার কাছে ভুলেও আশা করবেন না।”

বিপ্রতীপ নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে চুপ করে গেলো। বিহঙ্গিনী এবং তার বাবা কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলো। হঠাৎ নিরবতা ভেঙে রান্নাঘরের দরজা থেকে মোহনা বলে উঠলেন,
“অতি প্রেম তোমায় দিতে হবে না। আসলে-‘বেশি খাতিরে, পাতিল ভাঙে’ তাই ঐ মেয়ের সংসার ভেঙেছে। তুমি বরং একটা নাতি দিও। বংশের প্রদীপ জ্বালানোর মানুষ আনার জন্যই তোমাকে আনা হয়েছে। বড় বড় কথা বলার জন্য না।”

মায়া শাশুড়ীর পানে তাকিয়ে একটা গা জ্বালানো হাসি দিলো। শাশুড়ীকে খোঁচা দিয়ে বললো,
“আমার বয়স সবে ষোলো কিংবা সতেরো হবে,আমার বাকি জীবন তো পরেই আছে। এত তাড়াতাড়ি নাতির আশা করছেন কেনো, শাশুড়ী? আর আমি মানুষ কোনো মেশিন নই যে আপনারা চাইলেন আর আমি বংশের প্রদীপ দিয়ে দিলাম। এখনো আমায় চিনলেন না!”

মোহনার রাগ উঠলো। কিন্তু সে প্রকাশ করলো না। এই মেয়েকে ঘাটালে ভালো কিছু যে হবে না তা সে এতদিনে বুজে গেছে। কম বয়সী বউ এনেছে স্বাধ করে। এবার তার মজা টের পাচ্ছে। এই মেয়ে এত লাগামহীন।

মোহনার চুপসে যাওয়া মুখটা দেখে মায়া মুচকি হাসলো। এদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তো এত তোড়জোড়। এদের শিক্ষা না দিয়ে এ বাড়ি ছাড়ছে না সে।

_

বিকেল নেমেছে ধরণীর বুকে। সাথে নেমেছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। দর্শিনী আর তৃণা গ্রাম ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলো। হঠাৎ বৃষ্টি দেখে তারা পুকুর পাড়ের বিশাল ছাউনির নিচে গিয়ে আশ্রয় নিলো।

তৃণা বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বিরস কণ্ঠে বললো,
“প্রিয়দি, তোমাকে ওরা বড্ড কষ্ট দিয়েছে তাই না?”

দর্শিনীর দৃষ্টি তখন পুকুরের ঘোলা জলে নিবদ্ধ। তৃণার প্রশ্নে সামন্য চমকে উঠে সে। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“বড্ড কষ্ট কিনা জানিনা তবে বাবা আর বিহঙ্গিনী যে ভালোবাসা টা দিয়েছে সেটা অনেক ছিলো।”

“আর বিপ্রতীপ দাদা তোমায় কী দিয়েছে,দি?”

দর্শিনীর কণ্ঠ কিয়ৎক্ষনের জন্য থেমে যায়। এক আকাশ বিষণ্ণতা নিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“বিপ্রতীপ আমাকে সারা জীবনের বিষাদ দিয়েছে। বেঁচে থেকেও মৃত্যুর স্বাদ দিয়েছে। বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা দিয়েছে। বিপ্রতীপ যা দিয়েছে তা বলেও শেষ করা যাবে না। প্রথম প্রথম সে অনেক ভালোবাসাও দিয়েছিলো কিন্তু শেষবেলার অবহেলার কাছে ঢেকে গেছে সে ভালোবাসা। বিপ্রতীপ কখনোই আমাকে ভালোবাসে নি। সে আমায় ভালোবাসলে কখনো আরেক নারীতে মত্ত হতে পারতো না। আমি বিপ্রতীপের রঙচঙে মুগ্ধতা ছিলাম কেবল। মুগ্ধতা কেটে যাওয়ার সাথে সাথে আমাকে সে ছুঁড়ে ফেলেছে। প্রেমিক পুরুষরা দিনশেষে এমন বদলে যায় কেনো, বলতে পারিস? কী ভীষণ যন্ত্রণা ভালোবাসায়। আমি বলবো কখনো প্রেমে পরিস না। প্রেমিক পুরুষদের বদল মানতে পারবি না যে।”

তৃণা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দর্শিনীর পানে। দর্শিনী বদলে গেছে। এমন বিষাদময় দর্শিনী কখনো ছিলো না। ভালোবাসা কী পারে না? একটা উচ্ছ্বাসিত নারীকে কি অবলীলায় বিষাদে ঢেকে দিতে পারে!

তাদের কথার মাঝেই হুড়মুড় করে পুকুরপাড়ে হাজির হলো দুই মানব। তৃণা তাদের দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,
“আরে মৃত্যুঞ্জয়’দা আর দৃষ্টান্ত’দা? কবে এলেন আপনারা গ্রামে?”

মৃত্যুঞ্জয় শরীরের থেকে বৃষ্টির জল গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“এইতো, আমি এলাম গত পরশু আর দৃষ্টান্ত এসেছে সপ্তাহ খানেক হলো।”

দৃষ্টান্ত দর্শিনীর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,
“এই বৃষ্টির মাঝে তুই বাহিরে কী করছিস? তাও এই সন্ধ্যায়? নিজের খেয়াল রাখছিস তো?”

দর্শিনী আমতা-আমতা করে বললো,
“আসলে তৃণা এসেছে তো তাই গ্রাম ঘুরতে বেড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু বৃষ্টির জন্য আর বাড়ি ফিরতে পারি নি।”

মৃত্যুঞ্জয় সরু দৃষ্টিতে তাদের দেখলো। কেনো যেনো তার দৃষ্টান্তের এমন শাসন পছন্দ হয় নি। বিরক্তি ভাবে ভরে গেলো শরীরে প্রতিটি শিরা উপশিরা।

#চলবে

[ভালোবাসা পাঠকমহল। আগামীকাল থেকে আমার পরীক্ষা শুরু৷ তাই প্রতিদিন হয়তো গল্পটা দিতে পারবো না। একদিন পর পর দিবো। আর গল্পটার তত বেশি পর্বও হবে না। একটু ধৈর্য রাখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here