পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ তিন

0
385

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ তিন

“তোমাদের প্রেমের বিয়ে! কীভাবে?”

দর্শিনীর কণ্ঠে রাজ্যের বিষ্ময়। তার জানামতে বিপ্রতীপ এতটাও খারাপ না যে সংসারে থাকাকালীন পরকীয়াতে জড়াবে। তবে! মেয়েটা এই কথাটা কেনো বললো? তবে কী বিপ্রতীপকে দর্শিনী ঠিক চিনতে পারে নি! দর্শিনীর হৃদয়ে দ্বিধা,বিষ্ময় মিলে মিশে একাকার। তার অন্তর আত্মা কাঁপছে। বিপ্রতীপের এই চরিত্রটা যে সে সহ্য করতে পারবে না। তবুও মনকে শক্ত করলো। বিপ্রতীপ তো আর তার নেই। তাহলে সহ্য করার কথা আসছে কোথা থেকে?

দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই মায়া কৌতুক হেসে ফিসফিসিয়ে বললো,
“হ্যাঁ, প্রেমের বিয়ে। আজ থেকে এক মাস আগে আমাদের শুদ্ধ প্রণয় শুরু হয়েছিলো। তুমি কী ভেবেছো,আমি উনার সম্পর্কে খোঁজ নেই নি? তুমি যে উনার প্রথম বউ তা আমি খুব ভালো করেই জানি। কিন্তু এমন ভাব ধরেছি যেন কিছুই জানিনা। শ্বশুর বাড়ির মানুষ গুলো কিন্তু ভালো অভিনয় জানে।”

“তুমিও কম জানোনা। বিবাহিত পুরুষের সংসার ভেঙে সুখে থাকতে পারবে?”

দর্শিনীর কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা। মায়া মিষ্টি হেসে উত্তর দেওয়ার আগেই বিহঙ্গিনী তাদের রুমে হন্তদন্ত হয়ে প্রবেশ করলো। রুমে ঢুকেই অবিশ্বাস্যকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে, আকাশসম বিষ্ময় নিয়ে বললো,
“নতুন বউ,তুমি এখানে কেনো!”

প্রশ্নটা করেই সে ভীত দৃষ্টিতে তাকালো দর্শিনীর পানে। সত্যি টা যদি নতুন বউ জেনে যায়, সে ভয়ে। দর্শিনী চোখ দিয়ে আশ্বাস দিলো- নতুন বউ কিছু জানেনা। বিহঙ্গিনী ধাতস্থ হলো। চিন্তামুক্ত হয়ে ছোট্ট শ্বাস ফেললো।

মায়া ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চঞ্চল, উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বললো,
“এই দিদি টা অনেক ভালো, ননদিনী। তাই দিদির সাথে কথা বলতে এলুম।”

“তোমায় খুঁজছে সবাই। আজ তোমাদের ফুলসজ্জা। মহিলা এসেছে সাজাতে। চলো আমার সাথে।”

বিহঙ্গিনী কোনো মতে কথাটা যেনো উগড়ে দিলো। যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলো, সেভাবে হন্তদন্ত হয়ে চলেও গেলো। হয়তো চক্ষু লজ্জার জন্য।

দর্শিনী ঠেস মেরে বলে উঠলো,
“যাও,যাও। আজ নতুন রাত তোমাদের। এ ঘরে তোমায় মানাচ্ছে না। যে ঘরে মানাবে,সে ঘরে যাও। একজন বিবাহিত পুরুষকে ফাঁসিয়ে কতটুকু শান্তিতে থাকো সেটাও আমি দেখবো।”

মায়া মেয়েটা বয়সে যতটা ছোট বুদ্ধির দিক দিয়ে ঠিক ততটাই বড়। দর্শিনীর ঠেস মারা কথা বুঝতে তার কয়েক সেকেন্ডও ব্যয় করতে হয় নি। সেও আলতো হেসে বললো,
“তা আমি ফাঁসিয়েছি তোমায় কে বললো? নিজের স্বামীকে এখনো শুদ্ধ পুরুষ ভাবো! সে ততটাও ভালো না।”

মায়া আর দাঁড়ালো না। ধীর গতিতে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। দর্শিনী নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো কেবল। তার মাথায় মায়ার বলা শেষ বাক্য গুলো কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে। মায়া কী বুঝাতে চাইলো? বিপ্রতীপই তাহলে বাহিরে নজর দিয়েছিলো প্রথম! আর সে কিনা বোকার মতন অন্ধবিশ্বাস করে গেলো! মানুষ এভাবে খোলশ বদলানোর খেলায় জিতে যাবে, কে জানতো?

দর্শিনী ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো। বাম দিকের দেয়ালে টাঙানো তার আর বিপ্রতীপের হাসিমাখা ছবিখানা হাতে নিলো। এখন বিষণ্ণ সন্ধ্যা। বিষাদ বিলাস করার সময়। একটু পর রাত নামবে আকাশের বুকে। বিপ্রতীপের বক্ষ মাঝে থাকবে অন্য নারী! এ ব্যাথা বুঝি মানা যায়? কোনো নারী এ রাত মেনে নিবে?

দর্শিনী বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। আজ বৃষ্টি হবে। আকাশ কেমন থম মেরে আছে। আকাশেরও বুঝি মন খারাপ? দর্শিনী বিষাদ মাখা হাসি হাসলো নিজের উপর। ভালোবেসেই তো বিয়ে করেছিলো। তবে,আজ এ দিন কেনো এলো জীবনে?

নারী জীবন কী অদ্ভুত! আজ নারী বলেই কী স্বামীর বাসর দেখতে হবে? দর্শীনি দেখবে না সে বাসর। মানবে না নারী জীবনের শর্ত। নারী হৃদয়ে কী ব্যাথা লাগে না? মানুষ কেনো ভুলে যায় নারীরও হৃদয় থাকতে পারে?

হঠাৎ দর্শিনীর হৃদয় বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। মানলো না কোনোরূপ অজুহাত। ছুটে এলো রুমে। গুছাতে হবে নিজের শেষ বিদায়ের জন্য। শুনেছি জীবিত নারী একমাত্র মৃত হলেই শ্বশুর বাড়ি ত্যাগ করে। তবে কী আজ দর্শিনীও মৃত! নাহ্। দর্শিনী বাঁচার জন্য, নতুন করে জীবিত হওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়বে। কেবল রাত বাড়ার অপেক্ষা।

দর্শিনী ঘরের বাহিরে গেলো। লুকিয়ে নতুন বউয়ের ঘরে উঁকি দিলো। খুব গোপনে রক্তক্ষরণ হলো হৃদয় মাঝে। দেখলো না কেউ। শুনলো না কেউ হাহাকার। হৃদয় ভাঙার যে শব্দ হয় না। নিজেকে এমন গোপন ভাবে র’ক্তা’ক্ত করতেই তো এসেছিলো এখানে। ফুলের খাট দেখলে যে হৃদয়ে কোমলতা জাগবে না,তা দর্শিনীর ঢের জানা আছে। তাই তো একটু ঘৃণা কুড়াতে এলো। নাহয় মায়া,মোহ,প্রেম যে কাটবে না। কিন্তু ঘৃণা কী আর কুড়াতে পারলো? কুড়ালো তো এক রাশ ব্যাথা।

দর্শিনী রুমে ছুটবে তার আগেই মোহনার রাশভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“এখানে কী করছো?”

দর্শিনী চমকে গেলো। এমন করে ধরা পড়ে যাবে, কে জানতো? তবুও নিজেকে স্থির করলো। নিজেকে ধাতস্থ করে সুন্দর করে বললো,
“মা, ফুলসজ্জার ঘর দেখতে আসছিলাম।”

মোহনা যেনো বেজার হলো। মুখ কালো করে বললো,
“এটা দেখার কী আছে? নাকি নিজের সর্বনাশ দেখতে ভালো লাগে? কী অদ্ভুত মেয়েমানুষ তুমি! আমরা হলে এ লজ্জায় মারা-ই যেতাম। তোমার লজ্জা নেই বাপু?”

দর্শিনী খিলখিল করে হেসে উঠলো। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“কিসের লজ্জা,মা?”

মোহনা যেনো বোকা বনে গেলো। নতুন বউ আসার পর সে যেনো বোকা-ই বনে যাচ্ছে। বউ আনলো না অলক্ষী ভেবে পাচ্ছে না সে। দর্শিনীর প্রশ্নের আর উত্তর দেয় নি মোহনা। গটগট পায়ে চলে গেলো সেখান থেকে। দর্শিনীও তার ঘরে চলে গেলো। সে যেনো ধরা পরে যাবে, যাবে করেও বেঁচে গেছে। লক্ষ কোটি ধন্যবাদ জানিয়েছে সৃষ্টিকর্তাকে এর জন্য সে।

দর্শিনীর ফোন হঠাৎ বেজে উঠলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে বাবা নামের লেখাটা। দর্শিনী নিজেকে শক্ত করে ফোনটা রিসিভ করলো। কোমল কণ্ঠে বললো,
“বাবা,কেমন আছো?”
“এইতো মা,ভালো। তুই কেমন আছিস?”

দর্শিনী “ভালো আছি” বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কণ্ঠনালীয় কোথাও যেনো একটা বাঁধা সৃষ্টি হলো। তবুও সে টুকটাক কথা বলে ফোন রেখে দিলো। টেবিলের ড্রয়ারে থেকে খাতা,কলম বের করলো। একটা দারুণ চিঠি লিখতে বসবে। যে চিঠির কোণায় কোণায় ভরা থাকবে বিষাদ। কাল যখন বাড়ির মানুষ গুলো জানবে দর্শিনী বাড়িতে নেই, তখন যেনো বিষাদ মাখা চিঠিখানা পায়। বিষাদে টইটম্বুর হবে এই বাড়ির প্রতিটা ইট, পাথরও। সবাই জানবে, এক হৃদয় ভাঙা নারীর আর্তনাদ।

দর্শিনী লেখা শুরু করলো,

প্রিয় মায়া,
এ বাড়িতে আর কাউকে চিঠি না লিখে তোমায় লিখছি বলে অবাক হচ্ছো? তাও আবার প্রিয় সম্বোধন করেছি! আসলে এ বাড়ির মানুষ গুলো কখনোই আমায় আপন ভাবে নি৷ কীভাবে তাদের চিঠি লিখে যাই বলো? তাই তোমাকেই লিখলাম। তোমায় যতটুকু দেখেছি আমার দারুণ লেগেছে। আশারাখি তোমার এই চাঞ্চল্যের অস্তিত্বে ভরে যাক এ বাড়ি। এ বাড়ির মানুষ গুলোকে আমি যে বড্ড ভালোবাসি। বিয়ের পর জেনেছি আমার মা দুইটা। একটা জন্মদাত্রী আরেকজন যে আমায় এখন লালন পালন করবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে সে মা আমায় মেয়ে ভাবতে পারে নি। তবে হ্যাঁ, আমি একটা বাবা পেয়েছি। বাবাকে দেখে রেখো। তোমার ননদিনী কিন্তু আমি বলতে অজ্ঞান ছিলো। কিন্তু দেখো,সেও চক্ষু লজ্জার কারণে আমার সাথে কথা বলতে পারে না। কী লাভ আর এ বাড়ি আকড়ে ধরে পড়ে থেকে? যেখানে আমার পরিণতি বিদায়ের খাতায় গিয়ে ঠেকলো। এ বাড়ির মাটি জানে, এ বাড়ির ধূলো জানে আমি তাদের কত ভালোবেসেছি। কিন্তু ইট, পাথরের এ বাড়ি আমার হয়নি কভু। কেবল পর-ই করে গেলো। তুমিই নাহয় তার আপন হয়ে থেকো। আমি তবে নিলাম বিদায়। ভালো থেকো আমার সাত জন্মের সই।

ইতি
তোমার সই।

গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠিখানা শেষ হলো। চিঠিখানায় যুক্ত হলো দর্শিনীর অশ্রুকণা। আজই শেষ কান্না। এরপর আর সে কাঁদবে না। এরপর আর সে পিছু ফিরবে না। পিছুটান যে তার জন্য না।

পুরো বাড়ি বিভীষিকাময় আধারে পরিপূর্ণ। দর্শিনীর হাতে ব্যাগ চোখে অশ্রু। ছোট ছোট পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সদর দরজার দিকে। এ বাড়ির মায়া তাকে বার বার আঁকড়ে ধরছে। তবুও তাকে যে যেতে হবে। কার মায়াতে আটকে থাকবে? যে মানুষ আজ অন্য নারীতে মত্ত, তার মায়াতে? না থাকুক এমন বেশরম মায়া। যে মায়া ছোট করবে আত্মমর্যাদা, সে মায়া থেকে কী লাভ!

দর্শিনী ধীরে ধীরে দরজা খুলে কেবল বাহিরে পা রেখেছে,তখনই একটা রাশভারি কণ্ঠ ভেসে এলো,
“চলে যাচ্ছো? থেকে গেলে হয় না?”

কণ্ঠে তার রাজ্যের আকুতি। যে আকুতি থামিয়ে দিলো দর্শিনীর পা। ডুকরে কেঁদে উঠলো হৃদয় আঙিনা।

#চলবে

[এবার থেকে আসল কাহিনী শুরু হবে। সবাই ধৈর্য ধরা শুরু করো।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here