#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
পর্বঃ নয়
গ্রীষ্মের উত্তপ্ত রাত। বিষণ্নতার দীর্ঘশ্বাস পরিবেশে বিরাজিত। প্রিয়দর্শিনীর আজ অশ্রুভেজা রাত। কত গুলো বছর পর বিছানায় সে একা! দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রিয় মানুষটা পাশে নেই। অবশ্য এতদিন এক বিছানাতে থেকেও মানুষটার সাথে দূরত্ব ছিলো তার আকাশ পরিমাণ। আর আজ, বিছানাও আলাদা। মানুষটা হয়তো নতুনে মত্ত,আর সে পুরোনোতে নিবদ্ধ। শুভ্র রাঙা বালিশের কাভার খানা জায়গায় জায়গায় ভিজে আছে। দীর্ঘক্ষণের অশ্রু বিসর্জনের প্রমাণ হিসেবে জ্বল জ্বল করছে দাগ গুলো। দর্শিনীর হঠাৎ করেই ছোট বৌদির বলা কথাখানা মনে পড়লো। বাবার বাড়িতে এসেছে সে,দিন একও অতিবাহিত হয় নি। এখনই ছোট বৌদি বিয়ের কথা তুলে ফেলছে। বাকি দিন তো পরেই রইলো। বাবার বাড়িতে যে এতটা কঠিন হবে টিকে থাকা তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি দর্শিনী। এতদিন শ্বশুর বাড়ি মনে হয়েছিলো নরক কিন্তু এখন দেখছে বাবার বাড়ি তো এর চেয়েও ভয়ঙ্কর। বিয়ের পর মেয়েরা এতটাই পর হয়? স্বর্গের মতন বাবার বাড়ি নরকে রূপান্তরিত হয়ে যায়!
একটু আগের কথা ভেবে দর্শিনীর ঠেলে কান্না আসছে। ভাগ্যিস বড় ভাইয়া ছোট বৌদিকে ধমক দিয়েছিলো তাই বিয়ের কথা টা আর বাড়াতে পারে নি। কিন্তু কতদিন চুপ করে থাকবে বৌদি! একদিনেই ঘাঁড়ের বোঝা হয়ে গেছে সে।
দর্শিনীর মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো ভাবনা। তাকে কিছু করতে হবে। এভাবে বাবা ভাইয়ের বোঝা হয়ে থাকবে না সে। নিজের পায়ে তাকে দাঁড়াতে হবে। গোড়া থেকে কেউ যেন তাকে উপড়ে ফেলতে না পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
ভাবনার মাঝেই দর্শিনীর ফোনটা ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠলো। দর্শিনী হঠাৎ শব্দে চমকে উঠলো। পাশে তাকাতেই ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করলো একটা অপরিচিত নাম্বার। দর্শিনী ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোনটা বেজে কেটে গেলো। পরক্ষণেই আবার বিরতিহীন ভাবে বেজে উঠলো। দর্শিনীর ভ্রু ক্ষাণিকটা কুঞ্চিত হলো। এবার ফোনটা সে রিসিভ করলো। খুব বিনীত স্বরে প্রশ্ন করলো,
“হ্যালো,কে?”
“সই,আমি। তোমার সাত জন্মের সই বলছি।”
অপরপাশের উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠের অধিকারীকে চিনতে এক সেকেন্ডও সময় অপচয় হয়নি দর্শিনীর। বরং সে ভিষণ অবাক, বিষ্ময় নিয়ে বলে উঠলো,
“মায়া!”
“তুমি আমায় চিনলে কীভাবে, সই?”
আবারও মায়ার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেসে এলো। দর্শিনী নিজের বিষ্ময় কাটাতে কিয়ৎপরিমাণ সময় ব্যয় করলো। অতঃপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। ঘড়ির কাটা দুটোর কাছাকাছি। এত রাতে মায়ার কল দেওয়ার কারণ বোধগম্য হলো না দর্শিনীর। সে মুখ চোখ কুঁচকে জবাব দিলো,
“তোমার কথার ধরণেই তোমাকে চিনেছি। আর তুমি ছাড়া আমার এত জন্মের সই কেউ হতে চায় নি। অভাগিনী তো তাই। তা এত রাতে কী মনে করে কল দিলে?”
“এত রাতে তোমাকে মনে করে কল দিলাম। সারাদিন তোমাকে ভীষণ মনে পড়েছে তো তাই।”
মায়ার এহেন কথার ধরণে দর্শিনী বারংবার অবাক হচ্ছে। কণ্ঠে অবাক ভাবটা ধরে রেখেই বললো,
“আমায় মনে পড়েছে? কিন্তু কেনো?”
“ঐ যে,তুমি আমার সই বলে। কেমন আছো তুমি?”
“আমার ভালো থাকার কারণ কেঁড়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করছো কেমন আছি! হাসালে।”
দর্শিনীর কণ্ঠের তাচ্ছিল্য ভাবটা মায়া ঠিকই উপলব্ধি করেছে। দর্শিনীর তাচ্ছিল্যের বিপরীতে সে একরাশ নির্ভেজাল হাসি উপহার দিয়ে বিষাদময় কণ্ঠে বললো,
“সত্যিই কী আমি তোমার ভালো থাকার কারণ কেঁড়েছি,সই? তুমি কী এ সংসারে এতদিন ম্যালা ভালো ছিলে! ভীষণ ভালো থাকার অভাবে তবে প্রতিনিয়ত কে ধুঁকে ধুঁকে ম’রে’ছে?”
মায়ার কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো যা নাড়িয়ে দিলো দর্শিনীর অন্তর। মায়ার বিশাল গভীর প্রশ্নে হারিয়ে ফেললো নিজেকে। সত্যিই তো, সে কি এতদিন ভীষণ খুশি ছিলো? মোটেও না। তবে কেনো মিছে অভিযোগ? নিজেকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্যই কী এত তোড়জোড়? নাকি প্রিয় মানুষটাকে প্রতারক ভাবতে না চাওয়ার জন্য এত বিশাল আয়োজন?
দর্শিনীকে চুপ থাকতে দেখে মায়া খিলখিল করে হেসে উঠলো। মায়ার হাসির শব্দে দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। সে অবাক কণ্ঠে বললো,
“এই মেয়ে,হাসছো যে?”
“তোমাকে ভাবতে দেখে হাসলাম,সই। কী ভাবছো এত? তোমার মুক্তির কারণ এই মায়া। আর মায়ার প্রতিই তোমার এত অভিযোগ? থাকুক,এতে আমার কেনো আক্ষেপ নেই। দর্শিনীদের মুক্তির কারণ হতে আমার বড্ড ভালো লাগে। আজ তবে রাখি, সই? হুটহাট জ্বালাবো ভীষণ। মনে রেখো আমায়। ভালো থেকো, সই। এখন থেকে তোমার ভালো থাকার দায়িত্ব তোমার। নিজেকে ভালো রেখো, কেমন।”
অপরপাশ থেকে ফোনটা কেটে দেওয়া হলো। দর্শিনী অবাক নয়নে কেবল তাকিয়ে রইলো। তার বোধগম্য হলো না মেয়েটার আচরণ। মেয়েটা এমন কেনো? হুটহাট মনে ঝড় তুলে দেয় হেঁয়ালি মাখা কথা দিয়ে। মেয়েটার মাঝে বড্ড রহস্য।
_
গ্রামের সজীব সকাল। সূর্যের তেজ আজ তেমন উত্তপ্ত না। সামান্য ধোঁয়াশা ভাব পরিবেশে বিদ্যমান। দর্শিনী কেবল গ্রামের স্কুল থেকে বের হয়েছে। পেছন থেকে তাকে কেউ ডেকে উঠলো,
“প্রিয়দর্শিনী?”
দর্শিনী দাঁড়িয়ে গেলো ডাক শুনে। সচারাচর পুরো নাম ধরে তাকে কেউ ডাকে না। কণ্ঠের মালিকের খোঁজ করার জন্য পিছে ঘুরে তাকালো দর্শিনী। পিছের মানুষটাকে দেখে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্বি?”
মৃত্যুঞ্জয় এগিয়ে এলো। হাতের ভাজে এপ্রনটা নিয়ে মুচকি হেসে বললো,
“আপনি এখানে যে? স্কুলে কোনো কাজে এসেছিলেন বুঝি?”
দর্শিনীর এহেন প্রশ্নে সামান্য বিরক্ত লাগলেও সে বিরক্ত ভাব প্রকাশ করলো না। বেশ ভদ্র,বিনীত স্বরে বললো,
“হ্যাঁ, কাজেই এসেছি। বাবা ভাইদের ঘাড়ে তো বসে খেতে পারি না তাই চাকরি জোগাড় করতে এলুম। তা আপনি এখানে?”
“ক্যাম্পিং করতেই তো গ্রামে আসি। সেটাই করছি।”
দর্শিনী এবার পূর্ণ দৃষ্টি দিলো। মৃত্যুঞ্জয়ের হাতে এপ্রন দেখে ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আপনার পেশা? ডক্টর?”
মৃত্যুঞ্জয় দারুণ হেসে বললো,
“হ্যাঁ। ঠিক ধরেছেন মেডাম।”
দর্শিনীর হঠাৎ করেই দৃষ্টান্তের কথা মনে পড়লো। মনে মনে খচখচ করা শুরু করলো। আমতা-আমতা করে বললো,
“আপনি দৃষ্টান্ত দাদাকে চিনেন?”
“হ্যাঁ, চিনবো না কেনো? ও আর আমি দু’জনই একসাথে ক্যাম্পিং করছি। চলুন আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।”
মৃত্যুঞ্জয়ের প্রস্তাবটা খুব একটা খারাপ লাগে নি দর্শিনীর। সেও মাথা দুলিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। হাঁটতে হাঁটতেই বললো,
“আচ্ছা ডাক্তার সাহেব, আপনি আমাকে কবে থেকে চিনেন?”
মৃত্যুঞ্জয়ের পা টা থেমে গেলো দর্শিনীর এমন প্রশ্নে। হৃদয় মাঝে ছলাৎ করে উঠলো আকষ্মিক ভয়। হঠাৎ মেয়েটা এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো কেনো? নিজেকে ধাতস্থ করলো সে মিনিট খানেক নিয়ে। আমতা-আমতা করে বললো,
“কেনো?”
“দরকার আছে। বলুন,আমায় কবে থেকে চিনেন আপনি?”
“গতকাল থেকে।”
“তাহলে আমার বাবার কাছে কীভাবে খবর পাঠালেন?”
দর্শিনীর প্রশ্নে অবাক হলো না মৃত্যুঞ্জয়। বরং হো হো করে উচ্চশব্দে হেসে উঠলো। বেশ মিষ্টি করে বললো,
“বাহ্,আপনি তো দারুণ চালাক। অবশ্য এমনটাই আশা করা যায় আপনার কাছে। আপনাকে আমি গতকালই প্রথম দেখেছি কিন্তু গত চার বছর যাবত চিনি।”
থেমে গেলো দর্শিনীর পা। তার চক্ষু যেন বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অবাক কণ্ঠে সে শুধালো,
“চার বছর যাবত চিনেন মানে?”
“চার বছর আগে আপনার নাম শুনেছি। আপনাকে না দেখেই চেনা যাকে বলে।”
মৃত্যুঞ্জয়ের সহজ সরল জবানবন্দিতে অবাক ভাবটা বাড়লো বয় কমলো না দর্শিনীর। আর দারুণ লাগলো মৃত্যুঞ্জয়ের অকপটে সত্যি বলার ধরণটা। দর্শিনী বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তাহলে ট্রেনে আমাকে দেখে চিনলেন কীভাবে?”
“নাম শুনেই আন্দাজ করেছিলাম। আপনি যখন ঘুমিয়ে গেলেন তখন আপনার বাবাকে ফোন দিয়ে আপনার বিবরণ দিয়ে জিজ্ঞেস করে সিউর হয়ে ছিলাম।”
মৃত্যুঞ্জয়ের কণ্ঠে স্বাভাবিক ভাব। দর্শিনী অবাকের উপর অবাক হলো। আর ভালো লাগা কাজ করলো মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাক্তিত্বের উপর। পথে তাদের টুকটাক আরও কথা হলো। কথার এক পর্যায়ে মৃত্যুঞ্জয় বলে উঠলো,
“যাকে ছেড়ে এসেছেন তার জন্য পিছুটান কেনো রেখেছেন মেডাম?”
দর্শিনী ততক্ষণে নিজের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যুঞ্জয়ের প্রশ্নে সে হেঁয়ালি হেসে জবাব দিলো,
“পিছুটান তো আমি রাখি নি। তাকে একবারেই আমি মুক্ত করে দিয়ে এসেছি। মনের মুক্তি তো আগেই দিয়েছিলাম। খাতা কলমেও মুক্ত করার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছি।”
#চলবে
[এত বিলম্ব হওয়ার জন্য দুঃখীত। ভালোবাসা নিবেন। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন। ]