#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা
পঞ্চ স্বাদেরঃ পঞ্চাশ (অন্তিম পর্ব)
(অনেক বড় পর্ব বিধায় আপনারা মেইন ফেসবুক এ্যাপ দিয়ে পইড়েন, লাইটে পুরোটা আসবে না)
হৈচৈ, আনন্দে ডুবে আছে বাড়ি। অথচ দর্শিনীর বুক কাঁপছে। অনবরত অনাকাঙ্খিত কোনো আনন্দের আভাস পাচ্ছে ভেবে উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠছে হৃদয়। এত আনন্দ তার ভাগ্যে থাকতে পারে ভাবতেই শিউরে উঠছে শরীরের প্রতিটি লোমকূপ। ধীর গতিতে, বুকের অস্বাভাবিক কম্পন সাথে নিয়ে বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই শরীর শিরশির করে আনন্দের স্রোত বয়ে গেলো। সকালের টলমল চক্ষু যুগল নিয়ে, শুভ্রা রাঙা শার্ট পরিহিত যে পুরুষটা দর্শিনীকে চির অপেক্ষায় রেখে বিদায় নিচ্ছিলো, সে মানুষটাই উঠোনের এক কোণায় বসে কি ব্যাপার নিয়ে যেন হেসে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এরকম অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্য বোধহয় দু’টো নেই। দর্শিনী অপলক সেখানে তাকিয়ে রইলো। কোনো ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই। এই দৃশ্য দেখার তৃষ্ণা যেন তার মিটবে না।
উপস্থিত আনন্দে ভাঁটা পড়লো দর্শিনীর পদচারণে। প্রতিটি উৎসুক দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো দর্শিনীর পানে। দর্শিনী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবাইকে দেখলো। উঠানের মাঝে অবস্থানরত আরেকটি দৃশ্য দেখে দর্শিনীর চোখ সপ্তম আকাশে চলে গেলো। দর্শিনীর বাবা আর মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা দু’জন দু’জনকে জড়াজড়ি করে বসে আছে। এমন কিছুও যে ঘটতে পারে সেটা ভাবনার বাহিরে ছিলো।
প্রতাপ সাহা মেয়েকে দেখে একটা উচ্ছ্বাস মাখা হাসি দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মেয়েটাকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে! নিশ্চিত আজ ভীষণ শোক পালন করেছে মেয়েটা! মুখটা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে আছে। তবে মাঝে মাঝে নিজের মনের অনুভূতি বোঝার জন্য কিঞ্চিৎ শোক পালন করা মানানসই কিংবা উচিৎ। শোক যদি মনের রোগ দূর করে, তবে শোকই শ্রেয়।
ঠিক এমন সময়টায় দর্শিনীর কেমন প্রতিক্রিয়া জানানো উচিৎ সে বুঝতে পারছে না। অতি খুশিতে কাঁদবে! নাকি এমন অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটেছে বলে অবাক হবে! জীবনের এ পর্যায়ে এসে নিজেকে কেমন অনুভূতি শূণ্য লাগছে। তবে এমন একটা দৃশ্য দেখার পর মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকাটা মোটেও বৃথা হয় নি। ম*রে গেলে কি এত সুখ দেখার ভাগ্য হতো!
প্রতাপ সাহা নিজের বা’হাত দিয়ে মেয়ের বাহু আঁকড়ে ধরলো। দর্শিনী ফ্যাল ফ্যাল চোখে বাবার পানে চাইলো। দর্শিনীর চোখ হয়তো কি প্রশ্ন করছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না বাবার, তাই তো মেয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“মা, দেখো, আমার শৈশবের বন্ধু বন্ধুত্ব ভুলে নি, দিন শেষে সে আমার দারেই ফিরেছে, মা।”
বাবার কথা বোধগম্য হয় না দর্শিনীর। ভ্রু কুঁচকে গেলো তাই আপনা-আপনি। অবাক কণ্ঠে বললো,
“তোমার বন্ধু! কে তোমার বন্ধু?”
“কেনো, ঐ যে ওখানে লাট সাহেব সেজে পায়ের উপর পা রেখে বসে থাকা বিষ্ণুযশ সাহা লোকটা আমার বন্ধু। আমার ছোট বেলার বন্ধুর সাথে তোলা সাদা-কালো ছবিটা দেখে তো অনেক হাসতে, মনে নেই? সেই ছোট প্যান্ট পড়া ছেলেটাই এই আধ-পাঁকা চুলের বুড়ো বিষ্ণুযশই আমার বন্ধু।”
বাবার অকপটে স্বীকারোক্তিতে দর্শিনীর অবাক মাত্রা আকাশ ছুঁয়ে যায়। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা কিনা তার বাবার বন্ধু! অথচ সে টেরই পায় নি!
দর্শিনীর এমন থম মারা অবস্থা দেখে মৃত্যুঞ্জয়ের মা দৈবশ্রী হেসে উঠলেন। দর্শিনীর কাছে এসে আদুরে হাত মাথায় বুলিয়ে বললেন,
“অবাক হলে নাকি, মা? অবশ্য অবাক হওয়ারই কথা। তাদের তো এত বছর বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ চলছিলো। প্রেমের বিচ্ছেদের শোক পালন হয় মা, সবাই ও সেটা আগ্রহ নিয়ে শুনে, জানে কিন্তু বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের শোক ঘটা করে পালিত হয় না। তত মজা নেই বলে মানুষও তা প্রচার করে না। তাই হয়তো জানো নি। তবে আগে তুমি ভিতরে আসো। সারাটা দিন কোথায় ছিলে শুনি? সেই সকাল থেকে তোমার অপেক্ষায় তোমার বাড়িতে বসে আছি৷ সারাদিন না খেয়ে আমাদের ছোট্ট খেলার সাথীকে কষ্ট দিলে আমরা কিন্তু সেটা বরখাস্ত করবো না। চলো ভিতরে।”
কথা বলতে বলতে দর্শিনীকে ভদ্রমহিলা টেনে নিয়ে গেলো উঠোনে। কাঠের খালি চেয়ারটাতে বসিয়ে খুব যত্ন করে দর্শিনীর মুখমন্ডলটা মুছিয়ে দিলো। কার্তিক মাস প্রায় শেষের দিকে। এখন থেকেই গ্রামে বেশ শীত পড়া শুরু করেছে। এই যে বিকেল হলেই কেমন বরফের রাজ্যে পরিণত হয় পুরো গ্রাম! তখন টুকরো টুকরো শীতে গ্রামটাকে কত আদুরে লাগে!
সরলা দু’চোখ মেলে দেখলেন দৈবশ্রীর এমন কোমল আদর। মা হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব তার ছিটেফোঁটাও নিজের মধ্যে নেই ভাবতেই খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলো তার মন আকাশ। সন্তানদের অসময়ে সে খুব কঠোর হয়ে যায়। যেমন দর্শিনীর যখন তাকে প্রয়োজন ছিলো, তখন দর্শিনীর প্রতি উদাস ছিলো সে। আবার তার বড় ছেলের এখন তাকে প্রয়োজন অথচ সে বড় ছেলের প্রতি উদাস। নাতিটার প্রতিও অবিচার করেছে। কেবল সেদিন দর্শিনীর কঠোর কথার কবলে পড়ে নাতিটাকে দুধ, ডিম খেতে দেয়। মা হিসেবে সে ব্যর্থ, মানুষ হিসেবে সে প্রচুর স্বার্থপর। মায়েরা তো এমন হয় না। নিজের কৃতকর্মের কথা ভাবতেই আফসোসের শ্বাস বের হয়ে এলো খুব গোপনে।
দর্শিনী কাঠের চেয়ারটাতে বসে একপলক তাকায় মৃত্যুঞ্জয়ের পানে। মানুষটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলতেই চোখ সরিয়ে নেয় সে। বাবার দিকে তাকিয়ে স্মিত কণ্ঠে বলে,
“বাবা,একটু খুলে বলবে সবটা? উনাদের তো চলে যাওয়ার কথা ছিলো। আর তুমিও বা কাল রাতে কোথায় ছিলে? ওরা চলে না গিয়ে ফিরে এলো কেনো? তোমার বন্ধুত্ব বিচ্ছেদের সমাপ্তি হলো কীভাবে আবার বন্ধুত্বে বিচ্ছেদও বা হয়েছিলো কেনো, একটু খোলশা করবে, প্লিজ!”
প্রতাপ সাহা মেয়ের পাশের চেয়ারে এসে বসলো। ছোট্টো একটা শ্বাস ফেলে বললো,
“ছোটো বেলা থেকেই আমাদের দু’জনের গলায় গলায় ভাব ছিলো। ওর বাড়িতে আমি যেতাম, আমার বাড়িতে ও। আমাদের দুই পরিবারের মাঝেও বেশ সখ্যতা ছিলো। অতঃপর সেই সখ্যতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তোমার ছোট কাকার সাথে মৃত্যুঞ্জয়ের ছোট পিসির বিয়ে ঠিক হয়। কথাবার্তা একবারে পাকাপোক্ত হয় দু’জনের মত নিয়েই। কিন্তু বিয়ের আগের দিনই অঘটন ঘটে যায়।”
প্রতাপ সাহা কথা থামাতেই পরিবেশে উত্তেজনা ছেয়ে যায়। সকলের কৌতূহল দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ। পরে কি হয়েছে জানার জন্য প্রতিটা প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠে। দর্শিনী কৌতূহল দমাতে না পেরেই বলে উঠে,
“পরে কী হয়েছে বাবা, বলো না।”
প্রতাপ সাহা বন্ধুর মুখপানে চায়। অতীতের এই স্মৃতিটা খুব ভয়াবহ ছিলো। বন্ধুর সাথে বিচ্ছেদের সূত্রপাত যে এখানেই।
বিষ্ণুযশ হয়তো বুঝতে পারলো বন্ধুর মনের খবর, তাই বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে দিলো বন্ধুর কাঁধে। চোখ দিয়ে ভরসা দিলো “আমি আছি”।
প্রতাপ সাহা বড় এক শ্বাস ফেললো। এ বয়সে এসে আবার বন্ধুর বিশ্বস্ত হাত পাবে ভাবতেই পারে নি সে। অতঃপর মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
” তারপর তোমার ছোটো কাকা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে সময় এমন ঘটনা বিরল ছিলো। আর একটা মেয়ের বিয়ের আগেরদিন বিয়ে ভাঙাটা যে কতটা ভয়ঙ্কর ছিলো তখন, আমি বলে বুঝাতে পারবো না। পুরো গ্রামে ছড়িয়ে গেলো নোলকের মানে মৃত্যুঞ্জয়ের পিসির বিয়ে ভাঙার খবর। হৈ চৈ, হা হুতাশ, কুসংস্কারের বেড়াজালে পিষে গেলো মেয়েটার হাসি। ঘরবন্দী হয়ে নির্বাসনে গেলো সে। নিজের ছোটো বোনের এমন অসহায়ত্ব মানতে পারে নি তার ভাই, তার পরিবার। শুরু হয় রেষারেষি। দুই পারিবারের সখ্যতার ভাঙন ধরে সাথে বিচ্ছিন্ন হয় আমাদের সম্পর্কও। তোমার ছোটো কাকাও ততদিনে বিয়ে করে ফেলে। আমাদের সম্পর্কটায় অনাকাঙ্খিত ঘূণে ধরে। বাড়তে থাকে দূরত্ব। নোলকের অবশ্য পরে বড় পরিবারে বিয়ে হয় কিন্তু আমাদের ততদিনে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তা সাত সমুদ্র তেরো নদীর চেয়েও বিশাল হয়ে উঠে। বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগেই দেশ ছাড়ে সে। দূরত্ব তখন দেয়াল হলো, বিচ্ছিন্নতা নাম লেখালো বিচ্ছেদে। তারপর, শৈশবের খেলার সাথী কেবল চেনা মুখ হয়ে রইলো।”
কথা থামলো, দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো পরিবেশ। সন্ধ্যা তখন প্রকৃতিতে আরও ঘন হলো। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠলো কৃত্রিম আলোর ঝলক। উঠোন জুড়ে হলুদ বাল্বের আলোয় ঝলমল করে উঠলো কাছে আসার গল্প গুলো। কিছুটা সময় একবারে চুপ রইলো সবাই। নিরবে রইলো কণ্ঠধ্বনিরা।
কথা বললো এবার নিপা। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাবা, তাহলে আজ এত গুলো বছর পর আপনাদের দূরত্ব ঘুচলো কীভাবে, সেটা বলবেন না?”
“সে গল্প নাহয় আমি বলি?”
মৃত্যুঞ্জয়ের বাবার উত্তরে সবাই সেই মানুষটার দিকেই চাইলো। মানুষটার মুখটা আজ কেমন হাসি হাসি। অথচ এত গুলো দিন মানুষটাকে নিপাট ভদ্রলোক, গম্ভীর, কাঠখোট্টা ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। মানুষটা যে হাসতেও জানে, এটা যেন কারো ভাবনাতেই আসে নি।
“কি হলো বাচ্চারা? আমি বলবো বলে কী তোমরা শুনতে ইচ্ছুক না? এমন চুপ করে গেলে যে?”
ভদ্রলোকের কথায় সবাই কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেলো। দর্শিনী অকপটে বললো,
“নিরবতায় সম্মতির লক্ষণ। জানেন তো।”
ভদ্রলোক উপর নীচ মাথা নাড়ালো মুচকি হাসির সহিত। দর্শিনীর পানে তাকিয়ে বললো,
“তোমার কথার ধরণ আমার বেশ লাগে। বাবার মতনই হয়েছো, স্পষ্টভাষী। তো এবার বাকিটা বলি? কাল রাত তখন তিনটে। গ্রামের ছমছমে ভাব, দূরের জঙ্গলি শেয়াল গুলোর অনবরত ডাকে ঘুমটা কেমন হালকা হয়ে গেলো। আবার চলে যাবো, কবে না কবে আসি সবটার জন্যই ঘুমটা গাঢ়ো হওয়ার আগেই ভেঙে গেলো। আস্তে ধীরে উঠে বসলাম। ঘরের মাঝে কেমন দমবন্ধ লাগছিলো বলে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি। এমতবস্থায় হুট করে আমার নজর গেলো আমাদের বাড়ির সামনে খালি জমিটার দিকে। কে যেন বসে আছে জমিটার মাঝে। আমি প্রথমে বেশ চমকে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কিছু মনে হতেই তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম। জমিটার কাছে আসতেই পা দু’টো থেমে গেলো। প্রতাপ জমিটার মাঝে বসে কান্না করছে। আমি ভীষণ অবাক হলাম। আমার জীবনে আমি কখনো এই ছেলেটাকে ভেঙে পড়তে দেখি নি, এ অবস্থায় দেখে আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। যতই ওর সাথে কথা না বলি, একটা রেষারেষির দেয়াল তুলে রাখি না কেনো, একটা সময় ও আমার আত্মার সঙ্গী ছিলো, সেটা আমি ভুলে যেতে পারি নি কখনো। এই প্রথম আমি ডাক দিলাম, ‘প্রতু, কাঁদছিস কেনো?’ হঠাৎ কারো কণ্ঠে শুনে প্রতাপ চমকে যায়। সে বুঝতে পারে নি তার এত গোপনীয় দুর্বলতা কেউ বুঝে ফেলবে, ধরে ফেলবে। দুর্বলতা লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে গেলো সে অনবরত। আমি কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে ওর অধঃপতন দেখলাম। আমার কাছ থেকে কিনা ও কান্না লুকাচ্ছে! হাহ্। মিনিট পাঁচ পেরুতেই ও আমার বুকে এসে হামলে পড়লো। সেই চেনা মাঠ, শৈশবের প্রিয় জায়গা, প্রিয় বন্ধুকে কাছে পেয়ে অনেক বছরের মিছে অভিমানের দেয়াল হুড়মুড় করে খসে পড়লো। অনেকটা সময় দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে কাঁদলাম। এত বছরের ভারী ভাব এক নিমিষেই কমে গেলো। সারাটা রাত নিরবে দু’জন দু’জনের পাশে বসে কাটালাম। জীবনের সকল প্রাপ্তির খাতাটায় বিরাট অপ্রাপ্তি ছিলো এই বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ। হুট করেই যেন সে অপ্রাপ্তি প্রাপ্তিতে পরিণত হলো। যখন ভোরের আলো ফুটলো, তোমার বাবা এত এত বছরের জমিয়ে রাখা সরিটা ঢেলে দিলো আমার কোলে। নিরবতা ভেঙে বললো, ‘আমার ভুলের ক্ষমা হয় না। ক্ষমার মুখ নেই আমার, তবুও বলছি আমি দুঃখীত। আরেক জনম পেলে, বন্ধু হিসেবে তোকেই চাই।’ নিজের কথা শেষ করেই সে চলে এলো। আমার কথা অব্দি শুনে নি। আমিও বাড়িতে গেলাম। তোড়জোড় পড়লো বিদায় নেওয়ার। বুকে পাথর চেপে গাড়িতে উঠলাম, কিন্তু শেষ অব্দি সবটা ভেবে আর যেতে পারলাম না। বাঁচবোই তো আর ক’টা দিন, আফসোস নিয়ে দুনিয়া ছাড়ার মতন আফসোস যেন আমার না থাকে। অতঃপর আমি চলে এলাম বন্ধুর সাথে শেষ জীবনের অবসাদ ভাগ করে নিতে। ও দেশে আমার যা আছে তা ভাই ই দেখে রাখতে পারবে কিন্তু এ দেশে আমার যা আছে তা দেখে রাখার কেউ নেই। আমার বন্ধু, আমার দেশের মাটি, এদেশ ছাড়া কেমনে থাকি?”
দীর্ঘ বক্তব্যের পর থামলো ভদ্রলোক। এতক্ষণের টান টান উত্তেজনার অবশেষে অবসান ঘটলো। সবার চোখে অবাক ভাব। এই দু’জন মানুষ অন্তরে কতটা ভালোবাসা পুষে রেখে এতদিন কেবল পরিচিত হয়ে ছিলো! সামান্য এক বাক্যে তাদের দীর্ঘদিনের নির্বাসন শেষ হলো! উপস্থিত সবারই চোখে খুশির অশ্রু। ভালো কিছু দেখতেও ভালো লাগে।
তন্মধ্যেই নিধি রান্নাঘর থেকে ট্রে তে করে চা নিয়ে হাজির হলো। সবার হাতে হাতে চায়ের কাপ, বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে হাসি-হাসি মুখে বললো,
“অনেক তো হলো বিষাদ, এবার একটু স্বাদের চা খাওয়া যাক। আজ কিন্তু আমি আর নিপা মজার রান্নার আয়োজন করেছি, রাতে এখানেই খেতে হবে। কোনো না শুনছি না।”
নিধির এমন হাসিমুখ দেখে সবার হাসিই বিস্তৃতি লাভ করলো। নিপাও মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, বড়দির মতন হয়তো অত মজার রান্না পারবো না তবে খারাপও হবে না। অবশ্যই আজ এখানেই সবাইকে খেতে হবে।”
বউদের উৎসাহ দিয়ে প্রতাপ সাহাও বললেন,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, যেখানে আমার ঘরের লক্ষীরা প্রস্তাব দিয়েছে সেখানে আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। বৌদি, বিষ্ণু, মৃত্যুঞ্জয় সবাই শুনেছো তো?”
“হ্যাঁ ভাই শুনেছি। মা লক্ষীদের চটিয়ে লাভ নেই। আজ নাহয় বন্ধুর সাথে অন্নভোজ হবে।”
মৃত্যুঞ্জয়ের বাবার কথায় নিপা, নিধি খিলখিল করে হেসে উঠলো। সাথে উপস্থিত সবাই তাল মিলালো। দর্শিনী চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেবল দেখে গেলো হাসি-খুশি এই পারিবার দুটোকে। কোনো দুঃখ নেই, কোনো রাগ নেই, ক্ষোভ নেই। দুনিয়ার বাঁধা ধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে যেন একেক জন সুখে মত্ত হয়ে গেছে। এমন দৃশ্য দেখতে পাওয়াটাও সৌভাগ্যের। ইশ, দৃষ্টান্ত আর তৃণা থাকলে আর কোনো শূন্যতা অনুভব হতো না। একদম পার্ফেক্ট। তবে একটা কথা আছে না, দুনিয়ায় কোনো কিছুই পার্ফেক্ট হয় না। তাই এই দৃশ্যটিতেও কিঞ্চিৎ খুঁত রয়ে গেলো।
সবার অগোচরে ধীর গতিতে দর্শিনী উঠে গেলো। কিছু হিসেব যে এখনো মিলছে না। এত সুখেও নিজেকে সে খুঁজে পাচ্ছে না। ভাবতে ভাবতেই নিজের ঘরে চলে গেলো সে। বাহিরে তুমুল হাসাহাসির শব্দ। হৈ-চৈ। সুখেরা যেন আজ হাট বসিয়েছে তাদের বাড়ির উঠোনে।
অন্ধকার ঘর, বাহিরের চাঁদের আলো, ফিনফিনে শীতল বাতাস। এ পরিবেশটা খারাপ লাগছে না দর্শিনীর। জানালার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে যে বিশাল প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে। এর উত্তর কার কাছে মিলবে!
“উত্তর বিহীন প্রশ্ন গুলো পুড়োচ্ছে, তাই না মা?”
বাবার কণ্ঠে কেঁপে উঠলো দর্শিনী। বাবা মনের কথা জানলো কীভাবে? অবাক চোখে বাবার দিকে তাকায় সে।
দর্শিনীর তাকানো দেখে হাসে প্রতাপ সাহা। মেয়েটার তখন উঠে আসা চোখ এড়ায় নি তার। তাই তো মেয়ের দ্বিধা দূর করতে চলে এসেছে সে।
“বাবা,তুমি কীভাবে জানলে আমার মনের সংশয়?”
“বাবা হই তোমার। তোমার মন বুঝবো না? ছোট থেকেই তোমার অনুভূতিদের মুখস্থ করেছি, আজ তাহলে অবুঝ হবো কেনো?”
বাবার কথায় স্মিত হাসে দর্শিনী। বাবার কাছে এগিয়ে এসে বাবার বুকে মাথা রাখে। স্থির কণ্ঠে বলে,
“বাবা, কাকাবাবু তো একটা অন্যায় করেছিলো, তুমি সব বললে, সেটা বললে না?”
মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় বাবা। ছোট্ট কণ্ঠে বলে,
“আমাদের জমি আমরা ফিরে পেয়েছি, মা। হরমোহন বাবু কোনো ঝামেলা ছাড়াই নির্দ্বিধায় আমাদের জমি দিয়ে দিয়েছেন। দৃষ্টান্তের শেষ ইচ্ছে পূরণ করার জন্য ই নাকি এ কাজ করা। যতই হোক, সেও তো বাবা। বাবা শব্দটার অনুভূতি কিঞ্চিৎ তো তারও আছে।”
দর্শিনী অবাক হয়ে গেলো বাবার কথা শুনে। অমন একটা মানুষেরও শেষমেশ সন্তান প্রীতি জন্মালো! অবশ্য হারানোর পর প্রীতি জন্মিয়ে কি লাভ! যদি বেঁচে থাকাকালীন মূল্য না দেয়।
বিরাট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে। আনমনেই বললো,
“জমিটা পেয়ে গেছি তাই বলে তোমার বন্ধুর দোষ কমে যাবে না তাই না, বাবা? হরমোহন জেঠাকে উসকানি কিন্তু সে-ই দিয়েছিলো। আমরা নিজের চোখেই দেখেছিলাম। মনে আছে সেদিনের কথা?”
প্রতাপ সাহা চোখ বন্ধ করলো। সেদিনের কথা সে ভুলে নি। হরমোহনের বাড়ির ভেতরের মানুষটা বিষ্ণুযশই ছিলেন, যে হরমোহনকে জমি ছিনিয়ে নেওয়ার তাগিদ দিয়েছিলেন। পুরোনো রেষারেষি থেকে হয়তো এমন কাজ করে ফেলে ছিলেন। যেহেতু আজ সবটা ভুলে দু’জন দু’জনকে টেনে নিয়েছে বুকে তাই পুরোনো কিছু মনে রাখা বোকামো।
মেয়েকে আদুরে ভাবে বললেন,
“রাগ, জেদের বশে মানুষ অনেক কিছুই করে, মা। আমার বন্ধুও করেছে। কিন্তু আজ ও সেসব কিছুই মনে রাখে নি, এগিয়ে এসেছে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে, তাই আমাদেরও ভুলে যাওয়া উচিত সেসব। খারাপ মনে রেখে জীবনে ভালো থাকা যায় না, মা। জীবনটা ক্ষনিকের, প্রিয় মানুষ গুলোকে আঁকড়ে রেখে সে জীবন অতিবাহিত করাই বুদ্ধিমানের কাজ।”
বাবার কথার তাৎপর্য হয়তো বুঝলো দর্শিনী, তাই আর কিছু না বলে চুপটি করে মাথা এলিয়ে রাখলো বাবার বুকে। বাহিরের চাঁদের আলোয় ঝলমল করে উঠলো বাবা-মেয়ের ভালোবাসা।
মিনিট পেরুতেই প্রতাপ সাহার ডাক এলো। মেয়েকে বুকের মাঝ থেকে উঠিয়ে পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা চিঠি বের করে মেয়ের দিকে এগিয়ে দিলো সে। একুশ শতকের যুগে, বাবার হাতে চিঠি দেখে অবাকে হা হয়ে রইলো দর্শিনী।
প্রতাপ সাহা মেয়ের বাহুতে হাত রেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন,
“তোমার চিঠি, শহর থেকে এসেছে। কিছু মানুষকে গোপনে ভালোবেসে যেও। মানুষ হারায়, স্মৃতিরা না।”
বাবা প্রস্থান নিলেন। দর্শিনী কেবল বাবার যাওয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। বাবার কথা ঠিক বোধগম্য হলো না তার। কিন্তু চিঠিটার প্রতি কৌতূহল বেড়ে গেলো। ঘরের হালকা আলোর বাল্ব টা জ্বালিয়ে দিলো। টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। খুব যত্নে, ধীরে ধীরে চিঠিটা খুললো। চিঠিটা খুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো কিছু স্মৃতি। চিঠিতে লিখা,
প্রিয় বৌদিভাই,
বৌদিভাই বলাতে হয়তো রাগ করেছিস তাই না? কী করবো বল? তোর সাথে আমার পরিচয়টা এই সম্পর্ক দিয়ে তাই না চাইতেও ডাকলাম। বুঝলি তো সই, অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম, এই শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার। এ শহর তো আমার সব কেঁড়ে নিলো। আমার মা, বাবা, ভাই, বৌদি। আমার বড়ভাইকে মানুষ থেকে মানসিক রোগীতে পরিণত করলো। সব হারালাম আমি। কি লাভ এখানে পড়ে থেকে! জীবনটা আমার হারানোর খাতায় সীমাবদ্ধ। তাই নিজের মানসিক ভারসাম্য হীন দাদাকে নিয়ে পাড়ি জমালাম অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতে। আপন মানুষ ছাড়া একটা শহরে। যেখানে আমার হাসানোর মানুষও থাকবে না, কাঁদানোর মানুষও থাকবে না। তোকে এমন ঘটা করে চিঠি দেওয়ার কারণ কী জানিস? আমার দেওয়া একটা স্মৃতি তোর কাছে থাকুক যেটা মনে করাবে আমাকে, সেই জন্য ই চিঠি লিখা। তোর সাথে আমার আর কখনো দেখা হবে না ভাবতেই আমার ভীষণ কান্না পায় জানিস! আমার আপন মানুষ গুলো হারিয়ে গেলো এক নিমিষেই। হাসতে-খেলতে থাকা আমাদের সংসারটা কেমন মিলিয়ে গেলো হুট করে। আর কখনো তোর সাথে গল্পের আসর জমানো হবে না, আর কখনো ভাগাভাগি করা হবে না নিজেদের ভাগ, তোকে জাপ্টে ধরতে পারবো না আর। এই কষ্ট আমি কাকে দেখাবো রে? কেউ যে রইলো না আমার। তুই নতুন একটা জীবন শুরু করিস। তোর জন্য ভালো কিছু আছে। নিজেকে ভালো রাখিস। আমার কারো প্রতি রাগ-অভিযোগ নেই। এমনকি আমি ঘৃণা করতে পারলাম না কাউকে। কীভাবে করবো বল ঘৃণা? কাকেই বা করবো? বাবাকে? যে বাবা আমার আবদারের ঝুলি ছিলো। নাকি মাকে করবো ঘৃণা? যে মায়ের গর্ভে নয়মাস আর সংসারে এতগুলো বছর নিশ্চিন্তে বাস করেছি। আমার অভাগিনী মা’রে আমি কেমনে ঘৃণা করবো বল? নাকি দাদাকে? যে দাদা কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে আমায়। যদি ঘৃণা করতে হয় আমার ভাগ্যের প্রতি সকল ঘৃণা রইলো। এতটা খারাপ সে না হলেও পারতো। তোর প্রতি আমার এক আকাশ ভালোবাসা রইলো। কখনো মনে পড়লে স্মৃতির পাতায় খুঁজে নিস, মনে রাখিস, আমি আছি।
ইতি
তোর বিহু।”
চিঠি শেষ। বুকের মাঝে ভারী পাথরের মতন অনুভূতি। এত ব্যাথা কেন হারানোতে! বেছে বেছে তারই কেনো মানুষ হারায়!
চোখ হতে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা। পৃথিবীতে বড্ড রঙচঙে ঘটনায় কত মানুষ হারিয়ে যায়। এই হারিয়ে যাওয়ার শোক আদৌও ভুলা যায়?
ডান হাতের তালুতে শক্ত হাতের ছোঁয়া পেতেই ভড়কে গেলো দর্শিনী। দ্রুত পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মৃত্যুঞ্জয় দাঁড়িয়ে আছে। দর্শিনীর টলমল চক্ষু যুগল সেই মৃত্যুঞ্জয়েই আবদ্ধ হয়ে রইলো।
পাশের চেয়ারটা ধীর গতিতে টেনে বসলো মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনীর হাতটা এখনো তার বা’হাতের মুঠোয়। ডান হাতে দর্শিনীর চোখের জল গুলো মুছে দিতে দিতে বললো,
“আর কত কাঁদবেন! অনেক তো হলো কান্নাকাটি। এবার হাসুন, বাঁচুন। জীবনে চলার পথে অনেক মানুষ আসবে, যাবে, মানিয়ে নিতে হবে এই সত্যের সাথে। তবেই না ভালো থাকবেন। জানেন, যখন জেনেছিলাম আমার বাবার উসকানিতে হরমোহন আপনাদের জমি নিয়ে এতটা হুলুস্থুল করছে তখন নিজেকে কতটা নিচু লেগেছিলো। আপনার চোখে চোখ মেলানোর সাহস হচ্ছিলো না। মনে হচ্ছিলো পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচবো। তাই এত ব্যস্ততা নিয়ে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত করলাম। কিন্তু হুট করেই মনে হলো আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না, অসম্ভব। তাই ছুটে এলাম আপনার কাছে, ক্ষানিক আশার আলো জ্বেলে যে আপনি আটকাবেন। কিন্তু এখানেও আশাহত হলাম। ভাবলাম, চক্ষুলজ্জা লুকাতে পারলেই নাহয় আবার আসবো, কিন্তু তাও পারলাম না যেতে। যে মায়ায় বেঁধেছেন আপনি সে মায়া যে কাটবে না প্রিয়দর্শিনী। সবাই চলে যাওয়ার পর মনে রাখবেন, আপনার জন্য আমি আছি।”
এতক্ষণের মৃত্যুঞ্জয়ের মুঠোর মাঝে থাকা দর্শিনীর হাতটাও আঁকড়ে ধরলো মৃত্যুঞ্জয়ের হাত। যেন সে ও চায়, কেউ একজন থাকুক তার।
★★★
পরিশিষ্ঠঃ
সময়ের স্রোতে ভেসে গেছে পাঁচটি বছর। পরিবর্তন হয়েছে জীবনের গতি। সে গতিতে গা ভাসিয়ে ভেসে গেছে সবাই বহুদূর।
সময়টা ঠিক এপ্রিলের মাঝামাঝি। ফিনল্যান্ডের শহর এম্পোর একটি বরফ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি দু’জন মানব মানবী। তাদের সামনে দু’বছরের একটা ছোট্ট বাচ্চা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। সাদা ধবধবে, মায়া মায়া চেহারার বাচ্চাটি খিলখিল করে হাসছে আর দৌড়াচ্ছে। হুট করে অসাবধানতাবশত বাচ্চাটি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। বাচ্চাটির বাবা এগিয়ে আসতে নিলে তাকে থামিয়ে দেয় বাচ্চাটির মা। এবং শুদ্ধতম একটি হাসি দিয়ে উৎসাহিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“প্রিয়দর্শিনী, উঠে দাঁড়াও তো সোনা বাচ্চা। তুমি না সাহসী মেয়ে।”
বাচ্চাটি পড়ে গিয়ে কেঁদে দিয়েছে। সে উঠার চেষ্টা করেও পারছে না। বাচ্চাটির মা আবার বললো,
“আমার প্রিয়ো পারবে উঠতে, উঠো তো মা।”
অষ্টম বারের চেষ্টায় বাচ্চাটি উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হলো। দুই বছরের বাচ্চাও উঠে দাঁড়াতে পেরে খিলখিল করে হেসে উঠলো। এবার হৈমন্ত মুখ খুললো। মায়ার দিকে তাকিয়ে প্রশংসিত কণ্ঠে বললো,
“বাহ্, মেয়েটাকে তো একদম লড়ুকে বানিয়ে দিয়েছিস। একদম পার্ফেক্ট।”
মায়া মিষ্টি হেসে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো,
“প্রিয়দর্শিনীরা কখনো হারতে জানে না হৈমন্ত ভাই। ওরা সবসময় জিতে যায়। তুমি তো আমাকে প্রিয়দর্শিনীর সাথে সাথি হয়ে থাকতে দিলে না, তাই আমি নিজের মেয়েকেই প্রিয়দর্শিনী বানিয়েছি।”
মায়ার কথার বিপরীতে হৈমন্ত ছোট্ট শ্বাস ফেলে। বাংলাদেশ ছেড়ে তারা চলে এসেছে আজ পাঁচ বছর। হৈমন্তের কথা অনুযায়ী মায়া দর্শিনীর সাথে যোগাযোগ রাখে নি কিন্তু নিজের মেয়েকেই বানিয়েছে দর্শিনী।
_
ছোট্টো গ্রামটার আজ অগাধ পরিবর্তন। টিনের ঘর এখন বিলুপ্ত প্রায়। ঘরে ঘরে, বাড়িতে বাড়িতে উঠেছে দালান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভরে উঠেছে চারপাশ।
দর্শিনী ব্যস্ত ভঙিতে তৈরী হচ্ছে। শরীরে বেগুনি রঙের চকচকে শাড়ি, ডান হাতে কালো ঘড়ি। স্কুলের সময় হয়েছে। গ্রামের স্কুলটাও এখন আধুনিক হয়েছে আরও। কি সুন্দর শৃঙ্খলা! সেই স্কুলেরই সহকারী অধ্যাপক সে। ডাক্তার হওয়ার শখটা তার পূরণ হয়নি কিন্তু সমাজে সম্মানিত একটা জায়গা পেয়েছে। স্কুলের থেকে দেওয়া কোয়াটারেই থাকে সে আর তার মেয়ে। বাবা তাকে অর্ধেক সম্পত্তি দিতে চেয়েছিলো কিন্তু সে সবটা ফিরিয়ে দিয়েছে হাসিমুখে। ঐ সম্পত্তির অধিকার তার ভাইদের আছে। ভাইদের প্রতি এমন অবিচার যে সাজে না।
তৈরী হয়ে ঘর থেকে বের হতেই মনে পড়লো তার মেয়ে আজ আসবে বাড়িতে। মেয়েটা মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়িতে ছিলো গতকাল। ঐ বাড়ির সবার চোখের মনি যেন মেয়েটা। তার মেয়েটা যে এত ভালোবাসা পাবে, ভাবতেই পারে নি সে। অবশ্য মৃত্যুঞ্জয় যেখানে, সেখানে ভাগ্যবতী হওয়টাই স্বাভাবিক। মৃত্যুঞ্জয়ের বাবা তো মোহনাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। ‘মোহনা মৈতী’ হলো প্রিয়দর্শিনীর মেয়ের নাম।
গ্রামের সরু পথটাতেই উঠতেই একটা কিশোর ছেলের সাথে দেখা হয় দর্শিনীর। তার জন্য চিঠি নিয়ে এসেছে ছেলেটা। শহর থেকে নাকি এসেছে। দর্শিনী ভ্রু কুঁচকে চিঠিটা হাতে নিলো। এতবছর পর কে তাকে চিঠি পাঠিয়েছে ভাবতেই অবাকে কপালে ভাজ পড়লো। চিঠির উপরের ঠিকানার মাঝে একটা সিল মারা। সিলটা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের।
হঠাৎ করেই ধক্ করে উঠলো দর্শিনীর বুকটা। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠলো এককালীন ভালোবাসার মানুষটার মুখটা। এত গুলো বছর যে মুখটা ঝাপসা হয়ে ছিলো, আজ সেটা চকচকে হয়ে উঠেছে। শরীর কেমন কাঁপছে, ঘাম বের হচ্ছে তরতর করে।
কাঁপা কাঁপা হাতেই দর্শিনী চিঠিটা খুললো। বিপ্রতীপের হাতের লেখা ভেসে উঠলো,
“প্রিয়-দর্শিনী,
তোমাকে প্রিয়দর্শিনী বলার অধিকার আমি হারিয়েছি সেই কবেই, আমি জানি। তাই একটু অন্য ভাবে বললাম, তবুও বললাম। আমি জেল থেকে বলছি দর্শিনী। আমি তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা বিপ্রতীপ বলছি, যাকে ভালোবেসে তুমি ঠকেছো। খুব বাজে ভাবে ঠকেছো। আজ তোমাকে একটা সত্যি কথা বলতে চাই দর্শিনী, আমি তোমার সাথে বেইমানী করেছি ঠিকই, কিন্তু আমি মায়াকে অপবিত্র করি নি। বিয়ের এত গুলো মাসেও আমি ওকে ছুঁই নি। কেনো ছুঁই নি জানিনা, তবে এতটুকু জানতাম তোমার মতন কেউ হবে না। আমার একটা মোহ আজ আমার ধ্বংসের কারণ। নিজের সন্তানের মুখ অব্দি দেখতে পাই নি। কত যন্ত্রণা নিয়ে যে বেঁচে আছি, কাকে জানাবো এই চৌদ্দ শিকের গল্প! অবশেষে, আগামীকাল আমার ফাঁ*সির তারিখ। এরপর জেল থেকে মুক্তি পাবে মৃ*ত আত্মার বিপ্রতীপ। জেল কর্তৃক জানানো হয়েছে তারা আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ করবে। আমার শেষ ইচ্ছে টা যেন তাদের বলি। তাই আমি তোমায় লিখলাম, আমার জীবনে অবহেলায় তুমি ছিলে, আজ নাহয় শেষ ইচ্ছেতে রাখলাম। তোমার কাছে চিঠি যেতে যেতে হয়তো আমি বিদায় নিবো পৃথিবীর বুক থেকে, তবে মনে রেখো দর্শিনী, ভালোবাসা আমার জীবনে একবারই এসেছিলো। যা আমি রাখতে পারি নি। আজ অনেক গুলো বছর পর কিছু বাক্য সাজিয়েছি অনুভূতি দিয়ে। “ভালোবাসি দর্শিনী, মৃত্যুর এই মুহূর্তটায় এসে মনে হলো, তোমার সাথে কাটানোর জন্য আমার একটা জনম বড্ড কম সময় হয়ে গেলো। তোমার সাথে আমি ত্রুটিমুক্ত একটা জীবন চাই। পরজন্মে তাহলে আমার হবে তো?
ইতি
ফাঁ*সির আসামী”
চিঠি শেষ। অনুভূতিরা শেষ হয় নি। কাঁপা কাঁপা শরীরটা হেলে পরে যেতে নিলেই কারো শক্ত বাহু বন্ধনে আটকে গেলো। চেনা শরীরের ঘ্রাণ বলে দিলো, যুগ যুগের বন্ধুর হাত এটা।
মৃত্যুঞ্জয় ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“কি হলো প্রিয়দর্শিনী! শরীর খারাপ করছে? এমন করছেন কেন? আমি না আসলে এখন কী হতো বলেন তো? ইশ, ঘামছেন তো।”
দর্শিনী ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মৃত্যুঞ্জয়ের দিকে। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“বিপ্রতীপের ফাঁ*সি হয়েছে। মানুষটা আর নেই।”
কান্নায় ভেঙে পড়লো দর্শিনী। মৃত্যুঞ্জয় বাহু বন্ধনে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটাকে। যতই হোক, জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষকে আদৌও ভুলা যায়? যায় না তো। তারা থেকে যায় অন্তরের অন্তস্থলে। তাদের থেকে যাওয়া ক্ষত’র উপর কেউ প্রলেপ লাগাতে পারে না। অনেক মানুষ আসে, দ্বিতীয়বার ভালোবাসা জন্মায় কিন্তু প্রথম ভালোবাসা যে মুছে না।
মৃত্যুঞ্জয়ের শার্ট আঁকড়ে ধরে দর্শিনী চিৎকার করে উঠলো,
“মানুষটা নেই, ভিনদেশী সাহেব। মানুষটা নেই।”
“আমি আছি তো। হয়তো তার বিকল্প হিসেবে না, কিন্তু বন্ধু হিসেবে আছি আমি।”
দর্শিনীর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার শব্দ ভেসে এলো। ভরসার হাতটাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। সত্যিই, এ মানুষটা তো তার আছে। গত পাঁচ বছরে ছেড়ে যায় নি। বিবাহ বন্ধনে হয়তো আবদ্ধ হয় নি তবে বন্ধু হয়ে থেকে গেছে। মানুষটা অপেক্ষায় আছে, দর্শিনী হয়তো কোনো একদিন তার হবে। আর খাতা কলমে দর্শিনী তার হোক বা না হোক, এমেনেতে তো দর্শিনী তারই। তাই তো দর্শিনী আজ নির্দ্বিধায় ভরসার বুকে ঠাঁই পেয়েছে।
বিপ্রতীপের বিদায়ে আজও কাঁদলো ভালোবাসা, প্রিয়দর্শিনী। পৃথিবীর বুকে প্রতিটি মেয়েই প্রিয়দর্শিনী। যারা প্রতি পদক্ষেপে ঠ*কে যায়, মূর্ছে যায়, উঠে দাঁড়ায় আবার। কেউ কেউ হারিয়ে যায় হয়তো না পাওয়ার আর্তনাদে। জীবন যু*দ্ধে মেয়েরা সবাই যোদ্ধা, সাহসী প্রিয়দর্শিনী। তৃণা, মায়া, মোহনা, বিহু, মৃত্তিকা, নিপা, নিধি সবাই, সবাই প্রিয়দর্শিনী। যারা লড়ে যাচ্ছে টিকে থাকার জন্য। এই লড়ে যাওয়ার গল্প হয়তো খোদাই হয় নি ইতিহাসের পাতায় কিন্তু পথ থেকে পথান্তরে প্রিয়দর্শিনীদের গল্প বুনে রাখে মানব হৃদয়। মানব হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো খোদাইয়ের স্থান নেই। পথান্তরের প্রিয়দর্শিনীরা বাঁচুক যুগ যুগ। হাসুক তারা। তাদের ভরসার কাঁধ হয়ে নাহয় মৃত্যুঞ্জয়রা নিঃস্বার্থ ভাবে থেকে যাক। প্রকৃতি রটুক প্রিয়দর্শিনীর জীবনমালা।
#সমাপ্ত
[অবশেষে এত এত অপেক্ষার পর বিদায় নিলো প্রিয়দর্শিনী। আলোচনা সমালোচনায় রেখে দিও তাকে। ভালোবাসা আমার ধৈর্যবান পাঠকমহলকে।]