এক_সমুদ্র_প্রেম! লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি (২৬)

0
478

#এক_সমুদ্র_প্রেম!
লেখনীতে: নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
(২৬)

‘আমরা তো আটজন। তাহলে এই টাকা কত করে ভাগে পড়বে?’
সুপ্তি বিরাট কৌতুহল নিয়ে আওড়াল। জোরাজুরি আর শত তর্কের পর এইটুকু আদায় করেছে বরপক্ষ থেকে। ক*ষ্ট তারা করলেও ভাগীদার তো কম নেই। পুষ্প,শান্তা কেউই তার কথায় কান দিলো না। দুজনে গভীর মনোযোগে কচকচে নোট গুনছে।
পুষ্প গুনে গুনে শেষ করে বলল ‘ তেরো হাজার। ‘
শান্তা ভ্রুঁ তুলে বলল ‘ দু-হাজার কম দিলো?’
‘ তাইতো দেখছি।’
‘ কত্ত বড় ধরিবাজ! ঠকালো আমাদের। দেখাচ্ছি মজা!’
সে তে*ড়ে যেতে নিলে পুষ্প থামিয়ে দিল। টেনে ধরে বলল
‘ যাসনা! এখন বললেও বিশ্বাস করবেনা। ভাববে দু হাজার সরিয়ে রেখে এসছি।’
‘ তাহলে কী করব এখন? এটাত চি*টিং! চি*টিংবাজ পরিবারে বোনকে পাঠাব?’
‘ তো কী করবি? মনে হয় ভাইয়ার ভাইটার কাজ এসব। টাকাত তিনিই দিলেন। ওটাকে একটা শায়েস্তার ব্যবস্থা করতে হবে।’
শান্তা দুপাশে মাথা দোলাল। রা*গ নিয়ে বলল ‘ বিয়ে ভে*ঙে দেই?’
‘ বিয়ে ভা*ঙবি? আচ্ছা যা, পারলে মামাকে বল গিয়ে।’
শান্তা চুপসে গেল। সুপ্তি ঠোঁট টিপে হেসে বলল
‘ আপুর সেই সাহস আছে না কী?’
শান্তা চোখ রাঙালো ওকে।
তারপর পুষ্পর দিক চেয়ে বলে ‘ এখন কী করব তাহলে? ‘
পুষ্প ভাবুক ভঙিতে গালে হাত দেয়। কিছুক্ষন মন দিয়ে চিন্তা করে বলল,
‘ আগে এই টাকা রেখে আসি দাঁড়া। ব্যাটা দুলাভাইয়ের জুতো চুরি আর হাত ধোয়ানোর ওসিলায় ছোট বাজেট রাখব ভেবেছিলাম। কিন্তু না,ওনার ভাইয়েরা যখন ঠকিয়ে দিলো তখন একটা বড় এমাউন্ট দাবি করতেই হচ্ছে।’

সুপ্তি বলল ‘ যদি না দেয়?’
‘ দেবেনা কেন? ভরা বিয়ে বাড়িতে সন্মান বাঁচাতে হলেও দেবে। আর এবার ওখানে বসেই গুনব।’

পুষ্প বলল ‘ কারেক্ট! বুদ্ধি আছে তোর। আচ্ছা তোরা দুটো গিয়ে বরের আসনের ওখানে দাঁড়া। ফাঁকফোকড় খোঁজ কীভাবে জুতো আনা যায়! আমি টাকা রেখে এসে পিউকেও ডাকি। ও এসব চুরি টুরি ভালো পারবে।’

সুপ্তি বুঝতে অক্ষম। সে বোকা গলায় বলল,
‘ পিউপু চুরি ভালো পারবে কেন? ওকি চোর ছিল আগে?’
পুষ্প বিরক্ত চোখে ফিরে তাকাল। মৃদূ ধম*কে বলল,
‘ বলদ! যা ডেকে নিয়ে আয়। কই গেছে ওটা? গেট ধরার সময় তো দেখিনি।’

বলা মাত্র সুপ্তি গাউন উচুতে ধরে ছুটল।

পিউ মন খারা*প করে দাঁড়িয়ে। তাকে চেয়ার থেকে তুলে দিয়ে ধূসর বসেছে,পাশেরটায় জায়গা দিয়েছে ইকবাল কে। আর ওকে ক*ঠিন কণ্ঠে হুকুম করেছে
‘ এখানে দাঁড়িয়ে থাক!’

পিউ একটু পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। বিয়ে খেতে এলো কত লাফালাফি করার স্বপ্ন নিয়ে। মানুষটা আসবেনা বলে বহু কাঠখড় পু*ড়িয়ে একটা বুদ্ধি বের করেছিল! সফলও হয়েছে। অথচ গ্যারাকলে সেই পরল শেষমেষ । যে মানুষটাকে আনার এত তোড়জোড় সে-ই এখন ওকে এক পা-ও নড়তে দিচ্ছেনা। একেই বলে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মা*রা। ব্রিটিশের হাতে নবাবের শাস্তি। এর থেকে একা একা এসে ঘুরে গেলে ভালো হতোনা?
পরমুহূর্তে পিউ দুদিকে মাথা নেড়ে ভাবল
‘ না না। ধূসর ভাই যাই করুক,ওর সাথেই তো করছেন। সে যে চোখের সামনে থাকছেন এই ঢেড়। তাকে তো এভাবে বাসায় পাওয়াই যায়না। ওনাকে দিনরাত চোখের সামনে রাখতে একটা কেন,দশটা বিয়েতে নড়তে না পারলেও আক্ষেপ নেই। বরং এই এতদিন তাকে ছাড়া কীভাবে থাকতো? আর এই সুবাদে একটু কাছাকাছি হওয়া তো হয়েছে। সাথে নিশ্চিত হতে পারল মানুষটার অভিপ্রায় নিয়ে। ধুসর ভাইয়ের ঠোঁটের স্পর্শ…..’
পিউ ভাবতে ভাবতে তলিয়ে গেল। মানস্পটে আর মস্তিষ্কে কালকের কথা ভেসে উঠল। পিঠে ধূসরের চুমু দেয়ার মুহুর্তটা ভেবে ছোট্ট মন ঝাঁকুনি দেয়। কাঁ*পুনি ওঠে বক্ষে। পিউ ঠোঁট ভরে চিলতে চিলতে হাসে। ধ্যান ছুটল ধূসরের গম্ভীর স্বরে,
‘ পুষ্প!’
সে যাচ্ছিল বাড়ির দিকে। সহি সালামত স্থানে টাকা গুলো রেখে আসবে বলে। ডানে বামে তাকায়নি অবধি। ধূসরের ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গেল। ত্রস্ত পাশ ফিরে তাকাল। স্বাভাবিক, সহজ ভঙি। ধূসরের মুখ ছাপিয়ে পাশাপাশি চেয়ারটায় ইকবালকে দেখল বেখেয়ালে। চোখ সরিয়ে আনতে না আনতেই মস্তিষ্ক সজাগ হলো। ক্ষি*প্রবেগে ইকবালের মুখটায় ছুড়ল অক্ষিযূগল। ইকবাল মিটিমিটি হাসছে। চোখেমুখে দুষ্টুমি। এই সময় অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখে মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে উঠল। নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল পুষ্প৷ চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলল। বিস্ময়ের ভারে হাত থেকে টাকা খসে মাটিতে পরতেই ইকবাল আওড়াল,
‘ যা! পরে গেল।’
পুষ্প কম্পিত কণ্ঠে জবাব দিল,
‘ হহ্যাঁ ভভাইয়া?’
‘ এদিকে আয়।’
আগের থেকেও ভারী কণ্ঠ। চোরের মনে পুলিশ পুলিশ অবস্থা! পুষ্পর বুক ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। সে এক পা আগালে ধূসর বলল,
‘ টাকা তোল আগে।’
পুষ্প ভ*য়ে ভ*য়ে টাকা তুলল। বড্ড ক*ষ্টে, কাঁ*পা পায়ে এগিয়ে এসে ধূসর আর ইকবালের সামনে দাঁড়াল। আলগোছে একবার দেখল পিউকেও। ছোট মেয়েটার মুখমণ্ডল জুড়ে জিজ্ঞাসা। ঘটনার আদ্যোপান্ত মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে যে।

ধূসরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াতে পুষ্প চোখ নামিয়ে রাখল নীচে । ইকবালের ওপর রা*গে মাথাটা টগবগ করছে। এইভাবে না বলে কয়ে উড়ে এলো কেন? কোন সাহসে? এখন ধূসর ভাই বুঝে ফেললে? সর্বনা*শ! মে*রেই ফেলবে। পুষ্প মনে মনে দোয়া ইউনুস আওড়াল কয়েকবার। এর মধ্যেই ধূসর প্রশ্ন ছুড়ল,
‘ কী খবর তোর? সব কিছু ঠিকঠাক? ‘
পুষ্প বিদ্যুৎ বেগে মাথা তোলে। হুতভম্ব হয়ে চেয়ে রয়। হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন? তাও এখন? এরকম তো কস্মিনকালেও করেননি। ঠিক শুনল সে? সংশয় নিয়ে বলল
‘ হ্যাঁ? ‘
ইকবাল আগ বাড়িয়ে বলল,
‘ মানে তোমার দিন কাল কেমন যাচ্ছে?’

পুষ্প তাকালোনা। তবে কট*মট করে বলল ‘ ভালো।’
ধূসর তাকে আরো এক দফা অবাক করে বলল
‘যা। ‘
পুষ্প বিস্মিত। ধূসরের অদ্ভূত হাবভাব বিভ্রান্ত করছে মস্তক।
অনিশ্চিত কণ্ঠে শুধাল ‘ যাব?’
‘ হু।’
মেয়েটার বিশ্বাস হলোনা তাও। এইভাবে ধূসর ভাই ডাকলেন। আওয়াজ শুনেই তো প্রান ওষ্ঠাগত হয়েছিল। অথচ এমনি এমনি? সন্দিহান, অথচ নম্র কণ্ঠে বলল,
‘ এটা বলতে ডেকেছেন?’
ধূসর চোখ সরু করল,
‘ অন্য কিছু ভেবেছিলি?’
পুষ্প ঘন ঘন দুপাশে মাথা নেড়ে বলল ‘ না না।’
মনে মনে বলল ‘ সে আর বলতে! রুহ টাই উড়ে গেছিল।’
‘ যা তবে।’
আরেকবার ঘাড় হেলিয়ে হাঁটা ধরল সে। এপাশ ফিরে ইকবালের প্রতি রাগে কিড়*মিড় কিরল। একবার এই লোককে হাতের নাগালে পাক,এখানে আসার মজা বুঝিয়ে দেবে।

এর মধ্যে সুপ্তি হন্তদন্ত হয়ে হাজির হয়। পুরো প্যান্ডেল, উঠোনের তিন মাথা খুঁজে সে হয়রান যখন তখনি পিউকে দেখতে পেল এখানে। এতটুকু পথেই হাঁপিয়ে গিয়েছে সে। জোরে দুবার শ্বাস টেনে বলল,
‘ এই পিউপু! তোমাকে আমি কত জায়গায় খুঁজে ম*রছি জানো?’
পিউ বলল ‘ না জানিনা।’
‘ উফ! মজা বাদ দাও। চলো তোমার কাজ আছে!’
সুপ্তি ব্যস্ত ভঙিতে পিউয়ের এক হাত টেনে হাঁটা ধরতেই ধূসর বলল,
‘ কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ওকে?’
শীতল কণ্ঠে মেয়েটা দাঁড়িয়ে যায়। ভী*ত লোঁচনে তাকায়। ধূসরকে বসা থেকে উঠতে দেখে আ*তঙ্ক এক ধাপ বাড়ল। যবে থেকে শুনেছে লোকটা এলাকায় মা*রামা*রি করেছে, দেখলেই ভ*য় লাগে। ধূসর ভ্রুঁ উঁচাল তার চুপ থাকায়। সুপ্তি নড়েচড়ে উঠে, মিহি কণ্ঠে বলল,
‘ দুলাভাইয়ার জুতো চুরি করতে হবে।’
‘ ওকে নিচ্ছো কেন? ও কি চো*র?’
তারপর পিউয়ের দিক চেয়ে বলল ‘ তুই চোর?’
পিউ দুপাশে ঘন মাথা দোলায়।
‘ তাহলে যাচ্ছিস কেন?’
কণ্ঠের সাথে চাউনী দেখে সুপ্তির সাথে পিউও ভ*য় পায়। সে ঠোঁট চেঁটে উত্তর খুঁজল। এদিকে সুপ্তি হাতটা খামঁচে ধরেছে তার। ভ*য়ড*র উগলে দিচ্ছে নখে। পিউ মিনমিন করে বলল,
‘ বর্ষা আপুকে কথা দিয়েছিলাম,ওনার বরের জুতো আমিই চুরি করব। এখন না গেলে ওয়াদা ভ*ঙ্গ হয়ে যাবে না? ‘
ডাহা মিথ্যে কথায় ধূসর চিবুক শক্ত করতেই, পিউ অসহায় কন্ঠে বলল,
‘ একটু যাই,এরকম করছেন কেন? ওখানে বাবা,চাচ্চু,মামারা সবাই আছেন। কিচ্ছু হবেনা। ‘
ইকবাল পাশ থেকে বলল,
‘ যাক রে ধূসর! বাচ্চা মেয়ে, কতক্ষনই বা বসে থাকতে পারে?’

ধূসর রা*গ গি*লে নেয়। থম ধরে চেয়ে থাকে পিউয়ের মুখের দিক। মেয়েটা ভুলেও মাথা তুলল না। এই তুখোড় চাউনী তার ভেতরটা গুলিয়ে দেয়। ধূসর আচমকা তার বাম হাতের কনুই চে*পে ধরল। হকচকাল পিউ।
ধূসর ক*ড়া কন্ঠে বলল,
‘ একটা কথা শুনে রাখ পিউ,কালকের মত কোনও অকারেন্স যদি ঘটেছে! কে ঘটালো,কেন ঘটাল আমি কিন্তু সেসব দেখবনা। তবে কনফার্ম, খুন করে ফেলব তোকে।’

শৈত্য হুমকিতে পিউয়ের মেরুদণ্ড সোজা হয়ে এলো। হাড় ছাপিয়ে চলল অনুষ্ণ স্রোত। সে দুই ঠোঁট ফাঁকা করে চেয়ে থাকে। সুপ্তির মাথা চক্কর কা*টল,ঘোলা হয়ে এলো চক্ষু। এরকম ডায়লগ সে সিনেমায় বহুত শুনেছে, তাও খা*রাপ খারা*প লোকদের মুখে। এই প্রথমবার বাস্তবে শুনল। হাঁটু দুটো টলে উঠল তার। ধূসরের মতো ভ*য়ানক লোকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস হলোনা।
পিউয়ের হাত ছেড়ে রুদ্ধশ্বাস নিয়ে বলল
‘ আ আমি যাচ্ছি,তুমি এসো।’

পিউ ঢোক গিল*ল। আস্তে আস্তে পা বাড়াল। তার বিশ্বাস আজ কিচ্ছু হবেনা। কাল তো নাঁচতে গিয়ে অমন হয়েছে। আজ জুতো দুটো চুরি করেই এক জায়গায় যে বসবে টেনেও তুলতে পারবে না কেউ। জীবন এখনও বহুদূর বাকী। ধূসর ভাইয়ের বাচ্চার মা হওয়ার বদলে ওনার হাতে খু*ন হওয়ার শখ তার নেই।
নিজের প্রতি অঢেল,অসামান্য বিশ্বাস নিয়ে পিউ এগিয়ে যায়।

ধূসর কপাল কুঁচকে রেখেই চেয়ারে বসল। ইকবাল মন দিয়ে তার মুখশ্রী দেখল। সে তখনও পিউয়ের প্রস্থান দেখছে। ইকবাল হাসল। পরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে গান ধরল,

❝ প্রেম আ*গুন যার হৃদয় ভরা
অন্যে কি বুঝিবে তাহা সেজন ছাড়া?
সে জানে তার কেমন করে
কী জ্বা*লা পো*ড়ে বুকে,
প্রেমের মানুষ ঘুমাইলে চাইয়া থাকে।
ভালো মন্দের ধার ধারেনা যা বলার বলুক লোকে,
প্রেমের মানুষ ঘুমাইলে চাইয়া থাকে। ❞

ধূসর ঘাড় বেঁকিয়ে তাকাল। ইকবাল গান থামাল তৎক্ষনাৎ। পরপর হেসে ফেলল। ধূসর বলল,
‘ মজা নিচ্ছিস?’
ইকবাল জ্বিভ কেঁটে দুদিকে মাথা নেড়ে জানাল,
‘ না না, পাগল?’
ধূসর ছোট্ট শ্বাস ফেলল,
‘ নে,সমস্যা নেই। আমার মত অবস্থা হলে বুঝতি।’

ইকবালের দুষ্টুমি মিলিয়ে গেল। কাঁধে হাত রেখে গুরুতর কণ্ঠে বলল,
‘ আর কতদিন অনুভূতি চে*পে রাখবি ?’
ধূসরের বিদ্বিষ্ট মুখভঙ্গি যত্রতত্র বদলে যায়। চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। ঠিক আগের স্থানে চেয়ে থেকেই বলল,
‘ সময় হোক।’
‘ দেখিস, হিতে বিপরীত না হয়!’
‘ হবেনা।’
‘ নিজের ওপর এত কনফিডেন্স? ‘
ধূসর মৃদূ হেসে জানাল ‘ নিঃসন্দেহে! ‘

তারপর উঠতে উঠতে বলল ‘ চল, খাবার ওদিকটায় যাই। ‘
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ এখন তো ওখানে যাবেই।’
‘ কথা কম,আয়।’
ইকবাল হাঁটতে হাঁটতে বলল ‘ বলছিলাম কী ধূসর,শোন না…’

‘ কী?’
ইকবাল চিন্তিত কণ্ঠে বলল
‘ তোর চাচা তো আমাকে দেখলে কপাল কুঁচকে ফেলে। সহ্যই করতে পারেনা। এখন এখানে দেখলে কিছু বললে?’
ধূসর বলল,
‘ আমার ভরসায় এসেছিস?’
‘ হ্যাঁ, তো আর কার?’
‘ তাহলে চুপ থাক। ‘
ইকবাল ঠোঁটে আঙুল ধরে বলল ‘ ওকে।’

****
‘হাই দুলাভাই গণ’
টেনে টেনে ডাকল পিউ। বরের জন্যে পাতা আসন জুড়ে বর-সহ মোট পাঁচজন বসে। নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত ছিল তারা। ডাক শুনে এক যোগে তাকাল। বরের ভাই সাব্বির বলল,
‘ দুলাভাই গণ? আমরা এখনও বিয়ে করিনি। তাই আপনার মতো শালী থাকার চান্সও নেই । আপাতত এখানে আপনার দুলাভাই একজন মিস। এই যে আমার ভাই!’
পিউ ভ্রুঁ উঁচিয়ে বলল,
‘ ও তাই? সো সরি! আসলে আপনারা সবাই এত সেজেগুজে এসছেন,বুঝতেই পারিনি কোনটা বর কোনটা সং!’

সাব্বির নিজেদের একবার একবার দেখে বলল
‘ আমরা তো সাজিনি। আপনি বোধ হয় চোখে মেক-আপ নিয়েছেন বেশি। ওজন হয়ে গেছে তাইনা? ভারে চোখ মেলে তাকাতে পারছেন না বলেই এরকম মনে হচ্ছে!’

সৈকত বিয়ের বর বলে ঠোঁট টিপে হাসল। তবে বাকী তিনজন হেসে উঠল হুহা করে। পিউয়ের মধ্যে একটুও ভাবান্তর হলোনা। সে উলটে কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আপনার চোখে সমস্যা আছে। সানগ্লাস টা খুলে তারপর দেখুন। মেক-আপ না চিনলে এরকম তো বলবেনই। আমি কি মেকআপ করেছি? দুলাভাই আপনি বলুন, করেছি?’

সৈকত দুদিকে মাথা নাড়ল। তার বাম পাশে বসা মঈনুল জিজ্ঞেস করল
‘ তা আপনি মেয়ের কী রকম বোন হন?’
‘ পরিচয় কী দিতেই হবে?’
‘ দিলে ভালো হয়!’
‘ আপনিও কি আমার পরিচয় জানতে চান ভাইয়া?’

সৈকত ইতোপূর্বে পিউকে দেখেনি। দেখেছে পুষ্পকে। পুষ্পর সাথে পিউয়ের আদোল মিলিয়ে বলল,
‘ আপনি বোধ হয় পুষ্পর কেউ হন,তাইনা?’
‘ কার কী হই ওসব ছাড়ুন। আপনারা আমাকে দেখুন।’
তারপর
দুহাতের ভর দিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে বলল,
‘ আচ্ছা বলুন তো, আমি দেখতে কেমন? ‘
ভ্যাবাচেকা খেল সবাই। প্রবল বিস্ময়ে একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। গ্রামে এরকম প্রশ্ন, কোনও মেয়ের মুখে? মেয়েগুলো তো উলটে লজ্জ্বায় ধারে-কাছেই ঘেষেনা।
সাব্বির, সৈকতের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
‘ মেয়েটা মনে হয় শহরের।’

‘ ভাইয়ের কানে কী বলছেন? সামনা-সামনি প্রশংসা করতে বুঝি লজ্জ্বা লাগছে? ‘
সাব্বির ত্রস্ত তটস্থ হয়ে বসে বলল,
‘ না মানে…’
মঈনুল বলল,
‘ সরাসরি জিজ্ঞেস করেছেন,একটুত লাগছেই। ‘
‘ তাহলে এক কাজ করুন,ভাইয়ার রুমাল টা নিয়ে আপনাদের নাক চে*পে বসে থাকুন। ‘
জড়োতাহীন কথাবার্তায় ছেলেটা খানিক থতমত খেল।

সাব্বির এগিয়ে বসে বলল,
‘ আচ্ছা, লজ্জ্বা শরম বিসর্জন দিলাম, দেখি বেয়াইন সাহেবা কেমন! ‘
ওকে এগোতে দেখেই পিউ সোজা হয়ে দাঁড়াল। মুখ বেঁকিয়ে বলল,
‘ আপনার তো চরিত্রে দারুণ সমস্যা। মেয়ে দেখলেই এগিয়ে আসেন, ছিহ!’

সাব্বির অবাক হয়ে বলল
‘ আপনিই না বললেন?’
‘ আমি বললেই আপনি আসবেন? না বাবা বরের ভাই যদি এরকম হয়,বরের চরিত্র ভালো তো?’
সন্দিহান কণ্ঠে, সৈকত উদ্বেগ নিয়ে বলল,
‘ এই না না আমার চরিত্র ভালো। ‘
সাব্বির নির্বোধ বনে বলল,
‘ মানে কী? আমি কি দুশ্চরিত্র ?’
‘ তাইত মনে হচ্ছে! এখানে থাকা নিরাপদ না,যাই বাবা!’
তারপর ছুটে গেল পিউ। মঈনুল হতবাক চেয়ে বলল,
‘ কতটুকু মেয়ে আর কী কথাবার্তা! সাইজের সাথে মিল নেই।’

মাঈনুলের পাশে বসা কবির একটু নিরামিষ ধরনের। এতক্ষন ছিলও চুপচাপ। সে বলল
‘ ওসব বাদ দে। আপাতত সতর্ক থাক ভাইয়ার জুতো নিয়ে। সাব্বির কোনায় বসেছিস,দায়িত্ব কিন্তু তোর।’

সাব্বির নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বলল
‘ আরে হ্যাঁ হ্যাঁ জু’তো ঠিকঠাকই আছে, ভেতরের দিকে ঢোকানো একদম।’

‘ থাকলেত ভালোই। গেটে এমনিতেই টাকা কম দিয়ে বোকা বানিয়েছিস। এখন জুতো নিলে কত চাইবে ভাবতে পারছিস?’
‘ আরে নেবে কীভাবে? আমি আছিনা,আর কেউত এলোওনা নিতে।’
বলতে বলতে একটু সংশয় জাগল মনে। কী মনে করে চটপট খাটের ঝোলানো কাপড়টা তুলল। বসে থেকেই নিচে উঁকি দিল। জুতো দেখা যাচ্ছেনা। সাব্বির তৎপর নেমে দাঁড়াল। নীচু হয়ে ভালো করে চেয়ে দেখল জুতো নেই। আর্ত*নাদ করে বলল,
‘ ভাই জুতো তো নেই।’
সবাই উত্তেজিত হয়ে বলল ‘ ‘ কী? কে নিলো?’
সাব্বির সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথায় হাত দিয়ে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলল কিছুক্ষন। পরপর সচেতন কণ্ঠে বলল
‘ ওই মেয়েটা না তো?’
মঈনুল বলল ‘ ও হবে কী করে? খালি হাতে গেল তো।’
কবির বলল ‘ নিশ্চয়ই আমাদের বোকা বানিয়েছে। নাহলে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে নিজের চেহারা দেখিয়ে বলবে কেন আমাকে দেখতে কেমন? ‘

সাব্বির, সৈকতের দিক চেয়ে বলল ‘ আমাদের কথার তালে রেখে জুতো নিয়ে গেল। কী বুদ্ধি মেয়ের! ‘

***
‘ আসসালামু আলাইকুম! ‘
রাশিদ ধূসরের দিক চেয়ে চেয়ে উত্তর করলেন সালামের। শুধালেন,
‘ এ কে ধূসর?’
‘ আমার বন্ধু আঙ্কেল। একটা কাজে এসেছিল গ্রামে। তাই আপনাদের সাথে আলাপ করাতে নিয়ে এলাম। ‘
মুহুর্তমধ্যে রাশিদ গমগমে হাসলেন,
‘ ও তোমার বন্ধু? বাহ বাহ খুউব ভালো করেছ। তা বাবা কী নাম তোমার?’
ইকবাল বিনম্র জবাব দিল,
‘ ইকবাল হাসান। ‘
‘ বেশ বেশ। এই গ্রামে কী কাজে এলে?’
ধূসর বলল,
‘ ও জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আঙ্কেল। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন গ্রামে যায় লীগের পক্ষ থেকে। ওখানকার মানুষের সুবিধা অসুবিধা দেখে। সেরকম কাজেই এসছিল। ‘
‘ ও তাই না কী? বাহ ভালোই তো।’
ইকবাল ধূসরকে বলল,
‘ পরিচয় তো হয়েছে,আমি তাহলে এখন যাই?’
ধূসর বলল,
‘ হ্যাঁ যা! গাড়িতো আনিসনি। বাস পেতে পেতে সন্ধ্যা হবে। একটু অসুবিধে হবে পৌঁছাতে, তবে সমস্যা নেই ওকে?’
ইকবাল মাথা দুলিয়ে বলল
‘ আচ্ছা। আসি তাহলে আঙ্কেল?’
রাশিদ ভ্রু কুঁচকে বেগ নিয়ে বললেন,
‘ এই দাঁড়াও দাঁড়াও, কোথায় যাবে?’
‘ চলে যাব আঙ্কেল!’
‘ চলে যাবে মানে? এই ধূসর, বাবা তুমি এত বুদ্ধিমান ছেলে হয়ে এরকম কী করে বলছো বলোতো? ও তোমার বন্ধু,তোমার অতিথি,মানে আমাদেরও অতিথি। ও এসে আবার যাবে কেন? আজ এখানেই থাকবে। আমার মেয়ের বিয়ে, আর তোমার বন্ধু এসেও ফিরে যাবে এটা কোনও কথা?’

ইকবাল বলতে গেল
‘ কিন্তু আঙ্কেল…’
‘ উম্ম কোনও কিন্তু নয়। কাল তো ধূসররা ফিরছেই ঢাকাতে। তুমি গেলে ওদের সঙ্গে যাবে। আজ আর ফেরাফেরি নয়। ধূসর,তোমার বন্ধুকে কিন্তু কোথাও ছাড়ছিনা আজ। তুমি বরং ওকে নিয়ে খেতে বসো। ও না তুমিত সার্ভ করবে বলেছিলে, তাহলে বরং পোলাওয়ের বাটিটা নাও,আর আমি ওকে নিয়ে যাই। কেমন? ‘

ধূসর মাথা দোলায়। পরমুহূর্তে চিন্তিত কণ্ঠে বলল,
‘ ইকবাল থাকায় সমস্যা হবে না তো আঙ্কেল? না আসলে ও রাজনীতিবিদ, বড় আব্বু রাজনীতি… ‘
এটুকুতেই রাশিদ বুঝে নিয়ে বললেন,
‘ আরে চিন্তা নেই। দুলাভাইকে আমি সামলাব। ইকবাল তুমি এসো আমার সঙ্গে।’

সে বাধ্য ছেলের মত বলল ‘ জি আঙ্কেল!’
তারপর দুজন কদম ফেলল সামনে । ইকবাল যেতে যেতে ফিরে তাকাল। ধূসর ঠোঁট কাম*ড়ে হেসে ভুরু নাঁচাল। ইকবাল দুপাশে মাথা নেড়ে কপালে চার আঙেল ঠেকিয়ে স্যালুট দিলো। ধূসরের পাতলা ঠোঁট উঠে এলো এক পাশে। আশেপাশে তাকাল। আস্তে আস্তে টেবিল ভরে যাচ্ছে মেহমানে। সে দাঁড়িয়ে থাকল। একদম যেই টেবিল নারী শূন্য,শুধুমাত্র পুরুষ বসেছেন এগিয়ে গেল সেখানে। দায়িত্বে থাকা ছেলেটিকে বলল,
‘ এখানে আমি দিচ্ছি,তুমি অন্য টেবিলে যাও।’

*****

মারিয়ার মন আঁকুপাঁকু করছে বাইরে যাওয়ার জন্যে। ওখানকার শোরগোল দুইতলায় অবধি শোনা যাচ্ছে। অথচ বর্ষা একা,ওকে রেখে যেতেও পারছেনা। শেষে এখান থেকে তাকে সুমনা বেগম উদ্ধার করলেন। ঘরে ঢুকেই বললেন,
‘ ওর কাছে আমি বসছি মারিয়া। তুমি নিচে গেলে যাও।’
মারিয়া দ্বিধাদ্বন্দে পড়ল যাবে কী না। বর্ষার মলিন মুখস্রী। বেলাল কেঁদেকেটে যাওয়ার পর থেকে এক ফোটা হাসেনি সে। মারিয়া সিদ্ধান্তহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার মুখের দিক। বর্ষা তাকাল,হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ যা। আমি তো একটু পরেই আসব।’
মারিয়া স্বস্তি পেল। ঝটপট উঠে গেল বিছানা থেকে। স্ফূর্ত পায়ে চলল নীচে।

সাদিফ নতুন আরেকটা পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে বেরিয়েছে। তার মন মেজাজ খা*রাপ। সেটুকু আরো খা*রাপ হলো প্যান্ডেলে এসে পিউকে দেখে। ওর গায়ের মেরুন লেহেঙ্গা দেখে প্রথমে মনকাড়া লাগলেও এখন লাগছে ভীষণ বাজে। ম্যাচিং হয়েও হলোনা, আফসোস!
সাদিফ দাঁড়িয়ে থাকল। পিউ বরের জুতো নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত শান্তাদের সাথে। সে বুকের সাথে হাত ভাঁজ করে চেয়ে রইল ওর দিকে। অল্প অল্প হাওয়ায় পিউয়ের চুল উড়ে মুখে পরছে। কথার ফাঁকে সে গুঁজে দিচ্ছে কানে। ডাগর ডাগর চোখদুটো আরো বড় হচ্ছে আলোচনায়। সাদিফের মাত্র বিগড়ে যাওয়া মেজাজ প্রশান্ত হয়ে ফিরে এলো। দৃষ্টিতে ভীড়ল মুগ্ধতা। আরো একবার ঘোষণা করল,
‘ মেয়েটাকে তার চাই।’

কবে, কীভাবে, কোনদিন পিউকে এত মনে ধরেছে সে জানেনা। চোখের সামনে দেখতে দেখতে খুইয়েছে হৃদয়। পিউ একটু বড় হওয়ার পর থেকে সাদিফের বসন্ত কেঁটেছে ওর নামে। হয়ত পিউ এত চঞ্চল,ছটফটে বলেই। এই মন হারানোর সঙ্গা নেই,নেই দিনক্ষন। তবু সাদিফ জানে,পিউ তার অন্তকরনের অংশ। ওকে একটু হাসতে দেখলে বা পাশে ব্যঁথা হয়। বুক ধুকপুক করে। পিউয়ের হাতের ঠান্ডা জল তার তৃষ্ণা মেটায়। এর নাম কী? ভালোবাসা না? তাহলে নিঃসন্দেহে সে জানাবে,
‘ পিউকে সে ভালোবাসে। বহু দিন, বহু আগ থেকে ভালোবাসে। শুধু মেয়েটা বড় হোক,ভার্সিটির গন্ডিতে পা রাখুক,একদম সোজাসুজি পুরো পরিবারকে জানাবে সে! বড় চাচ্চুর কাছে চেয়ে নেবে ওকে। এইত আর কিছু দিনের অপেক্ষা। ‘

‘ এই ভাইয়া, ওখানে কী করছো? এদিকে এসো।’
পিউ হঠাৎই ডেকে ওঠে। ধ্যান ভা*ঙল তার। নড়েচড়ে পা বাড়াল। প্রতিটি কদমে শান্ত চোখে দেখতে থাকে পিউয়ের মুখখানি। এই ছোট্ট চেহারায় কী মায়া! কী স্নিগ্ধতা! কী শান্তি!
কাছে এসে দাঁড়াতেই পিউ ব্যস্ত কণ্ঠে বলল ‘ বরের জুতো চুরি করেছি বুঝলে,এখন এটা লুকোতে হবে। তুমি একটু বুদ্ধি দাওতো কোথায় লুকাই?’

সাদিফ মোহ থেকে বেরিয়ে আসে। নিজেকে সামলানোর অনবদ্য ক্ষমতা তার । বাকী প্রেমিকদের মত প্রেয়সীর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকেনা। পিউ কোনও দিন বলতেও পারবেনা এরকম দেখেছে। সে জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘ বাড়ির ভেতর রাখবি? না ঠিক হবেনা,কারো হাতে পরলে সমস্যা!’

শান্তা বলল ‘ আমিওত সেটাই বলছি। কোথায় রাখা যায়?’
তারা পাঁচজন চিন্তায় পড়ল। বাকীদের একটা হলেও পুষ্পর চিন্তার কারণ দুটো। সে ক্ষনে ক্ষনে সতর্ক চোখে ইকবালকে দেখছে। ওইত বরযাত্রীর সাথে কব্জি ডু*বিয়ে খেতে বসেছে লোকটা। হাসি ধরছেনা। দাঁত কপাটি সব উন্মুক্ত। পুষ্পর রা*গ হলো,নাকের পাটা ফুলে উঠল। তাকে দুঃশ্চি*ন্তায় মে*রে ফেলে এই লোক খাচ্ছে?

সুপ্তিও অনেকক্ষন ভাবল। আইডিয়া মাথায় আসতেই হৈহৈ করে বলল,
‘ পেয়েছি। আচ্ছা ধানের ঘরে রাখলে কেমন হয়? ওখানে তো আজ কেউ যাবেনা।’
সাদিফ বলল ‘ বুদ্ধিটা খা*রাপ না।’
পিউ বলল ‘ রেখে আসি তাহলে? ‘
‘ যা।’
সৈকতের পায়ের সাইজ নিঃসন্দেহে পিউয়ের দশটা পায়ের সমান। সে পা থেকে জুতো খুলে হাতে নিয়ে এগোবে এর মধ্যে রোহান ছুটে এলো। রূম্পা বেগম ওকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছেন। বরের হাত ধোঁয়াতে হবে।
পুষ্প এমনি সময় হলে যেত,কিন্তু যেখানে ইকবাল স্বয়ং উপস্থিত সেখানে প্রশ্নই ওঠেনা। ওই লোক এমনিতেই সন্দেহবাতিক।
শান্তা, সুপ্তি ছোট মানুষ। অতগুলো ছেলের মধ্যে ওদের একা পাঠানো ভালো হবে? পুষ্প বলল
‘ পিউ,তুই যা।’
পিউয়ের বুক ছ্যাত করে উঠল। মাথা খারা*প? ধূসর তাকে আস্ত রাখবে? জুতো নিতে গিয়ে কতগুলো সূরা যে পড়েছে! আর যাওয়া যাবেনা। উনিশ-বিশ হলে সর্বনা*শ। ধূসর ভাই জিন্দা ক*বর দিয়ে দেবেন।
সাদিফ ভাবল সে মানা করবে। এর আগেই পিউ বলল,
‘ না না আমি যাব না।’
‘ কেন?’
‘ আমি এসব পারব না। মৈত্রী আপু কই? ওনাকে তো আর দেখলামই না।’
‘ কল দিচ্ছি।’
পুষ্প ফোন ওঠালে সাদিফ বাঁ*ধা দিল,
‘ না থাক,দিসনা। শালীদের মধ্যে আর কেউ নেই?’

‘ ওইত মারিয়া আপু আসছে। ‘
মারিয়া তক্ষুনি উজ্জ্বল পায়ে এসে সভায় ভীড়ল। সাদিফ ওকে দেখতেই মুখ ঘুরিয়ে ফেলল আরেকদিক। মারিয়া কপাল কুঁচকে ভে*ঙচি কাটল মনে মনে। এই লোক কী ভাবল? যে অন্যদিকে মুখ ফেরাল আর সেও অপমানিত হয়ে গেল? অসহ্য! সে আস্ত সাদিফকে ছু*ড়ে ফেলল মাথা থেকে।
বাকীদের দিক চেয়ে বলল,
‘ আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল?’
পুষ্প বলল,
‘ হ্যা, তোমাকে দরকার।’
‘ বলো কী করতে পারি?’
‘ বরের হাত ধোঁয়াতে হবে।’
‘ এটা আর এমন কী?’
‘ সেটাইত। এই সামান্য কাজে আমরা কেউই যেতে চাইছিনা। তুমি বাকী,তুমিই যাও।’
‘ যাচ্ছি। কিন্তু হ্যাঁ, টাকাপয়সা যা পাব সেটা শুধু মেয়েদের। ছেলেরা কিন্তু ভাগ পাবেনা।’

সাদিফ ইঙ্গিত বুঝে তাকাল। নাকমুখ কুঁচকে বলল,
‘ এমন ভাব করছে যেন আমি থালা নিয়ে বসে আছি। যে সে হাত ধুইয়ে কখন টাকা আনবে আর আমাকে দেবে।’
মারিয়া পুষ্পর দিক চেয়ে বলল
‘ আমি কি কারো নাম বলেছি?’ অহেতুক লোকজন ক্ষে*পে যাচ্ছে কেন?
সাদিফ পুষ্পকে বলল,
‘ নাম বলেনি, মানে কথাটা আকাশে ছু*ড়েছে। আর সেটা এসে পরেছে আমার গায়ে। ক্ষে*পে যাওয়া স্বাভাবিক না?
মারিয়া বলল
‘ বুঝলাম না পুষ্প,আজকাল ছেলেরা এত মেসি টাইপের কেন হয়? সন্মান টন্মান নেই এদের? যেখানে সেখানে বা হাত নিয়ে চলে আসে।’

‘ পুষ্প তুই বলে দে, আমি সাদিফ, মানুষ বুঝে কথা বলি। আমিত তাকে বলিনি কিছু, সে অযথা উত্তর করছে কেন? আজব! মেয়ে মানুষ এত হ্যাংলা কেন?’

রে*গেমেগে উঠল মারিয়া,
‘ এই পুষ্প, এইসব লোককে থামতে বলো বলছি। নাহলে কিন্তু খুব খারা*প হবে ।’
‘ পুষ্প, তুই বলে দে আমি কারো কর্মচারী নই যে হুকুম মেনে চলব,থামতে বললে থামব। ‘
‘ নিজের মত চলুক না আমি তো কিছু বলিনি। শুধু আজেবাজে কথা বলতে মানা করো। ‘
‘ আমার মুখ, আমার ইচ্ছে, যা মন চায় তাই বলব।’

পুষ্প একবার মারিয়ার দিক দেখছে একবার সাদিফকে। মাঝখানে সে পরেছে মহাবিপ*দে। শান্তা, সুপ্তি, পিউ তিনজনেই হা করে শুনছে সব। একটা কথা কেউই বুঝতে পারছেনা, এরা ঝগড়া করছে কেন? কথা কা*টাকা*টি চরম পর্যায়ে যেতেই পুষ্প খেই হারাল। দুহাত তুলে চেঁচিয়ে বলল,
‘ ও প্লিজ চুপ করো তোমরা।’

দুজন হা করেও থেমে যায়। মারিয়া ফের ভেঙচি কে*টে আরেকদিক ফিরল। সাদিফ ও বিরক্তি নিয়ে ঘুরে গেল।
পুষ্প বলল ‘ এটা বিয়েবাড়ি। তোমাদের ঝগ*ড়া করতে হলে অন্য কোথাও যাও। ‘
মারিয়া বলল ‘ আমার বইয়েই গেছে যার তার সাথে ঝগ*ড়া করতে।’
সাদিফ ও বলল
‘ আমার ও বোধ খেয়ে দেয়ে কাজ নেই। এর থেকে রাস্তায় বেরিয়ে একটা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে আসা ভালো।’
মারিয়া ঘুরে বলল ‘ খুব খারা*প হয়ে যাচ্ছে!’
সাদিফ ও ঘুরে তাকাল ‘ হলে হচ্ছে! কী করবেন?’
রা*গে মুখ লাল হয়ে এলো মারিয়ার।
‘ আপনাকে আমি…. আপনাকে আমি…’
সাদিফ বিনা বিলম্বে বলল,
‘ কী? কী আমাকে? হুমকি দিতেই এত তোঁতলায়,সে আবার আসে সাদিফের সাথে লাগতে!’

পুষ্প উত্তেজিত হয়ে বলল ‘ এই তোমরা চুপ করবে ভাই প্লিজ? আসল কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। ‘
দুজনে নিশ্চুপ। অথচ একে অন্যকে ক্ষু*ব্ধ নজরে দেখছে।
পুষ্প দুটোকেই পুরোপুরি এড়িয়ে গেল। পিউকে বলল,
‘ তুই যা জুতো রেখে আয়। ‘
পিউ মাথা নাড়ল। মারিয়া শান্তাকে বলল,
‘ তাহলে চলো আমরা আমাদের কাজে যাই। ‘
সাদিফ নিস্প্রভ কণ্ঠে বলল
‘ এমন ভাব করছে যেন,পৃথিবী উদ্ধার করতে যাচ্ছে।’
মারিয়া দাঁত চে*পে বলতে গেল কিছু। পুষ্প অবস্থা বেগতিক বুঝে বলল,

‘ উফ ভাইয়া তুমিও না! এই তুমি চলোতো আমার সাথে।’
সাদিফের বাহু আকড়ে হাঁটা হরল সে। আপাতত পরিবেশ শান্ত করাই উদ্দেশ্য। পিউ যেতে যেতেও থেমে গেল। ওদের পেছন থেকে দেখে মুচকি হেসে উৎফুল্ল কণ্ঠে বিড়বিড় করল,
‘ রাবনে বানাদে জোরি।’

****
ইকবাল খেয়ে-দেয়ে উঠল সবে। পেট কানায় কানায় ভর্তি। একটু জল রাখার ও জায়গা হবেনা। ওর টেবিলের দায়িত্বে ছিলেন মুত্তালিব। ধূসরের বন্ধু বলে একটু বেশিই সমাদর করেছেন। আর সেই সমাদরের তোপে এখন হাঁটতে গেলেও পেটের খাবার লাফিয়ে উঠছে। সে চেয়ার ছেড়ে একবার চারপাশে তাকাল। জোয়ান জোয়ান ছেলেতে গিজগিজ করছে। এরকম জায়গায় পুষ্প আছে ভাবতেই তার গায়ে কা*টা দিচ্ছে। মেয়েটা মারাত্মক সুন্দরী! ঢাকায় থাকলেই তার ঘুম হয়না রাতে। আর সেখানে এত ক্রোস দূরে থাকলে তো হয়েই গেল। একটু বেশিই ভালোবাসে যে । অথচ পুষ্প সেসব বোঝেনা। কিছু বললে,নিষেধ করলেই ভাবে সন্দেহ করছে। শাড়ি পরতে মানা করায় কত ঝগড়াই না করেছিল! সে নিশ্চিত শাড়ি পরলে পুষ্পকে আস্ত একটা পরীর মতোন লাগতো। তখন যদি কারো পছন্দ হয়ে যেত? কোনও মুরুব্বি যদি ছেলের বউ হিসেবে পছন্দ করতেন? তখন কী হতো? কিন্তু এসব মেয়েটাকে কে বোঝাবে?
তার ধারনা ‘ পুরুষের ভালোবাসা বুঝতে নারীদের কয়েকবার জন্ম নেয়া প্রয়োজন। এক পুরুষকে বুঝতেই যাদের এক জনম ফুরিয়ে যায়,সেখানে মন বোঝা তো দূরের ব্যাপার। ‘

ইকবাল ভাবনা চিন্তা করতে করতে ট্যাপের দিকে এগোলো। উঠোনের এক পাশে একটা ছোট ট্যাপ বসিয়েছেন রাশিদ। পানির লাইন আসছে সরাসরি ট্যাংকি থেকে। এই আয়োজন আজকের জন্যেই বরাদ্দ। যাতে অতিথিরা খেয়ে স্বানন্দে হাত ধুঁতে পারে। ইকবাল ঝুঁকে ট্যাপ ছাড়ল। সাবান দিয়ে কচলে কচলে হাত ধুঁয়ে সোজা হতেই পুষ্প এসে দাঁড়াল সামনে। আচমকা এসে যাওয়ায় থতমত খেল সে। ধাতস্থ হয়ে দীর্ঘ হেসে বলল,
‘ কী খবর মাই লাভ?’
‘ এখানে আসার কারণ?’
পুষ্পর স্বর শ*ক্ত। ইকবাল টেনে টেনে বলল,
‘ তুমি যেখানে আমি সেখানে,সে কী জানোনা?’
‘ ঢং বাদ দাও। হুট করে এভাবে চলে এলে? ধূসর ভাই সন্দেহ করলে কী হতো?’
চাপা স্বরে হাসল ইকবাল। বলল ‘ করেনিতো।’
‘ করলে?’
‘ আমি জানতাম করবেনা।’
‘ সবজান্তা শমসের তুমি? ‘
‘ না, তার পরের ভার্সন।’
পুষ্প চেঁতে গেল,
‘ ফাজমালো কোরোনা। আমি চিন্তায় মরছি ইকবাল,আর তুমি?’
‘ তোমার আবার চিন্তা? তুমি চিন্তায় থাকো? না কি মানুষ কে চিন্তায় রাখো। কাল থেকে ফোন বন্ধ কেন?’
পুষ্প উত্তর দিল না। কপাল কুঁচকে অন্যদিক চেয়ে রইল। ইকবাল টেবিলের ওপর থেকে টিস্য এনে হাত মুছতে মুছতে বলল,
‘ তুমি জানো,তোমাকে ফোনে না পেলে আমার টেনশন হয়। আগে একবার বলেছিলাম যাই হোক ব্লক করবেনা। তাহলে আবার কেন? বড় হবেনা পুষ্প?’

পুষ্প তাকাল। কিছু বলতে গিয়ে একবার আশেপাশে দেখল। আস্তে কিন্তু কাঠ গলায় বলল,
‘ আমিও তোমাকে বলেছিলাম, আমার গলা শুনে তারপর হ্যালো বলতে। অথচ তুমি কী করলে? আগেই কথা বলে ভরিয়ে ফেলেছ। পিউ ঠিক বুঝে ফেলেছে ওটা তুমি। ও যদি ধূসর ভাইকে বলে দেয় তখন?’

ইকবাল নিরুদ্বেগ ‘ দিলে এতক্ষনে দিত। ও কিছুই বোঝেনি। তোমার মত বেশি বোঝা পাব্লিক সে নয়। ও ভালো মেয়ে।’
‘ তুমি একাই সব বোঝো,বাকী সবাই ঘাসে মুখ দিয়ে চলে,কারণ তারা গরু।’
ইকবাল ভুল শুধরে দেয়ার ভঙিতে বলল,
‘ উহু,গাভী। কারণ তুমি মেয়ে।’
পুষ্প চোখ রাঙাতেই হেসে ফেলল। টানা তিনদিন পর চোখের সামনে মনের মানুষ আর তার ঝরঝরে হাসি দেখে পুষ্পর রাগ কমে আসে। তবে দমে যায়না। চোখ ফিরিয়ে বলে,
‘ এভাবে এসে ঠিক করোনি।’
‘ কী করব বলো পুষ্পরানী? প্রেমে এমন কালোজাদু করেছে,সুতোয় টান পরলেই ঠিক /ভুল ভুলে যাই। আজও গিয়েছি। তাইত ছুটে এলাম। ‘

পুষ্প চোখা চোখে তাকিয়েও হেসে ফেলে। ইকবালের পেছন থেকে আমজাদ কে আসতে দেখল হঠাৎ। সে আনিসের সাথে কথা বলতে বলতে আসছেন। দেখেননি এদিকে। পুষ্প ভীত কণ্ঠে বলল,
‘ এইরে, আব্বু আসছেন। ‘
তারপর দ্রুত পায়ে দৌড়ে গেল। ইকবাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ সব শ্বশুরই জামাইদের জীবনের প্রধান প্যারা।’

আমজাদ খেয়াল করেননি ওকে। পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন,অকষাৎ ইকবাল বলল,
‘ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ আঙ্কেল।’
লম্বা চওড়া সালাম,আর হঠাৎ কথা বলায় ভদ্রলোক ভড়কালেন। হতভম্ব নজরে চেয়ে ইকবালকে দেখেই ভ্রুঁ গুটিয়ে বললেন,
‘ তুমি,ইকবাল না?’
ইকবাল মনে মনে বলল ‘ এই শুরু হলো,ব্যাটার কপাল গোছানো।’
মুখে হেসে বলল ‘ জি আঙ্কেল।’
‘ তুমি এখানে?’
‘ ধূসরের সাথে দেখা করতে এলাম।’
আমজাদ সিরিয়াস হয়ে শুধালেন ‘ কেন? কী দরকার?’
‘ এমনি আঙ্কেল,কোনও দরকার নেই। ও আমার বেস্টফ্রেন্ড তো,ওকে ছাড়া ঢাকায় ভালো লাগছিল না।’
‘ তাই না কী? কিন্তু আমার কেন যেন তোমার কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলোনা। কেন বলোতো বাবা? তোমার চেহারা দেখলেই কেমন চোর চোর ভাব পাচ্ছি।’
ইকবালের মেকি হাসি মুছে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
‘ কী শেয়ানা লোক! ঘুরিয়ে পেচিয়ে অপমান করে দিলো?’
বলল,
‘ না না আঙ্কেল সত্যি বলছি! ‘
আমজাদ মাথা নাড়লেন ‘ মিথ্যে না বলাই ভালো। আমি চাইওনা তুমি মিথ্যে বলো। ধূসরকে রাজনীতির ভূত যত ছাড়াতে চাই তত ঘাড়ে চে*পে বসে। শুরুটা অবশ্য তোমার জন্যেই। তুমিইত ওকে সাহায্য করেছিলে উচ্ছ্বন্নে যেতে।’
ইকবাল বেখেয়ালে বলল ‘ জ্বি আঙ্কেল। ইয়ে না আঙ্কেল, আমিতো ওকে বারন করি পার্লামেন্টে না আসতে। আপনার অফিসে থাকুক ও তাই চাই।’

আমজাদ সন্দিহান কণ্ঠে বললেন ‘ তাহলে নিজে ছাড়ছো না কেন?’
ইকবালের কথা বন্ধ হয়ে গেল। আমজাদ সিকদার বাঁকা হাসলেন। কাধ চাপড়ে বললেন,
‘ তাড়াহুড়ো নেই। সময় আছে শুধরানোর। ভেবেচিন্তে এগিয়ো। এমন না হয়, যে বয়স শেষ অথচ কপাল চাপড়ানো শেষ হলোনা। বুঝেছ?’

ইকবাল মাথা দোলায়। আমজাদ সিকদার বললেন,
‘ খেয়েছো?’
‘ জি। ‘
‘ হু। চলো আনিস।’
তারপর এগিয়ে গেলেন সামনে। ইকবাল মুখ কুঁচকে চেয়ে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here