পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ উনপঞ্চাশ

0
334

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ উনপঞ্চাশ

আজ রাতটা একটু বেশিই নীরব, পানসে,বিষন্নতায় পরিপূর্ণ। প্রকৃতিতে শরীর শীতল করা বাতাস থাকলেও মনে বিষাদের উষ্ণতা বিরাজমান। দূর হতে ভাটিয়ালি গান ভেসে আসছে। নন্দন জেঠু হয়তো গান ধরেছে। কি মধুর সুর তার! গলায় কি টান! বিষাদটা মাখো মাখো করার জন্য একদম সঠিক সুর,
“মাঝি বাইয়া যাও রে,
অকূলো দড়িয়ার মাঝে, আমার ভাঙা নাও রে মাঝি, বাইয়া যাও রে…”

দর্শিনী চোখ বন্ধ করে মনযোগ দিয়ে শুনছে। এমন মনোমুগ্ধকর কণ্ঠ না শুনে পারা যায়? যায় না তো। নন্দন জেঠু একজন ভবঘুরে মানুষ। ঘর,সংসার বলতে কিছুই নেই। ছোটবেলায় নাকি সে কোন মেয়েরে অসম্ভব রকমের ভালোবাসতো, অতঃপর মেয়েটার অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরই ভবঘুরে হন নন্দন জেঠু। তার গল্প গ্রামের প্রতিটা কোণ জানে। ভালোবাসার কি নির্দশন! কি সৌন্দর্যতা!

বাতাসের তালে মাঝে মাঝে গানের সুরের স্রোত কেটে যাচ্ছে, তবুও নির্জন রজনী হওয়ায় তত অস্বচ্ছ শোনা যাচ্ছে না। দর্শিনীর মনে হলো বর্তমানে জেঠুর গাওয়া গানটা যেন তার জীবনকেই নির্দেশ করছে। গানের লাইন গুলো যেন একেক জনের জীবনের প্রতিচ্ছবি। এই যে, যা-ই হোক, জীবন নামের বিধ্বস্ত তরী নিয়েই এই এই বিশাল বেঁচে থাকার সমুদ্র পাড়ি জমাতে হবে। হঠাৎ ঝড়ে তরী নড়বড়ে হবে, রৌদ্র তপ্ত দুপুর তরীর উপর পড়লে শরীর জ্বলে যাওয়ার উপক্রম হবে, তবুও জীবন তরী বাইতেই হবে। এ ছাড়া যেন পথ নেই, উপায় নেই।

দর্শিনীর ভাবনার ছেদ পড়লো বাহুতে একটা শক্তপোক্ত হাতের আভাস পেতেই। এত রাতে তো কেউ জেগে থাকার কথা না, তাহলে কে বাহুতে হাত রাখলো! চমকে গেলো দর্শিনী, ঘাড়টা একটু ডান দিকে নিতেই বাবার হাস্যজ্জ্বোল মুখ নজরে এলো। বাবার মিষ্টি হাসির বিনিময়ে হাসি ফিরিয়ে দেয় দর্শিনীও। প্রতাপ সাহা মেয়ের পাশে এসে বসে। মধ্য রজনী, মাথার উপর ঝকঝকে চাঁদ, বাবা-মেয়ে একসাথে মাচার উপর বসে আছে, এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে বোধহয় আর একটাও নেই।

নন্দন জেঠুর গানের সুর বদলালো, কথা বদলালো। নতুন গান ধরেছে,
“আমার সারা দেহ খেও গো মাটি,
চোখ দুটি মোর খেও না,
আমি ম*রে গেলেও তারে দেখার স্বাধ,
মিটবে না গো, মিটবে না।
তারে এক জনমে ভালোবেসে, ভরবে না মন ভরবে না।”

বাবা-মেয়ের নিস্তব্ধতার মাঝে গানের সুর গুলো যেন ঝংকার তুলেছে। প্রতাপ সাহা কতক্ষণ নিরব থেকে মেয়ের পানে তাকায়, বাচ্চাদের মতন ডাক দেয়,
“মা।”

দর্শিনী হঠাৎ এহেন ডাকে চমকে যায়। মনে হলো তারই সন্তান তাকে ডাকছে। কি অদ্ভুত! ছোট্ট বেলায় যারা সন্তানের বাবা-মা থাকে, সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই বাবা-মায়ের অভিভাবক হয়ে উঠে সন্তান। বাবা-মা নিজেদের সন্তানের মাঝে নিজেদের বাবা-মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

দর্শিনী বাবার এমন আদুরে ডাকে মিষ্টি হাসে। নরম কণ্ঠে শুধালো,
“কী, বাবা?”

প্রতাপ সাহা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, ভাব এমন যে বুকের সবটুকু স্নেহ সে ঢেলে দিবে মেয়ের তরে। বার কয়েক আদুরে হাত বুলিয়ে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
“মা, মৃত্যুঞ্জয় তো চলে যাবে, তোমার কী কিছু বলার নেই?”

হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয়ের কথা উঠতেই বুক ভার হলো দর্শিনীর। হুট করেই মন খারাপের মেঘ গুলো আহাজারি করে উঠলো বক্ষ মাঝে। তার শূণ্য শূণ্য লাগলো চারপাশ। এমন টা কেনো হচ্ছে! এমন হওয়ার কথা তো ছিলো না। রাত দশটার দিকে হুড়মুড় করে এসে মৃত্যুঞ্জয় তার চলে যাওয়ার বাণী দর্শিনীকে শুনিয়েই আবার চলে গেলো নিজ পথে। সে বেছে বেছে দর্শিনীকেই কেনো চলে যাওয়ার বার্তা শুনালো? তবে কী সে চায় দর্শিনী তাকে আটকে রাখুক, আগলে রাখুক নিজের সাথে! হয়তো চায়। তাইতো আকার ইঙ্গিতে প্রকাশ করলো সেটা।

মেয়েকে ভাবনার রাজ্যে ডুব মেরে যেতে দেখে হাসলেন প্রতাপ সাহা। মেয়ের পানে তাকিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে মেয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালো। তার কাজে সে সক্ষমও হলো। দর্শিনীর ধ্যান ভাঙলো। ক্ষানিক থতমতও খেলো। প্রতাপ সাহা মেয়ের থতমত ভাব কাটাতেই বললেন,
“ওরা তো ভোরের দিকেই বের হয়ে যাবে, বিদায় জানাতে যাবে না? আবার কিন্তু বছর ঘুরলে মৃত্যুঞ্জয় আসবে। ভাবতে পারছো, বছরখানেক দেখা হবে না তোমাদের? মানতে পারছো এ সত্য!”

দর্শিনী হাসলো। বাবা যে তার ভিতরের অনুভূতি বের করার চেষ্টা চালাচ্ছে তা বুঝতে বাকি রইলো না দর্শিনীর। বাবার কাঁধে মাথা রেখে আকাশ পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বললো,
“জীবনে সত্যিটা মানতে পেরেছি বলেই আজও টিকে আছি, বাবা। আমার আবার তেমন কষ্ট হয় না সত্যি মানতে। আর, যার চলে যাওয়ার কথা সে তো চলে যাবেই, বাবা। সবাই কি আর থাকে জীবনে!”

প্রতাপ সাহা জানেন, তার মেয়ের বাস্তবিক জ্ঞান এতটাই প্রখোর যে আঁচড় কাটবে যে কারো হৃদয়ে। কিন্তু মেয়েটা বরাবরই কল্পনার জগতে ভাসতে ভালোবাসতো। আজ আর তার মিছে শৌখিনতা নেই। জীবনের প্রতি উপচে পড়া উচ্ছ্বাসও নেই। বেঁচে থাকতে হবে বলেই হয়তো বেঁচে আছে।

দীর্ঘশ্বাসের পাল্লা ভারী হলো। হু হু করে রাতের বিষন্নতা বাড়লো। গুমোট রূপ ধারণ করলো প্রকৃতি। তবুও প্রতাপ সাহা মিইয়ে গেলেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান কণ্ঠে বললেন,
“মা, মাঝে মাঝে নিজের ভালোর জন্য ও কিছু মানুষকে আটকে রাখতে হয়। নিজের জীবনের প্রতি নিজের এমন নিষ্ঠুরতা যে সাজে না। আর মানুষ কখনো একা বাঁচতে পারে না। দুঃখ পাবো এ ভয়ে যদি কাউকে আঁকড়ে না ধরো তবে দিনশেষে তোমার প্রিয় একাকীত্বই হবে তোমার মৃ*ত্যুর কারণ। জীবন তো সুখ-দুঃখের রঙ্গমঞ্চ। সুখটাকে যদি উপভোগ করতে পারো তবে দুঃখে তোমার কেন এত অনীহা? আর দুঃখেই বা কেন এত নিমজ্জিত হবে যে সুখকে আঁকড়ে ধরবে না? দুটোকেই নিয়ে পথ চলতে হবে। আর হ্যাঁ অবশ্যই দিনশেষে সবারই নিজের একটা মানুষ লাগে।”

“প্রিয়দর্শিনী থেকে দর্শিনী বানানো মানুষ গুলোকে আদৌও নিজের ভাবা যায়, বাবা?”

“তুমি এতটাও অবুঝ না মা, যে মৃত্যুঞ্জয়ের অনুভূতি বুঝবে না বা অভিমান, আবদার বুঝবে না। মানুষের অনুভূতিকে মূল্য দিতে হয় সময় থাকতে । ফুরিয়ে গেলে হাহাকার বাড়বে, তাছাড়া আর কিছুই না৷”

বাবা বিচক্ষণ মানুষ। আর মৃত্যুঞ্জয়ের উন্মুক্ত অনুভূতি সবারই চোখে পড়েছে। বাবাও যে সেই সবার দলে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। দর্শিনী বাবার ডান হাতের উপর নিজের দু-হাত রাখলো। বিনীত স্বরে বললো,
“সবার অনুভূতি তো ফুরায় না, বাবা। এই যে প্রতি রাতে গান গাওয়া নন্দন জেঠুর তো কখনো অনুভূতি ফুরালো না। বিশ বছরের কিশোর নন্দন জেঠু প্রেমে পড়েছিলো, আজ তার বয়স পঁয়ষট্টির এপাড়-ওপাড়, কই এক বিন্দু তো প্রেম কমেনি। বরং দিনে দিনে তা বাড়ছে দ্বিগুণ আকারে। এখনও নন্দন জেঠু ললিতা মাসির সাথে কথা বলে। চুলে পাঁক ধরা ললিতা মাসির সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে পাশে আছে। কই, তাদের অনুভূতির তো নড়চড় হয় নি। মানুষটা সঠিক হলে অনুভূতিরা তো বদলায় না, বাবা। আমি সঠিক হলে মৃত্যুঞ্জয়ের অনুভূতিও বদলাবে না আশা রাখা যায়। মৃত্যুঞ্জয় চলে যাচ্ছে মানে এই না যে সে ফিরে আসবে না। সব চলে যাওয়া মানে তো বিচ্ছেদ না, বাবা। আমিও দেখি আমি ললিতা মাসির মতন শেষ বয়সের বন্ধু পাই কিনা? কিছু দূরত্ব ভালো যদি সে দূরত্ব মানুষকে কাছে আনে।”

“তবে তা-ই হোক। তোমার গোপন পরীক্ষায় যেন সর্বোচ্চ নাম্বার নিয়ে উত্তীর্ণ হয় মৃত্যুঞ্জয়, আমি সেই প্রার্থনাই করবো।”

প্রতাপ সাহার কথা থামে। প্রকৃতির নিরবতা আরও বাড়ে। অনেক রাত পর্যন্ত বাবা-মেয়ে বসে থাকে একসাথে। দূর হতে কখনো নন্দন জেঠুর গান ভেসে আসে কখনো বা হু হু কান্না। জেঠুর কান্নার সাথে তাল মিলিয়ে কিঞ্চিৎ শোক দর্শিনীও পালন করে। দু’ফোটা অশ্রু ঝরে। কার জন্য যেন বিশাল শূণ্যতা অনুভব হয় হৃদয় কোণে। কখনো দৃষ্টান্তের সাথে কাটানো শৈশব মনে পড়ে, কখনো বা ছোট্ট তৃণার মেলায় করা আবদারের কথা মনে পড়ে, কখনো বড়বৌদির স্নেহ মনে পড়ে, কখনো নিপা বৌদির গোপন বিরহের কথা মনে পড়ে, কখনো বা পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় নারী মোহনার কথা মনে পড়ে। মানুষটা ভালো আছে তো! জীবনের স্মৃতির পাতায় অনেক মানুষের মুখই ভেসে উঠে কেবল ভেসে আসে না বিপ্রতীপের প্রতিচ্ছবি, তবে কী লোকটাকে সে ভুলে গেলো! কি অদ্ভুত! অথচ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিলো। এত তাড়াতাড়ি ভুললো কীভাবে সে মানুষটাকে! দর্শিনীর নিজেরই ভীষণ অবাক লাগে নিজের এমন বদলে।

সবাইকে মনে করে দীর্ঘশ্বাসের পাল্লায় যখন চোখ বন্ধ করে, তখন চোখের পাতায় ভেসে উঠে ভিনদেশী মানবটা। যত্ন নেওয়ার মুহূর্ত গুলো। কি অদ্ভুত, তাদের মধ্যে তো কোনো সম্পর্ক নেই, তবে মনে পড়লো কেন মানুষটাকে?

ভোরের পাখিদের শোরগোল শোনা গেলো, সাথে কিঞ্চিৎ ঠান্ডা বাতাসের ঝিলিক। চোখে রোদ পরতেই ঘুম ভেঙে যায় দর্শিনীর। রোদের উত্তাপ দেখলেই বোঝা যায় বেলা বোধহয় বেশ হয়েছে। আড়মোড়া ভাঙতেই দর্শিনীর মনে পড়লো আজ মৃত্যুঞ্জয়দের চলে যাওয়ার কথা। মৃত্যুঞ্জয়ের কথা মনে পড়তেই মন খারাপের বিজ্ঞাপনে উত্তাল-পাতাল হলো হৃদয় মন্দির। ঘড়ির কাটায় দৃষ্টি দিতেই দেখে সাতটা বাজছে। আজ শুক্রবার, ছুটির দিন বিধায় ব্যস্ততা নেই আর তাছাড়া কাল রাতে অনেক দেরি করে ঘুমাতে এসেছে বলে আজ ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে তবে তত দেরিও না।

বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই তার নরম কোমল পা দুটোকে ছুঁয়ে দিলো কোমল রোদ। মনটা কিছুটা শান্ত হলো তার। মৃত্যুঞ্জয়রা চলে গেছে না এখনো আছে এটা ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে দিলো ক্ষীণ ভাবনায়। শরীর ঝাড়া দিয়ে অলসতা কাটিয়ে ফেললো। বাবা বলেছিলো শেষবার মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে, দেখতে যাওয়া কি উচিৎ কাজ হবে! সে তাহলে মৃত্যুঞ্জয়ের পিছুটান হয়ে রবে না! কারো পিছুটান হওয়া উচিৎ আদৌও!

ভাবনায় মত্ত হয়েই হাত-মুখ ধুয়ে এলো। ততক্ষণে সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে তার দৃষ্টি পড়লো টেবিলের উপর। তার পছন্দের নোবেল টেবিলের উপর চকচক করছে। সে তো কেনে নি এটা! তাহলে! বাবা আনলো?

আর অপেক্ষা না করেই নোবেল টা ছুঁয়ে দেখলো দর্শিনী। নাড়াচাড়া করতে গিয়ে নোবেলটা থেকে হলুদ একটা চিরকুট পড়লো। দর্শিনী অবাক হলো, বাবা তো চিরকুট দিবে না। আর এ নোবেল গ্রামের লাইব্রেরীতেও নেই। তবে!

চিরকুটের ভাজ খুলতেই নীল কালির উজ্জ্বল অক্ষর গুলো ভেসে উঠলো। যেখানে লিখা,
“আমি মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই চোখ লুকিয়ে পালাচ্ছি, প্রিয়দর্শিনী। আর যাই হোক, আপনার চোখের তাচ্ছিল্য আমাকে ভালো থাকতে দিবে না যে! কখনো চক্ষুলজ্জা লুকাতে পারলে ফিরে আসবো। থাকবেন তো আমার অপেক্ষায়?

মৃত্যুঞ্জয়”

বইখানা তবে মৃত্যুঞ্জয় দিয়েছে! আর এই চিরকুটের মাধ্যমে সে কি বুঝাতে চাইলো! তবে কি সেদিন দর্শিনীর বলা কথাটা সে শুনতে পেয়েছিলো। তার মুখ থুবড়ে পড়া বাকি, এটা শুনেছিলো সে! তবুও এত হাস্যোজ্জ্বল কীভাবে ছিলো মানুষটা?

খারাপ লাগায় ছেয়ে গেলে দর্শিনীর মন বাগিচা। শেষবার অন্তত মানুষটাকে ভুল বুঝে চলে যেতে দেওয়া যাবে না। মানুষটা খারাপ লাগা নিয়ে থাকবে এটা আদৌও মানা যায় না।

দর্শিনী দ্রুতই উঠোনে নামলো। তাকে উঠোনে নামতে দেখে সরলা রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে চিন্তিত স্বরে বললো,
“প্রিয়, তোর বাবাকে দেখেছিস? কাল রাত থেকে মানুষটাকে দেখছি না। কোথায় গেলো সে!”

মায়ের কথায় অবাক হলো দর্শিনী। বাবা তো অনেক রাত অব্দি তার সাথেই ছিলো। তারপর সে ঘরে চলে যায়, বাবা তখনও বসে ছিলেন উঠোনে। এরপর কী তাহলে আর বাবা ঘরে যান নি? কোথায় গেলো মানুষটা? সারারাত কোথায় রইলো?

অথৈজলে পড়লো দর্শিনী। কার খোঁজে আগে যাবে, বাবা না মৃত্যুঞ্জয়! আর মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ অব্দি আছে? না চলে গেছে? হাজার খানেক প্রশ্ন নিয়ে পা বাড়ালো পথের ধারে।

গ্রামের পথে ব্যস্ত পদচারণ মানুষের। দর্শিনী হাঁটতে হাঁটতে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি জমালো। উদ্দেশ্য মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়ি। মৃত্যুঞ্জয়দের বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার সামনে শা শা করে ছুটে গেল কতগুলো গাড়ি। গাড়ির গতি তত বাড়ন্ত না থাকায় সাদা চকচকে শার্ট পড়া মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে অসুবিধা হলো না তার। লোকটার চোখ টলমল করছে! কাঁদছে কি সে! দর্শিনীর বিরহেও কোনো মানুষ কাঁদে!

দর্শিনীর গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করলো, “থেকে যান ভিনদেশী সাহেব।” কিন্তু তা আর বলা হলো না। চোখের পলকে খুব দূরে চলে গেলো গাড়ি গুলো। ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো গন্তব্যে। যতটা দূরে গেলে আর ছোঁয়া যায়না, ঠিক ততটা দূরে।

খুব গোপনে দর্শিনীর চোখ থেকেও দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখার আগেই গালের সাথে খুব যত্নে মিশিয়ে ফেললো এই অশ্রুবিন্দু। কিছু অনুভূতি গোপনে থাক।

দর্শিনীর চারপাশে নেমে এলো শূণ্যতা। সকালটা ভীষণ একলা মনে হলো। চিরচেনা সেই পুকুর পাড়ের নিবিড় সিঁড়িটাই বসে থেকেই নিস্তব্ধ সকালটা পাড় করলো। দুপুরটা কেমন হৃদয় ছাড় খার করে গেলো। পুরো গ্রাম যেন মৃত্যুঞ্জয় বিহীন একা ঠেকলো দর্শিনীর কাছে। চারপাশে যেন ধূ ধূ মরুভূমি। হাসলো দর্শিনী। যে মানুষটা তার বিরহে কেঁদেছে, সে মানুষটাকে হাত ছাড়া করা জীবনের সবচেয়ে বড় বোকামি বোধ হলো। কিন্তু কিছু বোকামি শোধরাবার সুযোগ থাকে না।

শ্যাওলা সবুজ পুকুর পাড়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বিবশ হয়ে দর্শিনী বললো,
“ভিনদেশী সাহেব, আমার বিরহে আপনি কেঁদেছেন, আপনার বিরহে আমার মনের রাজ্যে উদযাপিত হবে আজ থেকে ভীষণ শোক। একজন নারীর জন্য কোনো পুরুষ কান্না করলে সে নারী ভাগ্যবতী। আজ থেকে নাহয় এত ভাগ্যবতী হয়েছি বলে রোজ আপনার জন্য আমি কাঁদবো। কেউ জানবে না, আমিও শেষ বয়সের জন্য একটা বন্ধু পেয়েছি। আপনি এলেই আমার অপেক্ষারা চির নির্বাসনে যাবে।”

পুকুরের জল টলমল করে উঠলো। একটা গোটা বিষন্ন দিন জানলো, মানুষেরও মানুষ হারায়।

সারাটা দিন এক ধ্যানে কাটিয়ে সন্ধ্যা নামতেই দর্শিনী পা বাড়ালো বাড়ির দিকে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মনে হলো বাবাকে তো সে খুঁজলো না। তবে এতক্ষণে হয়তো বাবা চলেও এসেছে। ভাবতে ভাবতে বাড়ির কাছে এসে পা থেমে গেলো তার। বাড়ি থেকে এত হৈচৈ ভেসে আসছে কেনো! একটা সাদা গাড়িও তো দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুঞ্জয় তো এমন একটা গাড়িতেই ছিলো। তবে কী মৃত্যুঞ্জয় যায় নি!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here